ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

যীশু

সুমন কোড়াইয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১১
যীশু

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011December/galpo 120111210162500.jpgযীশুর বয়স দশ কি বারো। সে এ পাড়ার সব চেয়ে চঞ্চল বালক।

এটা তার আসল নাম না। খেতাবী নাম। কিন্তু এই নামেই তাকে সকলে ডাকে। বালক যীশু এই নামে ডাকলে সাড়া দেয়, সে কিছুই মনে করে না। বাঙালি খ্রীস্টানদের মধ্যে সন্তানের নাম যীশু রাখতে শোনা যায় না।

মিনতি রোজারিও যীশুর মা। পেশায় একজন এনজিও মাঠ কর্মী। বয়স ৩৫। প্রচণ্ড পরিশ্রমী। সাইকেল চালিয়ে মফস্বল শহর থেকে গ্রামে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ে তাকে ক্লাশ দিতে হয়। গ্রামের দরিদ্র নারীরা তাকে আপা বলে সম্বোধন করে থাকেন। সুখের অন্বেষণ নামের এই এনজিও’র অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে গ্রামে সেনেটারি টয়লেট ব্যবহারের উপকারীতা, এইডস বিষয়ে সচেতনতা দান প্রভৃতি। ঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি সেইসব বিষয়েও সুপরামর্শ দেয় মিনতি। অফিসে তার কাজের দক্ষতায় এবং সংস্থার নিয়ম শৃঙ্খলা ঠিক মত পালন করার জন্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক তার উপর খুব খুশি। অন্যান্য কর্মীদের তিনি মিনতির মত হতে পরামর্শ দেন। ছেলে হিমেলকে বাড়িতে মার কাছে রেখে এলেও সে যতক্ষণ অফিসে থাকে ততক্ষণ খুব ভালো থাকে। অফিস, ফিল্ড ওয়ার্ক তার ভালো লাগে।

বাড়ি ফেরার পথেই ঘটে যত বিপত্তি। অনেক যুবক তাকে দেখলে কটু কথা বলে, মুরুব্বিরা তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করেন। এখন সে কোথায় আছে কি করে প্রভৃতি। পাড়ার ছেলেরা চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় বিকেলে যখনই মিনতি সেখানে দিয়ে যায় তখন তারা বলে কুমারী মারিয়া যাচ্ছে রে! হিমেলের নাম এই ছেলেরাই শুরু থেকে যীশু বলতো। এখন উত্তর পাড়ার প্রায় সবাই হিমেলকে যীশু ডাকে।

যার সাথে মিনতরি প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, তাদের কোর্টে বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু তার স্বামী মিনতির বাচ্চাকে নিজের বলে স্বীকার করেনি। তাই উত্তরপাড়ার যুবকরা বলে, যীশুর মত পবিত্র আত্মার প্রভাবে মিনতি গর্ভবতী হয়েছিলো এবং তার গর্ভেই এই প্রজন্মের যীশুর জন্ম!

ক্লাশ ফাইভে পড়ে হিমেল। খেলা মাঠে তাকে যীশু ডাকে। ক্লাশের ছেলেরাও তাকে যীশু ডাকে। সে প্রতিবাদ করে না। কিন্তু তাদের ক্লাশ টিচার খ্রীষ্টান হওয়ায় একটু অবাক হন। স্নিগ্ধা ম্যাডাম হিমেলকে জিজ্ঞেস করেন, তোমাকে ওরা যীশু ডাকে কেন? তোমার নামতো স্কুলের খাতায় শুধু হিমেল রোজারিও লেখা? সে টিচারের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। বন্ধুদের মুখের দিকে তাকায়। যেন যারা যীশু ডেকেছে তারাই উত্তরটা জানে।

একজন উঠে বললো, টিচার, আমাদের পাড়ায় সবাই ওকে যীশু ডাকে! আরেকজন যার বাড়ি হিমেলের বাড়ির পাশে সেও বললো, হ্যাঁ টিচার। ওকে বাড়িতেও যীশু ডাকে। সেদিন স্নিগ্ধা কোড়াইয়া ম্যাডাম আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

