ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব-৬]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব-৬]

[দুনিয়াজুড়ে সাড়া জাগানো এবং দীর্ঘদিন ধরে বেস্ট সেলার, জেলপালানো কয়েদির মনোমুগ্ধকর আর শিহরণ জাগানিয়া কাহিনী ‘প্যাপিলন’ফ্রান্সে জন্ম নেয়া হেনরি শ্যারিয়ার ওরফে প্যাপিলন লিখিত বাস্তব এই ঘটনা নিয়ে একই নামে হলিউডে সিনেমাও হয়েছে।

 

১৯৩১ সালের অক্টোবরে ফরাসি আদালত কর্তৃক বিনা অপরাধে (প্যাপিলনের দাবি মতে) খুনের আসামি হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৪ সালের জুলাই পর্যন্ত পরবর্তী ১৩টি বছর হেনরি শ্যারিয়ারের জীবন কেটেছে জেল পালানো এবং আবারো জেলে ফেরার মধ্যে দিয়ে। তবে সত্যিকারার্থে প্যাপিলন জেলমুক্ত হন ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর। এদিন এল ডোরাডো কারাগার থেকে প্যারালাইসিস আক্রান্ত আরেকজন প্রতিবন্ধী কয়েদি পিকোলিনোসহ মুক্ত হন প্যাপিলন।

 হেনরি শ্যারিয়ারের দীর্ঘ ১৩ বছরের ফেরারি এবং জেল-জীবনের  হৃদয়স্পর্শী, দুর্ধর্ষ, মানবিক আর আবেগমথিত অমানবিক সব অভিযানের কাহিনী লেখা হয়েছে প্যাপিলন-এ।

এরপরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে শ্যারিয়ার রচিত দ্বিতীয় বই ‘ব্যানকো’ তে। স্পেনীয় দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে জন্মভূমির মুক্তি আনয়নকারী মহান নেতা সিমন বলিভারের দেশ এবং বর্তমান সময়ের আলোচিত নেতা হুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনিজুয়েলা’একজন নাগরিক হিসেবে শুরু হয় তার নয়া জীবন। প্যাপিলনের শেষ পৃষ্ঠায় ছিল এল ডোরাডো পেনাল সেটলমেন্টের অফিসার প্যাপিলনকে ‘গুড লাক’ বলে বিদায় জানাচ্ছেন।

আর ব্যানকো’কাহিনী শুরু ঠিক এর পর থেকে। প্যাপিলনের মতই ব্যানকো-উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনায় জমজমাট, শ্বাসরুদ্ধকর আর এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত। যারা প্যাপিলন পড়েননি তাদেরও নিরাশ করবে না এই কাহিনী। এখানে প্যাট্রিক ও’ব্রায়ান-এর করা ব্যানকো’ইংরেজি অনুবাদের সংক্ষেপিত বাংলা রূপান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই অনুসরণ করা হয়েছে, যেমন- ফরাসী শব্দ ‘পাপিলঁ’-কে করা হয়েছে প্যাপিলন, আবার লেখক অঁরি শারিয়ারকে করা হয়েছে হেনরি শ্যারিয়ার। ] 

 

‘ফালতু কথা বোল না প্যাপিলন। যে লোক একটা গুপ্তধন পেয়ে যায় সে আর কখনো খনি শ্রমিকের জীবনে ফেরে না। বাদবাকী জীবনের জন্য সে ধনী হয়ে যায়, যদি না সে আনন্দে এতটাই আত্মহারা হয়ে যায় যে, তার খচ্চরগুলোকে লাচ্ছিতে গুলিয়ে একশ’ বলিভারের নোট গেলাতে থাকে। না, আমি সে লোকের কথা বলছি, যে হচ্ছে সাধারণ-স্বাভাবিক মানুষ। যে অল্প অল্প করে প্রতিদিন কিছু হীরা খুঁজে পায়, হোকনা তা খুবই অল্প। তারপক্ষে এভাবে সে যা পায় তা তার শহরের উপার্জন থেকে দশ বা পনেরগুণ বেশি। ব্রাজিলীয়, ব্রিটিশ, গায়ানা আর ত্রিনিদাদের লোক : এপথে তারা বিভিন্ন কারখানা বা কটন প্লান্টেশন অথবা অন্য যে কোন শোষণ থেকে পালিয়ে বাঁচে।

