ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জোহরা রাহমানকে নিয়ে কিছু স্মৃতি

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১১
জোহরা রাহমানকে নিয়ে কিছু স্মৃতি

নিউইয়র্ক থেকে কবি শহীদ কাদরীর সাথে প্রায়ই টেলিফোনে দীর্ঘ আড্ডা হয়। আমাদের আড্ডায় ঘুরে ফিরে আসেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার এবং আরো অনেকেই।

তিনি স্মৃতিচারণ করেন তাঁর সময়ের আর আমি করি আমার ফেলে আসা দিনগুলোর। তারপর দু’জনে মেলাতে চেষ্টা করি কিছু মেলে, কিছু মেলে না। গতকালও আমরা দীর্ঘক্ষণ নানান বিষয় নিয়ে কথা বললাম। শহীদ ভাই বললেন, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কিন্তু মানসিকভাবে খুবই সুস্থ-সবল। তাঁর বাসার কাছেই থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। শহীদ ভাই তাঁর জ্যামাইকাস্থ বাসায় প্রতি মাসে নির্বাচিত কবিদের ‘কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি’র আসর করছেন গত আগস্ট থেকে। সেই নিয়ে কথা বলেতে বলতে কবি শামসুর রাহমানের সহধর্মিনী জোহরা ভাবীর কথা উঠলো। জানতে চাইলেন তাঁর খবরাখবর।

বললাম, আমি একটা লেখা লিখছি ‘কানাডায় শামসুর রাহমান’। সে জন্য কয়েক মাস আগে ৯১১৬৩৫০ নম্বরে ফোন করতেই সেই চির চেনা কন্ঠ জোহরা রাহমান। ভেবে ছিলাম, টিয়াই ধরবেন; কিন্তু না ধরলেন জোহরা ভাবী। কত দিন পর ফোন করেছি, তবু তিনি চিনতে একটুও ভুল করেন নি। অভিযোগ- ‘তুমি আমার কথা ভুলে গেছো? তোমার ভাই নেই, তাই আর খোঁজ খবর নেও না!’ সত্যি খুব লজ্জা পেলাম।

তাঁদের ছোট মেয়ে শেবা থাকেন কানাডার অটোয়ায়। শেবার ফোন নম্বরটা দরকার। তিনি বললেন, দাঁড়াও টিয়াকে দেই, ওর কাছে আছে। আর শোনো, আমার খোঁজ খবর না নিলেও আমার মেয়ের খবর নিও। এটাই ছিলো তাঁর সাথে আমার শেষ কথা। আজ খুব ভোরে কথা হলো তাঁদের প্রিয় পুত্রবধূ টিয়ার সাথে। টিয়া তাঁর শ্বশুর এবং শাশুড়িকে যে সেবা দিয়েছেন আর শ্রদ্ধা করেছেন, তা এ যুগে বিরল ঘটনা। তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ পুত্রবধূ’ হিসেবে পদক দেওয়া উচিৎ। কোনো সংগঠন-সংস্থা তা ভাবতে পারেন, বিবেচনা করতে পারেন।

samsur rahman and jahora rahmanবাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে সকালেই নিউজটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। জোহরা ভাবী আর নেই! যখন এই লেখাটি লিখছি, ঠিক তখনই অনুজপ্রতিম কথাশিল্পী হামিদ কায়সার ফেসবুকে জানালেন, আরেক মন খারাপ করা খবর। ‘প্রেম একটি লাল গোলাপে’র কথাশিল্পী এবং রাহমান ভাইয়ের প্রিয় বন্ধু রশীদ করিম আর নেই!

স্মৃতির পেছনের আরো অনেক স্মৃতি থাকে। স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকে আরো নানান স্মৃতির শাখা-প্রশাখা। রাহমান ভাইয়ের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে রশীদ করিমের মধুর স্মৃতি, জোহরা ভাবির যৌথস্মৃতি। কি শান্ত, সাদামাটা, অমায়িক, আন্তরিক, উদার জোহরা রাহমান। তিনি কোনো কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু বড় মাপের এক কবির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন সারাক্ষন। আমি আর আমার স্ত্রী অপি একবার বেড়াতে গেছি তাঁদের বাসায়। ভাবী সাজগোজ করে চমৎকার শাড়ি পরেছেন, সেই সাথে ম্যাচিং করা চুড়ি। অপি জানতে চাইলো, ভাবী আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে! কোথাও বেড়াতে যাবেন? ভাবী বললেন, ‘না। কবি আমার সাজগোজ খুব পছন্দ করেন। তাই আমি ম্যাচিং করে শাড়ি পরার চেষ্টা করি’।

সাংবাদিকতার কারণে দুই বার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। একবার পাক্ষিক তারাকালোকে, তাও ২০/২২ বছর আগে। কবির ঘরোনী হিসাবে। একটি প্রশ্ন ছিলো- ‘রাহমান ভাই প্রতিনিয়ত প্রেমের কবিতা লিখছেন, প্রেম করছেন। এতে আপনার ঈর্ষা হয় না?’ জবাবে বলেছিলেন- তোমার ঈর্ষা হয় নাকি?

কবির জীবনে নারী নিয়ে ভাবীর কোনোই অভিযোগ ছিলো না। তখন অভিযোগ ছিলো- একটা ছোট্ট বাড়ির। জোহরা ভাবীর সেই স্বপ্নের বাড়িটি বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো- শ্যামলীতে।

পুরনো ঢাকার আওলাদ হোসেন লেন থেকে শুরু করে শ্যামলী পর্যন্ত তাঁর ভাবীর সাথেও দীর্ঘ ৩০/৩৫ বছরের ছায়াস্মৃতি। আজ পুরনো দিনের পারিবারিক সম্পর্কগুলোও মনে পড়ছে। আমার বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা আমার প্রথম মেয়ে অনাদির প্রথম জন্মদিনে দেখতে আসা অথবা কানাডা থেকে দেশে গেলেই জোহরা ভাবী নিজের মেয়ে শেবার কথা জানতে চাওয়া ইত্যাদি আর কোনো দিনই হবে না। আর কোনো দিনই বলবেন না, ‘আমার খোঁজ খবর না নিলেও আমার মেয়ের খবর নিও’।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ৬১৩-৭২৬-৯৯০৬ নম্বরে শেবার সাথে কথা হলো। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে তাঁর ঢাকায় যাবার কথা। তার আগেই চলে গেলেন জননী জোহরা। মা’কে মুখটা শেষবারের মতো দেখার মেয়ের আকুলতা আর পূরণ হলো না!

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১০২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।