ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কহেন যেমন জারাথুস্ট্রা : ফ্রেডরিখ নিৎশে

ভূমিকা ও অনুবাদ: কামাল রাহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১১
কহেন যেমন জারাথুস্ট্রা : ফ্রেডরিখ নিৎশে

[ফ্রেডরিখ নিৎশের অমর গ্রন্থ ‘দাজ স্পোক জারাথুস্ট্রা’ থেকে জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠের দশটি পর্ব অনুবাদ করা হয়েছে এখানে। নিৎশের ভাবনা থেকে বর্তমান সময়ের ভাবুকদেরও অনেক কিছু নেওয়ার আছে।

গত পর্বে একটি ভূমিকাসহ নান্দীপাঠের প্রথম পাঁচটি পর্বর অনুবাদ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্বে দেওয়া হলো দ্বিতীয় পাঁচটি। ]   

জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ৬
অতঃপর, যা হোক, এমন কিছু ঘটে যা প্রতিটি কণ্ঠ বোবা বানিয়ে ফেলে এবং অপলক রাখে প্রতিটা চোখ। ইত্যবসরে, দড়ি-নর্তক শুরু করে তার খেলা : ছোট্ট এক দরোজার সামনে বেরিয়ে আসে, এবং ঐ দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করে, দড়িটা বাঁধা দুটো উঁচু খুঁটির মাথায়, এবং ঐ বাজার ও লোকগুলোর ওপর দিয়ে ঝোলানো। ঠিক মাঝপথে সে যখন, ঐ ছোট্ট দরোজাটি আরো একবার খুলে যায়, এবং জমকালো পোশাক পড়া ভাঁড়ের মতো এক লোক স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে এগিয়ে আসে, এবং দ্রুত দড়ি-নর্তকের পেছনে হেঁটে আসে। ‘এগিয়ে যাও, পা শক্ত করো’, ভয়-জাগানো স্বরে চিৎকার করে ওঠে। এগিয়ে যাও, অলসের হাড্ডি, পরস্বপহরণকারী, পাণ্ডুর-মুখ-- তোমাকে কি পায়ে মাড়িয়ে যাবো আমি! এই খুঁটিগুলোর মাঝখানে তোমার কী কাজ? ঐ খুঁটিটা হলো আসল জায়গা, তোমাকে বেঁধে রাখার জন্য; তোমার থেকে যে  অনেক ভালো, তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছো! প্রতিটা শব্দ ছুঁড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো কাছে এগিয়ে আসে। মাত্র এক পা দূরে যখন সে, ভয়াবহ ঐ ঘটনাটা ঘটে, যা প্রতিটি কণ্ঠ বোবা বানিয়ে ফেলে এবং অপলক রাখে প্রতিটা চোখ : শয়তানের মতো বিকৃত এক চিৎকার দেয় সে, এবং লাফ দিয়ে অতিক্রম করে যায় ওকে। অবশেষে দড়ি-নর্তক যখন দেখে ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর বিজয়, একই সঙ্গে হারিয়ে ফেলে ওর মস্তিষ্কের এবং দড়ির ওপর পায়ের নিয়ন্ত্রণ; ভার সমতাকরণ দণ্ডটা ছুড়ে ফেলে, এবং ওটা থেকেও বেশি গতি নিয়ে নিচে নেমে আসে; হাত ও পায়ের একটা চক্র তৈরি করে শূন্যের ভেতর। বাজার ও মানুষগুলো ঐ ঝড় আসার সময় একটা সমুদ্রের মতো দুলে ওঠে : বিক্ষিপ্তভাবে দূরে সরে যায়, বিশেষ করে যেখানে ওর শরীরটা আছড়ে পড়ে।

জারাথুস্ট্রা, যা হোক, দাঁড়িয়েই ছিলেন, এবং ঠিক ওর পাশেই আছড়ে পড়ে শরীরটা, বীভৎস হয়ে যাওয়া, তখনও মরেনি সে, কিছুক্ষণ পর বিক্ষিপ্ত মানুষগুলোর চেতনা ফিরে আসে, এবং ওরা দেখে হাঁটু গেড়ে বসেছেন জারাথুস্ট্রা ঐ মানুষটার পাশে। কী করছিলে সেখানে তুমি? অবশেষে বলেন তিনি।

অনেক আগেই জানতাম, হোঁচট খাওয়াবে আমাকে শয়তান। এখন সে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নরকে আমাকে : তুমি কি ফেরাতে পারো ওকে?