এছাড়া আছে সত্যিকারে অভিযাত্রী দল, যারা পরিবেশগত প্রতিকূলতাকে মোটেই বরদাশত করে না, যারা দান মারার জন্য সর্বদাই নিজের সর্বস্ব বাজিতে লাগিয়ে দেয়-- ইতালিয়, ইংরেজ, স্পেনিয়, ফরাসি, পর্তুগিজ-- সব জাতের মানুষ। যীশুর দিব্যি, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এই স্বপ্নের ভূমিতে দৌড়ে আসা লোকজনের চেহাচরিত্রের প্রকারভেদ! স্বর্গবাসী ঈশ্বর হয়তো এই দেশটাকে পিরানহা, অ্যানাকোন্ডা, মশা, ম্যালেরিয়া আর হলুদ জ্বর-- ইত্যাদিতে ভর্তি করে দিয়েছে কিন্তু তেমনি আবার ভরিয়ে দিয়েছে স্বর্ণ, হীরক, টোপাজ, এমারেল্ডসহ অন্যান্য রত্ন--এর সমগ্র শরীর জুড়ে।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/20111104191510.jpgদুনিয়ার সব জায়গা থেকে পঙ্গপালের মত অভিযাত্রীরা ছুটে আসে, এখানে এসে তারা কোমর পর্যন্ত কর্দমাক্তপানিতে ডুবে গর্তের মধ্যে কঠিন পরিশ্রমে এমনই মশগুল হয়ে যায় যে, সূর্যের প্রখর তাপ, মশার কামড়, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব ভুলে যায়। খুঁড়েই চলেছে, পানিতে ডুবে আলগা মাটি তুলছে আর বারবার তা ধুচ্ছে ছাঁকনিতে হীরা বের করার জন্যে। এছাড়া ভেনেজুয়েলায় বিশাল সব ভূমি-প্রান্তর পরে আছে যেখানে তুমি কি করছো না করছো এমন প্রশ্নে কাগজপত্র পরীক্ষা করার মত কাউকে খুঁজে পাবে না। সুতরাং শুধু হীরা সন্ধানের রোমাঞ্চই নয়, সেখানে তুমি নিশ্চিত হতে পারে যে ইউনিফর্মধারী শুয়োরগুলোও তোমার শান্তি নষ্ট করতে যাবে না। যদি তুমি সত্যিকারে আন্তরিক হও তাহলে নিজকে গুছিয়ে নেয়ার আদর্শ স্থান এটা। ’

জো জো থামলো। এই সনাতন গল্পের কোনকিছুই ভুলে যায়নি সে, এখন আমি ধরতে পেরেছি ব্যাপারটা। দ্রুত একটা চিন্তা করে আমি বললাম, তুমি একাই যাও, জো জো। আমি নিজকে ক্রীতদাসের মত পরিশ্রম করতে দেখতে চাই না। তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে-- তুমি তোমার গুপ্তধন-এ বিশ্বাসী হতে পারো যেমন তুমি বিশ্বাস কর সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে। হ্যাঁ, তুমিই যাও সেখানে। আমি ক্যারাকাসেই আমার গুপ্তধন সন্ধান করবো। ’

আরও একবার তার কঠিন দৃষ্টি আমাকে বল্লমের মত বিঁধে ফেললো। ‘আমি বুঝতে পারছি, তুমি বদলাওনি। জানতে চাও আমি আসলে কি ভাবছি?’
‘বলে ফেল। ’
‘তুমি এল ক্যালাও ত্যাগ করছো কারণ এল ক্যালাও তোমাকে অসুস্থ করে ফেলছে এই কথা জেনে যে মকুপিয়া খনিতে অরক্ষিত স্বর্ণের এক ভান্ডার পড়ে আছে। ঠিক তো?
‘ঠিক। ’
‘তুমি একাকী নিঃসঙ্গভাবে এল ক্যালাও ত্যাগ করছো। এ জন্যে যে তুমি তোমার পুরনো স্যাঙ্গাতদের জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইছো না যারা এখানে শান্তিতে অবসর যাপন করছে। ঠিক না বেঠিক?
‘ঠিক। ’
এবং তুমি ভাবছো, আমার বলা কথা মত রত্নভাণ্ডার খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে অনেককে ইন্টারভিউতে ডাকা হয় কিন্তু পছন্দ করা হয় মাত্র কয়েক জনকে। ঠিক না বেঠিক?’
‘ঠিক। ’
‘এবং তুমি তোমার রত্নভাণ্ডারের খোঁজ ওই জঙ্গলে না করে ক্যারাকাসেই করতে চাচ্ছো, পরিপাটি করে গোছগাছ করা অবস্থায়, বাঁধাই ছাটাই করা হীরকখণ্ডগুলো-- যেগুলো কোন জুয়েলারীশপে অথবা কোন রত্ন ব্যাপারীর ভাণ্ডারে গচ্ছিত থাকে?’
‘হয়তো বা; কিন্তু সেটাই নিশ্চিত নয়। ভবিষ্যতই বলতে পারে। ’
‘আমার বিশ্বাস, তুমি একজন সত্যিকারের অভিযাত্রী; কোন কিছুই শোধরাতে পারবে না তোমাকে। ’
‘এরকমই হওয়া উচিত। কিন্তু তুমি এই বিষয়টি ভুলো না যে বিষয়টা আমাকে সর্বক্ষণ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে-- তা হলো প্রতিশোধ। যার জন্যে আমি যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। ’
‘অভিযান বল আর প্রতিশোধই বল, সবখানেই তোমার দরকার সিন্দুকভর্তি টাকা। আর তাই আমার সঙ্গে জঙ্গলে চল। এটা কত চমৎকার কাজ তোমাকে দেখাবো। ’
‘একটা কুঠার আর একটা বেলচা নিয়ে? এ জিনিস আমার জন্য নয়। ’
‘তোমাকে জ্বরে ধরেছে, প্যাপিলন? অথবা ব্যাপারটা তোমাকে এমন গুলিয়ে ফেলেছে যে তুমি ভাবছো যে তুমি একটা বৃন্তচ্যুত লেবুর মত। ভাবছো আগের মতই এখনো যেখানে খুশি সেখানে গড়িয়ে গড়িয়েই যেতে পারবে?’
‘আমি সেরকম ভাবি না। ’
‘তুমি আসল জিনিসটাই ভুলে গেছ-- আমার নাম। জো জো লা পাস্যে : জো জো দা ক্রাপস। ’
‘ঠিক হ্যায়, অর্থাৎ তুমি একজন পেশাদার জুয়াড়ী। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে এর সঙ্গে ওই গাধার মত পরিশ্রম করতে যাওয়ার সম্পর্কটা কি?
‘আমিও না। ’ দ্বিগুণ উদ্ভাসিত হয়ে সে বললো।
তার মানে? আমরা কি তাহলে খনি থেকে হীরক তুলতে যাচ্ছি না?
তাহলে, এগুলো আমরা পাচ্ছিটা কোথায়?
‘মাইনারদের পকেট থেকে। ’
‘কিভাবে?’
‘প্রতিরাতে ডাইসের খেলায় জিতে নেব, হারবোও কখনো কখনো। ’
‘তোমার কুবুদ্ধি ধরতে পেরেছি, দোস্ত। আমরা কখন রওনা হচ্ছি?’
‘এক মিনিট। ’

