ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কান্না

মাজহার খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১১
কান্না

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/galpo 120111123164857.jpgআমার স্ত্রী দীপা। কারণে অকারণে কান্নাকাটি করা তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

প্রথম প্রথম অবশ্য আমি খুব কষ্ট পেতাম এবং হৃদয় দিয়ে ব্যাপারগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন ওর কান্না দেখলে আমার হাসি পায়। আমাদের দেড় বছরের দাম্পত্য জীবনে কতবার সে অশ্রুসাগরে হাবুডুবু খেয়েছে সেকথা আমার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা আছে। খুব সম্ভব গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম ওঠাতে বছরখানেকের বেশি লাগার কথা নয়। প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা দিলে একটা বড় উপন্যাস হতে পারতো। ইচ্ছে আছে এ নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার। কিন্তু পাঠক শুধু কান্নাকাটির খপ্পরে পড়ে একঘেয়েমীর ফাপড়ে পড়তে পারে সেজন্য গল্প লিখতে বসেছি। আমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষও কোনদিন এক কলম লিখতে পারেনি। আমারও লিখতে গিয়ে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।

বাসর রাতের কথা থেকেই শুরু করি।
মধ্যরাত। সুনসান। গাঢ় অন্ধকারে পৃথিবীটা ঢেকে গেছে। এরই মাধ্যে বিচ্ছিণœ জনপদে অস্তিত্বময় দুটি প্রাণ নির্ঘুম মুখোমুখি বসা। ঘোমটার কোন বালাই নেই; লজ্জার কোন আবরণ নেই। সুন্দর দুটি চোখ, নিখুঁত কারুকার্যময় একটি মুখ, লাল শাড়িতে লেপ্টে থাকা কোমল শরীর, একগোছা চুড়ি, হাতে অস্পষ্ট মেহেদীর রং; সব মিলিয়ে আমার বুকে ঝড় তুলেছে সেই রূপ। চাওয়া পাওয়ার মাঝখানের দেয়াল ভেঙ্গে খানখান। তবে চোখের কোণা বেয়ে ঝর্ণাধারার মত প্রবাহিত হচ্ছে অশ্রুধারা। এতে বিস্মিত বা অভিভূত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনি। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন, নতুন আবহাওয়া, প্রিয় কিছু মানুষ থেকে দূরে থাকা; কান্না আসতেই পারে।

আমি চুপটি করে বসে স্ত্রীর কান্না উপভোগ করছি। মনের খেয়ালেই দীপার নরম হাত দুটি আলতো করে ছুয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কান্না আরও জোরে শব্দ পেল। খানিকটা ভয় পেয়ে তটস্থ হলাম। ভাবনায় পড়লাম; নববধূর মন পাওয়া বুঝি গেল না।
আমি নি®প্রাণ মূর্তির ন্যায় খানিকক্ষণ বসে থেকে মনে সাহস নিয়ে বললাম, তোমার কান্না বড়ই সুন্দর; আমি ধরিত্রীর বুকে এমন রূপ মাধুর্যময় কান্না আর কোথাও দেখিনি। উত্তর পাওয়ার প্রত্যাশা করে ব্যর্থ হলাম। কোন কথা তার মুখ দিয়ে বেরুলো না। হতাশ হয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই দীপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এই কান্নার কোন অর্থ বুঝলাম না। ভয়ে আবার বিছানায় বসে পড়লাম। বাকি রাতটা স্ত্রীর কান্না দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।

