ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাংলানিউজকে কবি শহীদ কাদরী

মাতৃভূমি ছাড়তে নেই, মাতৃভূমি ত্যাগ করা লেখকের আত্মহত্যার সামিল

শিখা আহমাদ, নিউ ইয়র্ক থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১১
মাতৃভূমি ছাড়তে নেই, মাতৃভূমি ত্যাগ করা লেখকের আত্মহত্যার সামিল

পুরো দু’ সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়ে বাসায় ফিরেছেন শহীদ কাদরী। পরের দিনই আবার ডায়ালিসিস।

ডায়ালিসিসের পর খুবই ক্লান্ত থাকেন। হুইল চেয়ারে বসেই টেলিফোনে নিজের অসুস্থতা, ক্লান্তি, নিউ ইয়র্কের জীবন, দেশ এবং দেশে সেই সর্বগ্রাসী আড্ডা আর তাঁর আজন্ম সঙ্গী কবিতার মানুষদের কথা বলছিলেন তিনি।

কবি শহীদ কাদরী আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তি। প্রবাসজীবন যাপন করছেন কয়েক যুগ ধরে। থাকেন যদিও দেশ থেকে বারো হাজার মাইল দূরের শহর নিউ ইয়র্কে— হৃদয়-মন তবু যেন বাংলাদেশের মাটির গভীরে প্রোথিত।

বললেন, ‘লেখক শিল্পীদের শেকড় ছিন্ন হয় না, তা তারা যেখানেই থাকুন না কেন। ’ কসমোপলিটান শহর নিউ ইয়র্কে থাকলেও মন তাঁর পড়ে থাকে ঢাকা ও কলকাতায়। ওই কুয়াশাভেজা সকাল, বৃষ্টিতে সাদা হয়ে যাওয়া কালো রাত, রিক্সার টুং টাং ধ্বনি, মাছির গুঞ্জনের ভেতর একদা পরে থাকা নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরেন মধ্য-ম্যানহাটানে বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতো বুকের উপর আছড়েপড়া দুর্বিনীত বাতাসের ঝাপটার ভিতর।

বললাম, ‘দেশকে মিস করেন না শহীদ ভাই?’
আমার প্রশ্নে যেন খুবই অবাক হলেন। বললেন, ‘দেশকে মিস করি না মানে? ভীষণ মিস করি। তোমার নামটা যেন কি বললে ?’
 ‘শিখা। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011December/quadri 120111218183140.jpg‘হ্যাঁ, শোন শিখা, দেশতো সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। মায়ের মুখের মতো, পিছনে ফেলে আসা ভেজা বাল্যকালের মতো। মায়ের মুখের কথা উঠলো যখন, তোমাকে বলি-- আমি আমার বাবাকে হারিয়েছিলাম কলকাতায় আর মাকে ঢাকায়। ওই দিনটি ছিল একই সঙ্গে আনন্দ আর বেদনার। বেদনার কারণ, আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম মায়ের মৃত্যুতে। আর আনন্দের কারণ, ওইদিন বুদ্ধদেব বসু’র ‘কবিতা’ পত্রিকায় আমার ‘এই শীতে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ’

১৯৬৬ সালের কথা বলছি, আমার বয়স তখন ২৪ বছর। জীবনের প্রথম সাফল্য। ওইদিন মায়ের দাফন সেরে সন্ধ্যায় বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায় গিয়েছিলাম, তখনো কেউ আসেননি। আমি একা, কষ্ট আর বিষাদে ভরা মন। টেবলে মাথা রেখে কাঁদছিলাম। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ, চোখ তুলে দেখি শামসুর রাহমান। তিনি তখন খবরটা দিলেন, আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। শামসুর রাহমান তখন কোলকাতা থেকে ডাকযোগে তাঁর কাছে আসা ‘কবিতা’ পত্রিকার সংখ্যাটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই দ্যাখো তোমার কবিতা। ’

 খুলে দেখি— ‘এই শীতে’ কবিতাটি:

... অথচ এ-শীতে একা, উদ্ধত আমি,
আমি শুধু পোহাই না ম্লান রোদ
প্রতিবেশী পুরুষ নারী আর বিশাল
যে রিক্তগাছ, যে ঈর্ষায় সুখী
নিয়ত উত্তাপ দিই বন্ধু পরিজনে।
              আমি শুধু
একাকী সবার জরার মুখোমুখি।

এবং আরো একজনের চোখে দেখি
লক্ষ সূর্যের আসা-যাওয়া এবং সেও একা
আমারই আত্মার মত
               প্রাঙ্গণের তরুণ কুকুর।

                                            
২.

