ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব--১৩]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব--১৩]

ব্যানকো [পর্ব--১২], [র্পব--১১],[র্পব--১০], [পর্ব--৯], [পর্ব--৮], [পর্ব-৭], [পর্ব-৬], [পর্ব-৫], [পর্ব-৪], [পর্ব-৩], [পর্ব-২], [পর্ব-১]

বিগ লিয়ন নিঃশব্দে আমার কথাগুলো শুনলো, মনোযোগের সঙ্গে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে। আর তেমন কথাবার্তা না বলে আমরা শেষ একপাত্র ড্রিঙ্কস সারলাম।

ও উঠে দাঁড়ালো, পরদিন পেড্রো দা চিলিয়ান ও তার সঙ্গে লাঞ্চের আমন্ত্রণ ও স্থান-সময় জানিয়ে চলে গেল।

গাছঘেরা একটি ছিমছাম শান্ত রেস্তোরাঁয় আমরা মিলিত হলাম।
‘তুমি আমাকে যা বলেছিলে তা নিয়ে আমি ভেবেছি, প্যাপি। আর তাই, তোমাকে বলছি আমরা ক্যারাকাসে কেন এসেছি। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011December/ban20111203172736.jpgতারা আসলে দক্ষিণ আমেরিকার আরেকটি দেশে যাচ্ছিল ভেনেজুয়েলা হয়ে। সেখানে তারা একটি বন্ধকী দোকানের ওপর হাত সাফাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের তদন্তে এবং দোকানটির একজন কর্মচারীর দেওয়া তথ্যমতে সেখানে তাদের প্রত্যেককে বিশাল বিত্তশালী করে দেওয়ার মত অলঙ্কারাদি রয়েছে। কষ্ট একটাই, ওগুলো সরিয়ে নিয়ে ডলারে রূপান্তরিত করা। এই কারণেই তারা ক্যারোত্তেকে খুঁজছিল। তারা ক্যারোত্তে এবং তার বিমানের সূত্রে পার্টনার বানাতে চাইছিল। কিন্তু এখন আর সে নিয়ে ভাবার আর কোনও রাস্তা নেই যেহেতু বিমানটাই নেই।

‘তুমি আমাদের সঙ্গে ভিরে যেতে পারো, প্যাপি। ’ বক্তব্য শেষ করলো লিয়ন।
আমার পাসপোর্ট নেই। এছাড়া সঞ্চিত টাকাও তেমন নেই। ’
‘পাসপোর্টের ব্যাপারটা আমরা দেখবো। ঠিক বলিনি পেড্রো?’
‘ধর তুমি এরই মধ্যে পাসপোর্ট পেয়ে গেছ। ’ পেড্রো বললো। ‘ভুয়া নামে। এর ফলে আইনানুযায়ী  না তুমি ভেনেজুয়েলার বাইরে যাচ্ছো, না এখানে ফিরে আসছো। ’
এতে কত পড়বে, আনুমানিক?’
‘প্রায় হাজার ডলার। এত টাকা আছে তোমার কাছে?’
হ্যাঁ।
‘ঠিক আছে তাহলে। ’
পনেরো দিন পরে আমি এখন দক্ষিণ আমেরিকান অপর একটি দেশের রাজধানী শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে, কাজ সারার পরদিন ভাড়া করা একটি গাড়ি নিয়ে, একটি বিস্কিটের টিনে আমার ভাগের অলংকারগুলো নিয়ে তা মাটির তলায় কোথাও পুঁতে ফেলার ধান্ধায় ব্যস্ত আছি।

সযত্ন পরিকল্পিত অভিযানটা নির্ঝঞ্জাটই ছিল। আমরা বন্ধকী দোকানটির পাশের একটি টাইয়ের দোকান দিয়ে সেখানে প্রবেশ করি। দোকানটির তালা পর্যবেক্ষণ এবং দেওয়ালের ঠিক কোথায় গর্তটা করতে হবে তা নির্ণয়ের জন্য আগে বেশ কয়েকবার পাশের টাইয়ের দোকানটিতে লিয়ন আর পেড্রো ঢুঁ মেরে গেছে, টাই কেনার ছুঁতোয়। দোকানে কোনো সিন্দুক ছিল না, শুধুমাত্র কাপবোর্ড দিয়ে ঘেরা। আমরা ভেতরে ঢুকি শনিবার রাত দশটায় আর বের হয়ে আসি রোববার রাত এগারোটায়।
 
একটা ছিমছাম নিষ্কণ্টক কাজ ছিল এটা। সেই সূত্রে এখন আমি শহর থেকে বারো মাইল দূরে, একটা বিশাল গাছের নিচে আমার টিনটা পুঁতে রাখলাম। আমি নিশ্চিত, এরপর সহজেই আমি জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারবো। কারণ ছোরা দিয়ে তৈরি চিহ্নটি ছাড়াও গাছটি সহজেই চিহ্নিত করা যায়। ঠিক ব্রিজটার পর থেকেই জঙ্গলের সীমানা শুরু, এবং বনের প্রথম গাছটিই আমার, রাস্তার ডান পার্শ্বে।

ওইদিন সন্ধ্যায় আমরা একটি অভিজাত রোস্তোরাঁয় মিলিত হলাম। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করলাম এবং এমন ভান করলাম যেন ঘটনাচক্রে সবার দেখা হয়ে গেছে বারে এবং সেখানে আমরা ঠিক করি যে একত্রে ডিনার করবো। প্রত্যেকেই যার যার হিস্যা লুকিয়ে ফেলেছে নিজের মত করে, লিওন তার এক বন্ধুর কাছে আর পেড্রো আমার মতই জঙ্গলে।
      
