ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জাতীয় চেতনা ও আহসান হাবীবের কবিতা

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১২
জাতীয় চেতনা ও আহসান হাবীবের কবিতা

আহসান হাবীব কবিতাচর্চার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস-নাটক লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন অন্য ভাষার কবিতা।

দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশে আজও তিনি অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এছাড়া শিশুতোষ রচনা, নিবন্ধ এবং স্মৃতিকথাও লিখেছেন। কবিখ্যাতির বাইরে তাঁর আরণ্য নীলমা (উপন্যাস, ১৯৬২), খসড়া (কাব্যানুবাদ, ১৯৮৫), বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (ছড়া, ১৯৭৭) পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে।

কবিতা এবং কথাসাহিত্যে তাঁর প্রখর-চেতন সমাজলগ্নতা ও শৈল্পিক অনুভূতির অভিব্যক্তি সচেতন পাঠকের চিন্তা-প্রবণতাকে আন্দোলিত করে। মধ্যবিত্ত-মানস, দাম্পত্য-পরিসর, সমাজপরিবেশ, কিশোর-স্বভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রভৃতি তাঁর চিন্তাভুবনের উপাদান। সমকালীন প্রবণতাকে বাদ দিয়ে শুধু কল্পনা বিলাসে শিল্পের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা অসম্ভব-প্রায়- এ উপলব্ধি তিনি লালন করতেন। কবিতাশিল্পের জন্য তাঁর আকুলতা আর এ পথে পথিক কিংবা সহযাত্রী তৈরিতে তিনি ছিলেন অফুরান অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শঙ্করপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি আহসান হাবীব; আর এই পৃথিবীর আালো-বাতাস থেকে চিরতরে তিনি বিদায় নেন ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই।
    
শিল্পকর্মে রুচিশীলতার লালনকর্তা-প্রশ্রয়দানকারী হিসেবে তাঁর মর্যাদা ঈর্ষণীয়। লোভ আর অস্থিরতা-প্রবণতাকে তিনি শিল্পের প্রতিকূল শক্তি বলে জানতেন, মানতেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যচিন্তা আর ইতিহাসজ্ঞানকে তিনি শ্রদ্ধা করেছেন নিবির্কারচিত্তে।   স্নায়ুবিভ্রান্তির সর্পিল দিনের যাত্রাপথে কবি হাবীব ইতিহাসের আলো দেখেছেন। বিশ শতকের সমাজ আর রাষ্ট্রগতিকে তিনি অনুধাবন করেছেন। ‘বৈপ্লবিক যুগে’ ভূমিজ-উৎপাদনবিমুখ যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার কালো ধোঁয়া যে প্রকৃতপক্ষেই ঋণশোধের রাজনীতির ফল; উন্নয়নের আর পরিবর্তনের রাজনীতি যে এটা নয়, তা তিনি বুঝতে কালমাত্র বিলম্ব করেননি। তাঁর কর্মপ্রয়াসে তাই অনিবার্যভাবে নির্মিতি লাভ করেছে রাষ্ট্রের-সমাজের বিচিত্র প্রবণতা আর মানবচরিত্রের বিবিধ গতিপথ। অবলোকন-অনুভব-অভিজ্ঞতা--- এই তিনের সমষ্টি তাঁর সমূহ প্রকাশের ভার বহন করেছে শিল্পীজীবনের প্রেরণা-শ্রান্তি-অভিঘাত আর অপ্রতিরোধ্য অগ্রগমন-কাতরতায়। গ্রামের সমাজ-অর্থনীতির ক্রম-পরিবর্তন, নগরায়নের ফলে গ্রামজীবনের প্রায়-বিলুপ্ত লোকাচার প্রভৃতি এই স্বপ্নবাজ-আশাজাগানিয়া কবিকে বিচলিত করেছে; করেছে ভাবনাক্লান্ত। নীলচাষ, কারখানা-সভ্যতার বিকাশ আর নগরজীবনের আপাত আরাম-আয়েশ যেন কেড়ে নিয়েছে গ্রামের প্রকৃত শোভা; আসল সৌন্দর্য। শান্ত-নিবিড়, শস্যস্নাত গ্রাম-- হাজার হাজার বছরে ধাপে ধাপে তৈরি হওয়া গ্রামীণ সংস্কৃতি আর গ্রামনির্ভরতা এসব যে প্রকারান্তরে নগর-সংস্কৃতির লালনভূমি তা বোধকরি আমরা মাঝে মাঝে ভুলতে বসি। কিন্তু কবি জানেন, মানুষের আসা-যাওয়া যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি প্রকৃতির নির্মলতা, ভূমিনির্ভরতার অকৃত্রিম বাস্তবতা। মানুষের এই সাময়িক বিভ্রমকে তিনি একটি ঐতিহাসিক পরিভ্রমণ-পথে দাঁড় করিয়ে প্রকৃত সমাজসত্য অনুভব করতে চেয়েছেন। পেছনে ফিরে তাকালে তিনি যেন দেখতে পান: “অনেক মানুষ ছিলো মরেছে অনেক। / সেই সাথে মরে গেছে তারো চেয়ে বেশি--/ শতাব্দীর গ’ড়ে ওঠা এইসব গ্রাম। ”

