ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব--১২]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব--১২]

ব্যানকো [র্পব--১১],[র্পব--১০], [পর্ব--৯], [পর্ব--৮], [পর্ব-৭], [পর্ব-৬], [পর্ব-৫], [পর্ব-৪], [পর্ব-৩], [পর্ব-২], [পর্ব-১]

৭ম পরিচ্ছদ

ক্যারোত্তে : বন্ধকী কারবারের দোকান

ক্যারাকাসে বড়দিনের উৎসব চলছিল। বড় সড়কগুলোতে চমৎকার আর বিশাল সব আলোকসজ্জা, সর্বত্র আনন্দের জোয়ার বইছে, হৃদয়গ্রাহী ভেনেজুয়েলিয় ছন্দে ক্যারোল গাওয়া হচ্ছে।

এদিকে আমি আমাদের সাম্প্রতিক ব্যর্থতায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিক্ততা বা হতাশা আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। জুয়ায় দান লাগিয়েছিলাম এবং আমরা হেরে গেছি; কিন্তু স্বস্তির ব্যাপারটা হচ্ছে আমি এখনো বেঁচে আছি এবং আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি মুক্ত আর স্বাধীন আছি। সব কিছুর পরও বলা যায়, গ্যাস্টনের ভাষায় এটা একটা হৃদয়গ্রাহী চমৎকার সুরঙ্গ ছিল!

এদিকে ধীরে ধীরে বেথেলহেমের শিশুকে নিয়ে চলমান এই সাঙ্গিতিক আবেশ আমার ভেতরেও সংক্রমিত হতে শুরু করলো; আমার মনকে হালকা করে দিতে শুরু করলো, হৃদয় আবারো শান্তির ছোঁয়ায় স্থিত হলো। মারিয়াকে একটা টেলিগ্রাম পাঠালাম--- মারিয়া, এই ক্রিসমাস ওই গৃহকে পরিপূর্ন করে দিক যেখানে তুমি আমাকে ঋদ্ধ করেছো অনেক অনেক আনন্দ দিয়ে।

বড়দিনটা পিকোলিনোর সঙ্গে হাসপাতালে কাটালাম, এখানকার ছোট্ট বাগানের একটি বেঞ্চে বসে থেকে। আমি দু’টো হ্যালাকাস নিয়ে এসেছিলাম, এই বিশেষ খাবারগুলো এরা শুধু বড়দিনের সময়েই বানায়। সব থেকে সেরা আর দামি জিনিসগুলোই। এছাড়াও পকেটে করে ছোট্ট আর চ্যাপ্টা দুটো সুস্বাদু চিয়ান্তির বোতল নিয়ে এসেছি।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/SeaborneSeaplane_landing1120111130162722.jpgআমাদের কাছে এটা ছিল এমন এক ক্রিসমাস যা দুজন মানুষকে পুনরায় জীবনমুখী করে তুলেছে। এমন একটা বড়দিন যা নিঃস্বার্থ নির্মল বন্ধুত্ত্বের দ্যুতিতে উদ্ভাসিত, পরিপূর্ণ স্বাধীনতায় আলোকিত একটি বড়দিন। টাকা খরচ করারও এক স্বাধীনতা উপলব্ধি করছি আজ আমি। যেমন আজ বেশ কিছু টাকাই খরচ করে ফেলেছি। এই বড়দিনটি হচ্ছে পিকোরিনোর জন্য আশার আশীর্বাদপুষ্ট। তার জিব এখন আর আগের মত বাইরে ঝুলে থাকে না, তার চিকিৎসা চলছে। এখন লালাও ঝরে না মুখ থেকে। হ্যাঁ, একটা অভূতপূর্ব বড়দিন ওর জন্য এটা--  কারণ এখন সে ‘হ্যাঁ’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারছে। ‘হ্যালাকাসটি ভাল ছিল তো’ প্রশ্ন করতেই ও পরিষ্কারভাবে এবং সানন্দচিত্তে জবাব দিল, হ্যাঁ।

কিন্তু ওপরওয়ালা সাক্ষী, নতুনভাবে আমাদের এই জীবন গড়ে তোলার প্রচেষ্টাটা ছিল অসাধ্য। কয়েক সপ্তাহ তো পার করেছি অসম্ভব কাঠিন আর প্যতিকূলতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই আমি হতোদ্যম হইনি কখনো। আমার ভেতরে দুটো জিনিস ছিল। প্রথমটি ভবিষ্যতের ওপর অটল স্থির বিশ্বাস আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে জীবনের জন্য প্রশ্নাতীত আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা। এমনও গেছে যখন কোনো পরিস্থিতিতে আমার উদ্বেগাকুল হয়ে পড়ার কথা ছিল, তখনো আমি এমন দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত থাকতাম যে রাস্তার ছোটোখাটো তুচ্ছ ঘটনায়ও মুখ ভরে হেসে উঠতাম। হঠাৎ করে কোনো বন্ধুর দেখা পেয়ে গেলে তার সঙ্গে নিদেন পক্ষে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে দিতাম, বছর বিশেকের তরুণের মত হাসি-আনন্দে মেতে।

ডা. বাউগ্রাট আমাকে তার বিউটি প্রোডাক্ট ল্যাবরেটরিতে ছোটোখাটো একটা চাকরি দিয়েছেন। এতে রোজগার তেমন একটা আহামরি ছিল না তবে আমার একার পক্ষে ধোপদুরস্তভাবে বাবুগিরি করে চলার পক্ষে যথেষ্ট। এই কাজ ছেড়ে আমি হাঙ্গেরিয়ান এক দইওয়ালির ওখানে কাজ নেই। দইয়ের ফ্যাক্টরিটা তার ভিলাতেই ছিল। এটাই সেই সুবর্ন স্থান যেখানে আমি এক বৈমানিকের সঙ্গে পরিচিত হই যার প্রকৃত নাম এখানে উল্লেখ করবো না কারণ বর্তমানে তিনি এয়ার ফ্রান্সের একটি জেট বিমানের কমান্ডে আছেন। তাকে এখানে ‘ক্যারোত্তে’ বলে উল্লেখ করবো।

