ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব--৮]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব--৮]

ব্যানকো [পর্ব-৭], [পর্ব-৬], [পর্ব-৫], [পর্ব-৪], [পর্ব-৩], [পর্ব-২], [পর্ব-১]

বাজি, আর বাজির পর বাজি পুরোদমে চললো। প্রতিবার জোজো ডাইস ঘুড়ালো আর আমি স্টেক কাভার করে গেলাম।

দু’একবার ছাড়া বারবার জোজো ডাবল থ্রি দিয়ে দান তুলছিল...ডাবল ফাইভ দিয়ে দশ তুলছিল বারবার...

 

উত্তেজনায় সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবারই ওদের একজন হাতের কাপ উঁচু করে ধরছিল আর একটা বছর এগারোর বাচ্চা ছেলে তা ভরে দিচ্ছিল। আমি জোজোকে বলেছি রাম আর সিগার যোগান দেয়ার কাজটা যাতে মিগুয়েলকে দেয়া হয়।

 

খুব শিগগিরই খেলা উত্তেজনার শিখরে স্পর্শ করলো। তার অনুমতি না নিয়েই আমি খেলার কৌশল পরিবর্তন করলাম। আমি শুধু তার উপরই না অন্যদের উপরও দান লাগাতে লাগলাম, এতে জোজোর চেহারায় তিক্ততা ফুটে উঠলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে ক্ষোভের সাথে ফিসফিসিয়ে উঠলো, ‘বন্ধুবর এসব রাখ বাবা, এভাবে ডাইল পাতলা করে দিও না। ’ সকাল চারটার মধ্যে আমার কাছে একটা ছোটখাট তুজ জমা হয়ে গেল-- বলিভার, ক্রুজেইরো, আমেরিকান আর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ডলার, হীরা এমনকি ছোটখাট স্বর্ণের কিছু টুকরোসহ।

জোজো, ডাইস হাতে নিল। সে পাঁচশ’ বলিভারের স্টেকে গেল। আমি হেরে গেলাম।

এবং জোজো সেভেন তুললো।

 

দুই হাজার বলিভার বানিয়ে আমি ছেড়ে দিলাম। জোজো তার জেতা পাঁচশ’ নিয়ে নিল। এবং আবারো সেভেন তুললো। সে তার স্টেক টেনে নিল। এবং আবারো সাত!

‘এনরিক, তুমি কি করতে যাচ্ছো? চিনো জিজ্ঞেস করলো।

‘আমি চার হাজার ছাড়ছি। ’

‘একাই বাজি। ’ যে এইমাত্র কথাটা বললো, আমি তার দিকে তাকালাম। খাটো মটকু ধরনের এক লোক। জুতোর কালির মত কালো, চোখ দুটো অত্যাধিক মদ্যপানের দরুন টকটকে লাল হয়ে আছে। নিশ্চিত বেটা ব্রাজিলীয়।

‘তোমার চার হাজার বেলোস ফেল। ’

‘এই পাথরটার দাম চার হাজারের চেয়ে বেশি। সে কম্বলে একটা হীরা ফেললো, ঠিক তার সামনে। গোলাপী হাফপ্যান্ট পরে সে সেখানে হাঁটুর উপরে দাঁড়িয়ে আছে। চীনে বুড়ো হীরাটা তুলে পাল্লায় রেখে মেপে বললো, ‘এটার দাম সাড়ে তিন। ’

‘ওকে সাড়ে তিনই সই,’ ব্রাজিলিয়ান বললো।

‘ছাড়ো, জোজো। ’

জোজো ডাইস ছাড়লো, কিন্তু ঘোরা শুরু করতেই ব্রাজিলীয়ান ওগুলো খপ করে মুঠোতে তুলে নিল। কি ঘটতে যাচ্ছে ভেবে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। সে মরিয়া হয়ে ওগুলো দেখতে লাগলো, কিন্তু থুতু ছিটিয়ে ওগুলো আবার জোজোকে ফেরত দিল। ‘এভাবে ভেজা অবস্থায়ই ওগুলো ছাড়ো; সে বললো।

জোজো বাম হাত দিয়ে গভীর ভাবে কম্বলের ভাজটা দাবিয়ে দিল। এবং থুতুতে ভেজা অবস্থায়ই সে ডাইস ঘোরালো। একটি দীর্ঘ, দীর্ঘতর ঘূর্ণন। এবং আবারো সেই সাত!

যেন ভিতরের কোন টানা স্প্রিং হঠাৎই ছুটে গেছে, ঠিক সেভাবেই ব্রাজিলিয়ানটি ওর পায়ের ওপর লাফিয়ে উঠলো, হাত পিস্তলে চলে গেছে। এরপরই শান্তস্বরে বললো, ‘এখনো আমার রাত আসেনি। ’ এবং সে বের হয়ে চলে গেল।

যে মুহূর্তে ও স্প্রিংয়ের মত নেচে উঠেছিল আমার হাতও নিজের পিস্তলের উপরে চলে গিয়েছিল। জোজো বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করেনি বা আত্মরক্ষার জন্যে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি ওর মধ্যে। আতংকের ব্যাপার হল কাল্লুটা জোজোর দিকেই লক্ষ্যস্থির করেছিল। আমি দেখলাম যে ড্র করা এবং গুলি করার নিশ্চিত সময়টি আত্মস্থ করার আগে আমাকে আরও অনেক শিখতে হবে।

 