বাল্যকাল কলকাতায় কেটেছে তাঁর। জন্ম ওখানেই।
‘বাবা ছিলেন ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’র সম্পাদক দামেস্কে’র ভারী তরবারির মতো আমরা খুব ভয় পেতাম বাবাকে। মা ছিলেন আমাদের খুব কাছের মানুষ। বৃটিশ আমলে কেন্দ্রীয় সরকারে জয়েন করেন বাবা। ভারতভাগের পরও আমরা কলকাতায় ছিলাম। বাবা হঠাৎ কলকাতাতেই মারা যান। আমার এক ফুপু ছিলেন ঢাকায়, খুবই কান্নাকাটি করতেন আমাদের জন্যে। তখন কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হতো খুব। ফুপুর মনে তখন আমাদের নিয়ে নানা আশঙ্কা। ১৯৫২ সালে আমরা ঢাকায় চলে আসি। কলকাতার দাঙ্গা নিয়ে আমার একটি কবিতা আছে, তোমাকে শোনাই:

একটা মেয়ে কোপায় তার কোমল লাল গোলাপ
ছুরিতে বেঁধা কোলকাতার শানানো ফুটপাতে
দেখেছিলাম ছেলেবেলায় ম্যানহোলের পাশে
রয়েছে প’ড়ে স্তনের নীচে হা-খোলা এক ক্ষত
হুবহু এই লাল গোলাপের মতো।
আজকে তাই তোমার দেয়া কোমল লাল গোলাপ
তীক্ষ্ণ হিম ছুরির মতো বিঁধল যেন বুকে। ...’

কিছুতেই যেন ভুলতে পারেন না কলকাতার স্মৃতি। তখন কলকাতা ছিল অত্যাধুনিক শহর।
 ‘...আর আমরা তখন ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের মতো ইংরেজিতে কথা বলতাম, কাউবয় মুভি দেখতাম। কেক-পেস্ট্রির দোকান চালাতো ডাচ, ইংরেজ, জার্মান আর ফরাসীরা। আমরা সুইজারল্যান্ডের আইসক্রিম খেতাম। সেই কলকাতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। কলকাতার একজন সাধারণ মানুষও যে কত সমৃদ্ধ, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁদের যে কত অনুরাগ, আত্মিক টান— একটি উদাহরণ থেকে বুঝতে পারবে। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি। দেখি, ফুটপাতে একজন বই বিক্রি করছে। আমি একটি বই হাতে নিয়ে উচ্চারণ করলাম, ‘লেস মিজারেবল’; দোকানি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘খোকা বইটির নাম ‘লা মিজারেবল ’--এই হচ্ছে কলকাতা। ’
 
‘কি রকম ছিল প্রিয়তম সেই শহর কলকাতা ছেড়ে চলে আসা?’
‘খুবই বেদনার। ইস্পাহানির ওরিয়েন্টাল এয়ারলাইন্সে যখন কলকাতা থেকে ঢাকা এসে নামলাম— মনে হ’ল, আলোর রাজ্য থেকে এক অন্ধকার গলিতে প্রবেশ করেছি। তবে একটি কথা বলছি তোমাকে— কলকাতায় আমি কোনোদিন নৌকা দেখিনি। ঢাকার সদরঘাটে নৌকা দেখা ছিল এক বিস্ময়ের মতো। আমার বয়স তখন ১০। প্রথমদিন বুড়িগঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকা দেখে আমি তো রীতিমতো অবাক। কী আশ্চর্য, ঢাকায় এভাবে সারাজীবন নৌকা দেখতে পারবো! প্রতিদিন বিকেলে সদরঘাট যেতাম নৌকা দেখতে। তারপর রিভারভিউ ক্যাফেতে বসে চা আর চকলেট-বিস্কুট খেয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম। ওখানে করনেশান পার্ক বলে একটা পার্ক ছিল। ওই পার্কে গিয়ে বসতাম আমার এক কাজিনকে নিয়ে। আমার সেই কাজিনটা মারা গেছে। ’

