ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

স্বকৃত নোমানের ‘রাজনটী`

লোকপুরাণ ও কল্পনার মিশেল

জুবায়ের রাসেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১২
লোকপুরাণ ও কল্পনার মিশেল

“তরুণ ঔপন্যাসিক স্বকৃত নোমানের রাজনটী তার চতুর্থ উপন্যাসমাত্র। বিষয়ে সিরিয়াস প্রকরণের নিরাবেগ।

একদা সর্বজনবন্দিতা ও পরিণামে সবার অলক্ষ্যে রাজপুরীত্যাগিনী হেলায় হারানো রাজসমারোহ থেকে শুধুমাত্র আত্মসম্মানটুকু সম্বল করে অজানা পথে অনির্দেশিত নিয়তিযাত্রা, নায়িকা গুলনাহারের একক অভিযাত্রা; সব মিলিয়ে পাঠককে অশ্রুচাপা রুদ্ধশ্বাস সহযাত্রী করে নেয় শেষ ছত্র অব্দি। বাঙালি নারীর এই সম্মান সুরক্ষার দূরপাল্লার একক অভিযান বাংলা সাহিত্যে এক দুর্লভ শিল্পসৃষ্টি। ত্রিপুরা রাজ্যের বিস্মৃত এক কিংবদন্তী লেখকের যাদুকলমে আধুনিকতার হাড়মাংসযোজনায় অমরত্ব লাভ করেছে রাজনটী উপন্যাসে। ”

উক্তিটি কবি ও কথাশিল্পী আবুবকর সিদ্দিকের কাছ থেকে ধার করা। ঔপন্যাসিক স্বকৃত নোমানের রাজনটী সম্পর্কে তিনি উক্ত উপন্যাসের শুরুতে এই মন্তব্য করেছেন। তাঁর কাছ থেকে মন্তব্যটি ধার করেছি নিজের অবস্থান মজবুত করতে। কারণ, স্বকৃত নোমান ও তাঁর রাজনটী সম্পর্কে সমালোচনাহীন এ আলোচনায় যা লিখব, পাঠকের কাছে তা অতিরঞ্জিত বা বাহুল্য মনে হতে পারে। তাই সাবুদ হিসেবে আবুবকর সিদ্দিককে হাজির করা। আমি হয়ত অতিশোয়ক্তি করতে পারি, কিন্তু একজন বর্ষীয়াণ কবি ও কথাশিল্পী তো আর তা করতে পারেন না! রাজনটী সম্পর্কে তাঁর এই মন্তব্য আমার কাছে যথাযথ বলে মনে হয়েছে। উপন্যাসটিকে তিনি ‘দুর্লভ শিল্পসৃষ্টি’ বলে অভিহিত করেছেন। আসলেই তাই। ত্রিশ ছুঁই ছুঁই একজন তরুণের পক্ষে এরকম একটি অসামান্য কাজ আসলেই আমাদের জন্য আনন্দের। কারণ, বাংলাদেশে উপন্যাস চর্চায় একটা সায়ংকাল চলছে। ঔপন্যাসিকরা ঠিক মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারছেন না। উপন্যাস বলতে যা বোঝায় ঠিক তা হয়ে উঠছে না কেন যেন। পাঠক হিসেবে এটা আমার পর্যবেক্ষণ। সেক্ষেত্রে স্বকৃত নোমানের এই প্রচেষ্টা তো আমাদের জন্য আনন্দেরই। তাঁর উপন্যাস পাঠে আমাদের মধ্যে একটা আশার আলো সঞ্চারিত হয়, বাংলাদেশের উপন্যাস যে নবীনদের হাতেই বিকশিত হবে সেই ইশারা পাওয়া যায়।

স্বকৃত নোমানের লেখালেখির সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত। তিনি যখন একটি জাতীয় দৈনিকে মুসলিম দর্শন বিষয়ে দুর্দান্ত সব লেখা লিখছেন, ইসলামি দর্শনের আলোকে মোল্লা-মৌলবিদের তুলোধুনো করে ছাড়ছেন, তখন থেকেই আমি তাঁর একনিষ্ঠ পাঠক। আমার ধারণা ছিল না তাঁর মতো একজন দর্শন-সমালোচক উপন্যাস চর্চাতেও এতটা পরিপক্ক। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নাভি’ পাঠের সৌভাগ্য না হলেও দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ধুপকুশী’ পড়ে আমি তাঁকে বিস্ময়করভাবে ঔপন্যাসিক হিসেবে আবিষ্কার করি এবং তাঁর লেখনী-শক্তির কাছে বিনত হই।

ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর বৈশিষ্ট্য এখানে যে, তিনি উপন্যাসের বিষয় নির্বাচন করেন অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সঙ্গে। আগের উপন্যাসগুলো তো বটেই, গত বইমেলায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত এই রাজনটীর ক্ষেত্রেও তার সচেতনতা লক্ষণীয়। সোয়া দুই শত বছর আগের ত্রিপুরার রাজসভার এক বাইজিকে নিয়ে রচিত রাজনটী। লোকপুরাণ মতে তার নাম নূরজাহান হলেও লেখক তার নাম দিয়েছেন গুলনাহার। মধ্য বয়সে গুলনাহার তার নিজ গ্রামে ফিরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। কিন্তু মানুষ যখন জানল সে বাইজি, তখন কেউ মসজিদটিতে নামাজ পড়ল না-- এই হচ্ছে উপন্যাসটির মূল কাহিনী। কিন্তু লেখক তাঁর কল্পনা ও সৃজনশক্তি দিয়ে কাহিনীটিকে বিস্তৃত করেছেন। ফিরে গেছেন গুলনাহারের শৈশব ও যৌবনের রঙিন দিনগুলোতে। ১৭৭৪-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের কালে গুলনাহারকে এক গোয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তার মা। সাবালিকা হওয়ার পর গোয়ালা তাকে বিক্রি করে দেয় সাবেরি নামক এক বাইজির কাছে। তার কাছে নাচ-গান রপ্ত করে ত্রিপুরা মহারাজ দ্বিতীয় রাজধর মানিক্যের রাজসভার রাজবাইজির পদাধিকারী হলো গুলনাহার। বহু বছর রাজবাইজি বা রাজনটী হিসেবে থেকে মহারাজের চিত্ত মনোরঞ্জনের পর একদিন তার ভাই কর্তৃক লাঞ্চিত ও মহারাজ কর্তৃক ভৎসনার শিকার হয়ে গুলনাহার নীরবে কোঠা ত্যাগ করে চলে আসে নিজ গ্রাম হরিদশ্বে। মহারাজ পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলনাহারের জন্য বহু ধনরতœ ও নগদ টাকা পাঠিয়ে দেয়। গুলনাহার অতীত জীবনের পাপের প্রাশ্চিত্তের জন্য নিজ গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করল। গ্রামবাসী তখনো জানত না গুলনাহার যে এক বাইজি। কিন্তু মসজিদের কাজ যখন পুরোপুরি শেষ হলো তখন বিষয়টি আর তাদের কাছে গোপন থাকল না। ফলে কেউ আর বাইজি কর্তৃক নির্মিত মসজিদে নামাজ পড়ল না। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কাছে অপমানিত হয়ে গুলনাহার ফের ফিরে যায় তার পুরনো পেশায়।

উপন্যাসটির ভাষা এত প্রাঞ্জল যে, সব শ্রেণীর পাঠককেই আকৃষ্ট করে। লেখার গতি যেন ধাবমান ঝর্ণাধারা। কোথাও বিঘ্ন নেই, নিরীক্ষা নামের কাঠিন্য নেই। প্রচুর পরিমাণে লোকজ শব্দের সংমিশ্রণ দেয় এক ভিন্ন আমেজ। কাহিনী টেনে নেয় পাঠককে পুরাণের গভীর থেকে গভীরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুই শত বছর আগের সমাজ-সংস্কৃতি, যুগে যুগে কালে কালে মোল্লাতন্ত্রের কাছে বিপর্যস্ত মানবতা। লেখকের সুক্ষ্ম রসবোধ ও রোমান্টিকতা পাঠককে কখনো আনন্দ দেয়, আবার নির্মম বাস্তবতা কখনো করে তোলে বেদনাবিধূর। নারী না হয়েও নারী-মনের গোপনকথার বয়ান লেখকের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করে। কাহিনীকে তিনি টেনে নেন ইতিহাসের ভেতর। উপন্যাসের বিস্তারিত পটভূমিতে আমরা জানতে পারি তৎকালীন ত্রিপুরা, কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর নানা বিষয়। ঔপনিবেশিক শক্তির নানা জোর-জুলুমের প্রসঙ্গও জানা যায়। উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে যে লেখককে প্রচুর খাটতে হয়েছে, প্রচুর পরিমাণে ইতিহাস পড়তে হয়েছে তা আমরা বেশ ভালোভাবেই টের পাই। বস্তুত উপন্যাস তো এরকমই হওয়া উচিত। কেবলমাত্র জীবনের একরৈখিক বাস্তবতা দিয়ে তো আর সুখপাঠ্য উপন্যাস হয় না।

আসলে আলোচনার মধ্যদিয়ে একটি উপন্যাসের পুরোপুরি ধারণা দেয়া সম্ভব হয় না। এর জন্য পাঠের বিকল্প নেই। তাই রাজনটী পড়ার আহ্বান থাকল। বাংলা সাহিত্যে আমরা পার্বতীর কথা জানি, চন্দ্রমুখীর কথা জানি। স্বকৃত নোমান এবার সৃষ্টি করলেন তেমন একটি কালজয়ী চরিত্র-- গুলনাহার। একদিন নিশ্চয় এই চরিত্রও হয়ত মুগ্ধ করবে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের।

বাংলাদেশ সময় ১১৪৮, জানুয়ারি ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad