ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ইলেভেন মিনিটস ও পাউলো কোয়েলহোর লেখকসত্তা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০
ইলেভেন মিনিটস ও পাউলো কোয়েলহোর লেখকসত্তা লেখক পাউলো কোয়েলহো। ছবি: সংগৃহীত

‘ওনযে মিনুতোস’ পর্তুগিজ উপন্যাস, যার ইংরেজি শিরোনাম ‘ইলেভেন মিনিটস’। উপন্যাসটির গল্পের নায়িকা মারিয়া, নিজের সম্পর্কে বলে, বিচক্ষণ চিন্তাগুলো খুব ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হলেও নিজস্ব পরামর্শ অনুসরণ করতে পুরোপুরি অক্ষম সে। এ উপন্যাসের লেখক পাউলো কোয়েলহো হাইপ্রোফাইলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কখনো কখনো আমারও এরকম হয়। তবে আমি যতটা সম্ভব আমার কথার কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করি, কারণ বেশিরভাগ সময় আমি নিজের জন্য লেখি। আমি কে তা ভালোভাবে দেখার জন্য লেখি। নতুন একটি বই লেখা শেষ করি আর বুঝতে পারি, মাই গড! এই জিনিসগুলো ওখানেই ছিল অথচ আমি ওগুলো আগে দেখতে পাইনি।

ঠিক যেমন যিশু এক অন্ধকে সারিয়ে তোলার পর সেই অন্ধ সিনাগগে গিয়ে বললো, সবাই দেখো তিনি আমাকে সারিয়ে তুলেছেন! তার কথা শুনে সবাই বললো, আরে এদিকে এসো! ওই লোক এক ভণ্ড, এক হাতুড়ে বৈদ্য। তখন সেরে ওঠা সেই অন্ধ সবাইকে বললো, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

আমি অন্ধ ছিলাম আর এখন দেখতে পাচ্ছি। আমার নিজেরও সেই একই কথা। কখনো কখনো আমি নিজের সম্পর্কে অন্ধ থাকলেও জবাবটা আমার মনের মধ্যে ঠিকই থাকে আর হঠাৎ আমি তা দেখতে শুরু করি।

ইলেভেন মিনিটস উপন্যাসে পাউলো কোয়েলহো ব্রাজিলের এক তরুণী যৌনকর্মীর ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা এবং যৌন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার আত্ম-উপলব্ধির দিকে যাত্রার কথা বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসটি মূলত মারিয়ার গল্প। মারিয়া প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এক ব্রাজিলিয়ান তরুণী। প্রথম প্রেমের নিষ্কলঙ্ক প্রত্যাখ্যানে তার মন ভেঙে যায়। খুব কম বয়সেই সে ভাবতে শেখে সত্যিকারের ভালোবাসা সে কখনোই পাবে না। তার বিশ্বাস, ভালোবাসা এমনই ভয়ানক জিনিস যা তাকে ভোগাবে। সে কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে। বিনোদনের খোঁজে সাপ্তাহিক ছুটির দিন রিও ডি জেনিরো শহরে কাটায়।

 

একবার সেখানকার কোপাকাবানা সৈকতে এক সুইস ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয় তার। লোকটি তাকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের এক বারে ব্যালে ডান্সারের চাকরির প্রস্তাব দেয়। শুরুতে তার কাছে সবকিছু রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। সে বিখ্যাত ও ভাগ্যবতী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল পুরোপুরি আলাদা। কিছুদিনের জন্য সে এক নাইটক্লাবে কাজ করে। কিন্তু শিগগিরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। একরাতে ক্লাব ম্যানেজারের সঙ্গে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডার পর সে চাকরি ছেড়ে দেয়। পরে মডেল হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। হাতে টাকা না থাকায় এক হাজার ফ্রাঙ্কসের বিনিময়ে এক আরবের সঙ্গে রাত কাটাতে রাজি হয়ে যায়। এরপর সে একজন যৌনকর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং জেনেভার কেন্দ্রস্থল প্রমোদনগরী রুই দে বানের এক পতিতালয়ে গিয়ে ওঠে। এভাবে মারিয়া যৌনপেশায় জড়িয়ে যায়। অনেকটা নিজের ইচ্ছেতেই সে কাজটি করে।

সেখানে নিয়া নামের এক যৌনকর্মীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নতুন পেশা সম্পর্কে সে তার কাছ থেকে পরার্মশ নেয়। গণিকাগৃহের মালিক মিলানের কাছ থেকে ব্যবসার সব ধরনের কলাকৌশল শেখার পর সে তার শরীর এবং মন দিয়ে ওই কাজে প্রবেশ করে। ভালোবাসার সবগুলো দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও একান্তে কেবল ডায়রিতে সে নিজেকে মেলে ধরে। খুব দ্রুত পুরোদমে সফলতা আর খ্যাতি অর্জনের পর সহকর্মীরা তাকে হিংসে করতে শুরু করে। এভাবে কয়েকমাসের মাথায় মারিয়া পরিপাটি একজন পেশাদার বারবণিতা হয়ে ওঠে। যে শুধু তার খদ্দেরদের শারীরিক চাহিদাই পূরণ করে না, বরং তাদের সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে আলাপ করে তাদের মনও শীতল করে।

অবশেষে এক সুদর্শন তরুণ চিত্রশিল্পীর দেখা পাওয়ার আগ পর্যন্ত, সব ধরনের রোমাঞ্চের পরও, যৌনতা ও ভালোবাসা তার কাছে রহস্যময়ই থেকে যায়। প্রেম সম্পর্কে তার হতাশাজনক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে পরীক্ষার মুখোমুখি করে। ঘটনাক্রমে সেও ছিল তারই মতো পথভ্রষ্ট। যৌনতার পবিত্রতা আবিষ্কারের জন্য মারিয়াকে সবার প্রথমে অবশ্যই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার একটি পথ খুঁজে নিতে হয়। নিজেকে আবিষ্কারের এ দুঃসাহসিক অভিযানে, নিজের খাতিরেই তাকে যৌনতৃপ্তির মতো অন্ধকার পথ রেখে ভালোবোসার টানে পবিত্র যৌনতা বেছে নিতে হয়। আর এভাবে নিজস্ব অন্তর আলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে তার সবকিছু ঝুঁকির মুখে ফেলে।

তরুণ সুইস চিত্রকর, রালফের সঙ্গে দেখা হবার পর তার জগত পুরোপুরি পাল্টে যায়। রালফ তার অন্তর আলো দেখতে পায়। মারিয়া তৎক্ষণাৎ তার প্রেমে পড়ে সত্যিকারের ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করে। এবার মারিয়া তার যৌন ফ্যান্টাসি আর রালফের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসার মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে সে রালফের স্মৃতি নিয়ে জেনেভা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ সে বুঝতে পারে তাদের মধ্যে যোজন দূরত্ব। তবে ফিরে যাবার আগে, সে রালফের অবদমিত যৌন আগুন পুনরুদ্দীপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়; এবং তার কাছ থেকে পবিত্র যৌনতার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারে, যে যৌনতা সত্যিকারের ভালোবাসার সঙ্গে মিলিত হয়ে ভালোবাসার মানুষকে নিজের আত্মা সমর্পণ করে।

এ উপন্যাসে কোয়েলহো যৌনতার পবিত্র স্বভাব এবং রতিক্রিয়ার স্থিতিকালের বর্ণনা তুলে ধরে দু’ধরনের পতিতাবৃত্তির কথা বলেছেন। টাকার জন্য পতিতাবৃত্তি এবং পবিত্র পতিতাবৃত্তি। সঙ্গে সরাসরি ধর্ষ-মর্ষকামের কথাও তুলে ধরেছেন।

নিজের ভেতরে এমন সুপ্ত গুপ্তধনের সন্ধান থেকেই লেখালেখি বা এটি কী কোনো শিল্প-কৌশল নাকি ভালোবাসার প্রসব এমন প্রশ্নে জবাবে হাইপ্রোফাইলের ব্রায়ান ড্রেপারকে কোয়েলহো বলেন, আমি বলবো আমরা যা যা করি ভালোবাসা এর সবই করতে সক্ষম। আপনার জীবনের যথার্থতা তুলে ধরতে পারে এমন কোনকিছুর কাছাকাছি হলে, হতে পারে তা বাগান করা, রান্নাবান্না, এমনকি ট্যাক্সি চালানো যা কিছু আপনি ভালোবাসেন তার যোগসূত্র হুবহু কিন্তু এক। আমি মনে করি না একজন লেখক যে কারো চেয়ে সেরা। আপনি উৎসাহ নিয়ে যা কিছুই করেন না কেন, বাস্তবে আপনি ঈশ্বরেরই প্রকাশ। এর পরের ধাপ হলো শিল্প-কৌশল রপ্ত করা। লেখার জন্য, প্রথমে আমাকে পড়তে হয়েছে। কোর্স বা ওয়ার্কশপ থেকে আপনি লেখালেখি শিখতে পারবেন না, ওসবে আমার বিশ্বাস নেই। অন্য লেখক, যারা তাদের মন, অভিজ্ঞতা, সবকিছু মানুষের কাছে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন, তাদের লেখা পড়ে আপনাকে শিখতে হবে কীভাবে লিখতে হয়। আপনি কী নিয়ে লিখবেন? আপনার মূল প্রশ্ন কী? আপনাকেই তা বেছে নিতে হবে এবং তারপর আপনার নিজস্ব কৌশল তৈরি করতে হবে। অন্যরা যা করে ফেলেছে তা পুনরাবৃত্তি করলে চলবে না, এ চিন্তা থেকে আপনাকে নতুন রীতির প্রচলন করতে হবে।

আমার ক্ষেত্রে, আমার প্রধান সমস্যা ছিল সহজিকরণ। আমি দুর্বোধ্য সব লেখকদের লেখা পড়ে অভ্যস্ত। কখনো কখনো আমি গল্পটা দাঁড় করাতে পারলেও ভাবি, হায় খোদা! এর সবই তো খুব জটিল হয়ে গেলো! কেনো এক পৃষ্ঠায়, এক প্যারাতেই সবটা লিখতে গেলাম। তাই কীভাবে কতটুকু বাদ দিতে হবে আমি তা শিখতে শুরু করি। এখন আমি তাই করছি। আমার যে কোনো বইয়ের চূড়ান্ত ভার্সন থেকে ওর খসড়া তিনগুণ বড় থাকে। অনেকটা নিজের মাংস কেটে বাদ দেওয়ার মতো হলেও, কাজটি করতে হয়।

পাউলো কোয়েলহো একাধারে একজন ব্রজিলিয়ান গীতিকার এবং ঔপন্যাসিক। উপন্যাস আলকেমিস্টের  জন্য তিনি সমধিক পরিচিত। এ উপন্যাসে তিনি প্রতীকের আশ্রয়ে অতীন্দ্রিয় উপকথার অবতারণা করলেও খুব সহজ ও সাবলীলভাষায় তা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। নিজেকে আবিষ্কারের আত্মিক অনুসন্ধানমূলক সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ব্রাজিল এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। পর্তুগিজ ভাষায় লিখলেও, কোয়েলহোর বইগুলো বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একজন উৎসুক ব্যবহারকারী হিসেবে, একটি ভার্চুয়াল পাউলো কোয়েলহো ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে ২০১৪ সালে তিনি তার ব্যক্তিগত লেখালেখিগুলো অনলাইনে আপলোড করেন।

নিজের এ আত্ম-অনুসন্ধান সম্পর্কে কোয়েলহো বলেন, কখনো কখনো আমি আমার মূল প্রশ্ন নিয়ে লিখি। আর সেই আধ্যাত্মিক জগত আমাকে একজন আধ্যাত্মিক লেখকে পরিণত করতে পারে না। যুদ্ধ নিয়ে লিখে জেনারেল হওয়া যায় না। গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে লিখে গোয়েন্দা হওয়া যায় না। কিন্তু যখনই কাউকে ‘আত্মিক লেখক’ হিসেবে লেবেল লাগানো হবে, লোকে ভাববে তার কাছে কোনো জবাব অবশ্যই রয়েছে বা তার কোনো ভালো যোগাযোগ থাকবে। না! যদি এমন কোনো জিনিস থাকে যা আমি ঘৃণা করি, তা হলো নতুন যুগ। আমার কাছে নতুন যুগের মানে হলো সব ধরনের ধর্ম একত্রে গুলিয়ে ফেলা। যাদের একটি মাত্র ধর্ম অনুসরণের সাহস নেই সেসব লোকই এর স্রষ্টা।

‘আমি একজন ক্যাথলিক লেখক। আমি এমন একজন লেখক ঘটনাক্রমে যে ক্যাথলিক, তাই না? মাঝেমধ্যে আমি পুরোদমে পোপের বিরোধিতা করি। আমি আমার ধর্মের মিশনারিকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্বাসের লোকজন নিয়েও আমাকে আলোচনা করতে হয়। সবারই একটা আধ্যাত্মিক জগত রয়েছে তা ভাবতে আমি আমার ধর্মের বাইরে যেতে চাই। ’

কোয়েলহো ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরো শহরে এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি তার বাবা-মা ছিলেন খুবই অনুগত। কিশোর বেলা থেকেই তিনি একজন লেখক হবার স্বপ্ন দেখতেন। তার মাকে কথাটি বলার পর তিনি বলেন, প্রিয় আমার, তোমার বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একজন যুক্তিবাদী, ন্যায়সঙ্গত মানুষ। পৃথিবী সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট। তুমি কি সত্যিই বোঝ একজন লেখক হওয়ার মানে আসলে কী?

১৭ বছর বয়সে কোয়েলহোর অন্তর্মুখিতা ও সনাতন প্রথা অনুসরণে বিরোধিতা থেকে তার বাবা-মা তাকে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করতে বাধ্য হন। সেখানে তাকে ইলেক্ট্রকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি) দেওয়া হয়। ২০ বছর বয়সে নিষ্কৃতির আগ পর্যন্ত সেখান থেকে তিনি মোট তিনবার পালিয়ে আসেন। পরে এ নিয়ে কোয়েলহোর মন্তব্য, এমন নয় যে তারা আমাকে আঘাত দিতে চেয়েছে, আসলে তারা জানতো না এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হবে... তারা আমাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তা করেনি, তারা আমাকে রক্ষা করতেই এমনটা করেছে।

বাবা-মায়ের ইচ্ছেতে কোয়েলহো আইন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং তার লেখালেখির স্বপ্ন ত্যাগ করেন। মাত্র এক বছরের মাথায়, ১৯৭০ সালে কোয়েলহো আইন বিদ্যালয় থেকে ঝরে গিয়ে প্রথাবিরোধী জীবন যাপন শুরু করেন। এ সময় তিনি দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ ভ্রমণ করেন, ও একই সঙ্গে মাদকে আসক্ত হন। ১৯৭২ সালে ব্রাজিল ফিরে এসে তিনি বেশকিছু গান লিখে দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ সময় তিনি এলিইস হেজিনা, হিতা লী, এবং ব্রাজিলিয়ান আইকন আউ সেশ্যো’র জন্য গান লেখেন। আউ’র গান লিখতে গিয়ে কোয়েলহো জাদু এবং অতিপ্রাকৃতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এক পর্যায়ে তার লেখা বেশকিছু গানে ‘নাশকতামূলক’ কথাবার্তা থাকার অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে দুবছর পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ বছর আগে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকার তার গানগুলোকে বামপন্থি ও বিপদজনক বলে গণ্য করে। গীতিকারের পেশা বেছে নেওয়ার আগে কোয়েলহো অভিনয়, সাংবাদিকতা ও থিয়েটার পরিচালকের কাজ করেন। মুক্তির পর তিনি ব্রাজিলের সিবিএস রেকর্ডসে রেকর্ডিং এক্সিকিউটিভের কাজ নেন। ১৯৮০ সালে চাকরি হারাবার পর আবারও তার ভবঘুরে জীবন শুরু হয়। এসময় কোয়েলহো বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে জানেন এবং তার লেখালেখির আগ্রহ নবায়ন করেন।

তরুণ বয়সে মানসিক আশ্রয়কেন্দ্রে এবং পরে গুপ্ত পুলিশি নির্যাতনের মুখোমুখি না হলে এখন যা করছেন তা নিঃশেষ হয়ে যেত কি-না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না। যীশুর জীবনের দিকে তাকান। তিনি তার জীবনের ৯৯ ভাগ কাটিয়েছেন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে, ঘুরে বেড়িয়ে, আর পান ভোজন করে। তারপর শেষ তিনদিন, আহ! এরপরই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি কি এর আগে দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন...? তার নিজস্ব অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল, তাই না? তা নিয়ে কিন্তু কোনো কথা হয় না। কিন্তু... দুর্ভোগ আসলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আপনি কি তাই মনে করেন?

আমাকে ‘ভুগতে’ হয়েছিল কারণ তা আমার সামনে পড়েছিল। বাস্তবে, পেছন ফিরে তাকালে আমার কাছে ওসব দুর্ভোগ বলে মনে হয় না। এসব আমার ভ্রমণের অংশ এবং এসব আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে। এসব দুর্ভোগ না পোহাতে হলে, আমি কি এই একাই সফল লেখক হতে পারতাম? সম্ভবত।

একই বছর কোয়েলহো চিত্রকর ক্রিস্টিনা ওয়েটিসিকাকে বিয়ে করেন। আগে তারা একত্রে বছরের অর্ধেক রিও ডি জেনিরো এবং বাকি অর্ধেক ফ্রান্সের পিরেনিস পার্বত্য এলাকার পল্লী বাড়িতে থাকতেন। তবে বর্তমানে এ যুগল স্থায়ীভাবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বসবাস করছেন।

১৯৮৬ সালে কোয়েলহো উত্তর স্পেনের প্রাচীন সড়ক সান্তিয়াগো দে কম্পোসতেলার পথ ধরে পায়ে হেঁটে পাঁচশত মাইলেরও দীর্ঘ এক তীর্থযাত্রায় অংশ নেন। সেই ভ্রমণ ছিল মারাত্মক অস্বস্তিকর। ৫৬ দিনের এ তীর্থযাত্রায় তিনি এমন এক আত্মিক উপলব্ধি লাভ করেন, যা তার দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী বেশিরভাগ কাজের মূল কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব কথা তিনি তার আত্মচরিত ‘দ্য পিলগ্রিমেজ’ এ তুলে ধরেন।

