ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নোবেলজয়ী কবি ট্রান্সট্রোমারের সাক্ষাৎকার [পর্ব--২]

ভাষান্তর : রানা রায়হান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১
নোবেলজয়ী কবি ট্রান্সট্রোমারের সাক্ষাৎকার [পর্ব--২]

টোমাস ট্রান্সট্রোমার ২০১১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৩১ সালে স্টকহোমে জন্ম।

এর আগে তিনি ১৯৮৩ সালে কবিতার জন্য মর্যাদাপূর্ণ বনিয়ার পুরস্কার পান, ১৯৮১ সালে পান পশ্চিম জার্মানির পেত্রার্ক পুরস্কার। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইকো প্রেস থেকে তার ‘সিলেক্টেড পোয়েমস ১৯৫৪-১৯৮৮’ (অনূদিত) প্রকাশিত হয়।

১৯৮৯ সালের ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ইন্ডিয়ানাপোলিসে লিন্ডা হর্ভাথ বাসায় এবছরের নোবেলজয়ী কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারটি নেন মার্কিন কবি ট্যান লিন নেভিললিন্ডা হর্ভাথ

মোট তিনটি পর্বে বিভক্ত সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় পর্ব এটি। ভাষান্তর করেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর রানা রায়হান

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011October/trans tromer 9920111013215037.jpgনেভিল: আপনার কবিতায় আপনি নিজেকে একজন অভিযাত্রী হিসেবে দেখেছেন, অথচ আমি তেমন কোনো অনুভূতি পাইনি কবিতা পড়ে। সুইডেন ও এর আবহাওয়ার সঙ্গেই আপনার শেকড় গাড়া। এর সঙ্গে আপনি কি একমত?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার: আমার মনে হয়, প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যাবলি, বিভিন্ন স্থান, অভিজ্ঞতার মূলে আমার শেকড় রয়েছে। আর আপনি যে আবহাওয়ার কথা বললেন তাতে। সুইডেনে আমরা যারা কবিতা লিখি তাদের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা উত্তরের অধিবাসী, তবে উপসাগরীয় জলপ্রবাহের কারণে আবহাওয়া শান্ত প্রকৃতির। এখানকার আলো উত্তরমেরুর। এটি পৃথিবীর একমাত্র যেখানে এরকম ঘটে। আমাদের গ্রীষ্মঋতুগুলো পুরোপুরি আলোকময় আর শীতকাল অত্যন্ত অন্ধকারময়।

নেভিল: হ্যাঁ, দীর্ঘ ও অন্ধকার। গ্রীষ্ম নিয়ে আপনার কিছু চমৎকার কবিতা রয়েছে। গ্রীষ্ম থেকে মুক্তির অনভূতি বেশ তীব্র। কিছুক্ষণ আগেই আপনি বলেছেন, তরুণ বয়সে সুইডেনের প্রকৃতি ও বাহিরের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আপনার কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি যে, কবিতাগুলোর কাঠামো আপনি অন্তর্জগৎ বা নিজস্ব বিষয় নিয়ে নির্মিত হলেও, এগুলোতে বহির্জগৎ প্রকাশ পেয়েছে এবং আদতে, আপনার কবিতায় অন্তর্জগত এসেছে খুব বেশি মাত্রায়।

‘ভারমিয়ার’ কবিতায় আপনি একটি কক্ষে, একটি স্টুডিওতে ও সরাইখানায় অবস্থান করছেন। আপনার এমন কবিতার সংখ্যা খুব কম। তবে আপনার ‘এলিজি’ কবিতায় অন্দরমহলে হাঁটলেও  হঠাৎ আপনার মনোযোগ এর বাইরে, জানালায় অথবা অলিগলি বা এর চলাচলের প্রতি প্রক্ষিপ্ত হয়। এ বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন? এটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে, আপনার আগ্রহ অন্তর্জগত হলেও আপনার বিমূর্ত কল্পনা সবসময়ে বাইরে চলে যায়।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : সম্ভবত এভাবেই আমার কাজের অনুপ্রেরণা পাই-- একইসময়ে একযোগে দুই স্থানে বিরাজ করার অনুভূতি। অথবা আপনি এ ব্যাপারেও সচেতন যে, আপনি যেখানে আছেন সেটা অত্যন্ত আবদ্ধ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সবকিছু উন্মুক্ত। এটা অস্পষ্ট হলেও আমার কবিতার লেখার জন্য সামগ্রিক অনুপ্রেরণার কাজ করে।

