ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

রহমান মাসুদের একগুচ্ছ কবিতা

ভূমিকা : ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১১
রহমান মাসুদের একগুচ্ছ কবিতা

দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মী কবি রহমান মাসুদ। নিয়মিতই তার সাথে দেখা হয়, কথা হয়।

আজও বিকেলের দিকে তার সাথে দেখা হলো। কিন্তু আজ ১৩ নভেম্বরে তার সঙ্গে দেখা হওয়াটা যেন একটু অন্য রকমের। কেননা আজ তার জন্মদিন। এই দিনেই জন্মেছেন আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

আমাদের সবার মনোযোগ যখন হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে, তখন হঠাৎ-ই আমাদের বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আলমগীর ভাই বললেন, আমাদের নিজেদের মধ্যেই যেহেতু একজন কবির জন্মদিন, আমরা কেন তার জন্য কিছু করছি না। আজকে যে তরুণ সে-ই তো একসময় কিছু একটা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তিনি আমাকে বললেন, রহমান মাসুদের একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে নাও।

কথা শোনামাত্রই  মনে হলো, রহমান মাসুদকে যেন কেউ  জন্মদিনের পোশাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমি অভয় দিয়ে বললাম, সমস্যা নেই সাক্ষাৎকারটা দিয়েই দেন। কিন্তু মাসুদ বললেন--- সাক্ষাৎকার তিনি দেবেন না। তার বদলে বরং কবিতা দেবেন।

১৯৭৬ সালে গোপালগঞ্জের মাটলায় আজকের এই দিনে জন্মানো মাত্রই হয়ত রহমান মাসুদ চিৎকার করে কেঁদে পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। সেদিনের সেই শিশুটিই আজ ৩৫ বছরে পা রাখলো। মাসকয় আগে বিয়ে করেছেন, বলা চলে বিবাহোত্তর এই তার প্রথম জন্মদিন। চেহারায় একটা সুখী সুখী ভাব।

রহমান মাসুদের বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। শৈশব থেকে দেশের নানা জেলায় ভাসমান জীবন তার।  

অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে  যখন কবিতা দিতে চাইলন, আমি তাকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যই রাজি হয়ে গেলাম।

রহমান মাসুদকে আমাদের সবার পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আশা করছি, আজকের এই দিনে তিনি আমাদের কাউকেই অখুশী করবেন না।  

সেইসাথে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম তার একগুচ্ছ কবিতা।


কৃষ্ণচূড়া এক বহতা নদীর নাম

তোমার নিঃসঙ্গতা জানি; জানি দ্বিধান্বিত ক্ষুব্ধ দৃষ্টির ইতিহাসও!
মেঘ কেটে গেছে কাল; আলো স্রোতে গলদঘর্ম
পৃথিবীর সকল গাছ পাখিদের নিরব দহনে পোড়ে
কেবলই বলছে, বৃষ্টিই ভালো ছিল, ভালো ছিল মেঘ!
যদিও ফুটপাতে বাসা বাঁধা মানুষের মতো
মরা গাছে সহবাস পাখিটিই কেবল আকাশ কালো দেখে
অনিশ্চয়তায় পুড়েছে সম্পূর্ণ রাত!

এমন বর্ষা দেখে, দেখে এভাবে নিজের ভেসে যাওয়া
বুনো ঘাসের দলের মতো-
অথবা রোদে পুড়ে পুড়ে নিজের সমস্ত বোধ
গলদঘর্ম বৈশাখী দহনে-তবু;
যেনো আজ এবং এখনই বলতে ইচ্ছে হয়
কৃষ্ণচূড়া; তোমাকেই ভালবাসি;
ভালোবেসেছি নিজের নখ এবং নাকের মতো-
চলো এবার দু’জনেই পুড়ে মরি
পিচ আর পাথরের সাথে...

(দুই)

আমায় তুমি না করোনি; না করেছে সবুজ ওড়না
আমি তার নীরব প্রতিবাদ মেনে নিয়েছি
সবুজ ওড়নার রক্তচোখের প্রতিবাদ করা যেতো
সুরমা পোড়ানো নীল সূর্যের আলোয়
তবে এত জন্ম নিতো আরো আরো সব রাক্ষুসে
মাকড়সার আর তুমি হারিয়ে যেতে-
ফড়িংয়ের মায়া পাখনার এক নদী মুগ্ধতায়...