‘নিজ নিজ ভাগ লুকানোর জন্যে প্রত্যেকের আলদা আলাদা গুপ্ত জায়গা থাকা অধিকতর নিরাপদ’ লিওন বলেছিল। ‘এতে করে আমাদের কেউই অন্যর সম্পর্কে জানতে পারবে না, তারা বলতে পারবে না অন্যরা তাদের সম্পদ নিয়ে কি করেছে? দক্ষিণ আমেরিকান অপরাধীদের এটা একটা সনাতন পূর্ব সতর্কতা পন্থা। কারণ কোন ঠোলা (পুলিশ) যদি তোমাকে ধরে ফেলে,তাহলে তোমার ওপর যে দলাইমলাই চালাবে তা মোটেই মজাদার কিছু নয়। এ অবস্থায় যদি অপরাগতায় কেউ মুখ খুলেও ফেলে, সেক্ষেত্রে, সে  শুধু তার নিজের সঙ্গেই ‘জুডাসি’ (মীর জাফরী) করতে পারবে। তাই এ ব্যাপারে আর কোনও দ্বিমত থাকলো না।

‘প্যাপি, তুমি কি ভাগাভাগি নিয়ে সন্তুষ্ট?’
আমি মনে করি প্রতিটি জিনিস সম্পর্কেই আমাদের আনুমানিক মূল্য নির্ধারণ এক্কবারে সঠিক হয়েছে। সব কিছুই চমৎকার, এর বিরুদ্ধে বলার মত আমার একটি শব্দও নেই।
সুতরাং সব কিছুই সন্তোষজনক ছিল এবং সবাই সন্তুষ্ট।
হ্যান্ডস আপ!
‘কেন? সমস্যাটা কী?’ লিওন চেঁচিয়ে উঠলো। ‘মাথা খরাপ হয়নি তো তোমার?’
অন্য কিছু বোঝার ফুরসৎ মিললো না; চোখের পলক ফেলার আগেই আমরা বন্দী হলাম, হাতকড়া পড়ানো হলো এবং সোজা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হলো। আমরা  অর্ডার দেওয়া অয়েস্টারটাও খেয়ে শেষ করতে পারলাম না।

এই দেশটিতে পুলিশ অপরাধীদের সঙ্গে মোটেই হালকা আচরণে অভ্যস্ত নয়। ব্যাপারটা সারা রাত ধরে চললো। নিদেন পক্ষে আট ঘণ্টা। প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘তোমরা টাই পছন্দ কর নাকি?’
‘নিপাত হও এখান থেকে আর পারলে নিজের পাছা মারতে থাকো!’ আমাদের জবাব ছিল এটা।

এবং ঘটনা এভাবেই চলতে থাকলো। সকাল পাঁচটার মধ্যেই আমরা পুরোপুরি থ্যাতলানো গোশতের কিমায় পরিণত হলাম। আমাদের কাছ থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে জংলী শুয়োরগুলো চরম হিংস্র হয়ে উঠলো, ক্রোধে ওরা কাঁপছিল, মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে। ‘ঠিক আছে! যেহেতু সবাই তোমরা ঘেমে গেছো আর গায়ের তাপমাত্রাও খুব বেড়ে গেছে, এবার তোমাদের ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করবো আমরা। ’

অসহনীয় যাতনা স্বীকার করে কোনোমতে দাঁড়ালাম আমরা। তারা আমাদের কালো একটি মারিয়ায় (গাড়িতে) ভরে নিয়ে পনেরো মিনিট পর বিশাল এক বিল্ডিংয়ের সামনে এনে হাজির করলো। শূকর শাবকগুলো ভেতরে যাওয়ার পর দেখা গেল দলে দলে শ্রমিক বের হয়ে আসছে, নিশ্চয়ই ঠোলারা তাদের বের করে দিয়েছে। এরপর আমাদের প্রত্যেককে দু’জন করে পুলিশ টেনে ছেঁচড়ে ভেতরে নিয়ে গেল।

বিশাল বিস্তৃত এক করিডোর। ডানে বায়ে সারি সারি স্টিলের দরোজা, প্রত্যেকটা দারোজায় ঘড়ির কাঁটার মত দেখতে যন্ত্র বাসানো। ঘড়িগুলোর কাঁটা মাত্র একটি করে। অর্থাৎ এগুলো থার্মোমিটার। সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে ফেললাম আমরা বিশাল এক কসাইখানার ডিপ-ফ্রিজারের করিডোরে হাজির হয়েছি। এক কোনায় অনেকগুলো টেবিল, আমরা তার সামনে এসে থামলাম। ‘যাহোক এখন,’ পুলিশ প্রধান শুরু করলো, ‘আমি তোমাদেরকে শেষ একটা সুযোগ দেব ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার জন্য। এগুলো মাংস রাখার ডিপ-ফ্রিজার। তোমরা বুঝতে পারছো এর মাজেজা কি? সুতরাং শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি, তোমরা গহনা আর অন্যান্য জিনিসগুলো কোথায় লুকিয়েছো?’
 