নেভিল: প্রত্যাহারের চোরাগর্ত, আত্মজ্ঞানবাদ, বিচ্ছিন্নতা থেকে আপনি যে দূরে থাকতে পেরেছেন এর পটভূমি কী? এ ব্যাপারটায় আমি আগ্রহী।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : (লম্বা সময় নিয়ে) আমার একজন ভালো মা ছিলেন (অট্টহাসি)।

নেভিল: আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আপনি এটাই বলবেন।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। আর আমি চমৎকার দাদা-দাদিও পেয়েছিলাম। দাদা ছিলেন নাবিক। অনেক বয়স হয়েছিল তাদের। আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের কাছ থেকেও মূল সমর্থন পেয়েছি। একই সময়ে আমি অত্যন্ত নিঃসঙ্গ ছিলাম। আমার শৈশবেই তারা আমার আগ্রহের ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। আমার মনে হয়, বিশেষ আগ্রহ বোধসম্পন্ন ছেলেরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে তীরস্কৃত হয়। কারণ তারা তাদের ছেলেদের স্বাভাবিক দেখতে চান। অন্য সব শিশুর মতো হবে, তাদের মতো করে খেলাধূলা করবে ইত্যাদি।

আমি প্রায়ই বড়দের কাছ থেকে আঘাত পেতাম, তারা আমাকে বড় হিসেবে স্বীকৃতি দিত না। তবে আমি নিজেকে তাদের মতোই ভাবতাম। তারা আমাকে শিশু বিবেচনা করত আর আমি এতে অপমানিত বোধ করতাম। তবে আমার ঘনিষ্ঠ লোকজন আমার ব্যক্তিত্বকে মেনে নিত। তারা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল আমার অত্যন্ত কঠিন জায়গা ছিল। কোনো কোনো শিক্ষককে পছন্দ করতাম, কাউকে কাউকে একদমই সহ্য করতে পারতাম না। সাধারণভাবে আমার শৈশব সহজ ছিল না, তবে তা খুব খারাপও ছিল না। আমার বয়স যখন ছিল এগারো বা বারো, সেসময় পোকামাকড় সংগ্রহ করার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ জন্মে। জীববিদ্যা আমার কাছে সব সময়ের জন্যই আকর্ষণীয়। বিশেষ করে, আমি গুবরে পোকা সংগ্রহ করতাম, এর একটি বড় সংগ্রহ ছিল আমার। এছাড়া এগুলো নিয়ে প্রজাপতির জালের জন্য বেরিয়ে পড়তাম।

নেভিল: আপনার কবিতায় প্রচুর প্রজাপতি পাওয়া যায়, তবে গুবরে পোকা বা অন্য পোকামাকড়ের উপস্থিতি খুব বেশি নেই বলেই আমার মনে হয়।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : ‘দ্য গোল্ডেন ওয়াসপ’ কাব্যগ্রন্থে?  আমার এই কবিতায়  একটি গুবরে পোকার সন্ধান পাবেন, অবশ্যই পাবেন। ‘গুঞ্জরিত বিদ্যুতের খুঁটির ওপর, একটি গুবরে পোকা রোদে বসে আছে। চকচকে আবরণের নিচে পাখনাগুলো সুকৌশলে ভাঁজ করা, যেন দক্ষ বৈমানিক তার প্যারাশুট মুড়িয়ে রেখেছেন। ’ (‘দ্য ক্লিয়ারিং’ কাব্যগ্রন্থ ) এখানে অবশ্যই গুবরে পোকা পাবেন।