ক্যারোত্তেও ওই হাঙ্গেরিয়ান নারীর চাকরি করতো। আমরা দু’জনেই এখানকার উপার্জন দিয়ে খেয়ে-পড়ে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু মৌজ মাস্তিও করতে পারতাম। প্রতি সন্ধ্যায় আমরা ক্যারাকাসের বারগুলোতে চক্কর দিতে ভুলতাম না। প্রায়ই আমরা সিলেন্সিও  জেলার হোটেল ম্যাজেস্টিকে বসে এক দুই পাত্তর টেনে নিতাম। এখন আর সেখানে ওই হোটেলটা নেই, তবে এক সময় এটাই ছিল শহরে একমাত্র আধুনিক স্পট।

এই সময়টা ছিল জীবনের সেই স্থবির এক মুহূর্ত যখন মনে হতে থাকে সামনে ভালো আর কোনো কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না, ঠিক তখনি এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। একদিন হঠাৎই লাপাত্তা হয়ে গেল ক্যারোত্তে। তবে কিছু দিন পরই ফিরে এলো আমেরিকা থেকে, সঙ্গে একটা প্লেন--- ছোট্ট একটা পর্যবেক্ষক বিমান, দুই আসন বিশিষ্ট, একটার পেছনে আরেকটা। চমৎকার একখান জিনিস। এটা কোত্থেকে আমদানি হয়েছে এ সম্বন্ধে আমি কোনো প্রশ্নই করলাম না: একমাত্র প্রশ্ন যা করলাম তা হলো এটা দিয়ে সে কী করতে যাচ্ছে?

একটু হেসে সে বললো, এখনো জানি না। তবে যাই করি, আমরা অবশ্যই পার্টনার থাকবো। কোন কর্মে?

কি করবো সেটা কোনো বিষয় নয় যদি আমরা এর দ্বারা একটু মজা আর দু-চার পয়সা কামাই করতে পারি।

ঠিক আছে, তবে তাই হোক। চলো বেড়িয়ে পড়ি।

ওই মনোহারিনী হাঙ্গেরিয়ান নারী, আমাদের চাকরির স্থায়ীত্ব নিয়ে যার মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, হাসি মুখেই বিদায় দিলেন আমাদের। এখান থেকেই শুরু হলো আনন্দ উত্তেজনা আর উন্মাদনায় টইটম্বুর অত্যাশ্চর্য একটি মাসের। হায়, সেই বিশাল প্রজাপতিটা-- তাকে নিয়ে কি কাণ্ডকারখানাই না করেছি আমরা!

ক্যারোত্তে ছিল এক ওস্তাদ পাইলট। যুদ্ধের সময়ে সে ইংল্যান্ড থেকে ফরাসি পাইলটদের উড়িয়ে নিয়ে আসতো, রাতের আঁধারে প্রতিরোধ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন মাঠে নামিয়ে দিত। পরে আরেক গ্রুপ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেত। প্রায়ই তাকে এমন অবস্থায় বিমান অবতরণ করাতে হতো যেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ভূমিতে তার জন্য অপেক্ষমান টর্চের আলো ছাড়া আর কোনো সংকেত বা নির্দেশনা থাকতো না। বলা যায় ও ছিল সম্পূর্ণরূপে উন্মাদগোত্রীয় এক আদম যে অকৃত্রিমভাবে পছন্দ করতো সর্বাবস্থায় হাসি-মস্করা করতে। একবার, আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় আমাকে কোন হুঁশিয়ারি না জানিয়েই এমনভাবে এক গোত্তা মারলো যে আকস্মিক আতঙ্কে আমার প্যান্ট প্রায় ভিজে যাওয়ার যোগাড় হলো। এই মারাত্মক ঝুঁকপূর্ণ কাজটি সে করেছির স্রেফ এক মুটকি টাইপের মহিলাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য যে পশ্চাদ্দেশ বাতাসে পুরো উম্মুক্ত করে বাগানের আড়ালে নির্বিঘœচিত্তে কাজ সারছিল।

তবে আমি এই যান্ত্রিক যানটাতে করে আকাশে ছোটাছুটিটা এতই ভালোবেসে ফেলেছিলাম যে এর তেল-পানি যোগান দিতে দিতে এক পর্যায়ে আমরা প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় পৌঁছে যাই। জ্বালানি কেনার পয়সাও যোগাড় হয় না। এ অবস্থায় চমকপ্রদ এক ফন্দি বের করলাম। এবার আমরা বিমানবাহী ফেরিওয়ালা হবো, অর্থাৎ বিমানে করে জিনিসপত্র ফেরি করে বেড়াবো।

জীবনে এই প্রথমবার কারো সেঙ্গ ধোঁকাবাজী করলাম। লোকটির নাম কোরিয়াত, আলমাসেন রিও নামে এক কাপড়ের দোকানের মালিক। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার মাঝারি আকারের শ্যামবর্ণ এই ইহুদি খুব ভালো ফ্রেঞ্চ বলতো। দেকানটি তার বেশ চালু আর সে সূত্রে আয় রোজগারও ছিল বেশ। মেয়েদের বিভাগে তার সংগ্রহে ছিল প্যারিস থেকে আমদানি করা সর্বাধুনিক ফ্যশনের উন্নতমানের সব পোশাক-আশাক। বাজার চলতি আর সহজে বিপননযোগ্য ফ্যাশনদুরস্ত নারীদের পোশাকের এক বিশাল ভাণ্ডার আমাদের সামনে উম্মুক্ত হয়ে গেল। আমি তাকে রাজী করালাম বাকিতে অথবা বিক্রি করে পরিশোধের শর্তে বেশ কিছু মাল দিতে। এগুলোর মোট দাম মোটাসোটা একটা অঙ্কই বলতে হয়। আমাদের পরিকল্পনাটা ছিল আমরা এসব কাপড়-চোপড় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে বিক্রি করবো।

