ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কহেন যেমন জারাথুস্ট্রা : ফ্রেডরিখ নিৎশে

ভূমিকা ও অনুবাদ: কামাল রাহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১১
কহেন যেমন জারাথুস্ট্রা : ফ্রেডরিখ নিৎশে

  জারাথুস্ট্রার, গ্রিসীয় উচ্চারণে জোরাস্টার, জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় মাত্র। তাঁর ‘প্রকৃত’ ইতিহাস পুরোটাই অনুমাননির্ভর।

গ্রিকদের অনুমান, প্ল্যাটোর ছয় হাজার বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন তিনি। অনেক পণ্ডিতের ধারণা, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শুরুতে কেটেছে তাঁর জীবনকাল। আবার অনেকে তাঁর আভেস্তা গ্রন্থের ভাষিক ইতিহাস ধরে চৌদ্দ অথবা তেরো খৃষ্টপূর্ব শতক অনুমান করেন। তাঁর জন্মস্থান ও জীবনযাপন কোথায় করেছেন তিনি, এ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। পূর্ব ইরান, আফগানিস্তান অথবা তুর্কমেনিস্তানের কোথাও হতে পারে এটা।

 

পাশ্চাত্যের অনেকের মতে, পৃথিবীর প্রথম নবী বলে কথিত জারাথুস্ট্রার জীবনে পরিবর্তন আসে যখন তাঁর প্রভু আহুরমাজদা এক দিব্যদৃষ্টি প্রদান করেন তাঁকে। ‘শুভভাবনা’ নামে এক পুণ্যশক্তি নেমে আসে তাঁর কাছে, এবং আদেশ দেয়, সে-সময়ের ইরানের প্রথাগত বিধান, রক্তঝরানো বলিদান, প্রভৃতি বন্ধ করে দিতে, এবং দরিদ্রদের সাহায্য করতে। এক বাণীতে বলেন তিনি :

 

তোমাকে পুণ্যভাবে গ্রহণ করেছি, হে আহুরমাজদা, যখন তোমার ‘শুভভাবনা’ নেমে আসে আমার কাছে, এবং জিজ্ঞাসা করে : ‘কে তুমি? এবং কার কাছে তোমার আনুগত্য?’  [...]

তখন জবাবে বলি: ‘জারাথুস্ট্রা আমি; মিথ্যাবাদীদের সাক্ষাৎশত্র্রু, কিন্তু সত্যবাদীদের জন্য সাহায্যকারী ও জয়োল্লাসী। [...]                                   

 

জারাথুস্ট্রা প্রচার করতে শুরু করেন যে,এক সর্বময় ঈশ্বর আছেন, ‘মহাজ্ঞানী প্রভু’ আহুরমাজদা, যিনি সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব, মানবকূল এবং সকল শুভ বস্তু, তাঁর পুণ্যশক্তি স্পেন্তা মাইনিউ দিয়ে। অবশিষ্ট বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ছয়টি অন্য শক্তি আমেসা স্পেন্তাস দিয়ে। শুভ ও অশুভ দুই শক্তি সার্বক্ষণিক সংঘর্ষে লিপ্ত। শুভজয়ের জন্য মানুষকে শুভশক্তির পক্ষে কাজ করতে হয়। শেষ বিচার সম্পর্কে মানুষকে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি, বলেছেন, সত্যের অনুসারীরা যাবে স্বর্গে ও মিথ্যাশ্রয়ীরা নিক্ষিপ্ত হবে নরকে। জারাথুস্ট্রার শিক্ষার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, শয়তানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিশেষ শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন তিনি। এসব মিলে যায় ঋগ্বেদের সঙ্গে! অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ঋগ্বেদের ভাষা পূর্ব ইরানে ব্যবহৃত হতো। ধারণা করা যায়, পাঞ্জাবে প্রচলিত পুরাতন ধর্মের বিপক্ষে ছিলেন জারাথুস্ট্রা। ভগবান মিথ্রার শিক্ষার সঙ্গে জারাথুস্ট্রার মতবাদ সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে যায়। এটা মনে করা যায় যে, জারাথুস্ট্রার সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়, তাঁর পরিবারের সদস্যরাও তাঁকে আশ্রয় দেয়নি। কোরাস্মিয়া অথবা আরিয়ার শাসক রাজা হিস্টাস্পেস তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন, এবং রাজ-আদালতে এই নবী মিথ্রার সঙ্গে বিতর্কে জড়ালে তাঁর মতবাদ জয়ী হয়। হিস্টাস্পেসের উদাহরণ অনুসরণ করে অনেকে জারাথুস্ট্রার নতুন ধর্মমতে দীক্ষা নেয়। সাতাত্তর বছর বয়সে আগ্রাসী যাযাবরদের হাতে নিহত হন তিনি। অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত জারাথুস্ট্রাকে একেশ্বরবাদিতার প্রথম প্রবর্তক হিসেবে উল্লেখ করলেও এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।

