ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

‘জীবনানন্দ’ পাঠের আনন্দ-বেদনা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৮
‘জীবনানন্দ’ পাঠের আনন্দ-বেদনা জীবনানন্দের প্রচ্ছদ

‘জীবনানন্দ’ পত্রিকার শুরুতে সম্পাদক লিখেছেন : ‘জীবনানন্দ-চর্চার পত্রিকার এই নিবেদন এমন সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন মানুষের হাত থেকে প্রতিনিয়ত খসে পড়ছে নিজস্ব সময়। দিনযাপন ও জীবিকা অর্জনের পেছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ বিধ্বস্ত; কখনো অস্তিত্ব ফুরিয়ে আসবারও যোগাড়; শৈশব থেকে চুরি হয়ে গেছে স্বপ্নলোক, যৌবন প্রায়শ বিষণ্ন, আমাদের সম্পর্কগুলো কেমন ঝাপসা ও অনিশ্চিত, মূল্যবোধের অবয়ে পৌঢ়রা পীড়িত; বইপড়ার সময় নেই, হয়তো আছেও; এসবেরই বিশদ ও অনুপম রূপকার জীবনানন্দ। লিখতে লিখতে কেউ তো আকাশে উঠে গেছেন, কেউবা সটকে পড়েছেন, মাটিতেও পড়েছেন কেউ ধপাস করে বা নীরবে; মৃত্যুর পরে যেমন, জীবিতাবস্থায়ও; কিন্তু তিনি মৃত্যুর পরই বেঁচে উঠেছেন স্বমহিমায়।’

জীবন সুন্দর, আনন্দের। জন্মের সময় হয়তো হিসাব-নিকাশটাও ছিল সে রকম।

একটা বিমলানন্দে ভরা জীবনের প্রত্যাশা থেকেই বাবা সত্যানন্দ দাশ এবং মা কুসুমকুমারী দাশ কিংবা পরিবারের কর্তা পর্যায়ের কেউ নবজাতকের নাম রেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। অথচ নিয়তির সিদ্ধান্ত ছিল একটু ভিন্ন। জীবনানন্দ নাম ধারণ করেই তিনি বিষাদ নিয়ে খেলবেন আজীবন। বিষাদের ভেতরেই খুঁজে ফিরবেন জীবনের সংজ্ঞা। নির্জনতা, ধূসরতাই হবে তাঁর সঙ্গী। নিজেকে লুকিয়ে রাখার  খেলা খেলতে গিয়েই কোনো এক অবসন্ন বেলায় জীবন খোয়াবেন ট্রামের তলায়। আত্মবিমুখ জীবনানন্দকে খুঁজে বের করার চেষ্টা নানাভাবে চলেছে। তাঁর জীবনটাই যেন বেদনার করিডোর, যেখানে আলো অন্ধকারে হারায়। সে জীবনকে ঘিরে পাঠকের আগ্রহ বিস্তর। আধখোলা খাতার মতো তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম। জীবনানন্দ ও তাঁর সৃজনভাণ্ডারের রহস্যনিকেতন উন্মুক্ত করার প্রয়াসে নতুনভাবে যুক্ত ও উন্মোচিত হলো জীবনানন্দ-চর্চার একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা ‘জীবনানন্দ’।

যে অক্টোবরের এক নিশুতি রাতে জীবনের মায়া ছেড়ে অন্য অন্য কোনো অচেনা আনন্দের পথে যাত্রা করেছিলেন, ৬১ বছর পর সেই অক্টোবরেই পয়দা হলো ‘জীবনানন্দ’ পত্রিকাটির। এটা যে কাকতালীয় নয়, তা সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক মাসউদ আহমাদ। তিনি লিখছেন : ‘হেমন্ত ছিল তাঁর প্রিয় ঋতু। এই ঋতুতে তিনি জীবনের ওপারে পাড়ি দিয়েছিলেন। হেমন্ত-ঋতুতেই প্রকাশিত হলো জীবনানন্দ-এর প্রথম সংখ্যা। ’