সূর্যোদয়ের সময়ে আমরা থামলাম। মরা ঘাসের ধোয়া বা সিগার অথবা সিগারেটের ধোয়ায় আমার চোখ এতই জলছিল যে দরদর করে পানি পড়া শুরু করলো। দর্জির মত দীর্ঘ নয় ঘণ্টা টানা একই অবস্থায় বসে থাকার ফলে আমার পা দুটো জমে পুরো অসার হয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যেও একটি ব্যাপার আমাকে আত্মতুষ্টি দিল: আমাকে এই দীর্ঘ সময়ে একবারের জন্যও প্রস্রাবের বেগের জন্য উঠতে হয়নি, এবং এর অর্থ হলো আমি স্নায়বিক দিক থেকে এবং আত্মরক্ষার প্রশ্নে সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণে আছি।

 

আমরা অপরাহ্ন দু’টা পর্যন্ত টানা ঘুমালাম। যখন আমি উঠলাম, জোজোকে ঘরে দেখলাম না। প্যান্ট পরলাম, কিন্তু পকেট ফাঁকা। ‘ধুস শালা! নিশ্চিত জোজো সব কিছু সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমরা তো এখনো আমাদের হিসাব মিলাইনি, তার তো এরকম করা উচিত হয়নি। সে নিজে নিজে খুব বেশি মাতব্বরী ফলাচ্ছে-- সবখানেই আমার উপর মাতব্বরী করছে, এবং এটা বেশ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমি কখনোই কোন অবস্থাতেই কারো ‘বস’ ছিলাম না এবং নিজেও কারো বস হতে যাইনি, কিন্তু আমি আবার সেরকম লোকাদেরও সহ্য করতে পারি না

 

যারা নিজেদেরকে সবক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠতর ভাবে-- ভাবে, যে কোনো ব্যাপারে তারাই সর্বেসর্বা। আমি ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম এবং মিগুয়েলের ওখানে জোজোকে খুঁজে পেলাম, ম্যাকারনি এবং মাইন্স দিয়ে খাওয়া সারছে। “কি ব্যাপার, দোস্ত?”

‘হ্যাঁ এবং না। ’

‘কী আশ্চর্য , না?’

‘কারণ আমার অগোচরে আমার পকেট সাফ করে দেয়াটা তোমার কোন মতেই উচিৎ হয়নি। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/gambling1120111116172356.jpg‘বাজে বকো না, বৎস। এসব নিয়ম-কানুন আমার জানা আছে। আর কেন আমি একাজ করেছি তার কারণ হল এসব ব্যাপারে পারষ্পরিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলছি, তুমি কি খেয়াল করনি যে খেলার সময়ে তুমি হীরক বা টাকাগুলি তোমার পকেটে ছাড়াও অন্য যে কোন জায়গায় রাখতে পারতে ভাল মতই, নাকি? তারপর, তুমি ঠিক জানও না যে আমি কত টাকা জিতেছি। সুতরাং আমরা উভয়েই যদি একে অন্যের পকেট খালি করি বা না করি, বিষয়টায় কোন ফারাক নেই। পুরোটাই আসলে আস্থার ব্যাপার। ’

 

যুক্তি তার ঠিকই আছে। এখন আর এ ব্যাপারটা বাড়তে দেওয়া উচিৎ হবে না। জোজো মিগুয়েলকে গত রতের রাম আর তামাকের পয়সা মিটিয়ে দিল।

ওদিকে রাতের পর রাত এই ধারায় আমাদের ডেরায় জুয়াবাজি চলতে থাকলো। আমরা এখানে এসেছি দু’সপ্তাহ হয়ে গেছে, দুইটি সপ্তাহ, যার প্রতিটি রাত আমরা উঁচু দরের এবং উত্তেজনাকর উন্মত্ততায় খেলা চালিয়ে গেছি, ডাইস এবং জীবন-- দুটো নিয়েই জুয়ায় মত্ত হয়েছি।

গতরাতে মুষলধারে এক জঘন্য বৃষ্টি হয়। দোয়াতের কালির মত নিকষ কালো এই রাতে মোটামুটি ভাল দান জেতার পর একজন উঠে দাঁড়ালো। সে বের হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন দশাসই লোক ও তার পেছন পেছন বেড়িয়ে গেল। যে এতক্ষণ খেলায় কোন অংশই নেয়নি টাকার অভাবে। অল্প কিছুক্ষণ সে বসেছিল এখানে। বিশ মিনিট পর এই আপাত ভাগ্যহীন লোকটি ফিরে এসে প্রচ- উৎসাহে খেলা শুরু করলো। আমি ভাবলাম জিতে যাওয়া লোকটি নিশ্চয়ই তাকে টাকা ধার দিয়েছে। তারপরও ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগছিলো যে লোকটা ধার তাকে খুব বেশি পরিমাণেই দিয়েছে মনে হচ্ছে। দিনের আলো ফুটতেই দেখা গেল সেই বিজয়ী জুয়াড়িটি মরে পড়ে আছে। আমাদের ঘর থেকে পনের গজেরও কম দূরত্বে তার ছুরি খাওয়া দেহ পড়ে আছে। আমি জোজোর সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলাম, জানালাম কী ভাবছি।

‘আমাদের করার কিছুই নেই এক্ষেত্রে,’ সে বললো। ‘এরপর থেকে সে সজাগ হবে। ’

‘তুমি একটা বুদ্ধু, জোজো। তার জন্য আর “এরপর”টা ফিরে আসবে না কখনো, যেহেতু সে মারা গেছে। ’

‘পুরোপুরি সত্য। কিন্তু এখানে আমরা কী করতে পারি?’