 

বিশ্বের প্রথম দিকের ধর্মগুলির উৎপত্তির সময়ে জারাথুস্ট্রা ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে দাবি করেন এক নৈতিক দৃঢ় অবস্থান। তাঁর শিক্ষা খুব জোরালোভাবে দ্বৈতবাদী। বিশ্বাসীদের ভালো অথবা মন্দ, যে কোনো একটা পক্ষাবলম্বন করতে হয়। বিশ্বাসীদের পবিত্র দায়িত্ব আহুরমাজদার পক্ষাবলম্বন করা, যা সম্ভব মিথ্যাকে ত্যাগ করে, দরিদ্রকে সহায়তা দিয়ে, বিভিন্ন রকম উৎসর্গ দান করে, অগ্নিপ্রথা বজায় রেখে, প্রভৃতিভাবে।

 

তিন থেকে আট হাজার বছর পর, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নিৎশে পুনরাবিষ্কার করেন এই পার্সি মহাপ্রাজ্ঞ ঋষি জারাথুস্ট্রাকে।   তাঁর ‘দাজ স্পেইক জারাথুস্ট্রা’ গ্রন্থটি সে-সময় এক অভাবনীয় আলোড়ন সৃষ্টি করে।

 

নিৎশে বলেন, ‘ঈশ্বর মৃত, খ্রিস্টীয় ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু, এটা মানবতাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক দাসত্বের আদর্শে যা এ জীবনের নয়, সম্পর্কিত পরবর্তী জীবনের জন্য। ’ অদৃশ্য ঈশ্বরকে বাতিল করে নিৎশে আবার উল্টো আশা করেন ঐ ঈশ্বরেরই গুণাবলি-সম্পন্ন এক ‘মহামানব’, যিনি ঈশ্বরসম মহাশক্তি দিয়ে একটা বীরোচিত আদর্শ সৃষ্টি করে মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন! নিৎশের মতবাদ নাৎসীদের দ্বারা অপব্যবহৃত হয়েছে মারাত্মকভাবে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে অনেক মনিষী তাঁর চিন্তা-চেতনা ও মতবাদ দ্বারা ব্যপকভাবে প্রভাবিত হন। বার্ণার্ড শ, আঁদ্রে জিদ, টমাস মান, লরেন্স, সার্ত্রে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

 

 http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/nietzsche_walrus_mustache-274x30020111102174443.jpgনিৎশে ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর মৃত। কিন্তু নিৎশের দুর্ভাগ্য যে, ঈশ্বর এখনো জীবিত, তিনিই মৃত। শেষ বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন নিৎশে, এবং অসুস্থ অবস্থায় মারা যান।

 

নিৎশের অমর গ্রন্থ ‘দাজ স্পেইক জারাথুস্ট্রা’ থেকে জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠের দশটি পর্ব অনুবাদ করা হয়েছে এখানে। নিৎশের ভাবনা থেকে বর্তমান সময়ের ভাবুকদেরও অনেক কিছু নেওয়ার আছে।

 

জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ১ 

জারাথুস্ট্রার বয়স যখন ত্রিশ, বাড়ি ছেড়ে যান তিনি, এবং ছেড়ে যান বাড়ির হ্রদ, উঠে যান পর্বতের আশ্রয়ে। সেখানে উপভোগ করেন তাঁর আত্মশক্তি, ও একাকীত্ব, এবং সে-সবে ক্লান্ত হননি পরের দশ বছরেও। অতঃপর পরিবর্তন আসে তাঁর অন্তরে, এবং এক গোলাপি প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে উঠে সূর্যের সামনে যেয়ে দাঁড়ান, এবং বলেন :

 

হে প্রণম্য নক্ষত্র! বিকিরণে কী সুখ তোমার, যদি না তা বিকীর্ণ হয় যাদের জন্য এসব আলো!

দশটি বছর ধরে দেখি তুমি উঠে আসো এখানে, গুহার কন্দরে আমার! হতে পারতে ক্লান্ত কখনো ওই আলো ও অনন্ত-যাত্রা নিয়ে তোমার, যদিও জানি, কেবল আমার জন্যই নয় এটা, এমন কি নয় আমার ঈগল ও কেউটের জন্য।

 

অথচ প্রতি প্রভাতে অপেক্ষা করেছি তোমাকে দেখার জন্য, অক্লেশে গ্রহণ করেছি তোমার উপচে পড়া আলো, এবং গুণকীর্তণ করেছি এজন্য তোমার।

 

দেখো! জ্ঞানের ভারে ক্লান্ত আমি ঐ মধুমাছিটির মতো, অতিরিক্ত মধু সংগ্রহ করেছে যে, বাহু প্রসারিত করতে হয় এখন ওটাকে ধরে রাখার জন্য।

 

বিলিয়ে দিতে পারতাম ওটা, অথবা ভাগ করে নিতে, যেন ঐ জ্ঞান একদা আরো উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারত, ঐ মূঢ়তার আধারে।

 

অতএব, অবশ্যই নেমে যেতে হবে আমাকে ঐ গভীরে, যেমন তুমি তা করো সন্ধ্যেবেলা, যখন নেমে যাও সাগরের ওপারে, এবং ছড়িয়ে দাও তোমার অবিনাশী আলো, পৃথিবীর অপরাংশেও! হে বিপুলা নক্ষত্র!