নিজেদের বাড়িটা নিজের কাছে নরকের মত লাগে মিনতির। বাবা অসুস্থ। শরীরের এক পাশ অবশ। দুই বোনের মধ্যে সে বড়। ছোট বোনটার বিয়ে হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। সেখান থেকে দিনাজপুরে বছরে একবার বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে। চারজনের সংসার হিমেলই মাতিয়ে রাখে। অসুস্থ বাবা বাসায় আসলেই প্যাঁচাল শুরু করে দেন। তিনি বলেন, শেষ বয়সে কেন আমাকে এইরকম দেখতে হলো। মেয়েটার একটা উপায় হলো না। গীর্জায় বিয়ে না হওয়ায় প্রতারণার সুযোগ নিলো বদমাশটা। ওকে অভিশাপ দেই। হারামজাদাটা যেরকম আমার পরিবারে অশান্তি লাগিয়েছে, সেও সারা জীবন অশান্তির আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলবে!... হায় খোদা, আমার মরণ দাও তাড়াতাড়ি...। এই মিনতির মা, মিনতির মা...। মিনতি যখন অফিস থেকে বাড়িতে আসে বাবার এই সব কথা টেপ রেকর্ডারের মত বাজতে থাকে । তাই সে অফিস থেকে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় যেন বাবার কথা কান পর্যন্ত না আসে। কিন্তু কোন এক ফাঁক দিয়ে ঠিকই তার কানে বাবার কষ্টের কথা পৌঁছে যায়। বিড় বিড় করে সে অফিসের পোশাক পাল্টায় আর বলে, এই বুইড়্যা যে কবে মরবে সেদিন শান্তি! কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার নিজেকে গালি দেয়। আজ তার পরিবারের এই অবস্থা শুধু তার নিজের আবেগীয় ভুলের কারণে! বয়সের ভুলের কারণে!!

সুদীপের সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো দীর্ঘ পাঁচ বছর। সুদীপ নিয়মিত মিনতিদের বাড়িতে যাওয়া আসা করতো। সবাই তাকে ভালো ছেলে হিসেবেই গ্রহণ করেছিলো। তাদের বাড়িতে তাকে জামাই আদর করা হতো। কিন্তু ঠিক উল্টো সুদীপদের বাড়িতে। মিনতি সেখানে গেলে কোন কথাই বলতো না কেউ। তাই মিনতি পারতপক্ষে সে বাড়িতে যেতো না। মাত্র এক বছর পরেই মাস্টর্সে পড়ুয়া সুদীপ মিনতিকে বিয়ে করবে সে অনুসারে পরিকল্পনা করে এগুচ্ছে। কিন্তু তার মা কোন ভাবেই মিনতির সাথে ছেলের বিয়ে দিতে রাজি নন। তিনি ছেলেকে বলে দিয়েছেন, প্রেম করেছিস ভালো, এখন সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে কর!

হ্যাঁ, মিনতি গায়ের রং একটু কালো। তবে তার উচ্চতা, দেহের গঠন আকর্ষণীয়। কলেজে পড়ার সময় অপূর্ব নামে এক মুসলিম ছেলে তাকে খুব পছন্দ করতো। সে তাকে ‘ব্লাক ডায়মন্ড’ বলতো। বলেছিলো, তুমি রাজি হলে আমি তোমাকে বিয়ের জন্য আমার বাড়ি থেকে প্রস্তাব পাঠাবো। আমাদের মিশ্র বিবাহ হবে। তখন মিনতির মন পড়ে আছে সুদীপের কাছে। অপূর্বর কথা শুনে সুদীপ মিনতিকে বলেছিলো, আমি তোমাকে কোন ভাবেই হারাতে চাই না। যত প্রতিকুলতাই আসুক, তোমাকে আমার চাই। তোমার জন্য প্রাণপণ লড়বো। যুদ্ধ করবো।

 http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011December/jishu 220111210162511.jpgতার মা রাজি না হওয়াতে শেষ পর্যন্ত কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে সুদীপ আর মিনতি। বিয়ে করে তারা ওঠে সুদীপের বাড়িতে। সেখানে অপমান করে তাড়িয়ে দেয় সুদীপের বাবা-মা।

তখন কলেজ পড়ার পাশাপাশি মিনতি কেবল মাত্র এনজিওতে চাকরি শুরু করেছে। এদিকে বড়লোক বাবার ছেলে সুদীপ বেকার। তার এখনো পড়াশোনা শেষ হতে প্রায় এক বছর বাকি। তাদের বাড়িতে তো জায়গা দেয়নি। যাওয়ার  কোন জায়গাও নেই। মিনতির মাথায় বুদ্ধি আসে। স্বামীকে বলে, চল আমরা নতুন সংসার পাতি। তার কিছু জমানো টাকা ছিলো। তা দিয়ে তারা দিনাজপুর শহরে একটি বাসা ভাড়া নেয়। চালিয়ে যেতে থাকে তার এনজিওতে চাকরি।

এদিকে মিনতির অসুস্থ বাবা মেয়ের বিয়ের খবর পেয়ে যেন আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার এত আশা ছিলো বড় মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করবে, তার অভাব ঘুচাবে, কিন্তু তার সেই আশার গুরে বালি!