আমাদের ফেরিওয়ালার জীবন শুরু হলো। যেখানে খুশি যাওয়া এবং যখন সুবিধা তখন ফিরে আসা। তবে বেচাকেনা যদিও ভালই চলছিল, কিন্তু যে আয় হচ্ছিল তা আমাদের খরচ মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। আর কোরিয়াতের প্রাপ্য টাকা পেট্রোলেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল।

বারবনিতারাই ছিল আমাদের সবচে’ ভালো খরিদ্দার। তাই পতিতালয়গুলোতে পণ্য ফেরি করতে আমরা কখনোই ভুল করতাম না। যখন কোনো পতিতার ডাইনিং টেবিলে আমাদের পণ্য সম্ভার ছড়িয়ে দিতাম তখন তা থেকে লোভ সম্বরণ করা সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়তো। কটকটে উজ্জ্বল রঙের ব্লাউজ, আধুনিকতম ট্রাউজারস, সিল্ক স্কার্ফ, ফুলের আদলের ছাটওয়ালা স্কার্ট, সেই সঙ্গে আমার প্রলুব্ধকর ‘ধারাভাষ্য, ভদ্রমহিলাগণ, শুনুন! এই জিনিসগুলো আপনাদের রুটি-রুজির ক্ষেত্রে মোটেই বিলাস-দ্রব্য নয়। উপরন্তু আমি বলবো আপনারা যদি এগুলো খরিদ করেন প্রকৃতপক্ষে তা হবে ব্যবসায়ে বিনিয়োগেরই নামন্তর। কারণ এগুলো পড়ে আপনারা নিজেদের যত আকর্ষণীয় করে তুলবেন ততই খদ্দেররা ভিড় করবে, হামলে পড়বে আপনাদের ওপর। যে রমনীরা আমার কাছ থেকে জিনিস না কিনে মনে করছেন টাকা বাঁচাচ্ছেন, আমি নিশ্চিত তারা ভ্রান্ত এক অর্থনৈকি চিন্তায় পরিচালিত হচ্ছেন। বলবেন কেন? কারণ আমাদের এসব আকর্ষণীয় পোশাক-আশাকে সজ্জিতা মেয়েগুলোই অন্যদের জন্য বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে।

কিছু কিছু পতিতালয় রক্ষক ছিল যারা আমাদের এই ধান্দাটিকে মোটেই ভালো চোখে দেখছিল না; তাদের চোখের সামনে দিয়েই তাদের অধীনস্থ মেয়েদের টাকা অন্যের পকেটে চলে যাচ্ছে এ বিষয়টা তারা কোনোমতেই হজম করতে পারছিল না। তাদের অনেকেই মেয়েদের কাছে এটা ওটা দরকারি জিনিসপত্র বিক্রি করতো। এই বেজন্মাগুলো চাচ্ছিল এখানকার মুনাফার একচেটিয়া দখল নিতে।

প্রায়ই আমরা পুয়ের্টো লা ক্রুজে যেতাম আমাদের বিমান-ফেরি নিয়ে। কারণ এর কাছাকাছি বাসিলোনা নামে ছোট্ট এক শহরে বেশ ভাল একটা এয়ারফিল্ড ছিল। এখানকার সবচেয়ে ফিটফাট পতিতালয়টিতে ষাটজন মেয়ে ছিল। কিন্তু এর মালিক ছিল শালা কুৎসিত এক মহা বাঞ্চোত, কুরুচিকর, দাম্ভিক, একগুঁয়ে এক জেদি মাস্তান। লোকটা পানামার। তবে তার ভেনেজুয়েলিয় বউটা ছিল চমৎকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানকার নিয়ম-কানুন সব চলতো স্বামীর নির্দেশে। এখানে আমাদের পণ্য সম্ভার টেবিলে সাজানো দূরে থাক, শুধুমাত্র বাক্স খুলে এক ঝলক দেখানোরও অনুমতি ছিল না।

একদিন সে বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত করে ছাড়লো। আমার গলায় পড়া একটি স্কার্ফ একজন পতিতা কিনে নেওয়ায় সে সঙ্গে সঙ্গে তাকে বরখাস্ত করে বসে। তর্কাতর্কি একেবারে জঘন্য পর্যায়ে চলে যায় এবং পতিতালয়ের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ আমাদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করলো এবং নির্দেশ দিল যেন আর কখনো সেখানে না যাই।

‘ঠিক হ্যায়, শালা বেশ্যার ভেড়ুয়া কোথাকার’ বললো ক্যারোত্তে, ‘আমরা এখানে আর পায়ে হেঁটে আসবো না সত্য, তবে আসবো আকাশ পথে। এতে আর বাধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা ধাকবে না। ’

পরদিন সকালের আগ পর্যন্ত আমি ক্যারোত্তের হুমকির মর্মার্থ ঠাওর করতে পারিনি। যখন আমরা বার্সিলোনা থেকে বিমান নিয়ে উড়তে যাচ্ছিলাম তখন ক্যারোত্তে আমাকে ইন্টারকমে বললো, এখন আমরা ওই পানামানিয়ানকে শুভেচ্ছা জানাতে যাচ্ছি। শক্ত করে বস আর ভয় পেওনা।

কি করতে যাচ্ছো তুমি?