 

তোমার মতোই নেমে যেতে হবে আমাকে, নিচে, যেমন মানুষেরা বলে, কার কাছে প্রণত হবো আমি।

বর দাও আমাকে এখন, যেমন তোমার প্রশান্ত চোখ দুটো সর্বোচ্চ সুখও ধরতে পারে না, কাতর না হয়ে।

প্রদান করো আমাকে ঐ পাত্র, কানায় কানায় যা পূর্ণ, এবং যেথা হতে ঝরে জল স্বর্ণ-রেণু হয়ে, বয়ে যায় সবখানে, স্বর্গসুখের হিরন্ময় দ্যুতি তোমার।

দেখো! এ পাত্রটিও আবার শূন্য হতে চলেছে নিজেই, এবং এক মানুষে পরিবর্তিত হতে চলেছে জারাথুস্ট্রা আবার।  

এভাবেই শুরু জারাথুস্ট্রার অবরোহণ!

 

জারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ: ২ 

পর্বত বেয়ে একাকী নেমে যান জারাথুস্ট্রা, দেখা হয় না কারো সঙ্গে। বনের ভেতর ঢোকেন যখন, অকস্মাৎ এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায় তাঁর সম্মুখে, নিজের শেকড়ের খোঁজে ছেড়ে এসেছে যে তার পবিত্র শয্যা। এবং জারাথুস্ট্রার কাছে বলেন এখন ঐ বৃদ্ধ :

 

এই ভবঘুরে মানুষটা অপরিচিত নয় মোটেও আমার কাছে, অনেক বছর আগে এ পথ ধরে চলে গেছে সে। জারাথুস্ট্রা বলতো ওকে লোকে, কিন্তু এখন বদলে গেছে সে।

 

অতঃপর ফিরে গেছো তুমি ভস্ম হয়ে আবার ঐ পর্বতে: এবার কি নিয়ে যাবে তোমার আগুন ঐ উপত্যকায়? ভয় করে না তোমার আগ্নেয় অন্তিমে?

 

দেখো, জারাথুস্ট্রাকে চিনতে পেরেছি আমি। ওর চোখ নিষ্কলুষ, ওর মুখের প্রতি নেই কোনো বিরূপ দৃষ্টিক্ষেপ। একজন নর্তকের মতোই কি চলে যায় না সে?

 

বদলে গেছে জারাথুস্ট্রা; এক শিশুতে পরিণত হয়েছে জারাথুস্ট্রা, একজন জেগে যাওয়া মানুষ জারাথুস্ট্রা : ঘুমের এই নগরীতে কী করবে তুমি?

 

সমুদ্রে যেমন নীরবতার ভেতর বাস করেছো; এবং এটা বাহিত হয়েছে যেমন সেখানে, হায়, এবার কি কূলে ফিরে যাবে? হায়, আবার কি বয়ে নিয়ে যাবে নিজের শরীর তোমার?

 

জবাবে বলেন জারাথুস্ট্রা : আমি ভালোবেসেছি মানবতা!

জিজ্ঞেস করেন ঐ সাধু, কেন এই অরণ্য ও মরুতে ভ্রমণ করেছি আমি? এ কারণে নয় যে অনেক বেশি ভালোবাসি আমি মানুষে?

 

এখন আমি ভালোবাসি ঈশ্বরে : মানুষে ভালোবাসি না আর। আমার কাছে মানুষ এখন এক অতি অপূর্ণ সত্তা। মানুষকে ভালোবাসা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে আমার কাছে।

 

জবাবে বলেন জারাথুস্ট্রা : কী বলেছি আমি ভালোবাসা বিষয়ে! আমি বয়ে এনেছি মানুষের জন্য সেরা উপহার।

 

কিছুই দিও না ওদের, বলেন সাধু। বরং কিছুটা নিয়ে নাও ওদের বোঝা, এবং বয়ে চলো ওদের সঙ্গে সে-সব, ওটা হবে অনেক বেশি স্বীকৃতি ওদের কাছে : যদি তোমার কাছেও স্বীকৃতি হয় এটা।

 

তারপরও যদি কিছু দাও তুমি, দিও না ওদের ভিক্ষামুষ্ঠির অধিক কিছু, ওটাও আবার নিতে দিও ভিক্ষে করে।

 

না, জবাবে বলেন জারাথুস্ট্রা, ভিক্ষা দিই না আমি, এত দরিদ্র নই আমি।

 

হেসে ওঠেন ঐ সাধু, এবং বলেন : দেখো তবে কীভাবে গ্রহণ করে তোমার কোষাগার ওরা! সন্ন্যাসীদের প্রতি আস্থা নেই ওদের, এবং বিশ্বাস করে না যে উপহার নিয়ে এসেছি আমরা।

 

ওদের চলার পথে আমাদের পায়ের শব্দ ফাঁকা আওয়াজ তোলে। এবং ঐসব রাত্রির মতো, যখন ওরা বিছানায় থাকে, এবং সূর্যোদয়ের অনেক আগে শোনে একজন মানুষের আনাগোনা, এবং আমাদের বিষয়ে নিজেদের জিজ্ঞেস করে : চোরেরা যায় কোথায়?