সঙ্গত কারণেই আপনি যদি পোকামাকড় সংগ্রহ করতে দৌড়ান আর প্রকৃতির সবকিছুতে দৃষ্টি ফেলেন, নিঃসন্দেহে সেগুলো সুখকর অস্তিত্ব হিসেবে ধরা দেবে আপনার কাছে। ক্যারোলাস লিনিয়াস (সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী) থেকে আসা এটা আমাদের সুইডিশ ঐতিহ্য। প্রকৃতি কেবল মনের ভাবের স্থান নয়, এখানে গবেষণাও করতে পারেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য-- খোলস, পোকামাকড়, পাখি আমার কাছে শিশু হিসেবে ধরা দেয়। আমি প্রকৃতিকে সুন্দর হিসেবে দেখি না, কারণ আমি নিজেকে বিজ্ঞানী ভাবতাম (হাসি)। তবে এটা আমার কাছে ধরা দিয়েছিল।

হর্ভাথ : আপনার কি আর কোনো বিশেষ আগ্রহ আছে?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : হ্যাঁ, আমি ইতিহাসের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। আমি প্রচুর ইতিহাস পাঠ করেছি, এখনো করি। আর তেরো বা চৌদ্দ বছর বয়সে সঙ্গীত আমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। সঙ্গীতের ওপর আমার অন্ধভক্তি ছিল, এখনো আছে।

নেভিল: নিজেই বাজান?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : হ্যাঁ, আপনার কি কোনো পিয়ানো আছে?

হর্ভাথ : আমি ভাবছি, কিভাবে আপনার কবিতায় আপনি দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেন?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : দৃশ্যকল্পগুলো নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে যায়। তবে আমি যখন একটির ওপর কাজ করি, সেটাকে আমি পাঠকের জন্য সবচেয়ে বোধগম্য করার চেষ্টা করি। যেমন, আপনার স্বপ্নে তা-ই আসে, যা আপনি সবসময় দেখেন।

হর্ভাথ: কখনো কি স্বপ্নের সংস্পর্শে থাকার চেষ্টা করেছেন।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে। আমি প্রচুর স্বপ্ন দেখি, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্রুতই সব ভুলে যাই।

হর্ভাথ : রাতে ঘুম থেকে জেগে সেই স্বপ্নগুলো লিখতে বসেন না নিশ্চয়ই?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : না, স্বপ্নে আমি তেমন কিছু পাই না। আমি ঘুমাতে চাই (হাসি)। তবে এমন ঘটনা ঘটেছে যে, স্বপ্নগুলো বলিষ্ঠ আকারে এসেছে। সেগুলোই পরে কবিতা হয়ে গেছে।

হর্ভাথ : যখন বিশেষ কোনো ঘটনায় একগুচ্ছ অনুভূতির দৃশ্যকল্প আপনার ভেতরে জন্মায়, এটা নিয়ে কাজ করতে হবে, অন্যের কাছে স্পষ্ট করতে হবে, তখন কী করেন?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : মাঝে মাঝে টুকরো আকারে একটি দৃশ্যকল্প হাজির হয়, যা হয়ত কতক শব্দকে কেন্দ্র করে। আবার শব্দহীন দৃশ্যকল্পও আসে, এরপর আমাকে শব্দ নিয়ে কাজ করতে হয়।

হর্ভাথ : সুতরাং আপনার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া অবচেতন থেকে উদ্ভাসিত হয়। নিশ্চয়ই ‘আমি বসতে যাচ্ছি এবং এ বিষয়ে একটি কবিতা লিখব’ বলে লিখতে বসেন না?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : সবকিছুই আসে ভেতর থেকে, অবচেতন থেকে। এটাই সবকিছুর উৎস। আমার ভেতরের গভীরতম অংশ থেকে যা উৎসারিত হয়, তার প্রতি যত্নtomas’s bookশীল হওয়ার বহু উপকরণ আমার আছে। তবে আমি নিজেকে কখনোই নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখার আদেশ দেই না। আমি সেটা চেষ্টা করেছি। কারাগারে তরুণদের জন্য আমি যখন মনোবিদের কাজ করছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি কিছু লেখার চেষ্টা করেছি। অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষামূলক কবিতা আমি সেসময় লিখেছি, তবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সবশেষে, যেসব বিষয় আমি গ্রহণ করতে পারতাম, সেগুলো নিয়ে কয়েকটি পঙক্তি লিখে ফেললাম। যেমন কারাগারে দরিদ্র ছেলেদের নিয়ে অবাস্তব ও উচ্চাক্সক্ষামূলক একটি কবিতা লিখি।