জবাবে কিছুই বলো না সে। কিন্তু আকাশ থেকে যখন পতিতালয়টি নজরে আসতেই সে বিমান নিয়ে উঠে গেল একটু ওপরে। এরপর আচমকাই সরাসরি ওই টিনশেড বাড়িটির দিকে পূর্ণ বেগে গোত্তা মেরে নেমে আসলো মাটির একেবারে কাছাকাছি, হাই-টেনশন বৈদ্যুতিক লাইনের অতি নিকট দিয়ে পাশ কাটিয়ে পতিতালয়ের ঢেউটিনের ছাদ প্রায় ছুঁই ছুঁই করে তীব্র গতি আর গর্জনে উড়ে গেল। ছাদের বেশিরভাগ ঢেউটিনই আলগা হয়ে উড়ে গেল দিকবিদিক--- নিচের প্রতিটি ঘরের বিছানা, ক্রিয়ারত নর-নারীদের খোলা আকাশে এবং আমাদের কাছে উম্মুক্ত করে দিয়ে। আমরা কিছুটা দূরে সরে ওপরে উঠে এলাম। এরপর আবারো অল্প উচ্চতার মধ্যে ঘটনাস্থলে ফিরে এলাম সরেজমিন তদন্তে। বিছানাস্থিত ওই নগ্নিকাদের সঙ্গে নানান সম্ভব এবং অসম্ভব ভঙ্গিমায় ক্রিয়ারত খদ্দেরদের যে দৃশ্য অবলোকন করলাম, আমার জীবনকালে হেন কৌতুককর দৃশ্য আর চাক্ষুস করিনি। ওইসব নারী-পুরুষ উম্মাদপ্রায় অবস্থায় ওই ঢাকনাবিহীন বাক্সসদৃশ ঘরগুলো থেকে ক্রোদোন্মত্ত মুষ্ঠি দেখাচ্ছে বিমানটির দিকে যেটা তাদেরকে রমন সুখের চরম পুলকের মাঝখান থেকে ছিনিয়ে এনেছে অথবা রমণক্লান্তির সুখনিদ্রার সুসুপ্তি থেকে তুলে এনেছে নির্দয়ভাবে। এদিকে ক্যারোত্তে আর আমি নির্জীব অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসি থামাতে পারলাম না।

আমরা ওখানে আর কখনো ফিরে যাইনি। কারণ এখন ওই জায়গায় শুধুমাত্র একজন ক্রোধোন্মাদ ভেড়–য়াই নয়, একদল ক্রোধোন্মাদ রমনীও পাবো। পরে অবশ্য সেখানকার এক মেয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল যে এর পুরো মজাটা আমাদের মতই উপভোগ করেছিল। আমাদের ওই কাণ্ড রীতিমত তা-ব ঘটিয়ে দেয় ওখানে। এর ফলে ওই শালা পানামানিয়ান হারামিটা তার স্বভাবসুলভ জেদের সঙ্গে নিজ উদ্যোগে প্রতিটি ঘরের ছাদ জাম্বু সাইজের সব বল্টু দিয়ে মজবুত করে আটকে দেয়।

ক্যারোত্তে আর আমি দুজনেই প্রকৃতি পাগল ছিলাম। প্রায়ই আমরা বিমান নিয়ে বেড়িয়ে যেতাম শুধুমাত্র নিসর্গ অবলোকনে। এভাবেই আমরা একদিন এমন একটা স্থান খুঁজে পেলাম যাকে বলা যায় পৃথিবীর এক আশ্চর্যতম জিনিস : লস রকেস (Los Roques), সমুদ্রের প্রায় দেড় শ’ মাইল ভেতরে, তিন শ’ ষাটটা ছোট ছোট ছড়ানো ছিটানো দ্বীপের সমষ্টি। পাশাপাশি একটার সঙ্গে আরেকটা সারি বেঁধে বিশাল এক ডিম্বাকৃতির লেকের সৃষ্টি করেছে। সমুদ্রের মাঝে শান্ত স্থির এক লেক, কারণ মালাগাঁথা দ্বীপগুলো চমৎকার এক বেড়িবাঁধের সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যকার হালকা সবুজ অনুজ্জল পানি এতটাই স্বচ্ছ যে ষাট-সত্তর ফিট নিচে পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। দুর্ভাগ্য যে ওই সময়ে সেখানে কোন ল্যান্ডিং স্ট্রিপ ছিল না। ফলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে পুরো দ্বীপপুঞ্জই আমাদেরকে অন্তত গোটা দশেক চক্কর দিয়ে অবতরণের মত উপযুক্ত জায়গাটি খুঁজে পেতে হতো--  এটা প্রায় কুড়ি মাইল পশ্চিমের একটি দ্বীপ, নাম লাস এইভ্স (Las Aves)।