অবশ্যই সত্য। তবে আমি এখানে মারিয়ার বাবা জোসের দেওয়া উপদেশ অনুসরণ করছিলাম। প্রতিদিন আমি আমার কামানো বিদেশি নোট, হীরক আর স্বর্ণগুলো একজন লেবানিজ ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছলাম। সে সিঁউদাদ বলিভারে একটা জুয়েলারি শপের মালিক। তার কুঁড়ের দরোজার ওপরে একটা সাইনবোর্ড  ঝোলানো আছ, ‘স্বর্ণ এবং হীরক ক্রয় করা হয় এখানে: সর্বোচ্চ মূল্য প্রদান করা হয়। ’ এবং এর নিচ দিয়েই লেখা ‘সততাই আমার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ। ’

 

আমার ফরমায়েশ অনুযায়ী সুবিধামত জায়গায় ভাঙানো যায় এমনভাবে তৈরি করা ক্রেডিট নোটগুলো অন্য কেউ ভাঙাতে পারবে না, তেমনি অন্য কোন নামে বদলানোও যাবে না। ইতিমধ্যে গ্রামের সব ঘুঘুই জেনে গেছে আমি কি করছি, তারপরও যদি কোন শর্মা যাকে দেখে অস্বস্তির কারণ হয়েছে অথবা এমন কেউ যে ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশ বলতে পারে না, তাদেরকে কৌশলে আমি স্বচক্ষে এগুলো দেখিয়ে দিয়েছি-- অর্থাৎ এগুলো হাতিয়ে কোন ফায়দা হবে না। সুতরাং এখানে আমার একমাত্র বিপদের সময়টা ছিল খেলাকালীন এবং যখন খেলা শেষ হতো। মঝেমধ্যে খেলাশেষে ওই ভালোমানুষ মিগুয়েল এসে আমাকে ওর সঙ্গে করে নিয়ে যেত।   

গত দু’দিন যাবৎ আমি অনুভব করছি যে এখানকার পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অধিকতর অবিশ্বস্ত অবস্থা। আমি পেনাল-এ এই আগাম অনুভূতির শিক্ষা অর্জন করেছি, দ্বীপের বন্দিদশায় যখন আমাদের ব্যারাকে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হতে যেত, কারও কাছ থেকে আগাম কিছু না জানা সত্ত্বেও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি তা জানান দিত। কিছু একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে চলেছে। যখন মানুষ সতর্কাবস্থায় থাকে, তখন আশপাশের যেসব লোক ঝামেলা পাকানোর জন্য ঘোট পাকাতে থাকে, তাদের বিভিন্ন আচরণে সে সম্পর্কিত ইশারা-ইঙ্গিত চিহ্ন ফুটে ওঠে সেগুলো কি আমরা সহজেই এড়াতে পারি? আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমার হিসাব-নিকাশ কখনো ভুল হয়নি।

 

যেমন, গতকাল রাত্রে খেলার সময়ে চারজন ব্রাজিলীয় আমাদের ঘরের চার কোনায় অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। মাঝেমধ্যে ওদের মধ্য থেকে একজন আলোয় বেড়িয়ে এসে কম্বলের ওপর নগণ্য পরিমাণে বাজির জন্য টাকা ফেলে যেত। তারা একবারও নিজেরা আগ্রহ ভরে ডাইস হাতে তুলেনি বা কারো কাছে চায়ওনি। আরেকটা ব্যাপার, তাদের কারো কাছে অস্ত্র আছে কী না বোঝা যাচ্ছিল না। কোন ম্যাশেটে, সাধারণ ছোরাও বা পিস্তল? ব্যাপারটা উদ্দেশ্যমূলক, এতে কোন সন্দেহ নেই।

 

আজ সন্ধ্যায়ও তারা এলো। প্যান্টের ওপরে শার্ট ছেড়ে দেয়া আছে প্রত্যেকের, ‘ইন’ করেনি। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে শার্টের নিচে কোমরে প্রত্যেকেরই অস্ত্র আছে। আজও অন্যান্য দিনের মতই অন্ধকারের ছায়ায় যার যার অবস্থান নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তবুও আমি তাদের ঠিকই দেখছিলাম। খেলোয়াড়দের প্রতিটি নড়াচড়া নিরীক্ষণ করছে তাদের চোখ। অন্যদিকে তাদের অজ্ঞাতসারেই তাদের ওপর আমারও নজর রাখতে হচ্ছিল, অর্থাৎ সরাসরি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কাশি দেওয়া এবং পেছনে এলিয়ে পড়ে নড়াচড়ার মাধ্যমে, মুখের সামনে কখনো হাত তুলে নজর রাখার ব্যাপারটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সামনের দিকে মাত্র দু’জনকে দেখতে পাচ্ছি। অন্য দু’জন আমার পেছনে। এবং আমি শুধুমাত্র নাক ঝাড়ার উছিলায় পেছন ঘুরে এক ঝলক মাত্র নজর বুলাতে পারছিলাম ওদের ওপর।

 

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011November/gamling w20111116172827.jpgজোজোর শীতলতাটা একটা অদ্ভুদ ব্যাপার। সে আগের মতই সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ আর নিশ্চিত রয়েছে। এর মধ্যেই, সে মাঝে মধ্যেই অন্যদের চালেও বাজী ধরে যাচ্ছিল, যার অর্থ সুযোগের সামান্যতম হেরফেরে জেতা বা হারা। নিশ্চিত ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে। আমি জানি যে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ খেলা খেলতে খেলতে জোজো উম্মাদনার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, এবং এটার ফলে তাকে একই জেতা টাকা বারবার জিততে হচ্ছিল। কারণ সে যেমন জিতছে তেমনি অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে হারছিলও। জেতার পরে সেই জিতটাকে স্থায়ী করার জন্য সে কৌশলি হচ্ছে না। ফলস্বরূপ মূল অসুবিধাটা হচ্ছিল যে খেলা যখন উত্তেজনার চরম শিখরে পৌঁছালো তখন সে জেতার জন্যে মাত্রাতিরিক্ত মরিয়া হয়ে উঠলো। আর এরই ফলশ্রুতিতে সে আমাকে খুব দ্রুত বড় বড় দান জিতিয়ে দিচ্ছিল।