‘আমরা কোনো অলংকার বা কোনো টাই সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ কিছুই জানি না,’ লিওন বললো।
‘ঠিক আছে আইনজীবী মহাশয়! তুমিই প্রথমে যাও তাহলে। ’
পুলিশ তালা খুলে একটি দরোজা পুরোপুরি খুলে ফেললো। এক ধরনের তুষারময় শীতল কুয়াশা নেমে এসে করিডোর ছেয়ে ফেললো। জুতো মোজা খুলে ওরা লিওনকে ভেতরে ঠেলে দিল।
‘তাড়াতাড়ি বন্ধ করো দরোজা,’ কর্তা বললেন, ‘নাহলে আমরা শুদ্ধ জমে যাবো। ’
‘এবার চিলিয়ান। তুমি কি মুখ খুলছো, হ্যাঁ অথবা না?’
‘আমার বলার মত কিছুই নেই। ’
অন্য আরেকটা দরোজা খুলে তাতে চিলিয়ানকে ঢুকিয়ে দেয়া হলো।
‘তুমি সবচে তরুণ, ইতালিয়ান (পাসপোর্টে আমার পরিচয় ইতালিয়)। এই থার্মোমিটারগুলোয় ভালোমত নজর বুলিয়ে নাও। কাঁটা মাইনাস ফোর্টিতে ছুঁয়ে আছে। এর মানে হচ্ছে যদি তুমি কথা না বলো আর আমরা তোমাকে ঘর্মাক্ত অবস্থায় এর ভেতরে ঢুকিয়ে দেই, এই ধরনের ধোলাই হজম করার পর, নির্ঘাৎ তুমি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবে এবং আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে মারা যাবে। আমি তোমাকে সর্বশেষ একটি সুযোগ দিচ্ছি, দেখ-- তোমরা কি টাইয়ের দোকানের ভেতর দিয়ে গিয়ে বন্ধকী দোকান লুট করনি? হ্যাঁ অথবা না?’
‘ওই লোকগুলোর সঙ্গে আমার কোনো রিস্তাদারি নেই। শুধু তাদের একজনকে আমি চিনতাম অনেক আগে, আর তাদের সঙ্গে স্রেফ আকষ্মিকভাবে আমার দেখা হয় রেস্টুরেন্টে। বারম্যান আর ওয়েটারদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখ। আমি জানি না এই কাজের সঙ্গে আমার কোনো সংস্রব আছে কি না। কিন্তু এটা নির্ভেজাল সত্য যে আমি এ কাজ করিনি। ’
‘তথাস্তু, ম্যাকারোনি। ‘তাহলে তুমিও বলিতে চড়। এই বয়সেই তোমাকে মরতে হচ্ছে দেখে আমি দুঃখিত। কিন্তু এটা তোমার গোনাহগারি। তুমি নিজেই একে ডেকে নিলে। ’

দরোজা খোলা হলো। আমাকে অন্ধকারেই ছুঁড়ে দিল ওরা ফ্রিজারে। ভেতরে ঝোলানো লোহার মত শক্ত হয়ে থাকা গরুর মাংসে আঘাত খেলাম সজোরে, এরপর মেঝেতে চিৎপটাং হয়ে পড়লাম। মেঝেটা বরফ আর তুষারে ঢাকা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম ভয়ংকর কঠিন এক শীতলতা আমার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে।  সূঁচালো ফলার মত ঠাণ্ডা মাংশ ভেদ করে হাড়ে গিয়ে খোঁচা মারছে। অমানবিক এক প্রচেষ্টার পর আমি হাঁটুর ওপর খাড়া হতে পারলাম কোনোমতে, এরপর ঝুলানো গরুর মাংশের একপাশে সেঁটে হাচড়ে-পাচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। যে ধোলাই তারা আমাদেরকে দিয়েছে তাতে করে বিরামহীন ব্যথায় প্রতি মুহূর্তে শরীর জর্জরিত হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি দুই বাহু দ্রুত ঝাঁকাতে শুরু করলাম এবং গলা, গণ্ডদেশ, নাক আর চোখ মালিশ করতে লাগলাম। বোগলে হাত দুটো ঢুকিয়ে ওগুলো গরম রাখার চেষ্ট চালালাম। গায়ে কাপড় বলতে ছিল শুধুমাত্র আমার প্যান্ট আর একটা ছেঁড়া শার্ট। ওরা আমার জুতো-মোজাও খুলে নিয়েছে। এতে করে পায়ের তালু বরফাচ্ছাদিত মেঝের সংস্পর্শে এসে ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছে। অনুভব করতে লাগলাম যে পায়ের পাতা জমে যেতে শুরু করেছে।

নিজেকে বললাম, ‘দশ মিনিটের বেশি এই অত্যাচার চলতেই পারে না--- সর্বোচ্চ পোয়া ঘণ্টা। এর অন্যথা হলে আমিও ঝুলিয়ে রাখা গরুর মাংশে পরিণত হবো। হিমায়িত মাংশের একখান দলা। না, না, এ অসম্ভব! তারা আমাদের সঙ্গে এতটা করতে পারে না! নিশ্চিতভাবে তারা আমাদেরকে জ্যান্ত জমিয়ে ফেলতে পারে না। সহ্য কর, প্যাপি। আর মাত্র ক’মিনিট এবং এরপর দরজা খুলে যাবে। ওই কনকনে ঠাণ্ডা করিডোরও তোমার কাছে তখন গনগনে চুল্লির মত উষ্ণ মনে হবে। ’

আমার দুই বাহু আর কাজ করছিল না, কোনো মতেই আর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারছিলাম না, আর না পারছিলাম আঙ্গুলগুলো ন‍াড়াতে। পা দুটো বরফে সেঁটে যাচ্ছিল অথচ ওগুলোকে ন‍াড়াচাড়ার কোনও ক্ষমতাই ছিল না। বুঝতে  পারছি অবচেতনে বিলীন হতে যাচ্ছি, ক্ষণিকের জন্য মানসপটে বাবার চেহারাটা দেখতে পেলাম। এরপর সেখানে ভেসে উঠলো প্রসিকিউটরদের চেহারা। কিন্তু ছবিগুলো স্পষ্ট নয়। কারণ এগুলোকে ঢেকে দিচ্ছিল আবার পুলিশের চেহারা। একই ফ্রেমে তিনটি চেহারা। ‘কি অদ্ভূত,’ ভাবলাম। ‘ওদের সবার চেহারাই (পুলিশ আর আইনজীবী) এক, এবং ওরা হাসছে কারণ জিতে গেছে তারা। ’ এরপর চেতনা হারালাম।

কী ঘটছিলো? কোথায় ছিলাম আমি? চোখ খুলে দেখি আমার ওপর ঝুঁকে আছে একটি চেহারা, ভদ্রস্থ একখান মুখ। কথা বলতে পারছিলাম না, কারণ পুরো মুখোমণ্ডল তখনো ঠাণ্ডায় জমে ছিল। কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতরে নিজকে প্রশ্ন করলাম ‘এখানে আমি করছিলামটা কী, টেবিলে সটান শুয়ে থেকে?’