 

যেও না মানুষের কাছে, বনে থাকো বরং। পশুদের কাছে যাও। কেন আমার মতো হও না-- ভালুকের সঙ্গে আরো এক ভালুক, পাখিদের সঙ্গে আরো এক পাখি?

 

এবং বনের ভেতর কী করে সন্ন্যাসীরা? জিজ্ঞেস করেন জারাথুস্ট্রা।

 

জবাবে বলে সাধু : পদ্য রচনা করি, এবং গাই ওগুলো; এবং ঐ স্তব রচনা করে আমি হাসি ও কাঁদি ও বিড়বিড় করি : এভাবেই ঈশ্বর বন্দনা করি আমি।

 

গান গেয়ে, অশ্রু ঝরিয়ে, হেসে, কেঁদে ও বিড়বিড়িয়ে আমি ঐ ঈশ্বরের পূজা করি, যিনি একান্তই আমার। কিন্তু উপহার হিসেবে কী নিয়ে এসেছো তুমি আমাদের কাছে?

 

জারাথুস্ট্রা যখন এসব বাণী শোনেন, অবনত হন ঐ সাধুর কাছে এবং বলেন : কী দেওয়ার আছে তোমাকে আমার! এবং এভাবে ওরা একে অপরকে ছেড়ে যায়, ঐ বৃদ্ধ মানুষ ও জারাথুস্ট্রা, পাঠশালার শিশুদের মতো হাসতে হাসতে।

 

যখন একাকী ছিলেন জারাথুস্ট্রা, নিজের অন্তরের কাছে বলেন তিনি : এটাও কী সম্ভব! বনের এই সাধু মানুষটা এখনো শোনেনি যে, ঈশ্বর মৃত!

 

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/Nietze e-book20111102182637.jpgজারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ৩ 

বনের কাছে গড়ে ওঠা শহরে যখন পৌঁছেন জারাথুস্ট্রা, দেখেন এক বাজারে জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ, ঘোষণা দেয়া হয়েছে দড়ি-নর্তক খেলা দেখাবে ওখানে এবং জারাথুস্ট্রা ওদের কাছে বলেন :

 

অতিমানব বিষয়ে শেখাব তোমাদের আমি। এমন একটা কিছু মানুষ, যাকে অতিক্রম করে যেতে হবে। কী করেছো তোমরা মানুষকে অতিক্রম করার জন্য?

 

নিজেদের অতিরিক্ত কিছু না কিছু করেছে সবাই এখানে এ পর্যন্ত, এবং ঐ জোয়ারের আরো এক ঢেউ হতে চাও তুমি, পশুদের কাছে বরং ফিরে যাও না কেন মানুষকে অতিক্রম করার আগে?

 

একজন মানুষের কাছে শিম্পাঞ্জি কি? হাসি-জাগানো এক প্রাণী, লজ্জার এক বিষয়। এবং অতিমানবের কাছে মানুষও একই : হাসি-লাগা এক লজ্জা।

 

কীট থেকে মানুষে পরিণত হয়েছো তুমি, এবং তোমার ভেতরে এখনো কীটের অংশটাই বেশি। একদা শিম্পাঞ্জি ছিলে তুমি, তথাপি যে-কোনো শিম্পাঞ্জি থেকেও বেশি শিম্পাঞ্জি এখন মানুষ।

 

এমনকি, যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী তোমাদের মধ্যে, সে কেবলই এক অসঙ্গতি এবং উদ্ভিদ ও ছায়াশরীরের সঙ্কর। কিন্তু তোমাকে কি আমন্ত্রণ জানাই আমি একটা ছায়াশরীর অথবা উদ্ভিদ হতে?

 

দেখো, অতিমানব বিষয়ে শেখাবো তোমাদের আমি!

 

এ পৃথিবীর অর্থ দাঁড়ায় এই অতিমানবে। তাহলে তোমার ঈপ্সা বলুক : অতিমানব হবে পৃথিবীর অর্থ!