ahsan_habib

আধিপত্যবাদী রাজনীতি, অহংকার প্রকাশের সংস্কৃতি আর আগ্রাসি পররাষ্ট্রনীতির কারণে গোটাপৃথিবীতে দখলবাজ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে আমেরিকা-ব্রিটেন। দরিদ্র আর আধাদরিদ্র দেশগুলো তাদের লোভীদৃষ্টির শিকারে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো দেশের তেল-গ্যাস-মেধা-নির্মূল্য শ্রমবাজার তাদের আকৃষ্ট করে নেশার মতো। খোলাবাজার অর্থনীতি আর আকাশনির্ভর সংস্কৃতির অন্তরালে তারা নির্মাণ করে চলেছে বদ্ধবাজার-পকেটনির্ভর রাজনীতি। তাই তারা বাহ্যত দূরে থেকেও কাছে থাকার মতোই শাসন-পরিচালনা করছে প্রায় পুরো নিকটপ্রাচ্য-মধ্যপ্রাচ্য। সারা পৃথিবীর বিচিত্র জাতিসত্তার বিনাশ-প্রচেষ্টার এই মহাযজ্ঞে আহসান হাবীব হতাশ হয়েছেন। দেশ-জাতির আপন আপন অস্তিত্ব আর পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে তিনি দৃঢ়-সংকল্প। তাঁর অভিব্যক্তি :
“আমাকে বিশাল কোনো সমুদ্রের ঢেউ হতে বলো।
হতে পারি, যদি এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারো--
সমুদ্রের ঢেউ
হারায় না সমুদ্রের গভীরে এবং
ফিরে আসে শৈশবের নদীর আশ্রয়ে।
সমুদ্রে বিলীন হতে চাই না। কেননা
সমুদ্র অনেক বড় আর বড় বেশি দম্ভ আছে বলে
তাকে ভয়;
সে আছে নদীকে গ্রাসের প্রমত্ত লোভে মত্ত হয়ে। ” (সমুদ্র অনেক বড়)

হাজার বছরের ইতিহাসের পরিক্রমায় আহসান হাবীব খুঁজে পেয়েছেন ইতিবাচকতার উদার আহ্বান। সকল প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এক এক করে অগণন মুহূর্ত পার হয়ে মানবসভ্যতা নির্মাণ করে চলেছে তার কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যাবলি; হাবীব জানেন এ সত্য অনিবার্য--অনতিক্রম্য। মানবিক বিজ্ঞান আর পরিবর্তন-প্রবণতা সমাজগতি রূপান্তরে রাখে অবিস্মরণীয় সব অবদান। শান্তি আর সুখের প্রত্যাশা কোনো অন্যায় অভিপ্রায় নয়; এ ধরনের অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিও বহন করে না কোনো অর্জনের আনন্দ। শান্তির জন্য সতর্ক অবস্থান ও ভূমিকা জরুরি। প্রয়োজন চেষ্টা আর প্রত্যয়ের। সৃজনশীল প্রতিভা কিংবা বলা চলে সৃজনক্ষম মানুষ অন্য মানুষের শান্তি আর সুখের জন্য নিয়োগ করেন তাঁদের কর্ম-প্রবণতা আর সৃজনবিলাস। শান্তিহারা মানুষের স্বস্তির জন্য বহুবার সংগ্রামে নামতে হয়েছে; প্রতিনিয়ত পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে আজো চলছে এ সংগ্রাম। যেহেতু প্রত্যাশার কোনো পরিসীমা নেই, তাই শান্তিরও নেই কোনো সঠিক সংজ্ঞা কিংবা নিশ্চিত ঠিকানা।