যেহেতু আমি বুঝতে পারছিলাম যে ওই লোকগুলো আমার ওপর নাজর রাখছে, আমি আমার অর্থকড়ির স্তুপটা সামনে ঠেলে এগিয়ে রাখলাম, যাতে সবাই দেখতে পায়। আমি নিজেকে জ্যান্ত একটা সিন্দুক হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছি না, অন্তত আজকের জন্য।

এক ফাঁকে কায়দা করে কয়েদীদের মাঝে প্রচলিত স্ল্যাং ভাষায় ওকে সতর্ক করলাম যে আমাকে খুব তাড়াহুড়ো করে দানগুলো জেতানো ঠিক হচ্ছে না। জবাবে সেএমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমার কথা সে বুঝতে পারছে না।

 

গতকাল আমি এখানে জোসের কথামত শৌচাগারে যাওয়ার কৌশলটা খাটিয়েছিলাম এবং বাথরুমের কথা বলে টাকাপয়সা নিয়ে চলে যাওয়ার পর আর ফিরে আসিনি খেলায়। এ পরিস্থিতিতে আজও একই কায়দা করতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না--  যদি এই চারমূর্তি আজই কাজ সেরে ফেলতে চেয়ে থাকে, তারা আমার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষায় থাকবে না। আমাদের ঝুপড়ি আর পায়খানার মাঝামাঝি জায়গায়ই খালাস করে দেবে আমাকে।

 

তাই সেই চিন্তা বাদ দিয়ে শান্তভাবে বসলাম। কিন্তু আমার সবগুলো ইন্দ্রিয় সজাগ রয়েছে। ঘাড়ের পেছনের শিরশিরে অনুভূতি জানান দিচ্ছে সেখানে দুই জোড়া চোখ অদৃশ্য গর্ত খুঁড়ে চলেছে। উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে। আমি ভয়ংকরভাবে এটা অনুভব করছিলাম। এক পর্যায়ে খুবই স্বাভাবিক গলায়, এমনভাবে নয় যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করছি, জোজোকে ফরাসিতে বললাম-- আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে বাতাসে বিপদের গন্ধ ভাসছে, আমি এর ঘ্রাণ পাচ্ছি। ইশারা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সাথে উঠে দাঁড়াবে। দুজনে এক সঙ্গে পিস্তল বের করে আমাদের ভাগ্যকে কাভার করতে হবে। এছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।

 

এ কথায় জোজা এমনভাবে হেসে উঠলো যেন আমি মজাদার কিছু বলেছি। সে আমার কথায় পাত্তা তো দিলই না এমনকি উপস্থিত অন্য আরো যারা ফ্রেঞ্চ জানত তাদের কথাও আমলে আনলো না। তাচ্ছিল্য ভরে সে বলে ফেলল, প্রিয় মাধব, কোন আক্কেলে তুমি এমন রাম-ছাগুলে আচরণ করছো? আর ঠিক ঠিক কাকে কাভার করতে চাইছো, বল তো দেখি?

 

হক কথা। কাকে কাভার করব? আর এ কাজ করতে গিয়ে এর পক্ষে কি ব্যাখ্যা দেব সবার কাছে? তথাপি আমার ভেতরকার অস্বস্তির বেলুনটা ওপর দিকে উঠতেই আছে। ওদিকে অনবরত ধূমপান করতে থাকা লোকটি পর পর দু’কাপ রাম নিল এবং সে তরলগুলো একেক ঢোকে গলায় ঢেলেছে। এই পীচ কালো অন্ধকারে একা একা বাইরে বেড়িয়ে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এমন কি পিস্তল হাতেও। কারণ বাইরে অপেক্ষমান ঘাতকেরা আমাকে সহজেই দেখতে পাবে অথচ আমি তাদেরকে দেখবো না। পাশের রুমে গিয়ে ঢুকবো? তথৈবচ। দশের মধ্যে নয়ভাগ সম্ভাবনা যে ওখানে সোনার ছেলেদের একজন আগে থেকেই ওঁৎ পেতে রয়েছে।

 

করার মত উপায় একটাই আছে আর তা হল, আমার জেতা মাল সবাইকে দেখিয়ে ক্যানভাস ব্যাগে ভরে আমি যেখানে বসে আছি সেখানেই রেখে প্রস্রাব করার উসিলায় বাইরে যাওয়া। সেক্ষেত্রে ভেতরের চান্দুরা বাইরের স্যাঙ্গাতদের কোন সিগন্যাল দেবে না। কারণ টাকা-পয়সা, সোনা-হীরা সব তো আমি এখানেই রেখে যাচ্ছি। আমার জিম্মায় এখন পাঁচ হাজারেরও বেশি বোলোস আছে। বেমক্কা জানটা খোয়ানোর চেয়ে ওগুলো হারানো অনেক শ্রেয়।