বিশাল, শক্তসমর্থ, দক্ষ দুটো হাত আমার সারা শরীর মালিশ করে দিচ্ছিল এবং ধীরে ধীরে আমি উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলাম। স্পর্শানুভূতি ফিরে আসছে। দু’তিন গজ দূর থেকে পুলিশ প্রধান অবলোকন করছিলো। তাকে রাগত এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। বেশ কয়েকবার তারা আমার মুখ খুলে সেখানে ফোঁটায় ফোঁটায় স্পিরিট ঢাললো। এক পর্যায়ে বেশিমাত্রায় ঢেলে ফেলায় শ্বাসনালী ফেঁসে গেল, আমি হাঁসফাঁস করে উঠলাম এবং সবটুকু স্পিরিট উগরে দিলাম।
‘কাজ হয়েছে’ মালিশওয়ালা বললো, ‘বেঁচে গেছে। ’

তারা আমাকে কমপক্ষে আরো ঘণ্টা আধেক দলাই-মলাই চালিয়ে গেল। অনুভব করলাম ইচ্ছা করলে এখন কথা বলতে পারি। কিন্তু মুখ বন্ধ করে থাকাটাই পছন্দ করলাম।   খেয়াল হলো আমার ডান পাশে অপর একটি টেবিলে শোয়ানো আছে আরেকটি শরীর। সেও নগ্ন, এবং তাকেও দলাই-মলাই করা হচ্ছে। কে এটা? বিগ লিয়ন না চিলিয়ান? আমরা তিন জন ছিলাম, কিন্তু আমি আর পাশের টেবিলের জন নিয়ে তো দু’জন হয়! তৃতীয় জন কোথায়? অন্য টেবিলগুলো খালি।
মালিশওয়ালার সাহায্যে উঠে বসলাম কোনোমতে এবং দেখলাম অন্য লোকটা পেড্রো দ্য চিলিয়ান। তারা আমাদেরকে কাপড় পড়ালো এবং এর ওপর হিমাগারে যারা কাজ করে তাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্যাডওয়ালা ওভারঅল পড়ালো।
শূকর সর্দার পূনরায় আক্রমণে ফিরে এলো। ‘কথা বলতে পারবে, চিলিয়ান?’
‘হ্যাঁ। ’
‘অলংকারগুলো কোথায়?’
‘আমি কিছুই জানি না।
‘আর তোমার খবর কি, স্প্যাগেটি?’
‘এদের সঙ্গে আমি ছিলাম না। ’
‘ওকে। ’
আমি টেবিল থেকে নামলাম। কোনোমতে শুধু দাঁড়াতে পারছিলাম। কিন্তু একবার সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পায়ের তলায় স্বাস্থ্যকর একটা জ্বলুনি অনুভব করলাম, এবং অনুভব করলাম দেহে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, সমগ্র দেহে এমন তেজে রক্ত দৌঁড়াচ্ছে যে দূরতম শিরা-উপশিরায় রক্ত আন্দোলিত হচ্ছে।

ভাবলাম, একদিনের জন্য আতংকের সম্ভবপর সর্বোচ্চ শিখর ছোঁয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ধারণা ভুল ছিল আমার, সম্পূর্ণ ভুল।
পেড্রো আর আমাকে ওরা পাশাপাশি দাঁড় করালো, এবং পুলিশ প্রধান যে এখন তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, হাঁক ছাড়লো, ‘এদের ওভারঅল খুলে নাও। ’
কোমড় পর্যন্ত উম্মুক্ত হয়ে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডায় আবার কাঁপতে শুরু করলাম।
‘তাহলে এবার এই জিনিসটার দিকে ভালো করে একটু তাকাও, বন্ধুরা। ’
একটা টেবিলের তলা থেকে ওরা শক্তমত একটা কাঠামো টেনে বের করে আমাদের সামনে ধরে দাঁড় করালো। জিনিসটা জমে যাওয়া একটা মৃতদেহ। কাঠের তক্তার মত টান টান হয়ে আছে, চোখদুটো বিস্ফারিত এবং স্থির, মনে হচ্ছে দুটো মার্বেল: মৃতদেহটা দেখলে আতংকে গা শিউড়ে ওঠে, ভয়ানক! বিগ লিওন! তারা তাকে জ্যান্ত অবস্থায় বরফ বানিয়ে ফেলেছে!