কবিতাটি হচ্ছে ‘অন আউটস্কার্টস অব ওয়ার্ক’। এরই কয়েকটি পঙক্তি যেমন, ‘কাজের ফাঁকে/ আমরা বিস্তৃত শ্যামলিমার জন্য তীব্র আকুতি জানাই/ জনহীন অরণ্যের জন্যই/ টেলিফোন তারের পলকা সভ্যতা/ একে বিদ্ধ করেছে। ’ কারাগার নিয়ে এরকম কয়েকটি পঙক্তিই কেবল দীর্ঘ, গম্ভীর ও অতি উচ্চাকাক্সক্ষামূলক কবিতা থেকে পৃথক আকারে এসেছে । সুতরাং কী লিখব তা আমি আসলে আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আপনা থেকেই আসতে হবে।

হর্ভাথ: আপনি নিজেকে কি এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, নির্দিষ্ট মনোকাঠামোর ভেতর, যাতে আপনার কবিতা এসে যায়?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : আমার জন্য এটা সহজ নয়, তবে যখন সম্ভব হয় একই সঙ্গে খেলাচ্ছল ও গুরুগম্ভীর মনোভাব সৃষ্টি করি। খেলা ও উচ্চাশার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য জারি রাখা অবশ্য জরুরি। এই ভারসাম্য রাখা কিন্তু কঠিন কর্ম। আর হাতে অনেক সময় থাকলেও খুব সহায়ক হয়, যা আমার নেই। অর্থাৎ এরকম সফরের মধ্যে আমি যদি এমন করতে পারতাম যে, হোটেলকক্ষে গিয়ে বসে পড়তাম এবং বলতে পারতাম, আমি সারাদিন কিছু করব না, কেবল বসে থাকব। কিন্তু আমি তা করতে পারব না। লোকজন আমাকে ডাকছে, আমাকে বিভিন্ন পার্টিতে নিমন্ত্রণ করছে ইত্যাদি। প্লেনে চড়লে হয় আমার বিরক্তি লাগে অথবা ভয় পাই। লেখালেখির কোনো ইচ্ছাই হয় না। বরং ট্রেন বেশ ভালো, দূরপাল্লার ট্রেন।

নেভিল: আর কার ভ্রমণ ভালো লাগে। কারে চড়ে আপনার বেশ কতক ভালো কবিতা আছে। যেমন, ‘ডাউনপোর ইন দ্য ইনটেরিয়র’, ‘ট্র্যাকস’ প্রভৃতি।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : ঠিক আছে, তবে কার নিয়ে আমার পরস্পরবিরোধী অনুভূতিও রয়েছে। একভাবে আমি কারের বিরুদ্ধে, কারণ এতে অনেক জিনিস ধ্বংস হয়। একই সময়ে আমি অবশ্যই বলব, প্রকৃতির ভেতর নিজেকে বহন করে যেতে একটি কার থাকা বেশ চমৎকার ব্যাপার।