এক সাক্ষাতকারে কোয়েলহো উল্লেখ করেন, (১৯৮৬ সালে), আমি যা করেছি তাতে ভীষণ সুখ পেয়েছিলাম। আমি এমন কিছু একটা করেছিলাম যা আমাকে খাবার আর পানি জুটিয়েছিল দ্য আলকেমিস্টে সেই একই রূপক ব্যবহার করে আমি কাজ এগিয়ে নেই। আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল। হাতে টাকা ছিল। কিন্তু তারপরও তখনও আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছিলাম না। আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল আর এখনও সেই স্বপ্ন আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। এ সময় কোয়েলো তার গীতিকারের সেই লোভনীয় পেশা ছেড়ে পুরোদমে একজন লেখক হওয়ার কাজে নিজেকে ন্যস্ত করেন। পাশাপাশি একই বছরে শিশু ও বৃদ্ধদের সহায়তার উদ্দেশে তিনি পাউলো কোয়েলহো ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।

তার বেস্ট সেলার দ্য আলকেমিস্ট লেখা শেষ হয় মাত্র ১৪ দিনের মাথায়। কারণ লেখাটি মনে মনে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস আমাদের সবার মধ্যেই প্রকাশিত হওয়ার মতো একটি স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ থাকে। এখানে এ পৃথিবীতে এটাই আমাদের কাজ। আমাদের মানবীয় গুণাবলী তা দাবি করে। যাতে আমরা নিজেদের যথার্থতা বুঝে উঠতে পারি। তাই খুব ছোটবেলা থেকে আমি লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমি কালক্ষেপণ করেছি, কারণ আমি এখানকার যুক্তির মুখোমুখি হতে ভীত ছিলাম।

যখনই আমি আমার জাহাজগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই এবং লিখতে শুরু করি, তখন আমার বয়স ৪০। আমি দ্য পিলগ্রিমেজ- এ সান্তিয়াগো দে কম্পোসতেলার পথ ধরে হাঁটার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলি। তারপর দ্বিতীয় বইতে, আমি আমার জীবনের রূপক লেখার সিদ্ধান্ত নেই। অবশ্য তখনো জানতাম না তা আমার মন ছুঁয়ে যাবে। তাই, আমার কাছে আলকেমিস্ট ছিল নিজেকে বোঝার জন্য অনেকটা পিছু ফিরে তাকিয়ে রূপকের আশ্রয়ে ভালো একটি গল্প খোঁজার মতো। আর এটি কাগজে নামিয়ে আনতে আমার দুসপ্তাহের মতো সময় দরকার হয়। কিন্তু বইটি অনেক আগে থেকেই এখানে ছিল, কারণ এটি আমার জীবনী।

এর কয়েকদিনের মধ্যে তিনি অ জিয়াদ্যু দে উম মাগু লেখেন। ১৯৯২ সালে দ্য ডায়রি অব আ মাগুস শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়। ১৯৯৫ সালে দ্য পিলগ্রিমেজ শিরোনামে উপন্যাসটি পুনরায় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি তার এ ভ্রমণঅভিজ্ঞতার এক দার্শনিক বয়ান।

দ্য পিলগ্রিমেজের কাহিনী অবলম্বনে কোয়েলহোর জীবনীর নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটির আন্তর্জাতিক শিরোনাম ‘নাও পারে না পিসতা’। ব্রাজিলিয়ান প্রাক্তন ফুটবলার এবং কোচ ইভারিস্তো দে মাসিয়াদো এক টিভি সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে বলেন, চলচ্চিত্রটি আমাদেরকে এমন এক লোকের গল্প বলে যার একটি স্বপ্ন ছিল। এটি অনেকটা এলিস অ্যান্ড ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি ছিলেন তার ঘরের চেয়েও বড়।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার কালজয়ী উপন্যাস ‘অ আলকেমিস্তা’। ১৯৯৩ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য আলকেমিস্ট’ ছাপা হয়। এটি আন্দালুসিয়ান এক রাখাল বালকের গল্প। ছেলেটি মিশরের পিরামিডে গিয়ে গুপ্তধন সন্ধানের স্বপ্ন দেখে এবং তার পালের সব গবাদিপশু বিক্রি করে দেয়। এরপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেদিকে রওনা হয়। সারা পথে অন্তর্জ্ঞান তার সহযাত্রী। পার্থিব গুপ্তধনের সন্ধানে নেমে উপন্যাসের এ রাখাল বালক এক পর্যায়ে তার মনের সমৃদ্ধি নিয়ে ফিরে আসে। প্রথমে অখ্যাত এক ব্রাজিলিয়ান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বইটি ছাপার দায়িত্ব নেয়। ছোট্ট এ প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে মাত্র ৯০০ কপি বই ছাপে এবং বইটি আর পুনর্মুদ্রণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনাক্রমে কোয়েলহো বড় পাবলিশিং হাউজ হার্পারকলিন্সের খোঁজ পান এবং ১৯৯৪ সালে তার পরের বই ব্রিদাসহ দ্য আলকেমিস্ট বৃহত্তর কলেবরে ছাপা হয়। পরবর্তীকালে ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলার তালিকায় ঠাঁই পায়। বইটি ৩৫টিরও বেশি দেশে বিক্রয় তালিকার শীর্ষে অবস্থান করে প্রকাশনা জগতে বড় ধরনের এক বিস্ময় সৃষ্টি করে।