 

মিনতি জানাই তোমাদের, আমার ভায়েরা, সত্য থেকো এ পৃথিবীর কাছে, এবং বিশ্বাস করো না ওদের কথা, যারা অতিজাগতিক সব আশার কথা বলে তোমাদের! বিষে ভরা অন্তর ওদের, ওরাও জানে এটা, অথবা জানে না। জীবনের জন্য ঘৃণিত ওরা, ধ্বংস করে ফেলে, বিষাক্ত করে ফেলে অন্যদের, এবং নিজেদেরও, এদের প্রতি ক্লান্ত এখন বিশ্ব : অতএব দূরে থাকো ওদের থেকে! একদা ঈশ্বরনিন্দা ছিল সব চেয়ে বড় নিন্দা : কিন্তু ঈশ্বর এখন মৃত, এবং সেই সঙ্গে ঐ নিন্দুকেরা। বিশ্বের নিন্দা এখন ভয়াবহ পাপ, অজানা কিছু হতে অর্থপূর্ণ বিশ্বের অবস্থান উর্ধে রাখো চিত্তে তোমার।

 

আত্মা যখন অবজ্ঞাভরে তাকায় শরীরের প্রতি, এবং তখন ঐ অবজ্ঞা যেন চূড়ান্ত বিষয় : আত্মা চায় দেহ হোক বিচূর্ণ, অপর্যাপ্ত ও মুমূর্ষু। শরীর ও পৃথিবী হতে এভাবে পালিয়ে যাওয়ার বিষয় ভাবে আত্মা।

 

আহা, ঐ আত্মা নিজেই বিবর্ণ, খণ্ডিত ও মৃতের শামিল : এবং নিষ্ঠুরতা ছিল ঐ আত্মার দ্যুতি!

 

কিন্তু তুমিও, ভাই আমার, বলো আমাকে : তোমার শরীর কি বলে তোমার আত্মা বিষয়ে? তোমার আত্মাও কি নিঃস্ব নয়, দূষিত ও আত্মপ্রসাদে পীড়িত নয়?

 

বস্তুত, এক দূষিত স্রোতধারা হচ্ছে মানুষ। অবশ্যই সমুদ্র হতে হবে কাউকে, দূষিত ধারার প্রবাহ শুষে নিতে, নিজে কলুষিত না হয়ে।

 

দেখো, অতিমানব বিষয়ে শেখাবো তোমাদের আমি : তিনি হচ্ছেন ঐ সমুদ্র : ওখানে বিলুপ্ত হতে পারে তোমার বিপুল অবজ্ঞা।

 

সবচেয়ে বড়, কী এমন বিষয়ে অভিজ্ঞতা পেতে পারো তুমি? চূড়ান্ত অবজ্ঞার সময় ওটা। ঐ সময় যখন তোমার সর্বময় সুখও বিরাগ বয়ে আনে, এবং তোমার আদর্শ ও সদগুণাবলিও তাই করে।

 

এখন ঐ সময় যখন তুমি বলো : ‘শ্রেয়তর কীভাবে সুখ আমার! এটা এক দীনতা ও দূষণ ও আত্মপ্রসাদে পীড়িত! কিন্তু আমার সুখের উচিত অস্তিত্বের যথাযথ নিজেরই প্রতিপাদন করা!’

 

এখন ঐ সময় যখন তুমি বলো : ‘সুযুক্তিতে ভালো কী রয়েছে আমার? খাদ্যের জন্য যা করে সিংহ এটা কি তেমনই না? এটা এক দীনতা ও দূষণ ও আত্মপ্রসাদে পীড়িত!’

 

এখন ঐ সময় যখন তুমি বলো:  ‘ভালো কী আছে আমার ন্যায়ের সপক্ষে! আমি দেখি না যে আমি এক অনুভূতির উত্তাপ অথবা জ্বালানি। যা হোক, খাঁটি হচ্ছে অনুভূতির উত্তাপ অথবা জ্বালানি!’

 

এখন ঐ সময় যখন তুমি বলো : ‘ভালো কী আছে আমার অনুকম্পা দেখানোয়! ঐ ক্রুশ কি এক অনুকম্পা নয় যেখানে ঝোলানো হয়েছিল তাঁকে, ভালোবেসেছিল যে মানুষে? কিন্তু আমার অনুকম্পা নয় ঐ ক্রুশবিদ্ধ হওয়া। ’

 

এমন কী বলা হয়েছে তোমাকে কখনো? এভাবে কেঁদেছো কখনো তুমি? আহা! যদি আমি শুনতে পেতাম ওভাবে কেঁদেছিলে তুমি!

 

এ তোমার পাপ নয়-- এটা তোমার আত্মতুষ্টি যা স্বর্গে কেঁদেছিল; পাপের বিপক্ষে তোমার কূটতর্ক ওভাবে কাঁদিয়েছিল তোমাকে!

 

কোথায় সেই বজ্র যার জিহ্বা স্পর্শ করবে তোমাকে? কোথায় সেই ক্ষিপ্রতা যা তোমাকে পরিশুদ্ধ করবে?