স্বাভাবিকভাবেই আমি যা করার খুব দ্রুত করলাম। এখন পাঁচটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। টাকা, হীরা, অ্যাসপিরিন টিউব এবং আর যা ছিল সমস্ত কিছু জড়ো করলাম, সবাই আমাকে দেখছে। আমি ধীরেসুস্থে এই ছোট্ট ঐশ্বর্য্য ভাণ্ডারকে ব্যাগে ভরলাম। যত সহজ-স্বাভাবিকভাবে সম্ভব ব্যাগের মুখের দড়ি টাইট দিলাম। আমার থেকে এক ফুট দূরে ব্যাগটা রাখলাম এবং সবাই যাতে বুঝতে পারে তাই স্প্যানিশে বললাম, জোজো ব্যাগটার দিকে নজর রেখ। আমি অসুস্থ বোধ করছি, তাই একটু তাজা হাওয়া টানার জন্য বাইরে যাচ্ছি।

 

জোজো আমার সমস্ত কর্মকা- খেয়াল করছিল। এবার হাত বাড়িয়ে বলল, আমার কাছে দাও এটা। অন্য যে কোন স্থানের চেয়ে আমার জিম্মায় এটা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তায় থাকবে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি তার অনুরোধ রক্ষা করলাম। বুঝতে পারছিলাম নিজেকে আরো বিপদের মুখে ফেলছে ও, অবশ্যম্ভাবী বিপদ। কিন্তু এ অবস্থায় আমিই বা আর কী করতে পারি? ব্যাগটা ওর কাছে দিতে অস্বীকার করবো? অসম্ভব! এটা খুবই অভব্য আচরণ হয়ে যাবে।

 

বাইরে বেড়িয়ে এলাম, হাত পিস্তলে। অন্ধকারে কাউকেই দেখতে পেলাম না। কিন্তু তেনারা যে নিশ্চতই অকুস্থলে আছেন সেটা বোঝার জন্য তাদেরকে চাক্ষুষ দেখার প্রয়োজন নেই। তাড়াতাড়ি, অনেকটা দৌড়ে আমি মিগুয়েলের ওখানে ছুট লাগালাম। একটা ছোট সম্ভাবনা আছে যদি মিগুয়েলকে সঙ্গে করে একটা বড় কার্বাইড ল্যাম্পসহ আসতে পারি, তাহলে হয়তোবা দুর্ঘটনাটা এড়ানো যায়। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তার ঘর আমাদের এখান থেকে দু’শ গজেরও দূরে। আমি পুরোদস্তুর দৌড় শুরু করলাম।

‘মিগুয়েল! মিগুয়েল!’

: হয়েছেটা কি?

 

তাড়াতাড়ি ওঠ! তোমার পিস্তল আর ল্যাম্পটা নাও। ঝামেলা দেখা দিয়েছে।

ওদিকে আলকাতরা কালো রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ‘ব্যাং ব্যাং’ দু’টো শব্দ হলো।

আমি ঝড়ের বেগে দৌড়ে চললাম নিজেদের ডেরায়। কিন্তু ঢুকেই অপমান হতে হলো প্রাইভেসি নষ্টের জন্য---  তাড়াহুড়োয় অন্যের ঘরে ঢুকে পড়েছি। তবে অপমান করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মালিকরা গুলির কারণটা জিজ্ঞেস করতে ভুললো না। উত্তর দেওয়ার সময় নেই! আবার দৌড় লাগালাম। এবার আমাদের কুঁড়েটা খুঁজে পেলাম। লাইটার জ্বালালাম। গুলির শব্দ শুনে লোকজন আলো নিয়ে ছুটে আসছে। ঘরে কেউ নেই। শুধু জোজো মাটিতে পড়ে আছে, ওর গলার পেছন থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। মারা যায়নি, তবে কোমায় আছে। ঘাতকদল একটা ইলেক্ট্রিক টর্চ ফেলে গেছে। যা দেখে বোঝা যাচ্ছে ঠিক কি ঘটেছিল। প্রথমে তারা কার্বাইড ল্যাম্পাকে গুলি করে নেভায় এবং একই সময়ে জোজোকে আঘাত করা হয়। ওদিকে টর্চ জ্বেলে জোজোর সামনে পড়ে থাকা জুয়োয় জেতা ওর সম্পদের স্তুপ আর আমার ব্যাগ তুলে নেয়। ওর শার্টটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এবং কোমরে যে ক্যানভাসের একটা ব্যাগ আটকানো ছিল তাও ছোরা বা ম্যাশেটে দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে।

 

স্বাভাবিক কারণেই সমস্ত জুয়াড়ী কেটে পড়েছে। দ্বিতীয় গুলিটা করা হয়েছিল তাদেরকে ভয় দেখিয়ে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দেওয়ার জন্য। যাহোক, আমি যখন এখান থেকে বের হই তখন লোকজন খুব একটা বেশি ছিল না। বসা ছিল আট জন আর দাঁড়ানো দু’জন। এছাড়া চার মূর্তি চার কোণায় যথারীতি দাঁড়ানো ছিল, আর ছিল রাম ঢেলে দেওয়া ছেলেটি।

 

সবাই তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। জোজোকে মিগুয়েলের ঘরে নিয়ে এসে ডালপালা দিয়ে তৈরি একটি বিছানায় শোওয়ানো হলো। সারা সকাল কোমায় রইলো সে। ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বেঁধেছে, এখন আর রক্তপাত হচ্ছে না। একজন ইংরেজ মাইনার জানালো এটা যেমন একটা শুভ লক্ষণ তেমনি আবার খারাপও। কারণ যদি খুলি ফেটে গিয়ে থাকে তাহলে রক্তের ধারা মাথার ভিতরে ঢুকে যাবে। আমি ঠিক করলাম এ অবস্থায় ওকে নড়াবো না। জোজোর পুরনো বন্ধু এল ক্যালাওয়ের এক মাইনার পাশের খনিতে ছুট লাগালো তথাকথিত একজন ডাক্তারের খোঁজে।