তার লেখায় আলাদা সংস্কৃতি ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরা সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন লেখককে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আগ্রহী হতে হয়। শুধু নিজের গ্রাম নিয়ে লেখার জন্য আমি এখানে আসিনি। নিজের গ্রামকে খানিকটা তুলে ধরলেও, আর সব গ্রামকেও বুঝতে হবে। টলস্টয়ও তাই বলে গেছেন, একটি গ্রামে যে সব ঘটনা ঘটে তা সব জায়গাতেই ঘটতে দেখা যায়।

১৯৮২ সালে কোয়েলহো তার প্রথম বই ‘হেল আরকাইভস’ প্রকাশ করেন, যা উল্লেখযোগ্য প্রভাব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘দ্য প্রাকটিক্যাল মেনুয়াল অব ভ্যাম্পায়ারিজম’ লিখেন, যদিও তার কাছে বইটি ‘নিম্নমানের’ মনে হওয়ায় তিনি তা বইয়ের তাকগুলো থেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেন।

কোয়েলহোর বইগুলো পুনরাবৃত্ত একটি ধারণা হলো ব্যক্তিগত উপাখ্যান। যেখানে চরিত্রগুলো তাদের স্বপ্ন অনুসরণ করে এবং স্বরূপ-আবিষ্কার পথের পিছু নেয়। সেই দীর্ঘ সব পথে তারা নানা দুর্ভোগের মুখোমুখি হলেও, কেবল নিজেদের স্বপ্নের কাছে বিশ্বস্ত থেকে তারা আত্মিক পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। তার সাহিত্যকর্মে ধর্মীয় এবং দার্শনিক ধারণাগুলোর মিশ্রণ ঘটাতে কোয়েলহো সহজ, সরল ও স্পষ্ট ভাষার ব্যবহার করেছেন।

বড় বড় লেখকদের সৃষ্টিকর্মে যাজকীয় কিছুই কি নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেনরি মিলারের তা ছিল বলে কি আপনি মনে করেন? না! না! না! কিছু কিছু লেখক রয়েছেন যারা এটি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। এসব-ওসব শেখার চেষ্টা করতে আমি বই পড়ি না, কারণ সপ্তাহের জন্য আমি শিখতে পারলেও এসব শিক্ষা অদৃশ্য হয়ে যাবে। ঠিক নিজেকে সাহায্য করার বইগুলোর মতো। ওগুলো পড়লেন আর ভাবলেন, এবার বোধ হয় জীবনটা বদলে যাবে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর একই ধরনের সব সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। তাই লেখার সময় শেখাবার জন্য লিখলে চলবে না। লিখতে হবে শেখার জন্য।

কোয়েলহো বলেন, লিখে কাকে প্রভাবিত করতে যাচ্ছেন কখনোই আপনি তাতে সচেতন নন। আমি বস্তুত বিটলস দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলাম। এর জন্য কি জন লেলন ও ম্যাকার্থির তারিফ বা দোষ দেওয়া যেতে পারে? না। এমনকি আমার অস্তিত্বের কথাও তাদের জানা ছিল না। কিন্তু তাদের মধ্যে ভাবনাটা ছিল আর প্রতি মূহুর্তে আমি যা ভাবছি, তারাও তাই ভেবেছিলেন। সেই অনুভূতি বাস্তবেই এমন এক পার্থক্য তৈরি করে যে আমি মোটেই একা নই। সম্ভবত আমার বইয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। লেকেরা মনে করছে এ লেখক আমাদের মতো একই জিনিস ভাবছেন আর তারা একা নন।

লেখক হয়ে ওঠার দীর্ঘসূত্র কাটিয়ে ওঠার চেষ্টারত থাকার সময়, একবার কোয়েলহোকে বলতে শোনা যায়, আজকে কোনো সাদাপালক দেখতে পেলে, বুঝবো আমাকে নতুন একটি বই লিখতে হবে স্রষ্টা আমার কাছে তারই একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। তখনই কোয়েলো এক দোকানের জানালার ওপর ধবল একটি পালক দেখতে পান এবং সেদিনকার মতো লিখতে শুরু করে দেন। দ্য আলকেমিস্ট ছাপা হওয়ার আগ পর্যন্ত, কোয়েলহোকে সাধারণত প্রতি দুই বছরে অন্তত একটি করে উপন্যাস লিখতে হয়েছে। এর তিনটি- দ্য পিলগ্রিমেজ, দ্য ভালকিউরিস ও আলেফ আত্মজৈবনিক। ১৯৯২ সালে কোয়েলহো এবং তার স্ত্রীর মরুভূমি এলাকায় অনুসন্ধান অভিযান অনুসরণে ভ্রমণবৃত্তান্তের আঙ্গিকে লেখা ভালকিউইয়াস ছাপা হয়। ১৯৯৫ সালে ভালকিউরিস শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়।

