ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আব্বু ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ

টিয়া রাহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১১
আব্বু ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ

এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে বিয়ের প্রস্তাবটা আনেন আমার ফুফাতো বোন। এতবড় একজন কবির পুত্রবধু হতে যাচ্ছি জেনে খুশিই হয়েছিলাম।

আসলে আব্বুকে আমি প্রথম চিনি তার ছড়ার মাধ্যমে। আমি তখন প্রথম বা দ্বীতিয়  শ্রেনীতে পড়তাম। তার ‘ট্রেন’ ছড়াটা আমাদেও পাঠ্য ছিল--- ‘জক জকা জক ট্রেন চলছে, ট্রেনের বাড়ি কই’...। তারপরও আরও কিছু লেখা পড়েছি। বিয়ের আগে আব্বুকে আমি অনেকবার দেখেছি। আব্বুর শ্বশুরবাড়ি ছিল নাজিমউদ্দিন রোডে, ওখানে প্রায়ই যেতাম। আমি তাঁকে দেখলে সালাম দিতাম। আব্বু জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছ? এতটুকুই। খুব ছোট ছিলাম, তেমন কথা হতো না।

বিয়ের পর আমি আব্বুকে আব্বু বলেই ডাকতাম। আমি দেখেছি মানুষকে সম্মান করতে তার জুড়ি ছিল না। আমি যেদিন এ বাড়ির বউ হয়ে এলাম, তার পরের দিন আব্বুকে সালাম করলাম। তিনি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে আমাকে বসতে বললেন। আমি বসতে চাইলাম না। আব্বু বললেন ‘এই চেয়ারে তোমারই বসার অধিকার আছে। ’

আমি তখন আব্বুর মুখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, আমি আর কিছু বলার সাহস পাইনি। তারপর তিনি প্রত্যেকদিন আমাকে ডেকে নিতেন, বলতেন তুমি আস, আমার কাছে আস, পাশে বস।

প্রথম দিকে আব্বু আমাকে তার নিজের লেখা পড়তে বলতেন না, আমি নিজে থেকেই পড়তাম। কিন্তু পরে শেষ বয়সে তিনি যত কবিতা লিখেছেন, আমাকে বলতেন তুমি পড়, পড়ে দেখ কেমন হয়েছে। লেখালেখির ব্যাপারে শেষ দিকে আব্বু আমাকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। যে কোনো লেখা আমি না পড়লে উনি যেন শান্তি পেতেন না।

আমি তার অনেক কবিতার জন্ম নিজ চোখে দেখেছি। তবে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আমার দাদি শাশুড়ি মারা যাওয়ার কিছু দিন পর আব্বু একটি কবিতা লিখলেন ঠিক রাত আড়াইটার সময়। কবিতাটির নাম ‘রাত আড়াইটার পঙক্তিমালা’। ওই কবিতাটি পড়ে আমাদের পরিবারের সবাই খুব কান্নাকাটি করেছিল। সব সময় এ কবিতাটি আমার মনে পড়ে।

কবিতাটি হলো :

‘‘ এখন রাত আড়াইটা। টেবিলে ঝুঁকে আমি লিখছি। মৃত্যুশয্যাপ্রতিম গলিতে হঠাৎ কুকুরের হাসি না কান্না, বোঝা দায়। কান খাড়া করে কিছুক্ষণ বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি। আবার একটি বাক্যেও খংণ্ডাশকে পুরো সাজিয়ে তুলতে কলম ধরি। কয়েক মিনিট কাগজ আর কলমের মোহন ঘর্ষণ চলে, এমন সময় আমার মার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি। একশ’ পাঁচ ডিগ্রির জ্বরতপ্ত কপালে ন্যস্ত  শীতল পানিপট্টির মতো আর্দ্র হাত আমার কাঁধে রেখে মা বললেন, ‘বাচ্চু, তুই এত রাত জেগে লিখছিস?  তোর চোখে না ভয়ঙ্কর অসুখ? আজকাল তোর বাম ফুসফুস তো ঘন ঘন ভোগাচ্ছে তোকে। ফজর হতে এখনও অনেক দেরি। যা সূর্য না ওঠা পর্যন্ত ভালো করে ঘুমিয়ে নে। এভাবে রাত জেগে লিখলে তুই তো জলদি সব অন্ধকার দেখতে শুরু করবি। চোখ দুটোই খুইয়ে বসবি। বিমারি আরও বেশি খুবলে খাবে তোকে। আয় বাচ্চু, তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেই যেমন দিতাম তোর সুদূর। গোলাপ গাছের সবুজ কোমল পাতা আর ভোরের কচি, মধুর রোদের মতো ছেলেবেলা।
অনন্তের মা মিলিয়ে গেলে রাতের হাওয়া। ... হে স্নেহময়ী মা আমার, এ কী দেখাচ্ছ তুমি আমাকে। প্রতারক স্মৃতি-স্বপ্ন নিয়ে আর কতকাল থাকতে হবে আমাকে?
আম্মা, হে আমার জন্মদাত্রী, সাত মাস পর তোমাকেই আমি
যন্ত্রণাকাতর স্মৃতিগর্ভ থেকে জন্ম দিয়েছি আজ রাত আড়াইটায়। আর কতবার তোমার জন্মদাতা হব বাস্তবের কাঁকর আর ধুলোবালিতে দাঁড়িয়ে, কে জানে? মা, আমার এই পঙক্তিমালায় তুমি কি কোনও এতিমের ফোঁপানি শুনতে পাচ্ছ?’’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/rahman 220111023091643.jpgআমার দুই মেয়েকে নিয়ে আব্বু অজস্র ছড়া লিখেছেন। প্রথমে আমার বড় মেয়ে নয়নাকে নিয়ে অনেক ছড়া লিখলেন, সেই ছড়াগুলো নিয়ে একটা বই বেরলো বইটির নাম ‘নয়নার জন্যে’। বইটির সব ছড়া নয়নাকে নিয়ে। তারপর দিপিতার জন্ম হলো, লিখলেন ‘তারার দোলনায় দিপিতা’। এটা নিয়ে অনেক কথাও হয়েছে, ওদের নিয়ে এত লেখা কেন? আব্বু উত্তরে বলতেন, ‘তোমরা যে যাই বল ওদের নিয়ে লেখা আসলে আমি কী করব?’