 

এদিকে ঘটনার সূত্রধর হয়ে গেলাম আমি। মুস্তাফা আর মিগুয়েলকে পুরো ব্যাপারটা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। তারা দু’জনই আমাকে এই বলে সান্তনা দিল যে, যেহেতু আমার ধারণা যে পুরো ব্যাপারটাই পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল আর যেহেতু আমি জোজোকে পরিষ্কারভাবে সতর্ক করে দিয়েছি, সুতরাং তার উচিৎ ছিল আমার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা।

 

বিকাল প্রায় তিনটার দিকে জোজো চোখ খুলল। আমরা তাকে ক’ফোটা রাম গেলালাম এবং অতি কষ্টে, ফিসফিসিয়ে কয়েকটি শব্দে সে বলল, ‘আমার খেল খতম হয়ে এসেছে, বন্ধু। আমি এটা বুঝতে পারছি। আমাকে নড়াচড়া করিয়ো না। তোমার কোন অপরাধ ছিল না, প্যাপি, দোষ আমারই। ’ একটু থেমে সে আবার বলা শুরু করল, ‘মিগুয়েল, তোমার শূকরের খোঁয়াড়ের পিছনে মাটিতে পোঁতা একটি পাত্র আছে। একচোখা লোকটিকে দিয়ে এটি আমার স্ত্রী লোলার কছে পাঠিয়ে দিও। ’ এরপর আর মিনিট কয়েক তার চৈতন্য ছিল। সে আবার কোমায় চলে গেল এবং সূর্যাস্তের সময়ে মারা গেল।

 

ডোনা কার্মেনসিটা, প্রথম পানশালার মোটকু টাইপ মহিলাটি এলো, জোজোকে দেখতে। সে কিছু ডায়মন্ড আর তিন চারটা নোট নিয়ে এসেছে। এগুলো সে সকাল বেলা আমাদের ঘরের মেঝে থেকে পেয়েছে। আশ্চর্য বিষয়, শত শত লোক সেখানে যাওয়া আসা করেছে, অথচ ওই টাকা বা হীরাগুলো কেউ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি।

 

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এখানকার ছোটখাটো জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই উপস্থিত হল। ওই চার ব্রাজিলিয়ও এসেছে। এখনো ট্রাউজারের ওপরে ছেড়ে দেওয়া শার্ট পড়ে আছে। তাদের একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ব্যাপারটা দেখিনি ভান করে তার পেটে ইয়ার্কির ছলে একটা চাপড় লাগালাম। হ্যাঁ, আমার ধারণা সঠিক। পিস্তলটি জায়গা মতই আছে, যেখানটায় ঠিক অনুমান করেছিলাম।

 

আমার কি তাদের মোকাবেলা করা উচিৎ, এটা ভেবে কিছুটা অস্থিরতা বোধ করলাম। এখনি? না পরে? আর করবোটা-ই বা কী? কিছুই না। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

 

এখন আমি একটু একা হতে চাইছিলাম। কিন্তু এখানকার রীতি হচ্ছে কাউকে মাটি দেওয়ার পর মৃতের কাছের লোকজন এলাকার দোকান আর পানশালার যেসব মালিকরা দাফনে এসেছিল তাদের প্রত্যেকের ওখানে গিয়ে কিছু পান করবে। তারা সবাই এসেছিল।

 

ডোনার দোকানে আসতেই সে আমার পাশে এসে বসল, হাতে অ্যানিসপূর্ণ একটি গ্লাস ধরা। আমি যখন নিজের গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়াতে যাচ্ছিলাম, সেও নিজেরটা তুলল, কিন্তু পান করার জন্য না। আমার সঙ্গে কথা বলছে এটা গোপন করার প্রয়োজনে। ‘তোমার জায়গায় সে খর্চা হয়েছে, এটা ভালই হয়েছে’ ফিসফিসিয়ে বললো। ‘এখন তুমি যে কোনো স্থানে যেতে পারো নিশ্চিন্ত মনে। ’

: নিশ্চিন্ত মনে বলতে তুমি কী বোঝাতো চাইছো?

‘কারণ এটা সবাই জানে যে তুমি তোমার জেতা সবকিছু লেবানিজটার কাছে বিক্রি করে দিতে। ’

: হ্যাঁ, কিন্তু যদি লেবাননিটাও খুন হয়ে যায়!

‘তা ঠিক। আরো একটি সমস্যা বটে। ’

 

ড্রিংকসের পয়সা আমার নামে যাবে জানিয়ে বন্ধুদের সেখানে রেখেই বেড়িয়ে এলাম। ঠিক জানি না কি কারণে, আমি কবরস্থানে যাওয়ার রাস্তাটাই ধরলাম। জায়গাটা পঞ্চাশ বর্গ গজের পরিষ্কার করা একটা জমি।

 

কবরখানায় আটটা কবর, জোজোরটা সবচে’ নতুন। ওটার সামনে মুস্তাফা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে গেলাম। কি করছো তুমি, মুস্তাফা?