তার কথা আমাকে প্রভাবিত করতে পেরেছে দেখে সে খুবই আত্মতৃপ্ত হয়েছে। ধীরগতিতে ও উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মাঝখানে একটি টেবিল টেনে আনলো, এর উপর একটি কম্বল বিছিয়ে ছয়জোড়া ডাইস বের করলো। ‘ভাল করে দেখ। ’ খুব যত্নে ওগুলো পরীক্ষা করলাম। কোন ফাঁকি নজরে পড়লো না।
‘কেউ বলতে পারবে না যে এই ডাইসগুলোতে কারিগরি করা হয়েছে, পারবে?’
‘কেউ না। ’
‘সে একটা মাপার গজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘মেপে দেখ। ’ একটা পাশ খুব যত্নের সাথে ঘসে ফাইল করে পালিশ করা হয়েছে। এটাকে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের একভাগের চেয়েও কম ছোট করা হয়েছে। ধরার উপায় নাই। ‘চেষ্টা করে সাত বা এগারো ফেল। ’ আমি ডাইস ঘোরালাম, না সাত না এগারো, দুটোর কোনোটাই উঠলো না। ‘এবার আমার দান। ’ জো জো দ্রুত কম্বলে হাল্কা একটা ভাঁজ ফেললো। আঙুলের আগা দিয়ে সে ডাইসগুলো ধরে আছে। ‘এটাকে আমরা নিপারস বলি,’ ওগুলোর দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘আমরা শুরু করলাম। আর এই দেখ সাত, এখানে দেখ এগারো! এবার সাত। আবারো সাত! তুমি ছয় তুলতে চাও! বুম, এই দেখ ছয়! ছয়ের সাথে চার এবং দুই অথবা পাঁচ আর এক? এই  হল গিয়ে ব্যাপার। জনাব কি সন্তুষ্ট হয়েছেন?’
আমি চমৎকৃত হয়ে গেলাম, পুরোমাত্রায় চমৎকৃত। এর আগে কখনো এরকম দেখিনি। এটা অত্যাশ্চর্য কাণ্ড। কারচুপির সামান্যতমও ধরা যাচ্ছে না।


‘শোন, দোস্ত, আমি সারাজীবন জুয়া খেলে এসেছি। আমি বুত্তে থেকে শুরু করি, তখন আমার বয়স মাত্র আট। আমি ঝুঁকি নিয়েছি বাজি জিতার জন্য বন্ধু, এই ধরনের ডাইস নিয়ে আমি বাজি জেতার ঝুঁকি নিয়েছি। আর জানো কোথায়? গারে ডি ল’এসট-এর জুয়ার টেবিলে। রজার সোল এন্ড কোম্পানির সময়ে। ’
‘আমার মনে পড়ছে। পুরনো কিছু ঘাঘু মাল ছিল সেখানে। ’
‘আমাকে শিখিও না! আর যারা ওখানে নিয়মিত আসতো তাদের মধ্যে যেমন ছিল ছন্নছাড়া লোক, বেশ্যার দালাল, ধুরন্ধর চালাক আর গোবেচারা তেমনি ছিল জো জে-লা-বিউ’র মত কুখ্যাত পুলিশ, লা মেডেলিয়েনের বেশ্যার দালাল-পুলিশ, আর গ্যাম্বলিংস্কোয়াড থেকে আসা বিশেজ্ঞরা। এবং এদের সবাইকেই অন্যদের মত মক্কেল বানানো হয়েছে। তাই তুমি বুঝতে পারছো এখন মাইনারদের ক্যাম্পে একই ধরনের খেলা চালিয়ে বাজি জেতায় সম্ভাব্য কোন বিপদ নেই। ’
‘সঠিক। ’
‘কিন্তু মনে রেখ: এ ধরনের স্থানগুলোর প্রতিটি অন্যটির মতই সমান বিপজ্জনক। গারে ডি ল’এসট-এর জুয়ারীরা এখানের মাইনারদের মতই দান মারায় দক্ষ ছিল। স্রেফ একটা পার্থক্য: প্যারিসে দান মেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি জায়গা ছেড়ে লাপাত্তা হয়ে যেতে পারো। কিন্তু খনিতে দান মারার পরও তোমাকে অবস্থান করতে হয়। সেখানে অবশ্য আইনের কোন শূকর শাবক পাবে না। মাইনাররা নিজেরাই নিজেদের আইন তৈরি করে সেখানে। ’ একটু বিরতি দিয়ে ও ধীরে ধীরে নিজের গ্লাস শেষ করলো, আবার বলা শুরু করলো, ‘এখন বল, প্যাপিলন, তুমি আমার  সঙ্গে আসছো তো?’

আমি একটু চমকালাম। কিন্তু এর রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অভিযানের নেশা আমাকে তাড়িত করলো। নির্দ্বিধায় বলা যায় কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ; ওই মাইনাররা নিশ্চয় দুগ্ধযোগ্য শিশু নয়-- ঘাঘু মালই হবে সব কটা; তবে সেখানে বড় দান মারার সুযোগ আছে। কি হলো, প্যাপিলন, বাজি ধর জোজোর উপর। এবার আরও একবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কখন রওনা হচ্ছি?’
‘আগামীকাল বিকেলে, যদি তুমি চাও, পাঁচটায়, দিনের তাপ কমে এলে। এ সময়ে আমারা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে পারবো। প্রথমে আমরা রাত্রিতেই চলবো। তোমার কাছে বন্দুক আছে?’
‘না। ’
‘ভাল কোন ছোরা?’
‘কোন ছুরিই নেই। ’
‘ঘাবড়াও মাৎ। আমি তার ব্যবস্থা করবো। সিয়াও। ’

মারিয়ার কথা ভেবে বাসায় ফেরত এলাম। আমার ক্যারাকাসে যাওয়ার চেয়ে জঙ্গলে যাওয়া ও বেশি পছন্দ করবে। পিকোলিনোকে ওদের কাছে রেখে যাবো। আর তারপরই আগামীকাল, আমি হীরার সন্ধানে বের হবো। শুরু হবে এবং সাত! আর এগারো’র চক্কর! ওয়ান্স, সিয়েতে, এত সেপ্ত, এত ওনজে। আমি মনে মনে সেখানে পৌঁছে গেছি ইতিমধ্যে, বাকি শুধু সবগুলো নাম্বার স্প্যানিশ, ইংলিশ, ব্রাজিলিয়ান আর ইটালীয় ভাষায় শিখে নেওয়া।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/91512-13191420111104191539.jpgজোসেকে বাসায় খুঁজে পেলাম। তাকে জানালাম আমার মত পরিবর্তন করেছি। ক্যারাকাসে অন্য সময়ে যাওয়া যাবে; বর্তমানে আমি জোজো নামের শুভ্রকেশ এক ফরাসির সঙ্গে ডায়মন্ড মাইনারদের ডেরায় রওনা হচ্ছি।
তুমি কি হিসাবে যাচ্ছো?’
‘অবশ্যই তার পার্টনার হিসেবে। ’
‘সে সবসময়েই তার পার্টনারদেরকে নিজের জিতের অর্ধেক দিয়ে থাকে। ’
‘সেটাই নিয়ম। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছে তাদেরকে কি চেন তুমি?’
‘তিনজন। ’
‘তারা কি মোটা টাকা বাগাতে পেরেছিল?’
‘ঠিক আমি জানি না। তবে অনুমানে বলতে পারি, তাদের প্রত্যেকেই তিন চারটি করে ট্রিপ মেরেছিল জোজোর সঙ্গে। ’
‘এরপর?’
‘এরপর? তারা আর ফিরে আসেনি। ’
‘কি কারণে? তারা কি খনি এলাকায় আবাস গেরেছে?’
‘না। তারা সবাই মারা গিয়েছিল। ’
‘তাই নাকি? অসুখে ধরেছিল কোন?’
‘না, মাইনারদের হাতে মারা পড়েছিল। ’
‘ওহ্। জোজো দেখছি বারবারই পার পেয়ে গেছে; বলতেই হয় ভাগ্য বটে একখান। ’
‘হ্যাঁ। কিন্তু জোজো, সে খুব চেনা চেহারা। সে কখনোই নিজে বেশি জেতে না। সে এই কৌশল করে যাতে তার পার্টনার জিততে পারে। ’
‘বুঝতে পারছি। অর্থাৎ অন্য লোকটি সব সময়ে বিপদে থাকছে; জোজো না। জেনে ভালই হলো। ধন্যবাদ, জোসে। ’
‘আমার কাছে এসব শোনার পর, তুমি এখন যাচ্ছো না?’
‘শেষ প্রশ্ন, এবং আমাকে সোজাসাপ্টা উত্তর দিবে, দুই তিনটা ট্রিপ মারার পর বেশ টাকা কামিয়ে ওখান থেকে ফেরত আসার কোন রাস্তা আছে কি?’
‘অবশ্যই। ’
‘তাহলেতো জোজো ধনীই। কেন সে তাহলে বারবার সেখানে যায়?’
‘আমি যেমন বলেছি; জোজোর সঙ্গে শুরু করতে কোনই বিপদ নেই। দ্বিতীয়ত, সে কিন্তু আসলে ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ’
‘আমার জন্য তোমার আর কি উপদেশ আছে?’
‘যেও না। ’
‘সেটা না। আমি যাওয়া মনস্থ করেছি। এছাড়া আর কি?’