নেভিল: গদ্য কবিতা নিয়ে আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। আমি এ ধরনের কবিতায় আস্থা রাখি এবং নিজেও এ ধরনের কবিতা লিখি। তবে বহু লোক ভাবে এ ধরনের কবিতা নিরস, তারা এতে বিরক্ত হতে চায় না। আপনার মন্তব্য শুনতেই আমি আগ্রহী। এ ধরনের কবিতা লিখে কী আনন্দ পান, যা আপনার সাধারণ কবিতায় পাওয়া যায় না?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : ঠিক আছে, এটি ইউরোপে পুরনো ঐতিহ্য, বিশেষ করে ফ্রান্সে। ১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে আমি যখন এ ধরনের কবিতা লেখা শুরু করি, সেসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কবিতা সংগ্রহ বের হয়, গ্রন্থটির নাম ছিল ‘নাইনটিন মডার্ন ফ্রেঞ্চ পোয়েটস’। এতে রেনে শর, ইলিয়াদ, রেভার্দির মতো কবিদের গদ্য কবিতা ছিল। এটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়, খুব স্বাভাবিক। স্কুলে আমার একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান বন্ধু ছিল। তিরিশ বছর বয়সে তিনি তার বই প্রকাশ করেন। এতে সব কবিতাই গদ্য আকারে লেখা। কবি ম্যাক্স জ্যাকবের মতো এক ধরনের পরাবাস্তববাদী গদ্য কবিতা সেগুলো। সুতরাং আমার ক্ষেত্রে এ ধরনের কবিতার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম আমি, একেবারে শুরু থেকেই। তবে আমার নিজের গদ্য কবিতার শুরু কিছুটা দেরিতে। আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমি তার কামরায় ফেরা এবং বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে গদ্য কবিতা লিখি (দ্য বুককেস)।

নেভিল: কবিতা ও গদ্যের ভেতরে প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য কী?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : আমি শুরু থেকেই জানি, এটা গদ্য  নাকি পদ্য। দুই সপ্তাহ আগে প্রকাশিত আমার একটি বইয়ে সতেরোটি কবিতা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি গদ্য কবিতা। একটির নাম হচ্ছে, ‘নাইটিংগেল ইন বাদেলুন্ডা’।   আরেকটি গতকাল আমি পাঠ করেছি, এর নাম ‘মাদ্রিগাল’। এই দুটি কবিতা খুব ছোট। তবে গদ্য কবিতায় আপনি খানিক সাবলীল হতে পারবেন।

আমার সঙ্গে ব্লাইয়ের মিলের দিক হচ্ছে এটা। তিনি যখন তার গদ্য কবিতার বই প্রথম প্রকাশ করলেন, আমি তখন এ ধরনের কবিতা লেখা শুরু করি। আমরা দুজনই ফ্রানসিস পোঞ্জের প্রতি আগ্রহী ছিলাম। তার কবিতা এক ধরনের প্রগাঢ়, খুব কাছ থেকে কোনো জিনিস অবলোকন করে বা প্রকৃতির চিত্র সামনে নিয়ে আসে। কবিতাগুলো খুবই উদ্দীপনামূলক। যদিও পোঞ্জ যে উপায়ে লিখেছেন আপনি সেভাবে নাও নিতে পারেন। আপনার ও আমার অভিজ্ঞতা সম্ভবত একইরকম, কবিতাগুলো কিছু স্বাধীন, বিস্তারিত বর্ণনায় যায় এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

হর্ভাথ: আপনি গদ্য কবিতা নিয়ে বার বার কাজ করেন না?

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : মাঝে মাঝে করি। যেমন একটি গদ্য কবিতার কথা আমি বলতে পারি, এটা নিয়ে বছরে পর বছর কাজ করেছি। ‘বিলো ফ্রিজিং’ নামের ওই কবিতাটি হচ্ছে এরকম:

আমরা একটি পার্টিতে আছি, যা আমাদের পছন্দ করে না। সবশেষে,
পার্টির পর্দা পড়ে যায়, এটা কী তা দেখায়: আসা-যাওয়ার মালগাড়ি স্টেশন,
কুয়াশায় হিম দানব দাঁড়িয়ে রেললাইনে। গাড়ির দরজায় হিজিবিজি চকের আঁচড়
কেউই চিৎকার করে বলতে পারে না। তবে এখানে বহু অবদমিত সহিংসতা ঘটছে

অন্য বিষয়ের মধ্যে এটা সুইডেনের কিছুটা হতাশাজনক বর্ণনা।

নেভিল: গাদাগাদি করে থাকা একদল শিশু স্কুলবাসের অপেক্ষা করছে, কবিতাটা এভাবে হয়নি? এটা ভীষণ পছন্দ আমার।

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : এই কবিতাটিই বেই দাও (চীনা কবি) সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন।

[চলবে]


বাংলাদেশ সময়: ২১১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।