‘আমি একজন পুরনো বন্ধুর জন্য প্রার্থনা করতে এসেছি। আমি তার ভক্ত ছিলাম--- এবং তাকে একটা ক্রুশ নিবেদন করতে এসেছি। তুমি দিতে ভুলে গিয়েছিলে। ’

: ছিঃ ছিঃ, আমি তাই করেছি! ভাবিইনি এটার কথা। আমি এই ভালোমানুষ আরব বৃদ্ধটির সঙ্গে করমর্দন করে তার সাধুকর্মের জন্য ধন্যবাদ জানালাম।

‘তুমি কি খৃস্টান নও?’ সে জিজ্ঞেস করল। ‘যখন কবরে মাটি দেওয়া হচ্ছিল তখন তোমাকে প্রার্থনা করতে দেখিনি। ’

: তা বটে, আমার মতে...ঈশ্বর অবশ্যই একজন আছেন, মুস্তাফা...’ওকে সন্তুষ্ট করার জন্য বললাম আমি। আর তারচেয়েও বড় কথা আমি ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, জোজোর জায়গায় কবরে আমাকে নামানোর বদলে হেফাজত করার জন্য। আর আমি এই বুড়ো লোকটির জন্য প্রার্থনার চেয়েও বেশি কিছু করেছি, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। বেলেভাইলের বস্তি থেকে উঠে আসা ছোট্ট গোবেচারা এক বালক ছিল সে, এবং সে শুধুমাত্র একটা কাজেরই উপযুক্ত ছিলÑ ডাইসের দান জেতা।

‘কি সব বলছ তুমি, ভাই? আমি বুঝতে পারছি না!’

: কোন অসুবিধা নেই এতে। কিন্তু শুধু এটা স্মরণ রেখ, সে মারা গেছে এজন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি তাকে বাঁচাতে চেষ্টাও করেছি। কিন্তু কারও এটা কখনোই ভাবা উচিৎ না যে অন্য সবার চেয়ে সে নিজে চৌকষ লোক, কারণ একদিন সবাই দেখতে পায় কোন একজনকে যে তার চেয়েও চালু-- এটাই প্রকৃতির বিধান। এখানে জোজো ভালই আছে। সে যা কিছু ভালোবাসত তাদেরকে সঙ্গে করে সে এখানে চিরনিদ্রায় রত থাকবে, অভিযান আর বিস্তীর্ণ বনভূমি; এবং ঈশ্বরের ক্ষমায় সিক্ত হয়ে সে নিদ্রা যাবে।

‘হ্যাঁ, ঈশ্বর অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেবেন, কারণ সে একজন ভাল মানুষ ছিল। ’

: তা ঠিক।

 

আমি ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে ফিরে এলাম। এটা সত্য যে জোজোর ওপরে আমার তিক্ততা ছিল না। যদিও সে আমাকে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। তার মনোবল, প্রচণ্ড প্রাণশক্তি এবং ষাট বছরের বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সদা সজীব তারুণ্য আর অপরাধ জগৎ সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত মূল্যায়ন-- সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

আর এসবের বাইরে আমাকে এ ধরনের পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল মারিয়ার বাবা জোসে। জোসেকে তার সৎ পরামর্শের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট্ট একটা পত্র পাঠিয়েছি। সে না থাকলে আজ আমাকে আর দু’পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।

 

হ্যামকে শুয়ে ধীর লয়ে দোল খেতে খেতে আমি একটার পর একটা জাম্বু সাইজের সিগার টেনে যাচ্ছিলাম, মূলত নিকোটিনে শরীরটাকে ভিজিয়ে রেখে মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে চাইছিলাম আর কি। এ সুযোগে নিজেকে নিয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম।

 

ঠিক, মুক্তি পাওয়ার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আমার সঞ্চয়ে এখন দশ হাজার ডলার রয়েছে। আর এখানে এবং এল ক্যালাওয়ে জাত-বেজাতের হরেক পদের অসংখ্য নরনারীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যাদের প্রত্যেকেই ছিল মানবিক আবেগ আর উষ্ণতায় ভরপুর একেকটি পাত্র। তাদের সকলের সাহচর্য্য আর বনবীথির ভেতরকার এই বন্য জীবনের ছোঁয়া, এমন এক প্রকৃতি যা শহরের পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর, এখানে আমি অনুভব করেছি স্বাধীনতা কত মধুর, বিচিত্র, যে স্বাধীনতার জন্য আমাকে এতকাল প্রাণপন কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে।

 

এছাড়া ওদিকে যুদ্ধও শেষ হয়ে এসেছে, এজন্য শার্ল দ্য গল আর ইয়াংকিদের ধন্যবাদ। যদিও লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের এ দুর্দশা আর জিল্লতির মাঝে আমার মত একজন জেলখাটা আসামীর কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। কিন্তু আমার জন্য সন্তুষ্টির বিষয় এটাই যে, যুদ্ধোত্তর নানান সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে আমার অতীত সংশ্লিষ্ট তুচ্ছ বিষয়াদি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের চাইতে আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে।

 

আমার বয়স এখন সাঁইত্রিশ। তের বছরের পেনাল সেটেলমেন্ট, তিপ্পান্ন মাসের নির্জন কারাবাস, এছাড়া সাঁতের দিনগুলি, কনসিয়ার্জারি আর বিলিউ, সেই সঙ্গে দ্বীপের বন্দিদশা, রিকল্যুশন। আমার গায়ে নির্দিষ্ট কোন পেশাজীবীর লেবেল লাগানো কষ্টকর। আমি না এমন কোন বেজš§া ধাঁচের গোবেচারা ছিলাম যে শুধুমাত্র বেলচা, শাবল বা কুঠার নিয়ে দিনমজুরিই করতে পারে, না ছিলাম সত্যিকারের কোন পেশাজীবী যে তার কাজের মাধ্যমে একটা সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহ করতে পারে দুনিয়ার যে কোন জায়গায়, যেমন একজন মেকানিক অথবা ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে।

 