 

দেখো, অতিমানব বিষয়ে শেখাবো তোমাকে : তিনি হচ্ছেন ঐ বজ্র, তিনি হচ্ছেন ঐ ক্ষিপ্রতা!

 

জারাথুস্ট্রা যখন এমন বলেন, লোকগুলোর ভেতর থেকে একজন ডেকে বলে : দড়ি-নর্তক বিষয়ে এতক্ষণ অনেক কিছু শুনেছি আমরা; এখন সময় এসেছে ওকে দেখার! এবং সবাই হাসতে থাকে জারাথুস্ট্রাকে নিয়ে। কিন্তু ঐ দড়ি-নর্তক, যে ভেবেছে ঐ সব কথা ওর বিষয়ে বলা হয়েছে, শুরু করে দড়িখেলা।

 

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/Friedrich_Nietzsche 720111102173023.jpgজারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ: ৪ 

জারাথুস্ট্রা, যা হোক, মানুষগুলোর দিকে তাকান ও অবাক হন! অতঃপর বলেন :

 

পশু ও অতিমানবের মাঝখানে টানানো একটা রশি হলো মানুষ-- অতল গহ্বরের ওপর ঝোলানো এক রশি।

 

ভয়াবহ এক পথসঙ্গম, ভয়াবহ এক পথপরিক্রমা, ভয়াবহ পেছন-ফিরে-তাকানো, ভয়ঙ্কর কাঁপাকাঁপি, সবশেষে থেমে যাওয়া।

 

মানুষের মধ্যে যা মহৎ তা হলো, সে এক সেতু, কোনো লক্ষ্য নয় : ভালোবাসাযোগ্য যা মানুষের ভেতর তা হলো সে এক অতি-গামী, এবং এক নিম্ন-গামী।

 

আমি ভালোবাসি ওদের, যারা জানে কীভাবে বাঁচতে হয় নিম্ন-গামী হয়ে।

 

আমি ভালোবাসি উপেক্ষিতদের, কারণ ওরা ভালোবাসার পূজারী, এবং অন্য উপকূল অভিমুখী।

 

আমি ভালোবাসি ওদের, যারা প্রথমে কারণ খোঁজে না নক্ষত্রের অস্তগামিতার জন্য, এবং উৎসর্গের জন্য, বরং উৎসর্গ করে নিজেদের পৃথিবীর কাছে, যেন এ পৃথিবীতে আগমন হতে পারে অতিমানবের।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে বেঁচে থাকে জানার জন্য, এবং জানতে চায় যেন অতিমানব বেঁচে থাকতে পারে এর পর। এভাবে চায় সে নিজেই নিম্ন-গামী হতে।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে পরিশ্রম করেছে এবং আবিষ্কার করেছে, যেন সে অতিমানবের জন্য বাড়ি বানাতে পারে, এবং বানাতে পারে পৃথিবীর জন্য, পশু ও উদ্ভিদের জন্য-- এভাবে চায় সে নিজেই নিম্ন-গামী হতে।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে ভালোবাসে ওর সদগুণাবলিকে : সদগুণাবলি যা নিম্ন-গামিতার সদিচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষার উদ্গাতা।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে নিজের অন্তরাত্মার জন্য কিছু নির্দিষ্ট করে রাখে না, অথচ সদগুণাবলির জন্য পুরোটাই রেখে দিতে চায় : এভাবে যায় সে, যেমন অন্তরাত্মা অতিক্রম করে সেতু।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে ওর সদগুণাবলিকে করেছে নিয়তি, ও উৎসঙ্গ : এভাবে, সে বাঁচতে চায় সদগুণাবলির জন্য, এছাড়া আর কোনোভাবেই না।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, সদগুণাবলির ভারে যে খুব বেশি নুয়ে পড়ে না। একটা সদগুণ দুটো সদগুণের চেয়ে বেশি, কারণ একজনের নিয়তি নির্দিষ্ট করার জন্য একটা গ্রন্থিই যথেষ্ট।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যার আত্মা অমিতাচারী, যে ধন্যবাদ প্রত্যাশা করে না এবং ফিরিয়ে দেয় না : সবসময় প্রদান করে এসেছে সে, এবং নিজের জন্য কিছু রাখার ইচ্ছে করেনি।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে লজ্জিত হয়েছে যখন পাশার ঘুঁটি ওর অনুকূলে পড়েছে, এবং যে তখন জিজ্ঞাসা করেছে : ‘আমি কি এক অসৎ খেলোয়ার?’-- সে চেয়েছে হেরে যেতে।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে সোনালি শব্দগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে ওর ভবিষ্যত দলিলে, এবং সব সময় ওর অঙ্গীকারের অতিরিক্ত কিছু করেছে : যে চেয়েছে ওর নিজের নিম্ন-গামিতা।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে ভবিষ্যতের কাউকে প্রযুক্ত করেছে, এবং কারো অতীত পুনরুদ্ধার করেছে : যে বর্তমানের মধ্য দিয়ে কারো কাছে বিলীন হতে ইচ্ছে করে।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যে সংযত হয়েছে ওর ঈশ্বরে, কারণ সে ভালোবাসে ওর ঈশ্বরে; কারণ তাকে অবশ্যই বিলীন হতে হবে ঈশ্বরের তীব্র ইচ্ছার ভেতর।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যার আত্মা অনেক গভীর, এমন কি আহত অবস্থায়ও, এবং সামান্য বিষয়েও বিলুপ্ত হতে পারে : এভাবে স্বেচ্ছায় সে সেতুর ওপর দিয়ে চলে যায়।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যার আত্মা এখন অতি-পূর্ণ যে নিজেকেও ভুলে যায়, এবং সব বস্তু ওর ভেতর সুপ্ত থাকে : এভাবে সব কিছু হয়ে ওঠে ওর নিম্ন-গামিতা।