কিন্তু আমিতো মুগ্ধতা চাই না
চাই না আমার ক্ষেতের উপর দিয়ে উড়ে যাক
ভিনদেশি চিল আর ফিঙের দল
ক্ষেতের ডোবা-নালায় বসবাস কীটদেরও যে আমি
ভীষণ ভালবাসি, তোমার ওড়না আর চোখের মতো...
কৃষ্ণচূড়া; আমি জেদ করতে পারি
পান করতে পারি নিজের রক্তও;

পৃথিবী এখন ঘুমে কাতর, আর তুমি পরবাসী হাওয়ায়
কূলেতে ঝুলছে বিস্ময়, জলে দুলছে টিমটিমে আলোর মায়া
অথচ দেখো, দূর থেকে দেখো-
ডুবে যাচ্ছে ধীরে তোমারই আঁচল
ভাঙ্গা ঢেউয়ে দোদুল্যমান কাগুজে নৌকো,
যা আমরাই ভাসিয়েছিলাম
কোন একদিন, উঠোনের বৃষ্টির জলে...

(তিন)

তোমার দুই পাড় ভেঙ্গে ছুটে আসা কূলমেঘ
আমাকে কেবলই বুনো সুরভীর ঢেউয়ে দুলিয়ে দিচ্ছে
আর আমি সন্ন্যাসী বালক; গায়েতে অভিমানের ধূলো মেখে
বসে আছি পূর্বপুরুষের খণ্ডিত লাশের ওপর!
বিকেলের তেজী রোদ ভাঁটফুলের তেজ নিয়ে
ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে গোধূলী বৃন্তে...

তবু তুমি ঢেউ দিয়ে যাচ্ছ : ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ভেঙ্গে দিচ্ছ আমার দীর্ঘ প্রতিবিম্ব জলের আয়নায়....

কৃষ্ণচূড়া; ছোট হয়ে যাচ্ছি
ভাগ হয়ে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে, কোচড়ে জমানো
মার্বেল হাতে নিয়ে দেখি, তোমারই দুরন্ত মুখ
আর আমি অভিমানী বালক সন্ন্যাসী!

সন্ধ্যা হয়ে এলো, তোমার বুক জুড়ে ছুটে যাচ্ছে দক্ষিণী হাওয়া
তুমি মাধবীর ঝাপটা দিয়ে বলে গেলে লাল পিঁপড়াদের কথা
গাঙশালিকের কানে, তোমার শরীরে আশ্রয় খোঁজে
ঘণ্টাধ্বনি সূর্য আর মন্দিরে কীর্তনের সুর।

অথচ কেউই জানে না সত্য, তোমার পায়ের কাছে
বসে- এ অভিমানী বালক সন্ন্যাসী; আমিই যে বলছি শুধু
কৃষ্ণচূড়া; তোমাকেই ভালবাসি, কামারের হাপর আর হাতুড়ির
মতো...

 

বিষন্ন জুঁই
এতো কষ্টের কথা কিভাবে তোমাকে বলি-
একথা ভাবতেই একঝুড়ি বিষণ্ন জুঁই ফুল মুখ
ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। ঠিক যেনো,
সিনেমা শুরুর আগে ঘটা করে দুলে যাওয়া পত্পত্
জাতীয় পতাকা। এর অর্থ হতে পারে- তুমিই
নিরন্নের আশ্রয় আর কবিমনের নিষিদ্ধ গন্ধম ফল,
মানে ভাঁপ ওঠা সাদা ভাত।

আমি বাতাস থেকে ছেঁকে নেয়া অস্থির নক্ষত্রের মায়া
পেড়ে নিয়ে, মাপ মতো ছড়িয়ে দেই তোমার ওপর-
এরপর বিশুদ্ধ চিন্তায় পূর্ণিমাকাতর অমাবশ্যা রাতে
কেউটের শরীর থেকে ছুটে আসা বুনোলতা ঘ্রাণ
মগজের ভাঁজে নাচে নিষিদ্ধ রক্তবীজের পরম মায়ায়-
তারপর সুঁইচোরার সবুজ পাখায় উড়ে যায়
সভ্যতার আদিম ধূলো-
এই ধরা পড়ার কথা কিভাবে তোমাকে বলি
ভাবতেই কেটে যায় চন্দন পোড়া রাত.....

 

কথন - ১

অন্ধগলির ঢাকনাহীন ম্যানহোলের মতো হা-করে আছে আমার ঘর। আমি সেখানে প্রতিদিন ফিরে যাই- চরম অনাগ্রহে; যেন ফিরব না, আর ফিরব না কোনো দিন!

অথচ ফিরে আসি ভাটা কেটে আসা জোয়ারের মতো, আমার শোকবাড়ি। শোকার্ত বিড়ালের উষ্ণ দৃষ্টির টানে। টান এমনই হয়, যারে টানে সে-ই বোঝে; বুকটান আর পিঠটানের পাশে পিছুটান যায় কি যায় না!

আমার সময় ভর্তি শোকের মাঝেও আমি অবিচল থাকি; সান্ত্বনা পাই। কেননা শোক মানেই যে উৎসব! উৎসব মানেই আনন্দ, আর আনন্দ যে পরমানন্দের টান; অর্থাৎ নিরানন্দের খোঁজে প্রতিদিন ম্যানহোলে ঢুকে পড়া!

বাংলাদেশ সময় ১৭২০, নভেম্বর ১৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।