‘ভালোমত দেখ, দোস্তরা, ’ প্রধান আমাকে বললো। তোমাদের সঙ্গী এখন আর কথা বলতে পারবে না। যাক ভালই হলো, আমরা সবগুলো পন্থায় ওর ওপর চেষ্টা চালিয়েছি। এবার তোমাদের পালা, যদি তোমরাও তার মতই একগুঁয়ে অপরিণামদর্শী হয়ে থাকো। আমাকে নির্দয় হবার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ তোমাদের এই কীর্তিটা খুবই বেশি রকমের স্পর্শকাতর, বন্ধকী দোকানটা সরকার পরিচালিত। আর ওদিকে বিশ্রী এক গুজব ছড়িয়েছে--- লোকজন মনে করছে যে এটা একটা পূর্ব পরিকল্পিত পাতানো খেলা যার আয়োজক হচ্ছেন কিছু সরকারি কর্মকর্তা। সুতরাং হয় তোমরা মুখ খোলো নইলে আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমাদের অবস্থা দোস্তের মতই হয়ে যাবে। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011December/vectorians_floral_ornaments20111203172757.jpgআমার ভেতরকার চিরন্তন রসবোধ এখনো ফিরে আসেনি। আর এই দৃশ্যটা আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিলো যে দীর্ঘতর তিনটি সেকেন্ড আমি মুখ খোলার ব্যাকুলতা অনুভব করলাম। একটা চিন্তাই আমাকে এই কাজ থেকে প্রতিহত করলো যে আমি জানি না অন্যদের জিনিস লুকানোর জায়গাগুলো কোথায়। তারা আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করবে না এবং এর ফলে আমার অবস্থা এযাবত কালের জঘন্যতম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।

হঠাৎই আমি চূড়ান্ত বিষ্ময়াভিভূত হয়ে খুবই কাঙ্খিতে এক কণ্ঠস্বর উপভোগ করলাম, পেড্রোর গলা, বলছে, ‘রাখো ওসব এবার; এভাবে তুমি আর আমাদেরকে ভয় ধরাতে পারো না। কেন? যেহেতু এটা ছিল অবশ্যই একটা দুর্ঘটনা। তোমরা কখনোই চাওনি তাকে জমিয়ে ফেলতে, এটা ছিল হিসাবের ভুল, এর বাইরে অন্য কিছু নয়। কিন্তু আমাদের নিয়ে একই ভুল আর করতে যাচ্ছো না। একজনের মৃত্যু নিয়ে তোমরা পার পেয়ে যেতে পারো, কিন্তু তিনজন? তিন-তিনজন বিদেশিকে বরফের টুকরোয় পরিণত করে ফেলা, এটা বিরাট ব্যাপার এবং আমি মনে করছি না যে তুমি দু’টি আলাদা অ্যামব্যাসিতে এসবের ব্যাখ্য দিতে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়তে চাইছো। একজন চলে। তিনজন, এটা খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।


পেড্রোর ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর প্রশংসা না করে পারলাম না। খুবই শান্তভাবে দাঁতালো জানোয়ারটা চিলিয়ানের দিকে তাকালো, মুখে রা নেই। এরপর অল্প বিরতি দিয়ে, ‘তুমি একজন দাগী অপরাধী, এবং এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাকে একথাও স্বীকার করতে হবে যে তোমার ষ্পর্ধা আছে। ’ অন্যদের দিকে ঘুরে বললো, এদের উভয়ের জন্য একটা করে শার্টের ব্যবস্থা করে গারদে নিয়ে যাও, বিচারকই এদের ব্যবস্থা করবেন। এই ধরনের কঠিন বান্দাদের সঙ্গে এসব চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই--- এটা সময়ের অপচয় মাত্র। ’ সে পেছন ফিরে দাঁড়ালো এবং গট গট করে হেঁটে বেরে হয়ে গেল।

একমাস পর তারা আমাকে ছেড়ে দিল। টাইয়ের দোকানদার স্বীকার করেছে তার দোকানে আমার পদধূলি পড়েনি কখনো। ঘটনা সত্য। বারম্যান স্বীকার করেছে আমি তার ওখানে দুই পাত্র হুইস্কি পান করেছি সেই টেবিলে বসে যেটা আমি আমার জন্য বুক করেছিলাম সেখানে ওই দু’জন উপস্থিত হবার আগেই। এবং আমাদের তিনজনকেই ওই সময় খুবই আশ্চর্যাম্বিত দেখায়- এই শহরে আকষ্মিকভাবে দেখা হয়ে যাওয়ার সূত্রে।

এতদসত্ত্বেও তারা আমাকে পাঁচ দিনের মধ্যে এই শহর ত্যাগের আদেশ দিল। কারণ, তারা ভয় পেয়েছিল যে লিওনের তথাকথিত দেশিভাই (আমার মত লিওনেরও ইতালিয়ান পাসপোর্ট ছিল) হিসেবে আমি ইতালিয়ান কনস্যুলেটে গিয়ে এই হত্যা সম্পর্কিত কাহিনী বয়ান করে দিতে পারি।


ওই সময়ে আমাদেরকে একজন লোকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যাকে আমি চিনতাম না কিন্তু পেড্রো চিনতো, বন্ধকী দোকানের কর্মচারী- যে তাকে এই কর্মে জড়ায়। যেদিন সন্ধ্যায় আমরা মালের ভাগাভাগি করি সেদিন এই শালার বেজন্মাটা নাইটক্লাবের একটি মেয়েকে তার ভাগে পাওয়া অলংকারের অংশ থেকে একটি দুর্লভ অ্যান্টিক আংটি উপহার দেয়। এবং পুলিশের নজরে সেটি আসার পর তাকে কথা বলাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি তাদের। এ কারণে বিগ লিওন আর পেড্রোকে এত সহজে শনাক্ত করা গিয়েছিল। পেড্রো দ্যা চিলিয়ান এই পাকচক্রে কড়ামত ফেঁসে সেখানেই রয়ে যায় শেষ পর্যন্ত।