 

আমি ভালোবাসি ওকে, যার আছে এক মুক্ত চেতনা এবং এক হৃদয় : এভাবে তার মস্তক হয়ে ওঠে তার হৃদয়ের অন্ত্র; তার হৃদয়, যা হোক, কারণ হয়ে ওঠে তার নিম্ন-গামিতার।

 

আমি ভালোবাসি সবাইকে, যারা কালো মেঘ হতে একের পর এক ভারী বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরে পড়ে মানুষের ওপর : এরা ঘোষণা করে বিদ্যুচ্চমকের, এবং বিলুপ্ত হয় ঘোষক হয়ে।

 

দেখো, আমি বিদ্যুচ্চমকের এক ঘোষক, এবং মেঘের ভেতর থেকে ঝরে ভারী বর্ষণ : ঐ বিদ্যুৎ, যা হোক, এক অতিমানব।

 

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/friedrich-nietzsche220111102173043.jpgজারাথুস্ট্রার নান্দীপাঠ : ৫ 

এসব বলার সময় জারাথুস্ট্রা আবার তাকান মানুষগুলোর দিকে, এবং নীরব হয়ে থাকেন। তাহলে এই অবস্থান ওদের! নিজের অন্তরের কাছে বলেন তিনি। ওরা হাসে এসবে : ওরা বোঝে না আমাকে; ওদের কানের জন্য আমার এ মুখ নয়।

 

প্রথমে কি ধ্বংস করে দিতে হবে ওদের কানগুলো, যেনো ওরা শিখতে পারে চোখ দিয়ে শোনা? ক্রমাগত নাকাড়া বাজাতে হবে কাউকে প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ে বকবক করা ধর্মোপদেষ্টার মতো। অথবা ওরা কি বিশ্বাস করে শুধু তোতলাদের মতো পুনঃউচ্চারণকারীদের?

 

ওদের এমন কিছু আছে নিশ্চয়ই, যা নিয়ে ওরা গর্বিত। কী নামে ডাকে ওরা ওটাকে, যা ওদের গর্বিত করে? সংস্কৃতি, এই নামে ডাকে ওরা, ভেড়ার পাল হতে এটা পৃথক করে ওদের।

 

ওরা অপছন্দ করে ওদের অবজ্ঞার বিষয়ে কিছু শুনতে, অতএব আমি আর্জি জানাব ওদের গর্ব বিষয়ে; ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি সর্বশেষ ব্যক্তি!

 

এবং এভাবে মানুষগুলোকে বলেন জারাথুস্ট্রা :

 

মানুষের নিয়তি নির্দিষ্ট করার জন্য এটাই সময়। সবচেয়ে বড় স্বপ্নের বীজ বোনার এই সময়।

 

এখানে ওর মাটি অনেক উর্বর এটার জন্য। কিন্তু একদিন এই মাটি হারাবে এর উৎপাদনশীলতা, ওখানে আর জন্মাতে পারবে না কোনো লোভন বৃক্ষ।

 

হায়! ঐ সময় আসবে যখন নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য আর কিছুই করতে পারবে না মানুষ-- এবং ওর ধনুকের ছিলা ভুলে যাবে তীর ছোঁড়া!

 

আমি বলি তোমাদের : এখনো অনেকের ভেতর রয়েছে নৈরাজ্য, একটা নটরাজ জন্ম দিতে। আমি বলি তোমাদের : এখনো তোমাদের ভেতর রয়েছে নৈরাজ্য।

 

হায়, ঐ সময় আসবে যখন মানুষেরা আর নক্ষত্রের জন্ম দিতে পারবে না। হায়! মানুষের জন্য সবেচেয়ে তাচ্ছিল্যের ঐ সময়টা এসেছে, যে কিনা নিজেকেও আর ঘৃণা করতে পারে না।

 

দেখো! তোমাদের শেষ মানুষটাকে দেখাচ্ছি আমি।

 

‘ভালোবাসা কী? সৃষ্টি কী? আকাঙ্ক্ষা কী? নক্ষত্র কী?’ শেষ মানুষটা এভাবেই জিজ্ঞেস করে ও মিটমিট করে চোখ।