আব্বুর অনেক কবিতায় আমিও আছি; একবার ফ্রান্স গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে আব্বুর আমাদের খুব মনে পড়ছে, তখন তিনি একটি কবিতা লিখলেন, সে কবিতায় আমি, আমার মেয়ে, আমার শাশুড়িসহ পরিবারের সবার কথা আছে।
আব্বু আমাকে ছেলের বউ হিসেবে কখনো দেখেননি, মেয়ে হিসেবে দেখেছেন। মেয়ের চেয়ে বেশি আমাকে ভালো জানতেন। নিজেই বলতেন, ‘আমি ওকে মেয়ের চেয়েও বেশি আপন মনে করি। ’ কেন জানি না আব্বু আমার ওপরে খুব ভরসা করতেন। তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও তাঁর এত কথা হতো না, যত আমার সঙ্গে হতো। তাঁর ছেলের সঙ্গে তেমন হতো না। কারণ বাপ- ছেলে দুজনই খুব কম কথা বলতেন। তবে আমার মনে হতো না আব্বু কম কথা বলতেন। কারণ আমার সঙ্গে তার খুব কথা হতো।

 শেষ দিকে আব্বু দেশের রাজনীতি নিয়ে বেশি কথা বলতে চাইতেন না। তখন তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে ডেকে কাছে রাখতেন। তিনি চাইতেন যেন আমরা তাকে ঘিরে থাকি। রাতে আমি আব্বুর সঙ্গে তার ঘরেই ঘুমাতাম, তিনি আমার হাত ধরে শুয়ে থাকতেন। একদিন আমি শোয়া থেকে উঠে বাথরুমে গেলাম, বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি আব্বু বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আব্বু কি ব্যাপার আপনি ঘুমাচ্ছিলেন না?  আব্বু বললেন ‘আমার যেন কেমন লাগছে’, আবার আমি তাকে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে থাকলাম। শেষ দিকে ভয়ই পেত নাকি? আমাকে সব সময় কাছে কাছে রাখতে চাইতেন।

আমি ১৫ বছর তার কাছাকাছি থেকেছি, আমার সঙ্গে একবারও রাগ করেননি। আব্বুর কাছে শেখার অনেক কিছু ছিল, বিশেষ করে মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়। আমাকে সব সময় বলতেন ‘রবীন্দ্রনাথের বই পড়, অনেক কিছু জানতে পারবে। আমার বই পড়ে কী হবে। ’ আমি বলতাম আমি আপনার বই পড়ব। আব্বু বলতেন ‘আমার বইয়ে কী এত কিছু জানার আছে, যা আছে রবীন্দ্রনাথে। ’ একথা বলে আব্বু আমাকে রবীন্দ্রনাথের বই বের করে দিতেন।

আমি কখনও বাইরে গেলে, দেরিতে ফিরলে আম্মা বলতেন ‘তুমি দেরি করে এসেছ, তোমার আব্বা রাগ করেছে। নিচ থেকে এই কথা শুনে উপরে উঠে দেখি আব্বু আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই হাসি দিতেন। বলতেন ‘তুমি যখন থাক না তখন আমার বুকটা ধগধগ করে ওঠে। আমার বুকে মা হাত দিয়ে দেখ। ’ এ কথা শুনে আমার খুব কষ্ট লাগত।

 শেষবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তির পর একদিন আব্বু আমাকে বলেছিলেন, তার মৃত্যুর সময় যেন রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে দিই এবং তার দেহটা মেডিকেল কলেজে দিয়ে দিই। আমি ক্ষমা চেয়ে বলেছি, আব্বু আমি এসব পারব না।

আব্বুর চিন্তা-ভাবনাই ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। মানুষ হিসেবে তিনি অন্যরকম ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি সহজে কাউকে না  বলতে পারতেন না, সব সময়ই চাইতেন সবাইকে খুশি করতে। আব্বুর কথা ভাবলেই আমার কাছে মনে হয়, আব্বু ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।


http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/tia rahman20111023091653.jpg

 

 

টিয়া রাহমান

(কবির পুত্রবধূ)

 

 

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০৯১০, অক্টোবর ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।