আমার পকেটের পাঁচ শ’ ডলারে বিমান ধরলাম। আমি কোনোভাবেই আমার মাল লুকানোর জায়গার কাছাকাছি হইনি, ব্যাপারটা খুবই বিপজ্জনক হতো। ওই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত হওয়ার পর আমি হিসাব মেলালাম, পত্রিকাগুলোর দেওয়া তথ্যমতে লুণ্ঠিত মালামালের আর্থিক মূল্য দুই লাখ ডলার। যদি তারা ফাঁপিয়ে এটাকে দ্বিগুণও বলে থাকে, তারপরেও এর পরিমাণ হয় এক লাখ ডলার। অর্থাৎ আমার গর্তে মজুদ আছে প্রায় তিরিশ হাজার ডলার। যেহেতু অলংকারগুলোর মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়েছে এসব বন্ধক রাখার বিপরীতে দেওয়া ধারের টাকার পরিমাণের ভিত্তিতে, তার মানে এগুলোর সত্যিকারের মূল্যের চেয়ে অর্ধেক ধরা হয়েছিল, এবং যদি আমি কোনো দালাল না ধরে সরাসরি এগুলো বিক্রি করি তাহলে ষাট হাজার ডলারেরও বেশি পাবো। অর্থাৎ আমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এখন আমার মুঠোয়। এই টাকা পবিত্র, এটা একটা পূণ্য কাজের জন্য সংরক্ষিত এবং যে কোনও রকমের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবেলায়ও আমি এতে হাত দেবো কোনোক্রমেই।

বন্ধু লিওনের মর্মান্তিক মৃত্যু সত্ত্বেও, এই কাজটি আমার জন্য ছিল এক স্বর্ণোজ্জ্বল বিজয়। অন্যদিকে আমার নৈতিক দায়িত্ব বর্তেছিল চিলিয়ান পেড্রোকে সাহায্য-সহযোগিতা করার। তবে মাস কয়েকের মধ্যেই সে কোনো বিশ্বস্ত বন্ধুকে পাঠিয়ে তার গুপ্তধন উদ্ধার করে উকিলের বিল পরিশোধ আর গারদমুক্ত হওয়ার কোনো ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে নিশ্চয়।

যাহোক, আমাদের চুক্তিটাই ছিল এরকম--- প্রত্যেকের মাল লুকোনোর নিজস্ব গোপন জায়গা থাকবে যা অন্যেরা জানবে না। এর ফলে ধরা পড়লে কেউ অন্যের ভাগ্যের শিকার হবে না। আমি এ পন্থার পক্ষপাতি ছিলাম না, কিন্তু দক্ষিণ আমেরকান অপরাধ জগতের কাজ-কর্মের এটাই ছিল প্রচলিত পন্থা। কাজ হয়ে যাবার পর ‘প্রত্যেকে তার নিজের জন্য আর ঈশ্বর সবার জন্য!’
 
আর ঈশ্বর সবার জন্য... হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তিনিই আমাকে এ যাত্রায়  রক্ষা করেছেন। তাহলে বলতে হয় তিনি সদাশয়ের চেয়েও অধিক কিছু, তিনি করুণাময় মহানুভব।  তবে, এত কিছুর পরেও আমার প্রতিশোধ চরিতার্থ করার কর্তৃত্ব আমি তার হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।

তিনি চাননি আমি এ কাজে অগ্রসর হই, এ খবর আমার জানা আছে। এল ডোরাডোর ওই দিনটির কথা মনে পড়ছে, আমি মুক্ত হওয়ার আগের দিনটি। আমি চেয়েছিলাম ক্যাথলিকদের খোদাকে ধন্যবাদ জানাতে, এবং আবেগমথিত হয়ে আমি তাকে বলেও ছিলাম, ‘আমি যে আপনার সহায়তার জন্য আপনার প্রতি সর্বান্তকরণে কৃতজ্ঞ তা প্রমাণে আমি কী করে দেখাতে পারি? আমার কাছে মনে হয় আমি তার জবাব শুনতে পাচ্ছিলাম, ঠিক যেন একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পাই যে আমাকে বলছে, ‘ তোমার প্রতিশোধস্পৃহা ত্যাগ কর!’
 
উত্তরে আমি বলেছিলাম--- না; অন্য যে কোনও কিছুতে রাজি আছি, কিন্তু এটা নয়! সুতরাং, এ যাত্রায় আমাকে যিনি রক্ষা করেছেন তিনি ঈশ্বর হতে পারেন না। অসম্ভব! সৌভাগ্য আমার সহায় ছিল, স্রেফ তাই, শয়তানের সৌভাগ্য। ওপরওয়ালা সদাশয় প্রভুর এ ধরনের কদাকার বস্তুতে কোনও উৎসাহ থাকার কথা নয়।    
 

কিন্তু এর ফলাফল ভালমতই সংরক্ষিত আছে প্রাচীন এক বৃক্ষের পদমূলে। আমার মনের জন্য এটা একটা প্রচণ্ড শক্তির আধার, এটা নিশ্চিত হয়ে যে বিগত তেরটি বছর যাবৎ আমি যে প্রতিশোধ চরিতার্থ করার ব্যাপারে প্রবোধ দিয়ে এসেছি নিজেকে, তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এখন আমার আছে।


কীভাবে আমি একথা ভাবতে পারি! ওইসব বানচোত, যারা আমাকে দুর্ভাগ্যের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে, তারা পার পেয়ে যেতে পারে কোনও কারণে? আপাতত এই প্রেক্ষিতে আমার করণীয় কর্তব্য একটাই, আঘাত করার চূড়ান্ত ক্ষণের আগের অপেক্ষমান সময়টুকুতে, আমার ওই গুপ্ত সম্পদ উত্তোলনের আগ পর্যন্ত ভদ্রস্থভাবে দিন গুজরানের নিমিত্তে একটা কাজের সন্ধান করা।