 

ছোট হয়ে এসেছে এই পৃথিবী, এবং এটার ওপর শেষ মানুষটা আশা পোষণ করে যে, সবকিছু ছোট করে এনেছে সে। ওর নমুনাগুলো অমোচনীয়, মাটির মাছির মতো, শেষ মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচে।

 

‘আমরা সুখ আবিষ্কার করেছি’ বলেন শেষ মানুষটা, এবং চোখ পিটপিট করেন অতঃপর।

 

ঐ অঞ্চলটা ছেড়ে এসেছে ওরা যেখানে বাস করা কষ্টকর; ওদের জন্য চাই উষ্ণতা। এখনো কেউ প্রতিবেশীকে ভালোবাসে, এবং মাখামাখি করে ওর সঙ্গে, উষ্ণতার প্রয়োজন রয়েছে তার।

 

রুগ্ণ ও সন্দিহান হওয়াকে পাপপূর্ণ বিবেচনা করে ওরা : দ্রুত অতিক্রম করে যায় এসব। সে এক বোকা যে এখনো হোঁচট খায় পাথরে, অথবা মানুষে!

 

সামান্য বিষ যখন-তখন সুখস্বপ্নের জন্ম দেয়। এবং যথেষ্ট বিষ, অবশেষে যা সুখকর মৃত্যু।

 

এখানে কেউ কাজ করে, কাজ যেন এক অতীত। কিন্তু অতীত যেন কাউকে আহত না করে, এজন্য হতে হয় যত্নশীল।

 

কেউই এখন আর ধনী অথবা দরিদ্র নয়; উভয়ে ভারাক্রান্ত, কে এখনো শাসিত হতে চায়? কে এখনো মেনে চলতে চায়? উভয়েই যথেষ্ট ভারাক্রান্ত। নেকড়ে নেই, পশুর পালও নেই! সবাই চেয়েছে একই জিনিস; সবই সমান : স্বেচ্ছায় পাগলাগারদে যাওয়ার জন্য যার অন্য এক মন আছে।

 

‘শুরুতে পুরো পৃথিবী ছিল উন্মাদ’, ওদের মধ্যে চতুরতম ব্যক্তিটি বলে, এবং চোখ মিটমিট করে।

 

ওরা চালাক এবং জানে যা কিছু ঘটে গেছে : অতএব তাদের গালাগালির আর শেষ নেই। মানুষ এখনো বিবাদ করে, কিন্তু শীঘ্র মিটিয়ে ফেলে আবার-- নয়তো ওদের অন্ত্র নষ্ট হয়ে যায় ওসবে।

 

দিনের জন্য ওদের আছে সামান্য আনন্দ, এবং রাতের জন্য সামান্য আনন্দ : কিন্তু ওদের সুস্থতার জন্যও আছে এক কামনা।

 

‘সুখ আবিষ্কার করেছি আমরা’ বলেন শেষ মানুষটি, এবং চোখ মিটমিট করেন।

 

এবং এখানেই শেষ জারাথুস্ট্রার প্রথম হিতোপদেশ, যাকে প্রবেশক হিসেবেও উল্লেখ করা যায় : এখানে এসে জনতার চিৎকার ও হাসির হুল্লোড় তাঁকে বাধাগ্রস্ত করে। ঐ শেষ মানুষটাকে দাও আমাদের, হে জারাথুস্ট্রা, ওরা চিৎকার করে বলে। আমাদেরকে ঐ শেষ মানুষে পরিণত করো। তাহলে তোমাকে একজন অতিমানব উপহার দেবো আমরা! এবং সবাই মিলে ঠোঁটের চ্ছু-চ্ছু শব্দ করে ও তালি দিতে থাকে। জারাথুস্ট্রা, যা হোক, দুঃখে ভারাক্রান্ত হন, এবং তাঁর অন্তরকে বলেন : ওরা বোঝে না আমাকে; ওদের কানের জন্য আমার এ মুখ নয়।

 

সম্ভবত অনেক দীর্ঘদিন কাটিয়েছি আমি পর্বতে; দীর্ঘ সময় ছোট্ট জলধারার কল্লোল, গাছেদের মর্মর শুনেছি : এখন, কথা বলছি ওদের সামনে যখন, এক পাল ভেড়া যেনো ওরা।

 

শান্ত আমার আত্মা, এবং স্বচ্ছ, প্রাতঃকালের পর্বতের মতো। কিন্তু ওরা ভাবে আমি শীতল, এবং ভয়ঙ্কর তামাশা নিয়ে আসা এক ভাঁড়।

 

এবং ওরা এখন হাসে আমাকে দেখে : হাসে এবং ঘৃণা করে আমাকে। ওদের হাসিতে রয়েছে বরফ।

 

[আগামী পর্বে সমাপ্য]

বাংলাদেশ সময় ১৮৫৮, নভেম্বর ০২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।