অন্যদিকে আমার পক্ষে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নেওয়াও সম্ভব নয়, এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা আমার নেই। স্কুলের লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের প্রয়োজন যে কোন বৃত্তিমূলক কাজ ভালমত শিখে নেওয়া। যদি লেখাপড়ার লাইনটা ব্যর্থ হয়ে যায় কোন কারণে, তখন জীবিকা নির্বাহের একটা রাস্তা অন্তত প্রস্তুত থাকে। এর মানে আবার এই নয় যে অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানা থাকলে নিজেকে একজন ঝড়–দারের চেয়ে শ্রেয় মনে হয়। আমি কখনোই কোনো মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করিনি, কারারক্ষী ওয়ার্ডেন আর পুলিশ বাদে। কিন্তু তারপরেও নিজেকে নিয়ে কখনো আমি সামলে উঠতে পারিনি। আমার অবস্থাটা ছিল দুই নৌকায় পা দেওয়ার মত। আমার ধারণা ছিল সুখী হওয়ার উপকরণগুলো আমার মধ্যে আছে, কিন্তু আমি সেগুলোকে নাগালের মধ্যে পাচ্ছিলাম না। আমার দুটোই ছিল, খুব বেশিমাত্রায় শিক্ষা আর অল্প বিদ্যা। জঘন্য, দুনিয়ায় এই কিসিমের মন্দভাগ্য খুব কমই আছে।

 

তারপর আবার যদি আমি সাধারণ একজন আটপৌরে মানুষ হতাম, অন্যদের মতই স্বাভাবিক মানুষ, কিন্তু নিজের ভেতরকার গভীরতম আকুলতাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতাম? আমি অবশ্যই শান্তি আর সুযোগ অন্বেষণ করতাম এবং হয়তো এল ক্যালাওয়ে অবসরপ্রাপ্ত অপরাধীদের মতই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করতাম; কিন্তু বাস্তবে আমার আমির ভেতরে যা অনুভব করছি তা হল এক ধরনের বিস্ফোরন্মুখ অবস্থা, জীবনের জন্য এক ভয়ংকর তৃষ্ণা। অভিযান প্রবণতা আমাকে এমন এক অমোঘ গতির মুখে এনে ফেলেছে যে আমি ভেবে হতাশ হই, হয়তো আমার এই জীবনে স্বস্তিতে দিন কাটানো আর কখনোই সম্ভব হবে না।

 

আর এটাও সত্য যে আমাকে প্রতিশোধ নিতেই হবে। এটা নিশ্চিত যে আমি কোনমতেই ওই লোকগুলোকে ক্ষমা করতে পারব না, যারা আমার পরিবার আর আমার নিজের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। শান্ত হও, প্যাপি, স্থির হও। তোমার হাতে প্রচুর সময় আছে। তোমাকে পর্যায়ক্রমে ভবিষ্যতের ওপর বিশ্বস্ত হওয়ার শিক্ষা নিতে হবে। আর যদিও তুমি এই দেশে স্বাভাবিক ভদ্রস্থ জীবন যাপনের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ, কিন্তু এখানে তুমি তো সত্যিকারে মুক্ত বিহঙ্গ, স্বেচ্ছাধীন, নিজের প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত।

 

অন্য লোকদের মত জীবন যাপন কতটা কঠিন, অন্যদের মত আনুগত্য প্রকাশ করা, অন্য সবার পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, নিয়ম-কানুনের কঠোর অনুসরণ--তা আমার মত অবস্থায় না পড়লে ঠাহর করা অসম্ভব।

 

নিজের পছন্দ বেছে নাও, প্যাপি। হয় তুমি ঈশ্বরের নিজের দেশের এই আইন-কানুন মেনে চলার জন্য মনস্থির কর এবং প্রতিশোধ চিন্তা ত্যাগ কর, অথবা নিশ্চিন্ত হও যে তুমি তোমার আবেগকে পাশ কাটিয়ে আগে বাড়তে পারবে। এবং সেক্ষেত্রে, যেহেতু তোমার অজস্র টাকার প্রয়োজন হবে যা তুমি কাজ করে কখনোই জোগাড় করতে পারবে না, সেজন্য তোমাকে অবশ্যই আবারো বেপথে নামতে হবে।

 

আর সেজন্যে আমি খুব সহজেই যে কোনো সময়ে ভেনেজুয়েলার বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের ধান্দায় নামতে পারি। এটা খুব একটা খারাপ আইডিয়া না, বৎস। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা আর অতি দ্রুত ভাবনা-চিন্তা আর হিসেব-নিকেশের। চল, এবার একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

 

কিন্তু তার আগে দরজার বাইরে গিয়ে একটু না দাঁড়ালেই নয়। বাইরে বেড়িয়ে এসে দীর্ঘক্ষণ আকাশের তারাগুলোর দিকে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কান পেতে রইলাম হাজারো পদের অদ্ভুদ সব শব্দের ঐকতানের দিকে যা ভেসে আসছিল রহস্যময়ী জঙ্গল থেকে। জঙ্গলটা এই গ্রামটিকে পুরু এক অন্ধকারের দেওয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে, এ অন্ধকার এমনি এক অন্ধকার যার ছোঁয়ায় চাঁদ তার রূপের পূর্ণতায় ঝলমলিয়ে ওঠে, একই সঙ্গে অন্ধকারও তার নিজস্ব বর্ণ-বিভায় উদ্ভাসিত হয়ে পড়ে।

 

এবং এরপর ঘুমিয়ে পড়লাম হ্যামকে মৃদুমন্দ দোলা খেতে খেতে। চেতনার মূল বিন্দুতে এই সুখানুভূতি মন্থন করতে করতে যে আমি মুক্ত এবং নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা।

 

[চলবে ]

 

বাংলাদেশ সময় ১৬৪৫, নভেম্বর ১৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।