জোসে চিন্তাক্লিষ্টভাবে তার মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেললো। দীর্ঘ বিরতি। যখন সে মাথা তুললো তার চেহারা উজ্জল দেখাচ্ছিল, চোখে বুদ্ধি ঝিলিক দিচ্ছে। ধীরে ধীরে, স্বগতোক্তির মত সে বললো, সেই লোকটার উপদেশ গ্রহণ কর যে ওই জগৎ সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানে। প্রত্যেকবারই ওখানে একটা বড় খেলা হয়। সত্যিকারের বড় দানের খেলা-- যখন দেখবে তোমার সামনে প্রচুর হীরা জমা হয়েছে আর পুরো পরিস্থিতি বিস্ফোরণোম্মুখ অবস্থায়। অপ্রত্যাশিতভাবে উঠে দাঁড়াও এবং নিজের জেতা মাল নিয়ে সেখানে আর বসে থেকো না। সবাইকে বলবে তোমার পেট ব্যথা করছে এবং সরাসরি টয়লেটে চলে যাও। এবং অবশ্যই আর ফেরত আসবে না; আর সে রাত্রে অন্য কোথাও ঘুমাবে, নিজের জায়গায় না?
‘চমৎকার, জোসে। এরপর?’
‘যদিও খনিতে ক্রেতারা এল ক্যালাও বা সিঁউদাদ বলিভারের চেয়ে বেশ কম দামই দেয়-- তারপরেও তোমাকে যেহেতু সমস্ত জেতা হীরে বেচতে হবে, ওগুলো বিক্রি করে দাও। আর কখনো নগদ টাকা নিতে যেও না। তোমার নামে ওদের কাছ থেকে রশিদ লিখে নাও যাতে এল ক্যালাও বা সিঁউদাদ বলিভারে এগুলো ভাঙাতে পারো। বিদেশি টাকার ক্ষেত্রেও একই কাজ করবে। সবাইকে বলো যে তুমি যা জিতেছো তা একদিনেই হেরে যাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে এ কাজ করছো। এবং তুমি যা করছো তা সবাইকে বলে বেড়াও যাতে ব্যাপারটা সবাই ভালভাবে জানে। ’
‘অতঃপর এই পন্থায় আমি ফিরে আসার একটা সুযোগ পাবো?’
‘হ্যাঁ, তুমি জ্যান্ত ফেরত আসার একটা সুযোগ পাবে, যদি ঈশ্বর ইচ্ছা করেন। ’
‘অনেক ধন্যবাদ, জোসে। বুয়েনাস নোচেস। ’

রমণক্লান্ত হয়ে মারিয়ার বাহুডোরে শুয়ে আছি। আমার মাথা ওর বুকের খাঁজে গুঁজে আছি; ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ অনুভব করছি আমার গালে। অন্ধকারে ডুবে, ঘুমে তলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আমার সামনে হীরকের এক স্তূপ দেখতে পেলাম। যখন ঘুমের কোলে সম্পূর্ণ সমর্পিত হলাম তখন আমার মনের পর্দায় ছিল জোজোর বুদ্ধিদীপ্ত সরল চোখ, পূর্ণ আলোয় ঝকঝক করছে--- একমাত্র যেসব লোক প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে তাদেরই এরকম চোখ থাকে।