পুরো পত্রিকাটিতে জীবনানন্দকে ধরা হয়েছে সচেতন, সতর্ক ও সার্থকভাবে। এতে আছে কবিতা, গল্প, জীবনালোচনা, সাক্ষাৎকার কিংবা আত্মজৈবনিক রচনা; কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রে আছেন জীবনানন্দ ও তাঁর সৃষ্টিসম্ভার। সবমিলিয়ে এতে আশ্চর্য সাম্য রা করা হয়েছে। বহুমুখী জীবনানন্দকে চেনার ও চেনানোর জন্য এসব রচনা স্বাদ ও বৈচিত্রে অনন্য, সমৃদ্ধ। জীবনানন্দ-রচনা থেকে সংকলিত ‘আমার মা’ দিয়ে শুরু ম্যাগাজিনটি ২৫২ পৃষ্ঠায় গিয়ে শেষ হয়েছে গদ্যশিল্পী হরিশংকর জলদাসের ‘যেভাবে লেখা হলো ‘‘জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’’’ রচনার মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে কবি ও জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ এবং কথাকার শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার; জীবনানন্দ ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে ১৩টি গদ্য, ৭টি গল্প, ২৪টি কবিতা স্বমহিমায় ঢুকে পড়েছে। ‘আমার জীবনানন্দ’ অধ্যায়ের ৭টি রচনা যেন গল্পের চেয়েও বেশি কিছু। সুন্দর। আকর্ষণীয়। কাব্যগল্পে মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘ও জানেমন জীবনানন্দ, বনলতা সেন লিখছি’ রচনাটি কল্পরসে টইটম্বুর, স্বাদে অমৃত। আরও অনেক বাঙালি নারীর মতো তিনি যেন সত্যিই বনলতা সেজে জীবনানন্দের পথ চেয়ে বসে আছেন! নাসির আলী মামুনের  নেওয়া জীবনানন্দ-গবেষক কিনটন বি সিলির সাক্ষাৎকারে বন্ধুবিমুখ জীবনানন্দ দাশকে বেশ খোলামেলাভাবে পাওয়া যায়। যা পাঠে বেদনার ভেতরেও অদ্ভুত আনন্দ ছুঁয়ে যায়। ...জীবনানন্দ দাশের অবস্থান বাংলা সাহিত্যের কোন কাতারে তা নির্ণয় কখনো মুখ্য হয়ে ওঠে না। কারণ তিনি সাড়ম্বরে প্রভাব বিস্তার করতে চাননি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প এবং নানা ধরনের রচনা সৃজন করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। জীবনানন্দ এমনই। যিনি অনুভূতির গভীরে দীর্ঘ দাগ কেটে যান। একাকীত্বের দীর্ঘশ্বাসে মিশে থাকেন। তাঁর প্রেমে সাহসের চেয়ে মায়া বেশি, কায়ার চেয়ে ছায়া  বেশি। তিনি প্রকৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে অজান্তেই প্রকৃতির অভেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন। জীবনানন্দকে কেবল স্মরণ নয়, তাঁকে নিয়ে নিরীর যে খেরোখাতা মাসউদ আহমদ খুলেছেন নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার। জীবনানন্দপ্রেমকে সচেতনভাবে বৃদ্ধি করে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এ পত্রিকা, এটা একটামাত্র সংখ্যাতেই সুচারুভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ-চর্চায় পত্রিকাটি নানামাত্রিক ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা পত্রিকাটির বহুল প্রচার কামনা করি।

জীবনানন্দ
সম্পাদক: মাসউদ আহমাদ, নামলিপি: কাইয়ুম চৌধুরী, প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর, ১ম সংখ্যা: অক্টোবর ২০১৮, পৃষ্ঠা: ২৫৬, দাম: ৯৯ টাকা

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৮
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।