দিনে দিনে এই পৃথিবীতে জমতে দেখেছেন অনেক আশা, অনেক আলোক, অনেক প্রসন্নতা। আর সে অভিজ্ঞতার কথা পরিবেশন করতেও ভোলেননি তিনি। প্রকৃতির নিত্যদিনের চালচিত্র থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি; নিতে পারি নিয়তির দুর্নিবার অমোঘতা থেকে। আমরা হয়তো মাঝে মাঝে কতক সংশয়ের পরেও বিশ্বাস রাখি যে, কোনো অসীম শক্তি আমাদের সকল বিষয়ের নিয়ন্ত্রণভার সংরক্ষিত রেখেছে। আমরা এখানে অসহায় পুতুল মাত্র। তিনি যেভাবে খেলাচ্ছেন, সেভাবেই খেলছি আমরা! আর প্রতিনিয়ত আমাদেরকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে কুমতি-সুমতির দারুণ বিতণ্ডা-বাতাস। পিঠে দায় আর দায়িত্বে মুখ-আঁটা বস্তা নিয়ে আমরা ক্রম-ধাবমান যেন: “নিয়তি!/ নিয়তি আমাকে দেখো/ কেমন অন্ধের মত ঘোরায় তোমার হাতে!/ তোমার হাতেই শিকার/ আর তোমার লোভেরই শিকার ওরা--/ আমি দেখো কুখ্যাতি কুড়াই সারা জীবন। ” (জাল) মুক্তির আনন্দ, স্বাধীনতার সুখ আর উদ্দীপনা কবি আহসান হাবীব কবিতার সাথী করেছেন; তবে কবিতাকে তিনি রাজনীতির মঞ্চ বানাননি। তাঁর কবিতায় রাজনীতির পরিবেশ-আভাস আছে; রাজনৈতিক অভিযানে জনতার অংশগ্রহণের প্রেরণার নিষ্ঠাপূর্ণ বিবরণ আছে। অধিকার আর মর্যাদা আদায়ের দাবিতে যে জনতার উল্লাস, তাকে তিনি পরিহার করতে পারেননি। স্বাধীনতার জন্য মানুষের যে আকুলতা-অপেক্ষা, তার বাস্তবতাকে তিনি কবিতার পংক্তিমালায় স্থান দিয়েছেন গভীর আগ্রহে--  নিবিড় পরিচর্যায়। যেমন:
“মিছিলে অনেক মুখ
দেখো দেখো প্রতি মুখে তার
সমস্ত দেশের বুক থরোথরো
উত্তেজিত
শপথে উজ্জ্বল!
...আর সেই মুখের আভায়
পথের ধুলোয় দেখো আলো জ্বলে,
জানালার মুখ
উদ্ভাসিত এবং চঞ্চল। ” (মিছিলে অনেক মুখ)