উজ্জ্বল মনোমুগ্ধকর আকাশের বুক চিরে বিমান উড়ে যাচ্ছে, তুষার-শুভ্র মেঘের এক গালিচার ওপর দিয়ে পথ করে, এখানে সবকিছু পরিষ্কার নিষ্কলুষ। আমি ভাবতে লাগলাম আমার পরিজনদের কথা, আমার বাবা-মা, আমার পরিবার আর আলোর সরোবরে নাওয়া শৈশব। ওই শ্বেতশুভ্র পেঁজা পেঁজা মনোরম মেঘরাশির নিচে কালো ধূসর মেঘের দঙ্গলও আছে, আছে অপরিচ্ছন্ন বৃষ্টি, পার্থীব দুনিয়ার এক চমৎকার চিত্রকল্প। যে দুনিয়া সারাক্ষণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর লিপ্সায় বিভোর, যেখানে ‘তুমিই হচ্ছো অন্যদের চেয়ে সেরা’ এ কথা প্রমাণের জন্য তীব্র আকাঙ্খর লড়াই সর্বদা ক্রিয়াশীল। সেই শুষ্কং-কাষ্ঠং হৃদয়হীন প্রবৃত্তি পরিলক্ষিত হয় সে সমস্ত লোকের মধ্যে যারা কোনও আদম সন্তানকে ধ্বংস করে দিয়েও মনে কোনও পাপবোধে তাড়িত হয় না, শুধুমাত্র এজন্য যে এতে তাদের কিঞ্চিৎ স্বার্থ আদায় হলেই হল।



৮ম পরিচ্ছদ
বোমা

আবারো ক্যারাকাসে এলাম। এই সজীব সচল প্রাণবন্ত শহরের পথঘাটে আবারো হাঁটতে পেরে আপ্লুত হয়ে গেলাম।
মুক্ত হওয়ার পর কুঁড়িটি মাস চলে গেছে, আর এখনো আমি এই জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে উঠতে পারিনি। সবাই বিনা পয়সার পরামর্শ দেয় ‘এবার শুধু তোমার একটা চাকরি জোটালেই হলো’। ’

কিন্তু উপযুক্ত কোনো কাজ খুঁজে না পাওয়ার অক্ষমতা ছাড়াও আমার যে সমস্যা ছিল তা হলো স্প্যানিশ বলতে না পারা। অনেক দরোজাই আমার সামনে বন্ধ হয়ে গেছে স্রেফ এ কারণে। অন্যদের বলাটা পুরোপুরি বুঝতে পারলেও নিজে ভালোমত বলতে পারতাম না। শেষতক স্প্যানিশ ব্যাকরণের একটি বই নিয়ে দরোজা বন্ধ করে পড়ে রইলাম, মনে জেদ--- যে করেই হোক ভাষাটা রপ্ত করেই ছাড়বো! কিন্তু উচ্চারণের কায়দাটা কোনোমতেই আয়ত্ব করতে পারছিলাম না। নিজের ওপর অসহায় রাগ ক্রোধে রূপান্তরিত হলো। ক’দিন বাদেই ঘরের কোণে বইটি ছুঁড়ে ফেলে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। পথ থেকে পথে, ক্যাফে থেকে ক্যাফেতে এমন কাউকে খুঁজে ফিরলাম যে আমাকে কিছু একটা করার পথ বাতলে দিতে পারে।

তখন ইউরোপ থেকে যুদ্ধ আর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরবর্তী হানাহানি থেকে পরিত্রাণ পেতে ফরাসিরা পঙ্গপালের মত ছুটে আসছিল এ অঞ্চলে। কেউ আসছিল পক্ষপাতদুষ্ট একচোখা বিচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য যা তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার অনুসরণে ইচ্ছামত হেরফের হচ্ছিল, অন্যরা আসছিল স্রেফ শান্তি আর স্থিতির সন্ধানে- শান্তিময় এমন এক বেলাভূমির খোঁজে যেখানে তারা প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারে, আর এজন্যে যখন তখন কোনও অনাহুত এসে তাদের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে যাবে না বা বুঝতে চেষ্টা করবে না এর সুর, তাল, লয়, ছন্দ।

এই লোকগুলো সনাতন ফরাসিদের মত নয়, কিন্তু তারপরেও তারা ফরাসি। এই সজ্জনদের সঙ্গে পাপা শ্যারিয়ারের কোনো মিল নেই। আমার শৈশবে দেখা ফ্রেঞ্চম্যান নয় তারা। তাদের চিন্তা-চেতনা সব আলাদা ধরনের, অনেক ক্ষেত্রেই একপেশে। আমি প্রায়ই তাদের বলতাম, ‘ঠিক আছে, তোমরা অতীতের ব্যাপারগুলো ভুলতে পারছো না তাতে অসুবিধা নেই, কিন্তু সেসব বিষয় নিয়ে কথা বলাটা এখন অন্তত বন্ধ করা উচিৎ তোমাদের। এটা কি সম্ভব যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে নাৎসি সমর্থক রয়ে গেছে? শোন আমি কী বলি: ‘তোমরা যখন ইহুদিদের নিয়ে বল তখন মনে হয় একটা গোষ্ঠী তাদেরই সমভাবাপন্ন অপর গোষ্ঠীর ওপর ঘৃণার বমি উগড়ে দিচ্ছে।


তোমরা এখন ভেনেজুয়েলায়, রয়েছো এখানকার চমৎকার মানুষগুলোর মাঝখানে, তারপরেও তোমরা তাদের মহতি সেই দর্শনকে অনুধাবন করতে পারছো না। এটা সেই দেশ যেখানে কোনো ধর্মীয় বা গোষ্ঠীগত পক্ষপাত নেই। সমাজে যদি সুবিধাভোগী শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ভাইরাসে কেউ তাড়িত হয়, তাহলে সেটা হবে হতদরিদ্র জীবন যাপনের অভিশাপ বয়ে বেড়ানো চরম দরিদ্র শ্রেণিটা। কিন্তু বাস্তব হল ভেনেজুয়েলায় সেই ভাইরাসেরও অস্তিত্ব নেই।

তোমরা তো বেঁচে থাকার যুক্তিতেও বেঁচে থাকতে পারঙ্গম নও। জীবন কি তাহলে পরস্পর ভিন্ন মতাবলম্বী কিছু মানুষের বিরতীহীন যুদ্ধের নামান্তর?