পরদিন সকালে সবাই নববধূকে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত। তখন সে পাকা রমণীর ন্যায় সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। রাতের কান্না এবং সকালের হাসির মধ্যে কোন মিল খুঁজে পেলাম না। আমার সাথে এই রসিকতার অর্থ কী।
সে কি ইচ্ছে করেই আমাকে বোকা বানানোর জন্য কয়েক টন অশ্রুপাত করেছে। নাকি এটাই নারীর ধর্ম, এটাই নারীর স্বভাব, এটাই নারীর চিরাচরিত রূপ।
সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে রাত। এরই মধ্যে একটা ছোট্ট রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হলাম। তা হলো, দীপা কান্নাকাটি করে লোকচক্ষুর আড়ালে। দুপুরে খাওয়ার পূর্বে একটু কান্না, খেয়ে এসে আর একটু কান্না। বিকেলেও ঠিক একই নিয়মে কান্না চলতে লাগলো। ভাবলাম দু’চার দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু অনুমান একেবারেই অমূলক। বরং স্ত্রীর সাথে মাঝে মাঝে আমাকেও কাঁদতে হয়।
এরই মাঝে আমাদের মনের মিল হয়ে গেছে। চাওয়া পাওয়ার দুয়ার খুলে গেছে। গতিময় পূর্ণতা পেয়েছে আমার জীবন।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/golpo_feb1020111123164907.jpgপরের দিন সকালে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে দীপার সে কী কান্না। কান্নার রহস্য উদঘাটন করতে রান্নাঘরে গিয়ে একটি আধমরা তেলাপোকা আবিষ্কার করলাম। নববধূকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না। তবুও বললাম,  পুরো বাসা ¯েপ্র করে দেবো। এই বাসায় কোন তেলাপোকা রাখবো না।
ঠিক তো।     
হ্যাঁ ঠিক। এই তেমার গা ছুয়ে কসম করলাম।
একটু পরে আবারও কান্নাকাটি শুরু হলো। তখন একটি অন্তঃসত্ত্বা টিকটিকি আবিষ্কার করলাম। এভাবে তেলাপোকা, টিকটিকি, মাকড়সা এমনকি মশার জন্যও দীপা তার কান্না চালিয়ে যেতে লাগলো।

পরের দিন আর এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। নতুন জামাই বাইরে বাইরে না ঘুরে নিজেকে বউয়ের আঁচলের নীচেই সমর্পণ করলাম। আমি আবার বৌ পাগল একটা ছেলে। এ নিয়ে বন্ধুমহলে বেশ খোঁশগল্প হয়। জামাইকে আপ্যায়নের জন্য মুরগি জবাই হলো। জানতে পারলাম মুরগিটি দীপা নিজে লালন পালন করেছে। এটা জবাই করার কারণে সে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আমার শাশুড়ি বিষয়টা গোপন করার চেষ্টা করলেও আমার কাছে তা গোপন রইলো না। দীপা ছুটে এসে আমাকে নালিশ করলো এবং আমার প্রতি নীতিমালা জারি করলো। যদি আমি ঐ মুরগির মাংস খাই তাহলে রাতে সে আমার সঙ্গে শুবে না আর বিছানায় পানি ঢেলে দেবে।
নববধূর অবুঝ আবদার আর অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করলাম। রাতে খাবার সময় কৌশলে মুরগির মাংস এড়িয়ে গেলাম। সেই থেকে আমার কপালে শ্বশুর বাড়িতে মুরগির মাংস জোটে না।
বৌয়ের কথা রেখেছি তাই একটু মিষ্টি হাসি প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তা না, রাতে শুরু হলো আবার কান্না।
ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে এই কান্নার শব্দ কারও কানে গেল না ঠিকই কিন্তু আমি শুধু  গো বেচারীর ন্যায় সেই কান্না মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে লাগলাম।

তারপর থেকেই প্লেট ভাঙ্গা, গ্লাস ভাঙ্গা, মেঘের গর্জন, কুকুরের ডাক, বিড়ালের মিউ মিউ শুনলেই দীপা কাঁদতে থাকে। এভাবেই কেটে গেল দেড় বছর। শড়ি, গহনা, কাপড়-চোপড়ের প্রতি ওর কোন লোভ বা আকর্ষণ খেয়াল করিনি। শুধুমাত্র প্রকৃতির জীব জন্তুর জন্য যার মন কাঁদে সে কতটা বড় মাপের কাঁদুনে মেয়ে সে হিসেব পরিমাপ করা মুশকিল।
তবে ইদানিং আমারও কান্না রোগে পেয়ে বসেছে। বৌয়ের কান্না না দেখলে রাতে ভাল ঘুম হয় না; দিনে খেতে পারি না; অফিসে বোরিং লাগে। দীপা প্রতিদিন এভাবে কাঁদুক। কান্নাময় সুখের হয়ে উঠুক ওর জীবন; সেই সাথে আমারও। হে ঈশ্বর আমার স্ত্রীর চোখর পানি যেন ফুরিয়ে না যায় । তাহলে আমার মরণ! আমিন।

বাংলাদেশ সময় ১৬৪০, নভেম্বর ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।