নিজেকে জাদু বাস্তবতার লেখক মনে করেন কি-না? তার বইগুলো ম্যাজিকাল, তাহলে কেন তিনি দ্য পিলগ্রিমেজ ও ভালকিউরিসকে ননফিকশন বলছেন। তাতে করে কি তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ভালকিউরিস শতভাগ ননফিকশন নয়। তবে এর ননফিকশন চরিত্রের ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিজেকে আমি কখনোই ম্যাজিক রিয়েলিস্ট বলিনি। আমাকে আমি এমন একজন রিয়েলিস্ট বলেছি যে তার লেখার সাহায্যে ম্যাজিক স্পর্শ করেছে।

প্রসঙ্গক্রমে আমাদের অগোচোরে অদৃশ্য কোনো বিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই। এখানে অদৃশ্য একটি জগত একেবারেই বর্তমান। উদাহরণ হিসেবে ভালোবাসা বা ভয় অথবা ক্ষোভের কথা বলা যেতে পারে। এরা অদৃশ্য হলেও এখানে অবস্থান করেই পকেটের টাকার চেয়েও জীবনকে অনেক বেশি প্রভাবিত করছে।

অন্যদিকে তার বাদবাকি বেশিরভাগ উপন্যাসই ফিকশনধর্মী। তার বক্তব্য, দ্য মেনুয়াল অব দ্য ওয়ারিয়র অব লাইট ও লাইক দ্য ফ্লোয়িং রিভার- এর মতো বইগুলো মূলত প্রবন্ধ সংগ্রহ, সংবাদপত্র কলাম অথবা নির্বাচিত বক্তব্য। এ যাবত তার লেখা ১৭০টিরও বেশি দেশে প্রকাশিত এবং ৮০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তার বই একত্রে ১০ কোটিরও বেশি সংখ্যাক কপি বিক্রি হয়েছে। ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি রিকটোপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সমকালীন লেখকদের তালিকায় কোয়েলহোকে দ্বিতীয় স্থানে তালিকাভুক্ত করে।

তারপরও বিতর্ক ছাড়া কখনোই তার লেখার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হতে দেখা যায়নি। ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে ওঠা এবং নিজেকে এখনও বিশ্বাসি বলে উল্লেখ করার পরও, তার লেখার মধ্যে নতুন যুগের সর্বেশ্বরবাদ ও আপেক্ষিকতাবাদী বিষয়বস্তুর কারণে তার বুদ্ধিজাত দৃষ্টিভঙ্গি ক্যাথলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করা হয়। বিক্রি যাই হোক না কেন, কোয়েলহোর পরের কাজগুলোর রিভিউগুলোতে সঙ্গত কারণেই এসবের অগভীরতার কথা উঠে আসতে দেখা যায়।

কোয়েলহোর অন্য গদ্যের মধ্যে ‘না মাসান দ্যু রিও পিয়েদা ইউ সিনতেই এহ সোরে’ ছাপা হয় ১৯৯৪ সালে। ১৯৯৬ সালে ‘বাই দ্য রিভার পিয়েদা আই স্যাট ডাউন অ্যান্ড ওয়েপ্ট’ শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়। শারীরিক ও স্বর্গীয় ভালোবাসা এবং ঈশ্বরের নারী অংশের বিষয়বস্তু। বাইবেলের নবী এলিয়াকে নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক ফিকশন ‘লা কিউতা মোন্তানিয়া’। ১৯৯৮ সালে ‘দ্য ফিফথ মাউন্টেন’ শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়। মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোয়েলহোর অভিজ্ঞতার আলোকে একই বছরে ছাপা আরও একটি উপন্যাসের নাম ‘ভেরোনিকা দেসিদা মোহের’। ১৯৯৯ সালে ভেরোনিকা ডিসাইডস টু ডাই শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়। কাল্পনিক এক ছোট্ট শহরের ভালো-মন্দ নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘উ দেমনিয়া ই অ সিনিওরেত্তা প্রিম’। ২০০০ সালে দ্য ডেভিল অ্যান্ড মিস প্রিম শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়।