‘আপনি শুরুতে আপনার মায়ের কথা বলছিলেন। মায়ের মৃত্যুর কথা...’
‘হ্যাঁ, মা খুব অসুস্থ থাকতেন। তবে আমাদের লেখাপড়ার দিকে তাঁর ছিল শাণিত চোখ। আমার মায়ের হাতের মোরগ-মোসাল্লাম-এর স্বাদ এখনো যেন জিভে লেগে আছে। অপূর্ব। ঈদ আর কোরবানিতে মা নিজ হাতে রান্না করতেন। ভাইবোনদের সবার পছন্দ ছিল মায়ের হাতের সেই রান্না। এখনো আমার প্রিয় খাবার মোরগ-মোসাল্লাম। তবে আমেরিকান মুরগিতে একটা বিটকেলে গন্ধ আছে। খেতে ভালো লাগে না। ’

‘ওই সময় ঢাকাতে খাশির মাংশের সিনা দিয়ে ‘গ্লাসি’ নামে একটা খাবার বানানো হ’ত। চমৎকার। আর বিখ্যাত ছিল চকবাজারের মোরগ- পোলাও। বড় স্বাদের ছিল রেক্সের কাবাব-পরাটা, গ্রিন হোটেলের চিকেন টিক্কা আর রেড বাটনে গ্রিক স্টাইলে রোস্টেড ল্যাম্ব লেগ। আর ছিল কালাচাঁদের মিষ্টির দোকানের ছানার আমৃত্তি।

তখনকার ঢাকা শহরের অবস্থা এখনকার মতো ছিল না। ঢাকা অনেক ছিমছাম ছিল, লোকজন আর গাড়িঘোড়া ছিল খুবই কম।

আমরা শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন আর আমি সারা রাত হাঁটতাম শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায়। যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে যেত আমরা তখন যেতাম রেল-স্টেশনে। সেখানে ‘আদর্শ মুসলিম হোটেল’ ও ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ খোলা থাকতো সারারাত। মালিক একজনই— তিনি মুসলমান। আমরা তখন না-হিন্দু, না-মুসলিম। সব ধর্মই আমাদের ধর্ম তখন। আমরা রাত তিনটায় হিন্দু হোটেলে ঢুকে আড্ডা দিয়ে রাত শেষে মুসলিম হোটেলে চা খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। ’

একটা সময় ছিল যখন শহীদ কাদরী নিজেই ছিলেন জ্বলজ্যান্ত এক আড্ডার নাম। বলা হত, তিনি ল্যাম্প-পোস্টের সঙ্গেও আড্ডা দিতে পারেন। এমন কোনো সাক্ষাৎকার বা লেখা নেই যেখানে এই তুমুল আড্ডাবাজ মানুষটি আড্ডার কথা বলেননি। আমাদের ফোনালাপের অধিকাংশ সময় জুড়েই ছিল এই আড্ডার প্রসঙ্গ।

বললেন, ‘আমি হচ্ছি ইমিগ্রান্ট আড্ডাবাজ। এই দূর প্রবাসে সবচে’ বেশি মনে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সেই দিনগুলো-রাতগুলোর কথা। বিউটি বোর্ডিং, রেক্স রেস্তোরাঁ, ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের বাড়ি, শামসুর রাহমানের বাড়ি, ফজল শাহাবুদ্দিনের অফিস, সন্ধানী আর পুরানা পল্টনে আড্ডা হ’ত নিয়মিত। ’