আমার সম্মানে, বন্ধু আমার, জবাব দেন জারাথুস্ট্রা, তুমি যা বলেছো তার কিছুই নেই : না আছে শয়তান, অথবা নরক। তোমার শরীরের চেয়েও দ্রুত তোমার আত্মার মৃত্যু ঘটবে : ভয়, অতএব, আর কোনো কিছুরই না!

অনাশ্বস্ত চোখে তাকায় লোকটা। যদি সত্য না বলে থাকো তুমি, বলে সে, আমার জীবন হারানোয় কিছুই হারাই না আমি। একটা পশুর অতিরিক্ত কিছুই না। আমি, যাকে শেখানো হয়েছে নাচতে অপর্যাপ্ত বাতাসের মধ্যে।

মোটেও তা না, বলেন জারাথুস্ট্রা। ডেকে বিপদ এনেছো তুমি, ওখানে নিন্দনীয় ছিল না কিছু। এখন তুমি ডেকে এনেছো সংহার : ভেবো না আর, আমি নিজ হাতে সৎকার করবো তোমাকে।

যখন এটা বলছিলেন জারাথুস্ট্রা, মুমূর্ষু মানুষটা জবাবে কিছু বলে না; কিন্তু ওর হাতটা নাড়ায় যেন স্বাগত জানায় জারাথুস্ট্রাকে, অভিবাদনে।

জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ৭
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, বিষাদের ভেতর ঢুকে পড়ে বাজারের পরিবেশ। মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি ঝিমিয়ে আসে উৎসাহ ও ভীতি। জারাথুস্ট্রা বসে থাকেন তখনো মৃত মানুষটার পাশে, ডুবে থাকেন গভীর ভাবনায় : ভুলে যান সময়। অবশেষে রাত নামে, শীতল এক বাতাস বয়ে যায় ওর নিঃসঙ্গতায়। তখন উঠে পড়েন জারাথুস্ট্রা এবং ওর অন্তরকে বলেন :

বস্তুত, বড়শিতে একটা ভালো শিকারই পেয়েছি আজ আমি! মানুষ নয়, একটা মরা মানুষ!

কী মলিন মানুষের জীবন, এবং কতটা অর্থহীন : ভাঁড়ামি হয়তো এর নিয়তিনির্দিষ্ট।

মানুষকে শেখাতে চেয়েছি আমি ওদের অস্তিত্ব, যা হলো কিনা অতিমানব, কালো মেঘরূপ মানুষের মধ্যে বিদ্যুতের এক চমক। এখনো অনেক দূরে আমি ওদের কাছ থেকে, এবং আমার উপলব্ধি ওদের উপলব্ধির কাছে কিছু বলেনি। মানুষের কাছে আমি এখনো বোকা ও শবের মাঝখানে কিছু একটা।

বিষাদের রাত। বিষাদে ভরা জারাথুস্ট্রার পথগুলো। আসো, শীতল ও শক্ত হয়ে যাওয়া সাথী আমার! তোমাকে বয়ে নিয়ে যাব সেখানে, নিজের হাতে সমাহিত করব তোমাকে!

জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ৮
এসব বলছিলেন জারাথুস্ট্রা তাঁর অন্তরের কাছে, মৃতদেহটা কাঁধে তুলে নেন, এবং তাঁর পথে যাত্রা শুরু করেন। একশো পা না যেতেই, অন্ধকার ফুঁড়ে কে যেন সামনে এসে দাঁড়ায়, এবং ফিসফিসিয়ে বলে-- শোনো! খুঁটির ওপরের ঐ ভাঁড় সে, চিনতে পারেন জারাথুস্ট্রা। এ শহর ছেড়ে যাও, জারাথুস্ট্রা। তোমাকে ঘৃণা করে এমন মানুষের সংখ্যা এখানে অনেক বেশি। ভালো কিছুকে, এবং ঠিক তোমাকে ঘৃণা করে, ওদের শত্রু ও বিচ্ছিন্নতাকারী বলে ডাকে তোমাকে; গোঁড়া বিশ্বাসীরা ঘৃণা করে তোমাকে, এবং জনতার মধ্যে এক বিপদ ভাবে তোমাকে। এটা তোমার সৌভাগ্য, যার জন্য হাসতে পারো; এবং বস্তুত একটা ভাঁড়ের মতোই কথা বলেছো তুমি। এটা তোমার সৌভাগ্য, মৃত কুকুরটার সঙ্গী হয়েছো, নিজেকে এভাবে অবমাননা করে আজ, জীবন রক্ষা করতে পেরেছো, তুমি সরে পড়ো এ শহর হতে, অথবা আগামীকাল ঝাঁপিয়ে পড়ব আমি তোমার ওপর, একজন মৃত মানুষের ওপর একজন জীবিত মানুষ। এরপর অদৃশ্য হয়ে যায় সে; অন্ধকার পথ ধরে আবার হাঁটতে থাকেন জারাথুস্ট্রা।