আপনি আপনার উপন্যাসে ‘শুভের লড়াই’ প্রসঙ্গে বলেছেন। আপনি কি মনে করেন আমরা শুভ বনাম অশুভের মতো কোনো মহাজাগতিক যুদ্ধে বিজড়িত রয়েছি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব সময়, হ্যাঁ। একেবারে শুরু থেকেই। ... আমি সময়ে বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস পৃথিবী এখনই সৃষ্টি এবং ধ্বংস হচ্ছে। আমরা এ অনন্তে বসবাস করছি। বর্তমানে আমরা যা করছি তার সাহায্যে আমরা আমাদের অতীত ও ভবিষ্যত পুনরুদ্ধার করতে পারি। তাই এখানে এমন একটি যুদ্ধ চলছে, তবে তা স্রষ্টাকে দিয়ে প্রস্তাবিত। আমি একজন একেশ্বরবাদী। আমি বিশ্বাস করি না তার সমান ক্ষমতাধর অপর কোনো অশুভশক্তির অস্তিত্ব রয়েছে, কোনো অশুভ শক্তি শুভকে পরাজিত করতে পারে না। তাই এমন কতগুলো বিষয় এর সত্তাধীন যার কোনো জবাব আমার কাছে নেই এবং আমি জবাব দেওয়ার চেষ্টাও করি না।

সদাপ্রভুর প্রার্থনায় লেখা রয়েছে ‘আমাকে প্রলুব্ধ করো না!’ এর কী মানে? এর মানে হলো সব শেষে ঈশ্বর আমাদের পরীক্ষা নেবেন। তখন একটি লড়াই হবে। তবে বসন্তের আগমনের সময় হলে আমি এ একই ধরনের লড়াই দেখতে পাই। আমার মনে হয় না তাতে শীত খুব খুশি হয়। সে থেকে যেতে চায়, কিন্তু বসন্ত বলে বেড়ায় আমি আসছি। এর মধ্যে জীবনের একটি চক্র রয়েছে, আমরা যা টের পাই না। শরতে প্রকৃতির হাতে পাতা মরতে দেখে আমরা শিউরে উঠি। এটিই শুভ বনাম অশুভ। এটিই প্রকৃতি। আমাদের নিজেদের স্বভাবও কিন্তু এরকমই।

কোয়েলহো বলেন, তাই, উচ্চাঙ্গ এসব সমস্যার কোনো জবাব আমার কাছে নেই। আমি কেবল আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি এবং আমার অনুভূতি হলো সেই রহস্যের সম্মান করা! জবাব খোঁজার চেষ্টা করবেন না। ভালো বক্তা হলে হয়তো এমন একটি উত্তর দাঁড় করানো সম্ভব যার সাহায্যে অসংখ্য লোককে বোঝানো যাবে, কিন্তু তা কি সততা হবে? এরকম কোনো কাজ করা কি ঠিক হবে? বরং বলা ভালো আমার জানা নেই। আমিও তাই করি।

কোয়েলহো সপ্তাহে তিনবার তার ব্যক্তিগত ব্লগে পোস্ট করেন। ফেইসবুক ও টুইটারে তার লাখ লাখ ভক্ত রয়েছে। ২০১৪ সালের আগস্টে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সঙ্গে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে তার ও তার ভক্ত-পাঠকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়ে তিনি এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশ নেন। একই বছর নভেম্বরের মধ্যে তিনি তার সংগ্রহে থাকা নথি-পাণ্ডুলিপি, দিনপঞ্জি, আলোকচিত্র, পাঠকদের চিঠি, সংবাদবিজ্ঞপ্তির কাটা অংশসহ মোট ৮০ হাজার পোস্ট সম্পন্ন করেন এবং একটি ভার্চুয়াল পাউলো কোয়েলহো ফাউন্ডেশন গঠন করেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম। একজন লেখক হিসেবে আমাকে এমন সব প্ল্যাটফর্ম খুঁজে বের করতে হয় যা এই লিখন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যাবে। ইন্টারনেট এর একটি। ইন্টারনেটের কারণে লোকেরা এখন আগের চেয়ে ঢের বেশি লিখছে ও পড়ছে। তাই আমার পাঠকদের কথা শুনবার জন্য এবং তাদের সঙ্গে উভমুখী যোগাযোগ গড়ে তুলতে এ ভার্চুয়াল বিশ্ব আমার জন্য একটি পথ। এর মাধ্যমে তারা তাদের মতামত জানাতে পারছে। একই সঙ্গে তিনি জেনেভাভিত্তিক একটি স্থায়ী ভৌত ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডেভিল অ্যান্ড মিস প্রিম, ব্রিদা এবং দ্য উইচ অব পোর্তেবেল উপন্যাস অবলম্বনে টিভি সিরিজ তৈরির উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের ১ মার্চ কোয়েলহো একটি চুক্তি সই করেছেন বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২০
এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।