সকালটা খুব দ্রুত কেটে গেল। সবকিছু গোছানো হয়েছে। পিকোলিনো এখানে থাকছে, তার যত্নআত্তির কমতি হবে না এখানে। সবাইকে চুমু খেলাম। মারিয়াকে হাসিখুশি লাগছে। সে জানে যে আমি যদি খনিতে যাই তাহলে আমাকে এপথেই ফিরে আসতে হবে, অন্যদিকে যারা ক্যারাকাস যায় তারা কখনো ফেরে না সেখান থেকে। সে আমার সাথে পথের শেষ পর্যন্ত চললো। পাঁচটা বাজছে, জোজো সেখানে উপস্থিত ছিল এবং প্রচণ্ড উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে।

‘কি খবর, বন্ধু! সব ঠিক? সময় জ্ঞান আছে তোমার-- এটা ভাল?’ এক ঘণ্টার মধ্যেই সূর্য ঢলে পড়বে। সেটাই ভাল হবে। রাতে আমাদেরকে কেউ অনুসরণ করতে পারবে না। ’
একডজন চুমু খেলাম আমার সত্যিকারের ভালবাসাকে, এরপর স্যাডলে চেপে বসলাম। জোজো আমার রেকাব বেঁধে দিল। রওনা দেয়ার মুহূর্তে মারিয়া বললো, ‘সর্বাগ্রে, মি. এমোর, দরকারি মুহূর্তে  শৌচাগারে যেতে ভুলো না যেন। ’

খচ্চরের পেটে গোড়ালীর খোঁচা মারতে গিয়ে আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। ‘তুমি দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে তাহলে সব শুনে ফেলেছো, বিশ্বাসঘাতক জুডাস কোথাকার। ’
‘প্রেমে পড়লে, এটাই স্বাভাবিক। ’

আমরা দূরে চলে এসেছি এখন, জোজো ঘোড়ায় আর আমি খচ্চরে। এই নিষ্কলুষ জঙ্গলের নিজস্ব পথ রয়েছে, এগুলোকে পিকস বলে। পিকস হচ্ছে দুই গাছের মত চওড়া জঙ্গল কেটে বের করা একধরনের গলিপথ, লোকজন যারা এ পথে চলাচল করে প্রত্যেকেই তাদের ম্যাশেটে ব্যবহার করে এগুলোকে প্রয়োজনমত চলার উপযোগী রাখে। উভয় পার্শ্বে সবুজের দেয়াল, মাথার উপরে লক্ষ লক্ষ পাতায় ছাওয়া ছাদ। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গল এটা, সেলভা এর নাম। এই বন দুই ধরনের উদ্ভিদের দুর্ভেদ্য জটা দিয়ে তৈরি। প্রথমে আসে বিভিন্ন জাতের লতার মিশেল, গাছপালা যেগুলো উচ্চতায় বিশ ফিটের বেশি নয়। এরপর রয়েছে সত্তর থেকে একশ’ ফিট উচ্চতার বিশাল সব গাছের বড় বড় মাথা যেগুলো একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে সূর্যকে ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যদিও এদের মাথাগুলো সূর্যের আলোয় আলোকিত, তবে পাতাবহুল চওড়া শাখাগুলো একটা ভারী পর্দার মত তৈরি করে, যাতে সূর্যের তেজোদীপ্ত আলো বাঁধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু হালকা, ছাঁকনিতে ছাঁকা এক ধরনের ছায়াময় আলো ছড়িয়ে থাকে ভিতরে।

জঙ্গলে মানুষের স্রেফ একটা শত্রুই আছে যা সত্যিকারে ভাবিত করে। সেটা হচ্ছে পশুর পশু, সবচেয়ে বুদ্ধিমান নিষ্ঠুরতম পাপীষ্ঠতম, সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ, সবচেয়ে রহস্যময় এবং অবশ্যই সবচেয়ে অদ্ভূত জন্তু-- মানুষ।

[চলবে]

ব্যানকো [পর্ব-৫], [পর্ব-৪], [পর্ব-৩], [পর্ব-২], [পর্ব-১]

বাংলাদেশ সময় ১৭২০, নভেম্বর ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।