শহরের প্রধান ফটকে দেখা হয় গোর-খোদকদের সঙ্গে : মুখের ওপর মশালের আলো ফেলে ওরা, জারাথুস্ট্রাকে চিনতে পারে, অপ্রীতিকরভাবে উপহাস করে ওকে। মৃত কুকুরটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে জারাথুস্ট্রা : সুন্দর একটা বস্তু, একজন গোর-খোদকের দিকে ফিরে তাকান জারাথুস্ট্রা! আমাদের হাতগুলো ঐ পচা জিনিসটা না ছোঁয়ার জন্য অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। জারাথুস্ট্রা কি শয়তানের খাবারও চুরি করে খাবে? এমনকি শয়তানও যদি জারাথুস্ট্রার চেয়ে বড় চোর না হয়ে থাকে- ওদুটোকেই চুরি করবে সে, ওদুটোকেই খাবে! নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে থাকে ওরা, একসঙ্গে মেলায় ওদের মোটা মাথাগুলো।

এসবের কোনো জবাব দেন না জারাথুস্ট্রা, হেঁটে যান নিজের পথে। দু ঘণ্টা পথ চলার পর, অতিক্রম করে যান জঙ্গল ও জলাভূমি, শুনতে পান ক্ষুধার্ত নেকড়েদের ভয়ানক চিৎকার, এবং ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠেন নিজেও। নিঃসঙ্গ একটা বাড়ির সামনে এসে থামেন, হালকা আলো জ্বলছিল সেখানে।

ক্ষুধা আক্রমণ করেছে আমাকে, বলেন জারাথুস্ট্রা, একটা ডাকাতের মতো। জঙ্গল ও জলাশয়ের মধ্যে আমার ক্ষুধা আক্রমণ করেছে আমাকে, এবং রাতের শেষ ভাগে।

কী আশ্চর্য রসিকতা ক্ষুধার, প্রায়ই এটা আসে যখন একটা দীর্ঘ অতীত পেরিয়ে যায়, সারাদিন ওটা ব্যর্থ হয় : কোথায় ছিল এটা?

এবং তখন জারাথুস্ট্রা ঐ বাড়িটার দরজায় টোকা দেন। বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধ, হাতে নিভু নিভু এক বাতি, জিজ্ঞেস করেন : কে আসে আমার কাছে, আমার এই বাজে ঘুমের ভেতর?

এক জ্যান্ত মানুষ ও এক মরা মানুষ, বলেন জারাথুস্ট্রা। খাবার ও পানীয় কিছু দিন আমাকে, দিনের বেলায় ভুলে ছিলাম ওটা, প্রজ্ঞা বলে, যে বুভুক্ষুকে খেতে দেয়, সে তার আত্মাকে বলিষ্ঠ করে।

ভেতরে যায় বুড়ো মানুষটা, দ্রুত ফিরে আসে মদ ও রুটি নিয়ে। ক্ষুধার্তের জন্য একটা বাজে দেশ এটা, বলেন তিনি, যে-কারণে বাস করি এখানে। মানুষ ও পশু আসে আমার কাছে, হয়তো এক সন্ন্যাসীর কাছে। তোমার সঙ্গীকেও খেতে ও পান করতে দাও, তোমার চেয়েও ভগ্ন সে। জবাবে বলেন জারাথুস্ট্রা : আমার সঙ্গী মৃত; ওকে কিছু খেতে বলা আমার পক্ষে কঠিন। ওটা আমার বিষয় নয়, বিরক্ত হয়ে বলেন ঐ বুড়ো মানুষটা, আমার দরোজায় যে করাঘাত করেছে তাকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে যা আপ্যায়ন করি আমি। খাও, এবং বিদেয় হও ভালোভাবে!