ক্যারোত্তে ছিল বাস্তবিকই একজন অনন্য সাধারণ বৈমানিক। আমি তাকে দেখেছি প্রায় খাড়া ঢালু কোন সৈকতেও ল্যান্ড করতে যেখানে বিমানের এক ডানা পাড়ের বালু ছেঁচড়ে আর অন্য ডানাটি সমুদ্রের পানি কেটে আগে বাড়তে বাড়তে গিয়ে থেমেছে। আইল ডি এইভ্স মানে হচ্ছে পাখির দ্বীপ। এই দ্বীপে হাজার হাজার পাখি, ধূসর রঙের পাখি--- যা বাচ্চা অবস্থায় সাদা থাকে। এদেরকে বলা হয় বোবোস, কারণ এরা কিছুটা নির্বোধ প্রকৃতির, তাই নিশ্চিতভাবে নির্ভরযোগ্য আর নির্ভয়। সেখানে অবস্থান করাটা একটা অত্যাশ্চর্য রকম ভালো লাগার ব্যাপার। শুধুমাত্র আমরা দু’জন, প্যানকেকের মত সমতল একটি দ্বীপে আপাদমস্তক নগ্ন হয়ে ঘুরছি  আর আমাদের চারপাশে অসংখ্য অগণন পাখি ওড়াওড়ি করছে, কোনোটা আমাদের গায়ের ওপরও এসে বসছে, ঘোরাঘুরি করছে সম্পূর্ণ নির্ভীকভাবে। লেশমাত্র ভয় নেই ওদের চালচলনে, অথচ এর আগে কোনো মানুষ দেখেনি। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে দিতাম দ্বীপকে ঘিরে থাকা অপ্রশস্ত সৈকতে শুয়ে সূর্যস্নানে শরীর তামাটে করতে করতে। আমরা পাখিগুলোর সঙ্গে ছেলেমানুষী খেলায় মশগুল হয়ে যেতাম, ওদেরকে হাতের মুঠোয় নিয়ে; এদের কারো কারো প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল আমাদের মস্তকের প্রতি এবং মাথায় উঠে খুবই শান্তভাবে ঠুকড়ে দিত চুলের ভেতর।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/aves 120111130163646.jpgএরপর আমরা সাঁতার কাটতাম। তারপর আবারো  সূর্যস্নান এবং এরপর যখন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তাম তখন পানির ওপর ভেসে ভেসে রোদ পোহাতে থাকা বাগদা চিংড়ির ঝাঁক খুঁজে বের করতাম। খালি হাতেই সেখান থেকে কিছু চিংড়ি ধরে অকুস্থলেই পুড়িয়ে নিতাম। এক্ষেত্রে একমাত্র সমস্যা ছিল জ্বালানির জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে কাঠ-কুটো খুঁজে পাওয়া। কারণ দ্বীপে বলতে গেলে কোনো বৃক্ষ-তৃণ কিছুই জন্মাতো না।

ওই অনাঘ্রাত নিষ্কলুষ সৈকতে বসে, সুস্বাদু চিংড়িগুলো হোয়াইট ওয়াইনযোগে ভরপুর খেতে খেতে (বিমানে সব সময়েই কিছু বোতল মওজুদ থাকতো) কী যে অপার্থীব লাগতো। চতুর্দিকে শুধুমাত্র সমুদ্র আকাশ আর পাখিগুলো ছাড়া অন্য কারো উপস্থিতি বাদে খেতে খেতে আমাদেরকে এমন এক স্বর্গীয় অনুভূতি এসে আচ্ছন্ন করতো যে আমরা পরষ্পর আত্মিকভাবে এমন লীন হয়ে যেতাম যে অনুভূতি প্রকাশের জন্যে আমাদের মাঝে কোনো শাব্দিক ভাষা বিনিময় হতো না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর আমরা যখন আবার টেক অফ করতাম তখন আমার হৃদয় সুখ, সূর্য আর জীবনাবেগের পূর্ণতায় টইটম্বুর করতো; আমরা জীবনের অন্য কোন ক্ষয়-বৃদ্ধিতে ভ্রুক্ষেপ করতাম না, এমনকি পরবর্তী ট্রিপের জন্য পেট্রোলের টাকা যোগাড়ের কথাও বিস্মৃত হয়ে যেতাম।   এই ট্রিপগুলো ছিল একেকটা এমন এক অভিযান যার লক্ষ্য ছিল স্রেফ মানুষের প্রত্যাশার অতীত অনিন্দ্যসুন্দর কোন স্বর্গভূমিতে কিছুক্ষণ অবগাহন করা।

লাস এইভ্স-এ আমরা বিশাল এক সমুদ্র-গুহা আবিষ্কার করি। ভাটার সময় এর মুখ সমুদ্র-পৃষ্টের ওপরে ভেসে উঠতো এবং ভেতরে আলো-বাতাস প্রবেশ করতো। এই চিত্তাকর্ষক গুহাটির জন্য আমি অদ্ভুত এক মনের টান অনুভব করতাম। এর ভেতরে ঢুকে সাঁতার কাটা যেত, সেখানে পানি থাকতো পরিষ্কার আর অগভীর, তিন ফিটের বেশি গভীরতা ছিল না। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে তাকালে মনে হতো সেগুলো বুঝি সিকাডায় (ঘুঘরা পোকা) ছেয়ে আছে। আসলে ওগুলো সিকাডো নয়। পাথুরে দেওয়ালে আঁকড়ে থাকা হাজারে হাজারে ছোট ছোট বাগদা চিংড়ির দল। অনেক সময় আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য সেখানে অবস্থান করতাম এই চিংড়ি বাহিনীকে কোন রকমে বিরক্ত না করে। শুধু তখনি আমরা ওদের আত্মমগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটাতাম যখন দেখতাম বিশাল কোন অক্টোপাস, এগুলো শিশু বাগদা চিংড়ির জবরদস্ত প্রেমিক, তার একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এদের কতকগুলোকে বাগে নেওয়ার জন্য। তৎক্ষণাৎ আমরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ভিতরের অংশ টেনে বাইরে উল্টে দিতাম। এখন সে এখানে শুয়ে শুয়ে পচতে পারে। অবশ্য যদি সে পর্যন্ত সে সময় পায়। কারণ ওই অবস্থায় অক্টোপাসটি কাঁকড়াদের জন্য অনিয়মিত অথচ উপাদেয় এক খাদ্যে পরিণত হতো।

প্রায়ই আমরা লাস এইভ্স-এ গিয়ে রাত কাটাতাম। আমাদের দুজনেরই ছিল একটি করে বড় ইলেক্ট্রিক টর্চ। এ দিয়ে শুরু করতাম চিংড়ি ধরা। প্রতিটি আড়াই পাউন্ড ওজনের। সঙ্গে নিয়ে আসা ব্যাগ ভরে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা থামতাম না।