বিভ্রান্তি-মনোবিকলন আর অনাস্থা আধুনিক জীনাচারের অন্যতম অনুষঙ্গ। আহসান হাবীবের কবিতায় আমরা পাই সমাজের এই বিশেষ স্থিতির প্রতি সবিশেষ অভিনিবেশ। ক্রমাগত কেবল স্বস্তিহীন একটা গুমোটভুবনে প্রবেশ করছি আমরা; সাথে আছে যেন অমিত জিজ্ঞাসা: “আমারত কোথাও না কোথাও/ যেতে হবে/ অথচ কোথায় যাবে কোন পথে/ কেউ বলে না,। ” কিন্তু যাবার পথ কি অনুকূল--- কণ্টকমুক্ত? বণিক-স্বভাব এই সমাজে কার কী গন্তব্য জানা সাধ্য কার! নগর-ব্যবস্থাপনা এমনকি অফিস-ব্যবস্থাপনা কিংবা সভা-সমিতি পরিচালনার জন্য মত-বিনিময় যেমন জরুরি, তেমনি জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও দরকার জনমত-জরিপ। নাগরিক কবি আহসান হাবীব এই সত্য প্রকাশ করতে কোনো অস্বস্তি বোধ করেননি। অনেক সময় সরকারপক্ষীয় নেতা-প্রশাসকদের খেয়ালি সিদ্ধান্ত জাতির মাথায় চাপাতে দেখা যায়, যা বাস্তবিকঅর্থে গ্রহণযোগ্য নয়। জনপ্রশাসন এবং লোকপ্রশাসন বিষয়ে তাঁর এই কবিতানির্মাণ-প্রচেষ্টা আমাদেরকে আশান্বিত করে কথা বলতে, মত প্রকাশ করতে সাহস যোগায়। “আত্মম্ভরিতা”র চেয়ে “আত্মরক্ষা”র প্রয়োজনকে তিনি বড় করে দেখেছেন। দিনবদলের স্বপ্ন-বিভোরতা নিয়ে কবি আহসান হাবীব সমাজে সকল মানুষের অধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন। চলমান দিনের, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে নতুন দিনের অভিমুখে যাত্রার আহবান শুনতে পাই তাঁর কবিতাকথায়। পক্ষ-বিপক্ষ, পজিশন-অপজিশন--- সবাই মিলে সমবেতভাবে নতুন দিনের আলোকসভায় যোগ দেবেন এই প্রত্যাশা লালন করতেন কবি আহসান হাবীব।

স্বাধীনতার সুখ-প্রশান্তি আর এগিয়ে চলার সামর্থ্য যেন কবিকে জাগিয়ে তোলে অবিরাম হাঁটবার নেশায়। হাবীব স্থির বসে থাকার মতো মানুষ ছিলেন না; দেহকে টেনে টেনে হয়তো খুব বেশি দৌঁড়াননি তিনি, তবে মানসিকভাবে এগিয়ে চলার বাসনায় ছিলেন প্রখর-চেতন। তিনি অনুভব করতেন থেমে থাকবার জায়গা নয় এই পৃথিবী। ভাষা-বিজ্ঞান-গণিত-প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ঐতিহ্যের আলোয় অনাগতের পথে ধেয়ে চলাই যে জীবনের ধর্ম, তা তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি। । “ভাবনাহীন দৈনন্দিন সহজ জীবন” অন্বেষায় কেটেছে হাবীবের সারাপ্রহর। দেখেছেন ঘরে ঘরে সুগন্ধি ছড়ানো; যদিও সংসারি নেই আদতে কোনো সংসারে।

“বীরত্বের মহড়া” আর আসামি সনাক্তকরণে অসতর্কতা ও ভিতুপ্রবণতা যে সমকালের অন্যতম অসুখ, তা তিনি টের পেয়েছিলেন। আমাদের সামর্থ্যরে সীমানা-দেয়াল তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে পড়েছিল ক্রমান্বয়ে। বাঙালির বীরত্বের অহংকারের অন্তরালে যে বুক-কাঁপা স্বভাব লুকিয়ে রয়েছে, তা কি আর অনায়াসে ঢেকে ফেলা যায়? বিদেশপ্রীতি আর নিরর্থক বিভ্রান্তিতে পড়ে আমরা যে দিনদিন দেশলগ্নতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, সে ভাবনা কবিকে অবসন্ন করে তুলেছিল; ওই অপমানের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খুঁজেছেন তিনি।
    