এদিকে কোর্টে বিয়ে করাটা দেশের ক্যাথলিক মণ্ডলী সমর্থন করে না। অনিয়ম করে বিয়ে করাটা গীর্জার পরিচালনা পরিষদ প্যারিস কাউন্সিল পর্যন্ত বিষয়টা গড়ালো। সেখান থেকে মিনতির বাবাকে বলা হলো তোমার মেয়েকে আবার গীর্জাতে বিয়ে দিতে হবে, তবে এই বিয়ে বৈধতা পাবে। মিনতি রাজী গীর্জায় ফাদারের আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করাতে।

মিনতি শ্বশুর বাড়িতে না গেলেও বাবার বাড়িতে যেতো। একদিন তারা বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তখনই হঠাৎ খবর পায় সুদীপের মা খুব অসুস্থ। সেই খবর পেয়ে সুদীপ একা তার মাকে দেখতে যায়। গিয়ে সেখান থেকে আর ফিরে আসে না।

এরপর থেকে শুরু হয় মিনতির সমাজের মানুষের কাছ থেকে অপমান, লাঞ্চনা আর বঞ্চনা পাওয়ার জীবন। একমাত্র ছেলে হওয়ায় সুদীপ মায়ের প্রচণ্ড আদরের। অসুখের নাম করে ছেলেকে কাছে ডেকে তাকে আর তার স্ত্রীর কাছে যেতে দেয় না সুদীপের বাড়ির লোকজন। ইতিমধ্যে যেখানে তাদের বিয়ে পড়ানো হয়েছিলো সেখান থেকে ঘুষ দিয়ে কাগজপত্র সব গায়েব করা হলো। বিয়ের কাগজপত্র মিনতির কাছেও নেই। মিনতি এবং তার মা কত বার গিয়ে অপমান হয়ে ফিরে এসেছে সুদীপদের বাড়ি থেকে। কয়েকবার বিচার-শালিস পর্যন্ত বসেছে। সুদীপরা ধনবান হওয়ায় এবং সমাজে কয়েকজন প্রভাবশালী লোকজন তাদের পক্ষে থাকায় কোথাও সুদীপকে আটকে রাখা যায় না। সুদীপ বাড়িতে গিয়ে তার মার কথানুসারে চলতে শুরু করে। তার মা বলে দিয়েছে, যদি তুই ঐ মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা দিতে চাস, তাহলে তোকে ত্যাজ্যপুত্র করা হবে, শেষে আমার মরা মুখ দেখবি।

এরপর থেকেই সুদীপ মার কথানুসারে চলতে লাগলো। সে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা যেখানে মিনতি অভিযোগ করতে পারে সেখানে টাকা দিয়ে আগেই তাদের মুখ বন্ধ করে রাখে। মিনতি নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ে গেছে অভিযোগ নিয়ে। কোন লাভ হয়নি। প্রশাসন, বিবেকবান মানুষ সব যেন অমানুষ হয়ে গেছে। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা মিনতি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। বলেছে, আমার স্বামীকে আমার শাশুড়ির কাছ থেকে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।

 

এলাকায় দফায় দফায় শালিস বসলো। সেখানে সুদীপ বললো সে মিনতিকে বিয়ে করেনি। তার কোন প্রমাণ নাই। সেদিনকার আগে মিনতি ভেবেছিলো তার স্বামী তারই আছে, কিন্তু সেদিন শত মানুষের মজলিশে সুদীপের ওই কথা শোনার পর সে নিথর হয়ে গিয়েছিলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার পক্ষে তার মামা-কাকারা কথা বলেছেন। কিন্তু কোন লাভই হলো না। মিনতি ভাবে, এই পৃথিবীতে সহজ সরল হয়ে বাস করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। সে যদি বিয়ের কাগজপত্রগুলো তার সাথে রাখতো বা সেগুলো ফটোকপি করে নিজের কাছে রাখতো তবে আজ তার এই অবস্থা হতো না।

এর দুই বছর পর সেই সুদীপ বিয়ে করে এখন প্রবাসে আছে।

এক বিকেলে স্কুলের টিচার হিমেলের মাকে ডেকে পাঠালেন। একা এক রুমে নিয়ে বললেন, আপনার ছেলের নাম সবাই যীশু বলে ডাকে কেন? নিরীহ মিনতি তার অতীতের কথা বলে। মিনতির কথা শুনে জড়িয়ে ধরেন টিচার স্নিগ্ধা কোড়াইয়া। বলেন, আমি সত্যি খুবই দুঃখিত।

 বাইরে ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। যীশু দাঁড়িয়ে আছে। মিনতি জানে তাকে এবং তার ছেলেকে যীশু খ্রীস্টের মতই কালভেরি পর্বতের মত এক কঠিন অমসৃন পথ পাড়ি দিতে হবে। মিনতি ছেলের হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। যেন যীশুর কাল ভেরীর পথে যাত্রা।

বাংলাদেশ সময় ১৪২০, ডিসেম্বর ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।