দয়া করে তোমরা এসব বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ কর। এখানে ইউরোপিয়দের মত জাত্যাভিমানের গোঁ বগলে চেপে আসতে যেও না। সত্য কথা যে এখানকার গড়পরতা মানুষদের চেয়ে তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান অনেক বেশি, কিন্তু এর থেকে ভালোটা কী বেড়িয়ে আসছে? এটা কী সুফল বয়ে আনছে তোমাদের মত তথাকথিত শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্যে যেখানে তোমরা এদের চেয়ে অধিক নির্বোধ আর নালায়েকের দল ছাড়া আর কিছু নও? যতদূর তোমরা মেনে চল, সে মোতাবেক শিক্ষা মানে প্রতিভা, সদগুণ, সুশীলতা আর হৃদয়ঙ্গম করা নয়, শিক্ষা মানে স্রেফ বই থেকে জানা। যদি তোমাদের হৃদয়পদ্ম থেকে যায় স্বার্থন্ধ শুষ্কং-কাষ্ঠং, জিঘাংসাকাতর, জীবাষ্মভূত--- তাহলে ওইসব বই থেকে কী জানলে তাও কোনো অর্থ বহন করে না।

ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, বন-জঙ্গল আর এই চরাচর, কিন্তু সে কি শুধু তোমাদরই জন্যে?

তোমরা কি মনে করছো যে দুনিয়াকে পুনর্গঠনের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো জাতি তোমরা? আমি যখন তোমাদেরকে দেখি আর তোমাদের কথাবার্তা শুনি তখন মনে হয় তোমাদের মত কমবখ্তদের দ্বারা পরিচালিত দুনিয়ার অর্থ হবে শুধু পর্যায়ক্রমিক যুদ্ধ আর বিপ্লবের ধারাবাহিকতা, অন্য কিছু নয়। কারণ, তোমরা বলে বেড়াও যে দুনিয়ায় শান্তি আর স্থিতি চাও, কিন্তু বাস্তবতা হলো তোমরা তা তখনি চাও যখন তা তোমাদের কথা মত হয়। ’

এদের প্রত্যেকেরই কাকে কাকে গুলি করতে হবে তার আলাদা আলাদা তালিকা আছে, আছে নিষিদ্ধ করার বিষয় অথবা গর্তে ফেলে বন্দি করার মত পক্ষ। এবং যদিও এ বিষয়গুলো আমাকে মর্মাহত করে, তারপরেও আমি না হেসে পারতাম না যখন দেখতাম এই লোকগুলো কাফে বা তৃতীয় শ্রেণির সস্তা কোনো হোটেলের বারান্দায় মজলিশ জমিয়ে চারদিকের সবকিছুর এক তরফা সমালোচনা করে যাচ্ছে আর উপসংহারে এসে বলছে, আমরাই ছিলাম দুনিয়াটাকে ঠিক-ঠাক করে চালাবার মত একমাত্র যোগ্যপাত্রের দল।

এসব দেখে দেখে আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম, হ্যাঁ আমি ভীতই ছিলাম, কারণ এইসব নবাগতদের ব্যাপারে আমার খুবই বাস্তব একটা অনুভূতি কাজ করছিল- তারা তাদের সঙ্গে করে অতীতের ঘুণে ধরা গোঁড়ামিপূর্ণ আদর্শের বিষবাষ্প বয়ে নিয়ে এসেছে এখানেও।

১৯৪৭ সাল। পিয়েরে রেনে দ্য লফ্রে নামে এক সাবেক সাজাপ্রাপ্ত লোকের সঙ্গে পরিচয় হলো যার ধ্যান-জ্ঞান বলতে একটি জিনিসই ছিল, ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আংগারিতা মেদিনা। ১৯৪৫ সালের সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।  

দ্য লফ্রে ছিল কঠিন এক পাত্র। খুবই কর্মঠ, তবে উদার-হৃদয় আর মজারু স্বভাবের মানুষ। সে আমাকে তার সব ধরনের যুক্তি-তর্ক আর অভিনিবেশ দিয়ে এটা বোঝাতে ব্যাকুল ছিল যে ওই ক্যু’তে যারা লাভবান হয়েছে তারা মেদিনার জুতার-ফিতে হওয়ারও যুগ্যি না। মিথ্যে বলবো না, সে আমাকে এসব বচনে মেদিনাভক্ত বানাতে পারেনি। কিন্তু যেহেতু বেশ কঠিন একটা সময় পার করছিলাম তখন, তাই তার সঙ্গে আর কুটতর্কে জড়াতে চাইনি এ বিষয়ে। সে আরমান্দো নামে জবরদস্ত একজন বিনিয়োগকারীর অধীনে আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। আরমান্দো ভেনেজুয়েলার এক প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান, মেধাবী, সুশিক্ষিত, আদর্শবাদী, উদার, সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন এবং আশ্চর্যরকম সাহসী এক মানুষ। এতসব গুণের বিপরীতে তার সমস্যা  ছিল একটাই--- ক্লেমেন্তে নামে নালায়েক এক ভাইয়ের বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হতো। আজ পঁচিশ বছর পরেও ক্লেমেন্তের কিছু অপকর্ম দেখে বোঝা যায় যে, বেটা এতদিনেও বদলায়নি এক রত্তি।

[চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৭০৫, ডিসেম্বর ৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।