আমরা আমদের এই সংগ্রহ-সম্ভার কারলোত্তা শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত এয়ারফিল্ডে বিক্রির জন্য নিয়ে যেতাম। প্রতি ট্রিপে প্রায় হাফটন মত বাগদা চিংড়ি নিয়ে আসতাম সেখান থেকে। এভাবে চিংড়ি দিয়ে বিমান বোঝাই করা উদ্ভট পাগলামিরই নামান্তর, কিন্তু এর সবটাই ছিল নির্ভেজাল আনন্দেরই অংশ। এই বোঝা নিয়ে আমরা কোনমতে বিমান নিয়ে মাটি ছাড়তে পারতাম, আর উচ্চতা? এত ওপরে কখনোই উঠতাম না যাতে আকাশের চাঁদ-তারায় হোচট খাবো অর্থাৎ কোনোমতে পানির কিছুটা ওপর দিয়ে চলে যাওয়া! কিছুটা কসরত করতে হতো অবশ্য ক্যারাকাসের উপকূল থেকে উপত্যকা অঞ্চলের ১২ মাইল পথে। কোনমতে বাড়িঘরের ছাদ ছুঁই ছুঁই করে ফিরে আসতো আমাদের বিমান। সেখানে বাগদাগুলো বিক্রি করতাম উদ্ভট এক মূল্যে, আড়াই বলিভার প্রতিটি। এই অর্থ আমাদের এই বেখাপ্পা কর্মকা- চালিয়ে যাওয়ার পথে অন্তত বিমানের তেলের খরচটার জোগান দিত। কিন্তু খালি হাতে বাগদা ধরতে গিয়ে প্রায়ই ছোটখাটো আঘাতের শিকার হতে হতো, আর কখনো কখনো তো চিংড়ি ছাড়া একদম শূন্য হাতেও আসতে হতো আমাদের। কিন্তু এসব ছোটখাটো বিষয় আমাদের মোটেই হতাশ করতে পারেনি, আমরা আমাদের কায়দায় জীবনের মজা লুটে যাচ্ছিলাম। আমাদের প্রাণের পেয়ালা হরদম ভরপুর ছিল জীবনের মদে।

একদিন আমরা যখন পুয়ের্তো লা ক্রুজের পথে ছিলাম, এবং গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেছি, ক্যারোত্তে আমাকে ইন্টারকমে জানালো জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। আর তাই আমি বিমানটিকে স্যান টোমি অয়েল কোম্পানির এয়ারফিল্ডে অবতরণ করাতে যাচ্ছি। আমরা রানওয়ের ওপর দিয়ে উড়ে গেলাম ওদের এটা বোঝাতে যে জরুরী প্রয়োজনে তাদের প্রাইভেট ল্যান্ডিং প্লেসে নামতে বাধ্য হচ্ছি আমরা; কিন্তু গর্দভের দল তৎক্ষণাৎ আমাদের প্রতিরোধে একটি ট্যাংকার এনে এয়ার স্ট্রিপের মাঝামাঝি দাঁড় করিয়ে দিল, পেট্রোল না পানিতে ভর্তি খোদায় মালুম। যদিও ক্যারোত্তের নার্ভ ছিল ইস্পাতে গড়া, তারপরও আমি তাকে বারবার জানাচ্ছিলাম যে নিরাপদে মাটি ছোঁয়ার মত কোন ফাঁক আমার নজরে আসছে না। জবাবে সে শুধু বললো, ‘ধৈর্য ধর প্যাপি,’ এরপরই একপাশে পাঁই করে নেমে গিয়ে মোটামুটি চওড়া একটি সড়কের মাথার ওপর নেমে এল সে বিমানটা নিয়ে এবং তেমন কোন ঝাঁকি ছাড়াই সে ল্যান্ড করে বসলো, কিন্তু বিমানের প্রচণ্ড গতির ধকল হজম করতে পারলো না বেচারা। পিছলে একটা বাঁকের দিকে চলে গেল প্লেনটা, সেখানে তখন ষাঁড়ভর্তি এক ট্রাক-ট্রেইলার রাস্তা অতিক্রম করছিল, আচমকা আকাশ থেকে সামনে একটা বিমান নেমে আসতে দেখে প্রচ- আতংকে জন্তুগুলো বাঁধন ছিঁড়ে যে যেদিকে এবং যত দ্রুত পারলো ছুটে পালালো। ব্রেকের তীব্র ভয়ানক কর্কশ শব্দ নিশ্চিতই আমাদের তীব্রতর আতংকিত চিৎকারকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তা না হলে ট্রেইলারের ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওভাবে পাশের গর্তে গিয়ে পড়তো না, আর ট্রেইলারটি ওই গর্তে গিয়ে আশ্রয় না নিলে বিমান-ট্রেইলার মুখোমুখি সংঘর্ষে এতক্ষণে আমরা ইতহাসের পাতায় আশ্রয় নিয়ে ফেলতাম। আমরা লাফিয়ে বিমান থেকে নামলাম। আতংকে ক্যারোত্তের চেহারা পুরো সাদা কাগজ বনে যাওয়া এবং ঈশ্বরের নাম জপতে থাকা ট্রেইলার চালককে স্বাভাবিক-শান্ত করে আনলো। লোকটা ইতালিয়ান।

‘আগে তুমি আমাদের বিমান ঠেলতে সাহায্য কর, পরে অভিযোগ জানানোর ম্যালা সুযোগ পাবে। ’ ইতালিয়ান ব্যাটা তখনো আতংকে থরো থরো কাঁপছিল রক্তশূন্য চেহারা নিয়ে। আমরা তার ছুটে যাওয়া পশুগুলো ধরে আনতে সাহায্য করলাম, তবে বেচারার ট্রেলারটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। এই এলাহি টাইপের বিমান অবতরণ দেশময় এমন সাড়া জাগায় যে সরকার ক্যারোত্তের বিমানটি কিনে নেয় এবং তাকে ক্যারলোত্তা ক্যাম্পে বেসামরিক ইন্সট্রাকটর হিসেবে নিয়োগ দেয়।

