ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জল-আতঙ্ক

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০
জল-আতঙ্ক

রাত থেকেই পেটে ভীষণ ব্যথা। এক-একবার ব্যথাটা শুরু হচ্ছে একটা কামড়ের মধ্য দিয়ে।

বাসার সবারই এমনটা হচ্ছে কিনা মাহবুব জানে না। তবে সকাল থেকেই পানিতে দুর্গন্ধটা আসতে শুরু করেছে, একেবারে কাঁচা মলের গন্ধ। কুলি করার জন্য মুখে দিতেই গা গুলিয়ে এলো। মনে হচ্ছে পানির মধ্যে মল গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাহবুব দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালারা গাড়ি সাজিয়ে মৌসুমি ফল নিয়ে যাচ্ছে। অফিস যাওয়ার পুরো মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। নাখালপাড়ার পানিতে কখনো এত দুর্গন্ধ আসেনি এর আগে। পুরান ঢাকা, মিরপুর, শান্তিনগর, বাসাবো এইসব এরিয়ায় এই সমস্যার কথা শুনেছে মাহবুব। পেপার-পত্রিকায় দেদারছে লেখালেখি হচ্ছে কিন্তু তা শুধু ইনফরমেশন হয়ে স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে, কোনো অনুভূতি তৈরি করেনি এতদিন। আজ একেবারে ব্রক্ষ্মতালু জ্বালিয়ে দিয়েছে, না এ পানি মুখে তোলা যাবে না ।

মাহবুব কী অবস্থা দেখছ?

হুম।

এখন শান্ত-সৌম্যকে কোন পানি দেব? যাও বড় রাস্তার ওষুধের দোকান থেকে মাম কিনে এনে দাও। পাড়ার দোকানে সব নকল মাল।

কেন ঘরে ফুটানো পানি নাই আগের?
না নাই। সকালে উঠে নাশতা বানাতে গিয়ে সব খরচ হয়ে গেছে।
আশ্চর্য বাচ্চাদের পানি রাখবা না? মাম দিলে তার কী ভরসা। মামও তো ফুটিয়ে দিতে হবে।
দিতে হলে দেব। এত কথা বলো না। এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।
শাকিলা, সমস্যা মনে হয় তোমার একার হয়েছে, আর কারো হয় নাই?
কার হয়েছে তা দিয়ে আমি কী করব? কারো কারো তো সমস্যা হয়ও নাই। তাতে ফায়দা কী? এসব কুযুক্তি আমাকে দেখাতে আসবা না। কাজের মেয়ে দুইটার তো রাত থেকে ডায়রিয়া শুরু হইয়া গেছে, আমি এমডোকল দুইটা করে খাওয়াইছি সকালে, তাও কু কু করতেছে। আচ্ছা আমাদের বাসার পানিতেই কি এই সমস্যা দেখা দিয়েছে না অন্য বাসাগুলোতেও হয়েছে?
কী জানি! আমি জানি না।

তুমি হনুফা না হলে অজিফাকে পাঠাও জেনে আসুক।

কোন বাসায় পাঠাব? ওই হুজুরদের বাসায় পাঠাতে পারব না, ওরা মহা বেয়াদপ।
আরে আমি কি বলছি  ঐ বাসায় পাঠাতে, নির্মলাদের বাসায় যাও।
ওহ।

মাহবুবের পেটের কামড়টা আবার শুরু হয়েছে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে।

শান্ত-সৌম্যকে মামের বোতল দিয়ে স্কুলে পাঠান হলো। কাজের জন্য বড় রাস্তার আ¤ি¦য়া ফুফুর বাসা থেকে হনুফা, অজিফারা ক্যানভর্তি করে পানি নিয়ে আসে। বার বার যাওয়া-আসায় বাসা প্যাকপ্যাক হয়ে যায়। শাকিলা খিটখিটা মেজাজে সারাদিন ঘর পরিষ্কার করতে থাকে। পানির দুর্গন্ধটা একেবারে মগজের মধ্যে ঢুকে গেছে, কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না। কলেজে ফোন করে জানিয়ে দেয় আজ যেতে পারবে না। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এমন তিরিি মেজাজের অথচ তাকেই ফোন করে না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। শাকিলা বার বার ফোনের শব্দে দৌড়ে যায় কিন্তু কলটা অসে না। পিয়াল অনেক দিন ফোন করে না। ওর সাথে সকাল থেকে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ইচ্ছাটাকে দমন করে শাকিলা। পুরানো প্রেমিকের সাথে কথা ঘুরে ফিরে ঐ একই বিন্দুতে এসে শেষ হয়। দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসার সাথে চাপা দেয়া হিংস্রতাটাও এসে থাবা মারে। নাহ এর কোনো মানে হয় না। আর কোনোদিন পিয়ালের সাথে কথা বলবে না বলে ঠিক করে শাকিলা। যদিও এরকম বহুবার ভেবেছে কিন্তু একসময় এসব কোনো কিছুই তার কাছে আর অর্থ বহন করে না। মানুষের ব্যক্তিত্ব একটা মুখোশ ছাড়া আর কী? তাকে আরোপ করে বা জোর করে চাপিয়ে দিয়ে একটা অবয়ব হয়তো দেয়া যায় কিন্তু শাকিলার কাছে তা হাস্যকর ঠেকে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা শুরু হয় তাকে কুঠারাঘাত করে নতুন আকার দেওয়া বা পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের আগুন উসকে দিতে মন চায় না।

সন্ধ্যায় ওয়াসার পানির  গাড়ি কিনে আনে মাহবুব। পাঁচতলা বাড়ির প্রতি ফোরে দুটি করে মোট দশটি ফ্যাটের জন্য তিন গাড়ি পানি আনা হয়। রিজার্ভ ট্যাঙ্কি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। নতুন কেনা পানিতে কোনো গন্ধ নাই, তবু কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে মাহবুবের।

পাশের বাসার নির্মলা ছোট বোনকে নিয়ে রাতে আসে মাহবুবদের বাসায়। নির্মলার চোখ-মুখ গর্তে ঢুকে গেছে, পোশাকে একটা মলিনভাব, বয়সের ছাপটা একটু বেশিই পড়েছে যেন ওর। মাহবুব নির্মলাকে দেখে প্রথমে চমকে উঠলেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।
নির্মলা যে!

হ্যাঁ, মাহবুব ভাই...ভালো আছেন?
এই তো।
ভাবী নাই?
হ্যাঁ আছে, তোমরা বস।
নির্মলা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
নির্মলা অনেক দিন পর এলো মাহবুবদের বাসায়। তা প্রায় বারো বছর। তখন মাহবুব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, নির্মলা কলেজে। মাহবুবদের বাসায় একটা ছোট বাগান ছিল। রক্তকরবী, গন্ধরাজ, বেলি নানা জাতের ফুলের গাছ। বাসায় ঢুকলেই এক ঝাপটা ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগত। নির্মলা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

শাকিলা একটু গম্ভীর হয়ে ড্রইং রুমে এসে ঢোকে।
ওহ তোমরা।
জি ভাবী, ভালো আছেন?
এই তো আছি ভাই একরকম, তোমরা সব ভালো তো?
এই ভালো। বাচ্চাদের দেখছি না?
ওরা পড়ছে, তোমরা, কোনো দরকারে?
ভাবী আপনার সাথে একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এলাম।
হ্যাঁ, বলো।
ভাবী, আমাদের বাসায় পানির খুব সমস্যা, দুর্গন্ধ আসছে।
আমাদেরও একই অবস্থা। জঘন্য।
কী করব বুঝতে পারছি না, মেয়েটা খুব ভুগছে। সাতদিন হয়ে গেল এই অবস্থা।
বল কী! শাকিলা আঁতকে ওঠে।
মাহবুব এসে শাকিলার পাশে বসে।
নির্মলা তুমি কি স্কুলে চাকরি করছ?
হ্যাঁ। আগেরটাই।
অনেক দিন হয়ে গেল, না?
হুম...আট বছর।

নির্মলা হঠাৎ বলতে শুরু করে, মাহবুব ভাই পানির সমস্যার কথা কী আর বলব? আপনি শুনলাম পানির নতুন লাইন আনতেছেন, আমরাও আনতে চাই। কী করতে হবে না করতে হবে, কিছুই জানি না!

আনা তো খুব ঝামেলা, নির্মলা। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা সবার পারমিশন নিয়ে তারপর কাজটা স্টার্ট করতে হবে।

হ্যাঁ, অনেক ঝামেলা শুনেছি, সেজন্যই তো আপনাদের কাছে আসলাম।   আমার হাজব্যান্ডের পোস্টিং গাইবান্ধায়, আমার স্কুল সব কিছু সামলে করে উঠতে পারব মনে হয় না। মেয়েটার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। একসাথে যদি পানির লাইনটা আনা যায়... এই ফেবারটুকু যদি করেন।

শাকিলা ওদের কথার মাঝখান থেকে নিঃশব্দে উঠে যায়। নির্মলার আদিখ্যেতা দেখে রাগ লাগতে থাকে শাকিলার। রান্নাঘরে গিয়ে অজিফাকে বকাবকি করতে থাকে... কীরে এখনই ঘুমে ঢুলতেছিস, চাটাও বানাতে পারিস না? ঠাসঠুস শব্দ করতে থাকে নির্মলা। যত্তসব, নিজেদের হাজারটা ঝামেলায় বাঁচি না, এরা আসছে ভাই পাতাইতে। কেন নিজেরা যাইতে পারিস না? সিটি করপোরেশন, ওয়াসার অফিসে দৌড়াইয়া স্যান্ডেলের তলা খসা! কে তোদের না করছে! শাকিলা অজিফাকে দিয়ে ড্রইংরুমে কলা, বিস্কুট, চানাচুর পাঠিয়ে দেয়।

নির্মলা খাও তোমরা।
আরে ভাবী এত ঝামেলা করতে গেলেন কেন? আমরা মাত্র নাশতা করে এসেছি।
নাহ, ঝামেলা কী?
মাহবুবের দিকে তাকিয়ে নির্মলা বলে তাহলে আমরা কি পানির বিল আর টাকা নিয়ে আসব কালকে?
আমি খবর দেব নির্মলা। ওরা কখন আসবে বলে নাই জানলে অবশ্যই তোমাদের জানিয়ে দেব।
 কই কিছুই তো খেলে না তোমরা।

 এই খাচ্ছি ভাবী বলে নির্মলা একটা বিস্কুট তুলে কামড় দেয়। আপনিও নেন ভাবী।

শাকিলা মুখ ভার করে বসে থাকে। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। অন্ধকার আর গরমে ঘরের ভেতর গুমোট আবহাওয়া তৈরি করে। মাহবুব, শাকিলা, নির্মলা, নীলা চারজন চুপ করে বসে থাকে, ওদের নিঃশ্বাসের শব্দে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।   কয়েক মিনিট পর হনুফা মোম দিয়ে যায়। মাহবুব দেখতে পায় নির্মলার চোখের নীচে কালি জমে গেছে, কেমন কান্ত আর শুষ্ক ফলের মতো লাগে নির্মলাকে। নির্মলা চোখ নামিয়ে নেয়।

শাকিলা হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, নির্মলারাও দাঁড়ায়...
মাহবুব ভাই তাহলে আজ আসি, আপনি আমাকে খবর দিয়েন। ওহ আপনার মোবাইল নম্বরটা?
মাহবুব যন্ত্রচালিতের মতো বলতে থাকে... জিরো ওয়ান সেভেন টু... নির্মলার মোবাইল নম্বরটাও হাতের মোবাইলে সেভ করে নেয়।
ওরা চলে যাওয়ার পর মাহবুব অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে  সিগারেট খেতে থাকে। লোডশেডিংয়ের সময়টা ঘরে থাকা যায় না। বারান্দায় একটু বাতাস আসে, সেখানে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকে মাহবুব। আজ অনেকদিন পর নির্মলাকে সামনাসামনি দেখে ভিন্ন এক অনুভূতি হচ্ছে মাহবুবের মনে। এই নির্মলার জন্যই এক সময় পাগল ছিল মাহবুব। দিনরাত জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত, যদি একবার দেখা হয়। নির্মলা সব সময়ই খুব নিম্ন স্বরে কথা বলত। মাহবুবকে কখনো তুমিও বলেনি। নির্মলা চোখ তুলে তাকালে মাহবুব বেশিণ তাকিয়ে থাকতে পারত না। একবার ঈদের দিন নির্মলা তার কল্পনা মাসিকে নিয়ে এসেছিল মাহবুবদের বাসায়। তখন বাসায় কেউ ছিল না, সব নানাবাড়ি। মাহবুব নির্মলাকে ওর ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, নির্মলার তীœ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাহবুব হঠাৎ উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। কী যে সে উন্মাদনা! কী যে মন্থন! নির্মলার ভেতরে জমে থাকা অনেক দিনের উপচানো অস্থিরতা সেদিন প্রকাশিত হয়ে পড়ে। নির্মলার শান্ত অবয়বের মাঝে লুকানো তীক্ষè এক ধারাল অস্ত্রের সাথে সেদিন দেখা হয়েছিল মাহবুবের, যার ুরধার তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল । আর কারো মাঝে এই রূপ সে কখনো দেখতে পায়নি, কারো জন্য কখনো এমনটা হয়নি মাহবুবের। ওই দিনের পর থেকে নির্মলা কেমন যেন অচেনা হয়ে পড়ল, ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল। বাসায় আসা বন্ধ করে দিল, মাহবুবকে দেখলে দ্রুত হেঁটে চলে যেত, কলেজে  কথা বলতে গেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। মাহবুব ভাবত নির্মলা তার সাথে এমন আচরণ করছে কেন? সে কি মাহবুবের কাছ থেকে পালাতে চাইত না নিজের কাছ থেকে? মাহবুব কোনোদিন তা জানতে পারেনি। আর জানলেই বা কী হতো? অন্যরকম কিছু? নির্মলার কথা তার জীবনের সূত্রকে পাল্টে দিত? কে জানে! এরপর বছর পাঁচেক লিটনের আড্ডায় বুঁদ হয়ে ছিল মাহবুব। তরল-কঠিন-বায়বীয় এক জার্নি তার দেখার চোখটাকেই পাল্টে দিল। ঐ পরিভ্রমণ তাকে সব কিছুকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখতে শিখিয়েছিল। কোনো কষ্টই যেন আর ছিল না, শুধু  নির্মলার স্পর্শ তার কণ্ঠার কাছে একটা করুণ ঘণ্টার মতো সব সময় বেজে চলত।

শাকিলা পিছন থেকে মাহবুবের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাতাসহীন গ্রীষ্মের রাতে দুজনেই দরদর করে ঘামতে থাকে।
মাহবুব তোমার ইচ্ছাটা কী?
কীসের ইচ্ছা?
কীসের আবার, পানির লাইন আনার বিষয়ে। ওরাও কি আমাদের সাথে একত্রে লাইন আনবে?
আনলে আনবে! তাতে আমাদের সমস্যা কী?
এমনিতেই নিজেদের সমস্যায় বাঁচি না তার ওপর এই যন্ত্রণা!
শাকিলা নিজেরটা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারো না, না?
নাহ, পারি না। তাও যদি নিজেরটা পুরাপুরি চিন্তা করতে পারতাম। আমি বুঝি না কেন তুমি এত বছর পর আবার ওদের সাথে একত্রে কাজ করতে চাও?
 কেন চাই?
 কেন চাও তুমি তা খুব ভালো করেই জান।
শাকিলা এই জিনিসগুলো বাদ দাও। ওরা আসছে একটা সমস্যা নিয়ে। পারলে হেল্প করব, না পারলে নাই। ভেরি সিম্পল, তুমি শুধু শুধু কমপ্লিকেটেড করছো কেন?
অমি কমপ্লিকেটেড করছি, না তুমি?
করো ভাই, হেল্প করো। নারীজাতির কল্যাণে জীবনপাত করো। কিন্তু তোমার এখন বয়স কত সেই হুঁশ যেন থাকে। মনে করো না সবাই ঘাস খায়! কেউ কিছু জানে না! আমি এসব সহ্য করব না।
করো না সহ্য, যা ইচ্ছা হয় তাই করো।
করবই তো। ওদের সাথে কীভাবে একসাথে কাজ করো আমি দেখব!
আহ! এত রাতে  আমাকে অস্থির করে তুলো না শাকিলা!

দুজনে ঝগড়া করতে করতে বহু রাত হয়ে যায়। ইলেকট্রিসিটি আসে না। শান্ত-সৌম্য না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নাখালপাড়ার সরু গলির ভেতর অসংখ্য ফ্যাটবাড়ির মাঝে মাহবুবদের বাড়িটা মুখ গুঁজে থাকে। তাকে আলাদা করে চেনা যায় না। লোডশেডিংয়ের সময় দু-একটা বাড়ি দ্বীপের মতো আলোতে ভাসতে থাকে।

ভোর হতে না হতেই কলবেলের শব্দ। ওয়াসার নতুন পানির লাইন আনার জন্য টাকা নিতে এসেছে জব্বার। সে-ই সব কাজকর্ম করবে, দালালি । মাহবুব জানে জব্বার যা টাকা নিচ্ছে তার ওয়ান থার্ড অফিসে জমা দিতে হবে বাকিটা ওর পকেটে কিন্তু কিছু করার নেই। মাহবুব যখন থেকে অফিস-আদালতে যাতায়াত শুরু করল দেখছে এই দশা। তার বুকের ভেতর সবসময় একটা গর্ব, সততার গর্ব। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই বস্তুর খালি অহমটাই এখন পড়ে আছে, এটা আর মাহবুবের কোনো কাজে আসে না। তা এখন আর কাজ করছে না, অভিধানের জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। জব্বারের পিছন পিছন আধঘণ্টা পর এসে ঢুকল সিটি করপোরেশনের আকমল গুণ্ডা ওয়াসার লতিফুল মিয়া। ওদের ব্যস্ত-সমস্ত ভাব দেখলে ভিমরি খেতে হয়। মাহবুব আগেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছিল কিন্তু নির্মলা রাতে কল করে বলে তার হাতে এখন টাকা নেই। ঠেকার কাজটা চালিয়ে নিতে রিকোয়েস্ট করে। মাহবুবের জন্য হুট করে এতগুলো এক্সট্রা টাকা যোগাড় করা কঠিন ব্যাপার। শেষে মাহবুব অফিসের মকবুলকে ফোন করে রাতে টাকার বন্দোবস্ত করে। শাকিলা এসবের কিছুই জানে না। রাতে বারবার মকবুলের সাথে কথা বলা, বাইরে যাওয়া, টেনশন এসব দেখে শাকিলার মনে হতে থাকে মাহবুব তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। সকালে লোকজন আসার পর যখন শুনতে পেল নির্মলাদের পানির লাইনও একসাথে আসছে, আর মাহবুব টাকা দিচ্ছে, শাকিলা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, লোকজনের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, মাহবুব, নির্মলাদের পানির লাইনও একসাথে আসছে?

মাহবুব হুঁ বলে চুপ করে থাকে।

 কী বলছি শোনো ভালো করে, যদি ওদের লাইন আমাদের সাথে আনা হয় আমি সহ্য করব না। এবং এটাই ফাইনাল। তোমার লোকজনকে নিষেধ করে দাও, তোমাকে তো যা বলার রাতেই বলেছি। শাকিলার অগ্নিমূর্তি দেখে হকচকিয়ে যায় মাহবুব। ওয়াসার মকবুল বলে ভাবী, লাইন ওনাদেরটা আনলে আপনাদের কোনো লাভ নাই কিন্তু ওনাদের আছে। মাহবুব ভাই তো নিজে তদবির করে একসাথে আননের জন্য টাকা দিবেন বলেছেন। মাহবুব মাথা নিচু করে থাকে। শাকিলা বলে কিন্তু আপনারা ওনাদের কাজের সাথে আমাদেরটা মিলাবেন না, আমি বলে গেলাম, এটাই ফাইনাল। মাহবুব লোডশেডিংয়ের গরমে এমনিতেই ভিজে জুবুজুবু, শাকিলার রণরঙ্গিনী চেহারা দেখে একেবারে শেটিয়ে যায়। লোকজনকে বিকেলে আসার কথা বলে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে থাকে, শাকিলা রান্নাঘরে গিয়ে থালা-বাসন পেটাতে থাকে, কাজের মেয়ে দুটোকে অকারণে বকতে থাকে। মাহবুব এতটা আশা করেনি, তার মনও খচখচ করছিল। বিশেষ করে রাতে নির্মলার সাথে কয়েকবার কথা বলার পর তার নিজেরই সবকিছু ওলট-পালট লাগছে। এটা ঠিক কেমন অনুভূতি মাহবুব নিজেও বুঝতে পারছে না। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথার মতো আবার হঠাৎ হঠাৎ বলকানো পানির মতো ভেতর থেকে কেউ যেন মাহবুবকে জানান দিচ্ছে তোমার সব বাসনাই শেষ হয়ে যায়নি, নির্মলা একটা ফ্যাক্টর মাত্র। একটা উপল হয়ে দেখা দিয়েছে। তুমি যে জীবন কাটাচ্ছ তা কি সত্যি তুমি চেয়েছিলে? নিয়মরার মতো দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে...আর কোথাকার তুমি কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছ;  এতদিনকার বুকচাপা আর্তনাদটা গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। মাহবুব শাকিলার দিকে তাকিয়ে ভাবে, শাকিলার প্রতি তার কোনো আকর্ষণই নাই, বিয়েটা হয়ে যায় যান্ত্রিক নিয়মে। সমাজও যে একটা যন্ত্র আর তার অনু-পরমাণু এর সদস্যরা, তা বোঝা যায় বিয়েগুলোর মাধ্যমে।   নির্মলা ঝুঁকি নিয়ে পরিবার ছেড়ে আসতে চায়নি। তাই বলে যে বিষয়গুলো এমন যান্ত্রিক হয়ে গেল তা নয়। পূর্ব থেকেই যন্ত্রসমাজ চলছিল, তার একটা কে মাহবুব ছিল, কিছুদিন যন্ত্রের অর্ডার মেনে চলেনি, আউট ল, এই আর কী! কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রথার অনুসঙ্গ হয়ে ক্রিয়া করে গেছে শুধু। এতদিন পর হঠাৎ নির্মলাকে দেখে ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরিটা জেগে উঠেছে। মাহবুব জানে তার হাত-পা বাধা কোনোকিছুই সে ব্রেক করতে পারবে না, তা যদি করতে যায় তাহলে নিজশুদ্ধ উল্টে পড়বে, আর কেনই বা সে তা করবে? এসব চিন্তা মাহবুবকে আচ্ছন্ন করে রাখে। শাকিলার রক্তাভ চোখ সে দেখতে পায় না, শান্ত-সৌম্যর দিকে তাকানোর অবস্থাও তার নেই, ইচ্ছা করছে একটা একটা করে পানির পাইপ কেটে দিয়ে আসতে। পানিতে বিষ্ঠা যখন এসে মিশেছে তাহলে ভালো করেই আসুক। রাশি রাশি দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যাক এই শহর, জনপদ। বার বার ঠেকা দিয়ে কাকে রা করার জন্য এই আয়োজন? মাহবুব অফিসে যাওয়ার জন্য বড় বড় পা ফেলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। রিকশায় নির্মলাকে দেখতে পায় মেয়ে কোলে নিয়ে বসে আছে, চেহারায় একটা বিষণœতার ছাপ, কান্তি আর হতাশার চিহ্ন। নির্মলার গর্তে ঢুকে পড়া চোখের ভেতর মাহবুব ঢুকে পড়ে, এ যেন তলহীন কুয়া, তলিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে। মাহবুব রাশি রাশি জলের মাঝে সাঁতার কাটতে থাকে, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসে কিন্তু কোনো জলই সে মুখে দিতে পারে না, দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। পেটে কামড় দিয়ে ব্যথাটা আবার শুরু হয়, মাহবুব বাসার দিকে ফিরতে থাকে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮০০, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।