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতা-সংগ্রাম আর দেশগড়ার আন্দোলনে নিবেদিত-প্রাণ নেতৃবৃন্দ যখন ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নিঃশেষ হয়ে গেলেন, তখন হাবীব যেন বাংলাদেশি-বাংলাভাষীর মাথার ওপর থেকে বটবৃক্ষের ছায়া সরে যেতে দেখলেন। আর তখন তাঁর “পরিক্রম এবং অবস্থান প্রসঙ্গ” প্রকাশ করা জরুরি হয়ে পড়লো। শেষ কবিতাগ্রন্থ বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫)-এ তিনি লিখলেন: “বণ্টনবৈষম্য, সামাজিক অসাম্য, পরাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম/এবং মহাযুদ্ধের দায় এই সবই সমগ্র রাত্রিশেষের উপজীব্য। /উত্তরতিরিশ কবিতার সমাজ সচেতন অধ্যায়ে নিজের সংলগ্নতা আমি/এভাবেই এই সময়ে আবিষ্কার করি। /তারপর ক্রমান্বয়ে ছায়াহরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি/মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দু’হাতে দুই আদিম পাথর এবং প্রেমের/কবিতা। শ্রেণীবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্তিমতা/এবং উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা এই সবই আজো/পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু। এক শ্রেণীর মানুষের কৃত্রিম/জীবন তৃষ্ণা তাদের নীচ জীবনাচরণের প্রতি ব্যঙ্গবাণ--এইসব। /সুধীজনদের কেউ কেউ বলেন, বলতে বলতে চালু হয়ে/গেছে, আহসান হাবীব মৃদুভাষী কবি। কবিতায় মৃদুভাষিতা কি/জিনিস আমি কিন্তু বুঝি না। ভালা কবিতা আর মন্দ/কবিতা বুঝি, সার্থক রচনা আর অসার্থক রচনা বললে বুঝি। ” (পরিক্রম এবং অবস্থান প্রসঙ্গ)
    
পৃথিবীখ্যাত কবি সিলভিয়া প্লাথ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন এই ইচ্ছামৃত্যু! কেন নিজেকে হত্যা করেছিলেন মায়াকোভস্কি! জীবনানন্দও কি আত্মহত্যা করেছিলেন!; তাঁর “আট বছর আগের একদিন” কবিতায় বর্ণিত আপাত সুখি মানুষটিকে মরতে হলো কেন!-- এই সব অব্যাখ্যায় মৃত্যুর সঠিক হিসাব কি পাওয়া আদৌ সম্ভব? মৃত্যু কি কোনো উৎসবের ছদ্মনাম? চাঁদ কিংবা আকাশ কিংবা বৃষ্টি দেখলে আমাদের মন ভালো অথবা খারাপ হয় কী কারণে!-- কবি আহসান হাবীব এইসব অধরা-বিশ্লেষণঅযোগ্য বিষয়াদিতে নিমগ্ন হয়ে পড়তেন মাঝে মাঝে। পলিমাটির স্নেহমাখা এই জনপদ আজ যেন অশুদ্ধ বাতাসে পরিপূর্ণ। মানুষে মানুষে নেই সম্প্রীতির বন্ধন; চারিদিকে কেবল অশুভ-প্রবণতা আর ছলচাতুরির ছড়াছড়ি। অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখা, মমতা দিয়ে অনুভব করার ফলে কবি হাবীব দূরে থাকতে পারেননি বাংলাদেশের মাটির মমতারস থেকে। আর তাই তাঁর উপস্থিতি এবং দায়িত্বও যেন কষ্টবর্ণনাকারী হিসেবে। তিনি লিখেছেন: “অশুদ্ধ মানুষ খুব বেড়ে গেছে/সারিবদ্ধ শরনার্থী মানুষ/মরা নদী মরা স্রোত ছাড়িয়ে এখন--/বলে দাও/যেতে হবে অন্য কোনো নিরঞ্জনা নদীর সন্ধানে। ”
    
আহসান হাবীব তৎকালীন পূর্ববাংলা, বর্তমান বাংলাদেশের জাতিসত্তার কবি। তিনি বিভ্রান্তি-বিবরণের কবি; জীবনের আঁধার-আলোক তাঁর কবিতার বিষয়াবলি। সকল প্রতিকূলতা আর পঙ্কিলতার স্তুপের আড়ালে তিনি সম্ভাবনার মঞ্চ তৈরি করতে আগ্রহী এবং আগ্রহ জাগাতে উৎসাহী। এ ভূখণ্ডের জাতীয় চেতনার প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বস্ততা আর এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার-মর্যাদা এবং স্বপ্নবিভোরতা বিবরণের কবি। তাঁর কবিতাশিল্পের মহিমা ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, শিল্পের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর প্রজন্ম-প্রহরনিবিড়তা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আরো বহুকাল।

বাংলাদেশ সময় ১৩২৫, জানুয়ারি ০২, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।