অন্যদিকে আমার বৈমানিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। খুবই দুঃখজনক। ওই সময়টায় ফ্লাইং বিষয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টার প্রশিক্ষণও পেয়েছিলাম আমি ক্যারোত্তের কাছ থেকে এবং মোটামুটি ভালই করছিলাম। ঠিক হ্যায়, মন খারাপ করার কিছুই নেই। এই ঘটনায় একমাত্র যে সত্যিকারে ক্ষতির শিকার হয় সে হচ্ছে কোরিয়াত। তবে অত্যাশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এ নিয়ে সে আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা-টামলা করতে যায়নি। কয়েক বছর পর অবশ্য আমি তার পাওনা পাই পাই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম; এবং আজ এখানে সুযোগ যখন হয়েছে, আমি তার তখনকার সেই মহৎ সদাচরণের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি।

কিন্তু ওই কঠিন সময়টায় ঘটা ওই ল্যান্ডিং কাণ্ড’র জন্য আমি বিমানচ্যুতই হলাম না কিংবা হাঙ্গেরিয়ান সেই মহিলার ওখানে চাকরিটাই শুধু গেল না, এর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ক্যারাকাসের মধ্যবর্তী ওই এলাকাটা এড়িয়ে চলতে হয়েছে দীর্ঘকাল। কারণ সেখানেই ছিল কোরিয়াতের দোকানটি। আমি চাইনি দীনহীন অবস্থার ওই সময়ে সেই মালির ঘাড়ে গিয়ে আবারো পড়তে। অন্যদিকে আবারো আমার অবস্থা ‘মন্দ না’ বলার চেয়ে খারাপ হয়ে গেল। তবে এতে আমি মোটেই হতাশ হইনি। ক্যারোত্তের সঙ্গে বিমানবাজি করে কাটানো আমার ওই কটি হপ্তা এতটাই আনন্দমুখর ছিল যে এর বিনিময়ে যে কোন দুঃখ অতি সহজেই মাটি দিয়ে দেওয়া যায়।

এ ঘটনার পর অবশ্য ক্যারোত্তে আর আমি ফাঁক পেলেই মোলাকাত করতাম ট্রান্স আটলান্টিক থেকে রিটায়ার করা এক বুড়ো ফরাসীর চালানো ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্টে। একরাতে আমরা যখন ওই রেস্টুরেন্টের এক কোনে বসে অপর একজন স্প্যানিশ রিপাবলিকানপন্থী সাবেক কয়েদীর সঙ্গে ডোমিনোস খেলছিলাম, সানগ্লাস পরা দু’জন লোক এল। আমরা তাদের চিনতাম না, তারা জিজ্ঞেস করল, এটা কি সত্য যে এখানে প্রায়ই একজন ফরাসী বৈমানিক আড্ডা দেয়?

ক্যারোত্তে দাঁড়িয়ে বললো, আমিই সেই। আমি আগন্তুক দুজনকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করছিলাম এবং সহসাই চোখে থাকা গাঢ় রঙের সানগ্লাস সত্ত্বেও একজনকে চিনে ফেললাম। আচমকা জেগে ওঠা এক আবেগের শিহরণ অনুভব করলাম। আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি মুখ খোলার আগেই সে আমাকে চিনে ফেলল এবং বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো, প্যাপি!

এ হচ্ছে বিগ লিয়ন, জেলজীবনে আমার সবচে’ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। পাতলা চেহারার এক লম্বা লোক; উদার মনা একজন সত্যিকার মানুষ। তবে বেশি মাত্রায় বন্ধুবাৎসল্য দেখানোর সময় এটা ছিল না। সে শুধুমাত্র চিলি থেকে আসা তার ওই সঙ্গী পেড্রোর সঙ্গে আমাদের পরিচয়টা করিয়ে দিল, আর কিছু না। রেস্টুরেন্টের কোনায় বসে সুরাপান করতে করতে লিয়ন জানালো সে পাইলটসহ একটি হাল্কা বিমান খুঁজছে এবং কেউ তাকে ফ্রেঞ্চম্যান ক্যারোত্তের কথা বলেছিল।

‘সেই পাইলট এখানেই উপস্থিত,’ ক্যারোত্তে বললো, ‘এবং আমিই হচ্ছি সে। কিন্তু প্লেনটা নেই। তার মালিক এখন অন্য কেউ। ’

‘খুবই দুঃখজনক,’ লিওনের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া।

ক্যারোত্তে ডোমিনোস খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো, আমার জায়গায় তার সঙ্গী হল অন্য কেউ। চিলিয়ান পেড্রো গিয়ে দাঁড়ালো বারের সামনে, ফলে আমরা দুজনে বেশ জুত করে কথা বলতে পারছিলাম।

‘ভাল, প্যাপি?’

‘ভাল,লিয়ন’

‘আমাদের শেষ সাক্ষাতের পর দশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ’

‘হ্যাঁ, সলিটারি থেকে তুমি বেড়িয়ে আসছিলে আর আমি ঢুকছিলাম। লিওন, কিভাবে কাটছে তোমার এখন?’

‘খারাপ না, তেমন একটা খারাপ না। আর তুমি, প্যাপি?’