তারপর আবার দু ঘণ্টা পথ চলেন জারাথুস্ট্রা, পথ ও নক্ষত্রের আলোর ওপর ভরসা রেখে, এক অভিজ্ঞ রাতবিহারী তিনি, এবং ঘুমন্ত সব কিছুর ওপর দৃষ্টিপাত করে অভ্যস্ত। যখন ভোর হয়ে আসে, নিজেকে দেখেন জারাথুস্ট্রা এক গভীর জঙ্গলের ভেতর, সামনে আর কোনো পথ দেখা যায় না। ঐ মরা মানুষটাকে একটা গাছের খোঁদলের ভেতর রাখেন-- নেকড়ের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে চান তিনি-- নিজে শুয়ে পড়েন ঘাসের ওপর। শীঘ্র ঘুমিয়ে পড়েন, ক্লান্ত শরীর, কিন্তু এক গভীর প্রশান্ত আত্মা।
Thus-Spoke-Zarathustra-bg
জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ৯
দীর্ঘ সময় ঘুমে কাটান জারাথুস্ট্রা, সোনালি প্রত্যুষই নয় শুধু, সকালটাও পেরিয়ে যায় তাঁর মাথার ওপর দিয়ে। অবশেষে চোখ খোলেন, এবং অবাক চোখে আশ্চর্য সুন্দর বন ও এর নীরবতা দেখেন মুগ্ধ চোখে, অবাক চোখে দেখেন নিজেকে। তাড়াতাড়ি উঠে বসেন, এক সমুদ্রযাত্রী যেন অকস্মাৎ পেয়েছে তীরের নিশানা; আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, এক নতুন সত্য উপলব্ধি এসেছে তাঁর কাছে। অতঃপর অন্তরের কাছে বলেন :

আলোকিত এক প্রত্যুষ দেখা দিয়েছে আমার কাছে : আমার সাথি চাই-- জীবন্ত কেউ, মৃত সঙ্গী নয়, শব নয়, যেখানে যাব আমি তাকে সঙ্গী করে।

আমার চাই জীবন্ত সব সঙ্গী, আমাকে অনুসরণ করবে যারা, কারণ, নিজেদের অনুসরণ করতে চায় ওরা-- এবং যাবে আমার সঙ্গে, যেখানে আমি যাব।

আলোকিত এক প্রত্যুষ দেখা দিয়েছে আমার কাছে : ঐ সব মানুষের কাছে বলবে না কিছু জারাথুস্ট্রা, বলবে সঙ্গীদের কাছে! জারাথুস্ট্রা হবে না এক পশুপালের রাখাল, অথবা শিকারি কুকুর।

পশুপাল হতে অনেককে মোহিত করা-- এজন্য এসেছি আমি। মানুষ ও রাখালেরা ক্রোধান্বিত নিশ্চয় আমার প্রতি : রাখালেরা বলবে আমাকে: জারাথুস্ট্রা হলো এক ডাকাত।

রাখালেরা বলি আমি, কিন্তু ওরা নিজেদের বলে যথার্থ ও শ্রেয়তর। রাখালেরা বলি আমি, কিন্তু ওরা ওদের বলে গোঁড়া বিশ্বাসে বিশ্বাসী।

থাকো আঁকড়ে তোমাদের প্রকৃত ও যথার্থ! কাকে ওরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে? যিনি ওদের মূল্যবোধগুলো ভেঙ্গে ফেলেন, ধ্বংসকারী, আইনভঙ্গকারী : তিনি, যা হোক, সৃষ্টিকর্তা।

ধরে থাকো সব-বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের! কাকে ওরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে? যিনি ওদের মূল্যবোধগুলো ভেঙ্গে ফেলেন, ধ্বংসকারী, আইনভঙ্গকারী : তিনি, যা হোক, সৃষ্টিকর্তা।

সৃষ্টিকর্তা চেয়েছে সঙ্গী, শব নয়-- এবং পশুপাল নয়, অথবা বিশ্বাসীও নয়। সৃষ্টিকর্তা চেয়েছে অনুগামী-- যারা নতুন টেবিলে নতুন মূল্যবোধ উপবেশন করে।

সৃষ্টিকর্তা চেয়েছে সঙ্গী, এবং অনুগামী-আহরণকারী : যা কিছু পূর্ণ হয়েছে, পেকেছে, তাঁর সঙ্গে ওসব আহরণের জন্য। কিন্তু শতটা কাস্তের অভাব ওর, অতএব, যবের কানের কাছটাই কেবল সংগ্রহ করেছে সে, এবং বিক্ষুব্ধ হয়েছে।

সৃষ্টিকর্তা চেয়েছে সঙ্গী, যারা জানে কীভাবে শান দিতে হয় ওদের কাস্তেগুলোয়। ধ্বংসকারী বলা হবে ওদের, এবং ভালো ও মন্দের বিচ্ছিন্নতাকারী।

অনুগামী-সৃষ্টিকর্তা চেয়েছে জারাথুস্ট্রা; অনুগামী-আহরণকারী এবং অনুগামী-আনন্দোৎসবকারী চেয়েছে জারাথুস্ট্রা :
পশুপাল ও রাখাল অথবা শব নিয়ে কী করার আছে ওর!