‌‌‌‘শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, কায়সুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মাহমুদুল হক, সিকদার আমিনুল হক— আমরা নিয়মিত আড্ডা দিতাম। আমাদের আড্ডায় মাঝেমাঝে আসতেন মফিদুল হক। কখনো আবুল হাসনাত। তবে প্রায়শ বুড়ো ভাই, বিপ্লব দাশ, মুহম্মদ খসরু আর রাজিব আহসান চৌধুরী। ’

‌‘আর আসতো এক ঝাঁক তরুণ, ওরা বয়সে আমার অনেক ছোট: আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, ইকবাল হাসান, মাহবুব হাসান, হাফিজুর রহমান। যখন পুরানা পল্টনের বাসায় থাকতাম বেলাল, রফিক, মান্নান, আবিদ আর ইকবাল ছিল আমার নিত্যদিনের আড্ডার সঙ্গী। রমনা রেস্তোরাঁয়ও কিছুদিন আড্ডা দিয়েছি। ওই আড্ডায় ফরহাদ মজহার আসতো, খুবই প্রতিভাবান। আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। ’

‘বেলাল ও আমি চট্টগ্রামে একসঙ্গে ছিলাম এক বছর, তার পরিবারের সবার সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। বেলাল আর আমি ওই সময় টানা এক বছর চট্টগ্রামে আড্ডা দিয়েছি। আর রফিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তার ছাত্রাবস্থার সময় থেকে। তার সাথে আছে উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল হাজারো স্মৃতি। ’

‘মান্নান সৈয়দ ছিল আমার মতোই তুমুল আড্ডাবাজ। এক সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে— গ্রিনরোডে মান্নান সৈয়দের বাসায় হাজির হলাম, সঙ্গে রফিক আজাদ ও ইকবাল। গিয়ে দেখি, পুরো বাড়ি আলোকে আলোকময় মান্নানের বোনের বিয়ে। নো-প্রব্লেম, রফিক বলল, ওস্তাদ আড্ডা কিন্তু ছাড়া যাবে না। মান্নান বিয়ে নিয়ে থাকুক, আমরা আমাদের মতো করে আড্ডা দেবো। আমাদের শুধু একটা রুম হলেই চলবে। ’

‘সেরাতে মান্নান ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সঙ্গে রাতের শেষ অব্দি পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছিল। আমার ঢাকা থাকার শেষদিকে একদিন ইকবাল হাসান পুরানা পল্টনের বাসায় ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে এলো। মিলন তখন প্রচুর লিখছে। মিলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হ’ল আজ মিলনের মনে আছে কিনা জানি না। ও একবার একটা কাণ্ড করেছিল। আমি লন্ডন যাচ্ছি, মিলন এসেছিল এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে। হঠাৎ আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, শহীদ ভাই বিদেশে যাচ্ছেন অথচ আপনার হাতে ঘড়ি নেই— এ কেমন কথা! বলেই মিলন নিজের হাতের ঘড়িটি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল। মিলনকে বলছি, তোমার সেই ঘড়ি এতোদিন পর নিউ ইয়র্কে নষ্ট হয়েছে। এতোদিন আমার হাতেই ছিল। ’


http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011December/kadri 120111218183132.jpg‘আড্ডা নিয়ে দুটো ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে আমার। একটি সদ্যপ্রয়াত ঔপন্যাসিক রশীদ করীমকে নিয়ে। অন্য ঘটনাটির নায়ক কবি আবুল হোসেন। রশীদ করীম তখন বাংলাদেশে বিদেশি একটি তেল কোম্পানির বিগ বস। তাঁর সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। শামসুর রাহমানের বিশেষ বন্ধু। তিনি নিয়মিত রশীদ করীমের বাড়িতে আড্ডা দেন। তো একদিন শামসুর রাহমান আমাকে বললেন, রশীদ করীম আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন, কাবাব-পরাটা খাওয়াবেন। যাবেন ? বললাম, কাবাব-পরাটা খেতে রশীদ করীমের বাড়ি যেতে হবে কেন? ওতো রেক্সেই নিয়মিত খাচ্ছি। তারপরও শুধু আড্ডার লোভে গিয়েছিলাম। ’