যেহেতু এটা লিওন, তাই আমি ভাবলাম তাকে আমার সব বলা যায়।

 

‘আমি তোমাকে বিস্তারিত জানাচ্ছি। লিওন, আমি কমবেশি গাড্ডায় পড়ে গেছি। পাহাড় বেয়ে ওঠা খুব একটা সহজ কর্ম নয়। মনে সদিচ্ছা নিয়ে জীবনের পাঁকচক্র থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টাটা সব সময়েই সহজ।   কিন্তু নির্দিষ্ট কোন পেশা না থাকলে জীবনে চলার পথ কর্কশ কাঠিন্যতায় মুখ থুবড়ে পড়ে। এসময়টায় বারবার যে চিন্তাটা আসে তা হলে আবারো অপরাধ জগতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার প্রলোভন। লিওন, তুমি তো বয়সে আমার চেয়ে বড়, আর তুমি সাধারণ জেলখাটা কয়েদি নও। আমি তোমাকে বলছি আমার মনে কি চাইছে। একেবারে সোজাসাপ্টাভাবে নিশ্চয়তার সঙ্গে বলছি, আমার সর্বান্তকরণ দিয়ে আমি এই দেশটির কাছে আমার এখকার প্রতিটি ভাল জিনিসের জন্য ঋণী। আমি জীবনের মেলায় আবারো ফিরে আসতে পেরেছি এখানেই এবং এই মহানুভব সমাজকে সম্মান জানানোর ব্যাপারে আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি যত কম পারা যায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ক্ষতিকারক কিছু করার ব্যাপারে। কিন্তু কাজটা আদপে সহজ নয়। যদিও আমি নিশ্চিতভাবেই জানি যে অন্তরে গেঁথে থাকা চৌর্যবৃত্তির প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ সত্ত্বেও এখানে আমি সুখী মানুষের জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে উন্নতির শিখরে এগিয়ে যাবো ধীরে ধীরে- শুধুমাত্র যদি না প্যারিসের কিছু লোককে তাদের প্রাপ্য শাস্তি কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দেওয়ার দায়টা না থাকতো আমার। এবং এক্ষেত্রে আমি হাত গুটিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে পারছি না। যদি না ওই বদমাশগুলোকে আমার মুঠোয় পাবার আগেই তারা মারে গিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে।

যখন আমি এদেশের তরুণ-যুবকদের দিকে দেখি পরিপূর্ণ নির্ঝঞ্জাট আর জীবনানন্দে ভরপুর মদিরাপাত্রের ন্যায়, তখন আমি বর্তমানের দিকে খেয়াল না করে পেছনে ফিরে তাকাই আমার জীবনের ওইসব বছরগুলোর দিকে যা আমার থেকে চুরি করে নেওয়া হয়েছিল। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো। এবং আমার মনে ভেসে ওঠে অন্ধকূপে কাটানো সেই নিঃসঙ্গ দিনগুলোর কথা আর বিচারপূর্ব প্রতীক্ষার সেই যাতনাময় তিনটি বছর এবং এর পরবর্তী সময়টা, এবং সেই ঘিনঘিনে গা রিরি করানো পেনালের আবহ যেখানে আমাকে পাগলা কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্টতর পন্থায় নির্যাতন করা হয়েছে।

এবং এরপর যখন আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো বা দিনমান ক্যারাকাসের পথে পথে হেঁটে বেড়াই মাথায় ওইসব ঝড় বয়ে নিয়ে চলি। আমি আমাকে নিয়ে আসার জন্য ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেই না, আমার মাথায় এ ধরনের ভাবনা কখনো আসে না। আমি দেখতে পাই আমি ওইসব জায়গায় ফিরে গেছি যেখানে আমাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। আমি খাঁচাবন্দি ভালুকের মত পায়চারি করে বেড়াতাম গারদের ভেতরে। ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এটা সত্যিকারের এক অমোঘ নেশা। আমি ঘুণাক্ষরেও এটা ভাবতে পারি না যে যারা আমাকে অন্যায়ভাবে ওই নরককুণ্ডে ছুঁড়ে দিয়েছিল তারা এমনি এমনি শান্তিতে মরে যাবে, প্রতিফল ভোগ না করেই।

তাই আমি যখন এরকম আচ্ছন্নতায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, চতুর্দিকে আমার দৃষ্টিপাত মোটেই সাধারণ মানুষের মত থাকে না। প্রতিটি স্বর্ণকারের দোকান, প্রতিটি ক্ষেত্র যেখান থেকে আমার প্রয়োজনীয় মূলধন যোগাড় সম্ভব, আমার দৃষ্টি থাকে এসব দিকে। কিভাবে ওইসব সম্পদ হাতিয়ে নেয়া যায় তার পরিকল্পনা ফাঁদা থেকে নিজেকে কোনোভাবেই বিরত রাখতে পারি না। এখানে এ ধরনের বেশ কিছু সহজ কাজ এমন পড়ে আছে যে সেগুলো কারো হাতে পড়ার জন্য রীতিমত কাঁকুতি মিনতি করছে।

‘এই পর্যায় পর্যন্ত আমি এখনো নিজের ওপর একটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছি। যেই দেশটি আমাকে এভাবে বিশ্বাস করেছে, আমি তার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত গুরুতর কোনো অপরাধ করিনি। এরকম কিছু করা আমার পক্ষে খুবই ঘৃণ্যতর কাজ হবে, এতটাই কুৎসিত যে সেই গৃহকর্তার কন্যাদেরকে বলাৎকার করা যিনি নিজগৃহে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলন। কিন্তু এখন আমি ভয় পাচ্ছি, হ্যাঁ আমি আমার নিজেকে ভয় পাচ্ছি; আমি ভয় পাচ্ছি যে এক সময়ে হয়তো আমি আরও বড় ধরনের কোন দান হাতানোর তীব্র লোভ সম্বরণ করতে সক্ষম হবো না। কারণ কখনোই আমি সৎপথে উপার্জন করে আমার প্রতিশোধ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিশাল অংক সঞ্চয় করতে পারবো না। তোমার আমার দু’জনার মধ্যে, আমি আমার প্রতীক্ষার প্রহরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি।

[চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৮১৭ নভেম্বর ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।