এবং তুমি, আমার প্রথম সাথী, ঘুমাও শান্তিতে। তাহলে কি গাছের ঐ খোঁদলে সমাহিত করেছি তোমাকে আমি; নেকড়েদের কাছ থেকে কি লুকোতে পেরেছি তোমাকে!

কিন্তু এখন তোমাকে ছেড়ে যাবো আমি; সময় এসেছে। ঝলমলে গোলাপি প্রত্যুষ, এবং এই গোলাপি প্রত্যুষ এক নতুন সত্য নিয়ে এসেছে আমার কাছে।

এক রাখাল হওয়ার জন্য নই আমি, এবং গোর-খোদক হওয়ার জন্য নই আমি।   আর কখনো মানুষদের সামনে আলোচনা করতে যাবো না আমি; শেষবারের মতো কথা বলেছি আমি মৃতদের সঙ্গে।

সৃষ্টিকর্তার সঙ্গ, আহরণকারী ও আনন্দোৎসবকারীর সঙ্গ দেবো আমি : রঙধনু দেখাব আমি ওদের, এবং দেখাব অতিমানবের সব কটা সিঁড়ি।

নিঃসঙ্গ-যাপনকারীদের শোনাবো আমার গান, এবং শোনাবো জুটিবাঁধা-জীবনযাপনকারীদের; এখনো শোনার জন্য ঐ সব কান আছে যাদের, যা এখনো শোনেনি তারা, এবং আমার সুখ দিয়ে ভরিয়ে দেবো অন্তর ওদের।

আমার লক্ষ্য তৈরি করি আমি, আমার পথ অনুসরণ করি আমি; ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো ধীরগতিসম্পন্নদের ওপর দিয়ে লাফ দেবো আমি, এভাবে আমার চলতি হবে ওদের অধোগতি!

জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ১০
এই বলেছিলেন জারাথুস্ট্রা তাঁর অন্তরের কাছে, সূর্য্য দাঁড়িয়েছিল মধ্যগগনে। ঊর্ধ্বপানে তাকান তিনি, মহান এক অনুসন্ধিৎসায়, মাথার ওপর পাখির তীব্র চিৎকার শোনেন। এবং লক্ষ্ করেন, একটা ঈগল চক্রাকারে কেটে চলেছে বাতাস, ওর নখরে ঝোলানো একটা কেউটে, শিকারি ঈগলের গলা পেঁচিয়ে আছে ঐ সাপটা।

ওরা আমার পশু, বলেন জারাথুস্ট্রা, এবং তাঁর চিত্ত আমোদিত হয়।

সূর্য্যরে নিচে সবচেয়ে গর্বিত প্রাণী, এবং সূর্য্যরে নিচে সব চেয়ে প্রখর বুদ্ধিমান প্রাণী-- ওরা এসেছে পরস্পরের শক্তিমত্তা বুঝে নিতে।

ওরা জানতে চেয়েছে জারাথুস্ট্রা এখনো বেঁচে আছে কিনা। বস্তুত, আমি কি বেঁচে আছি!

মানুষ ও পশুদের মাঝে আরো ভয়ঙ্করভাবে খুঁজে পেয়েছি আমি এটা, জারাথুস্ট্রা গেছে ভয়াবহ পথে। আমার পশুরাই আমাকে পথ দেখাক তাহলে!

যখন এটা বলেন জারাথুস্ট্রা, তিনি স্মরণ করেন বনের ঐ সন্ন্যাসীর কথাগুলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, এবং তাঁর হৃদয়ের কাছে বলেন :

আরো জ্ঞানী হতে পারতাম আমি! আমার অন্তর হতে আরো বেশি জ্ঞানী, আত্মার ঐ সরীসৃপের মতো!

কিন্তু আমি এক অসম্ভব জিজ্ঞাসা করছি। অতএব আমার গর্বকে কি জিজ্ঞাসা করি, আমার জ্ঞানের সঙ্গে যেতে সব সময়!

এবং যদি এই জ্ঞান কোনো দিন পরিত্যাগ করে আমাকে, হায়! এটা ভালোবাসে উবে যেতে! তাহলে আমার প্রজ্ঞা উড়ে যাক আমার মূঢ়তার সঙ্গে!

এভাবে শুরু হয় জারাথুস্ট্রার নিম্ন-গমন।

কহেন যেমন জারাথুস্ট্রা : ভূমিকা ও প্রথম পাঁচ পর্বের জন্য ক্লিক করুন :

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০০০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।