‘কবি আবুল হোসেনের বাড়িতে শামসুর রাহমান যেতেন নিয়মিত। ওই বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেলে সবাই ধন্য হয়ে যেত। কিন্তু উনি সবাইকে ডাকতেন না। বিশেষ বিশেষ লোকদের ডাকতেন। একদিন শামসুর রাহমান হঠাৎ বললেন, আবুল হোসেন আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি তখন ‘সংলাপ’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। দুরুদুরু বুকে গেলাম। গিয়ে দেখি আল মাহমুদও আছেন। আবুল হোসেন তাঁর পত্রিকার জন্যে কবিতা চাইলেন। বললেন, আমি ‘সমকাল’-এ তোমার কবিতা দেখেছি। একবার যখন তোমাকে চিনে ফেলেছি আর অসুবিধা হবে না। ওই আড্ডায় আল মাহমুদ ‘জাপানি আড্ডা’ নামে একটি কবিতা পড়লেন খুব ভালো লেগেছিল আমার। ’
     
‘যাদের সঙ্গে এতো আড্ডা দিয়েছেন এক সময় তাঁদের অনেকেই চলে গেছেন। অনেকের সঙ্গে আপনার আর কোনোদিন দ্যাখা হবে না...’
‘হ্যাঁ, আমি ভাবতেই পারি না শামসুর রাহমান, রশীদ করীম নেই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আর দ্যাখা হবে না। সিকদার আমিনুল হক, বিপ্লব দাশও চলে গেল! আর আবিদও যে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে কখনো ভাবিনি। বিশ্বাস করো, প্রিয় বন্ধুদের এভাবে একে একে চলে যাওয়া আমার কাছে এক একটি নক্ষত্রপতনের মতো মনে হয়। ’

এবার একটি ভিন্ন প্রশ্ন-- ‘আপনার জীবনে এমন কোনো ভুল আছে যার জন্যে আপনি প্রায়শ অনুতপ্ত ?’

‘আমার জীবনের সবচে’ বড় ভুল ১৯৭৮-এ দেশ ছেড়ে হঠাৎ চলে আসা। মাতৃভুমি ছাড়তে নেই। একজন লেখকের মাতৃভূমি ত্যাগ করা আত্মহত্যার সামিল। দেশের নিত্যদিনের ঘটনাপ্রবাহ যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা একজন লেখকের জন্যে জরুরি। আমি জীবনে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তুমি অবশ্য বলতে পারো মিলান কুন্ডেরার কথা। আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার, ভ্লাদিমির নভোকভ, ইয়োসেফ ব্রদস্কির কথা। আরো অনেকেই আছেন যারা মাতৃভূমির বাইরে বসেই লেখালেখি করেছেন। তবে আমাদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য হ’ল, এরা সবাই পাশ্চাত্যে লালিত। কেউ রাশিয়া থেকে পোল্যান্ড গিয়েছেন, আবার কেউ ইউরোপ থেকে আমেরিকা। আর আমরা যারা প্রাচ্য থেকে পাশ্চত্যে এসেছি— তাদের শুরু শূন্য থেকে। আমাদের স্মৃতিতে থাকে দেশ আর সামনে থাকে শূন্যতা। ’

‘যে কারণে একজন লেখকের জন্যে কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়। ’
‘ঠিক ধরেছো!’

আমি ধন্য হলাম— কবি শহীদ কাদরী ভরাট কন্ঠে আমাকে শোনালেন হীরন্ময় কয়েকটি পংক্তি:

কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর—
জুঁই, চামেলি চন্দ্রমল্লিকা কিংবা কাঠগোলাপ থেকে
টিউলিপ ম্যাগনোলিয়া অথবা ক্রিসেনথিমামে
নিজস্ব শহর থেকে অচেনা ফুটপাতে
এশিয়ার আকাশে ময়ূরনীল থেকে
কুয়াশাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যে
না, কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর ...’

বাংলাদেশ সময় ১৫০৫, ডিসেম্বর ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।