ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

স্মৃতির চাহনি : একটি স্মৃতিলেখ [কিস্তি-১]

মূল : টোমাস ট্রান্সট্রোমার, অনুবাদ : কুমার চক্রবর্তী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১১
স্মৃতির চাহনি : একটি স্মৃতিলেখ [কিস্তি-১]

সাহিত্যে সদ্য নোবেলজয়ী কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার। জন্ম ১৯৩১ সালরে ১৫ এপ্রলি সুইডনেরে স্টকহোমে।

১৯৫৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই ‘১৭ টি কবিতা’। তার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে--- Secrets on the way (1958), Half-finished heaven (1962), (Echoes and traces/bells and tracks (1966),  Seeing in the dark (1970),  For the living and the dead (1989) 

১৯৯০ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারান ট্রান্সট্রোমার। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার স্মৃতিকথা। এতে উঠে আসে তার শৈশব-কৈশোর এবং কবি হিসেবে তার বেড়ে ওঠার অনেক ঘটনাই। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই স্মৃতিকথার অনুবাদ ।


স্মৃতিরা

‘আমার জীবন’ এই কথাগুলো চিন্তা করলে আমি সামনে দেখতে পাই এক আলোর ঝলকানি। নিকট থেকে দেখলে তার আকার অনেকটা ধূমকেতুর মতো যা মাথা ও লেজবিশিষ্ট। মাথার-- উজ্জ্বলতম প্রান্তটি হলো আমার ছেলেবেলা যা বেড়ে যাচ্ছে। নিউক্লিয়াস, ঘনত্ববহুল অংশটি হলো শৈশবকালের প্রথমভাগ, যেখানে আমাদের জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরাজি নির্ধারিত হয়। আমি তাদের স্মরণের চেষ্টা করি, আমি সে স্থানে ঢুকতে চেষ্টা করি। কিন্তু তা হয়ে ওঠে অনেক সময় কঠিন; এই নিবড় এলাকায় চলাফেরা করা, তা মারাত্বকও হতে হতে পারে, কারণ তার অনুভূতি যেন আমার মৃত্যু-নিকবর্তী হওয়ার মতো। পুনরায় ধূমকেতুটি পাতলা হয়ে যায়; তার দীর্ঘ অংশটি --- যা হলো লেজ--- তা ক্রমে কিছুটা ছড়িয়ে যায়, কিন্তু প্রশস্তও বটে। আমি এখন এই ধূমকেতুর লেজ হতে অনেক দূরে, --- এখন, যখন লিখছি ষাট বছর বয়সে।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/transtromar childhood20111009161508.jpgআমাদের আগের অভিজ্ঞতাগুলো অনেকাংশে অনভিগম্য। পুনর্কথন, স্মৃতির পর স্মৃতির স্মৃতিচারণ, ভাবের ওপর দাঁড়ানো পুনর্গঠন হঠাৎ করেই জীবনের গভীরে ছড়িয়ে পড়ে, আলোড়িত করে, অভিঘাতময় হয়।

আমার সবচেয়ে আগের মনে থাকা স্মরণীয় স্মৃতি হলো একটি অনুভূতির, এক গর্বের অনুভূতির। আমি তখন সবেমাত্র তিন বছরের এবং তা ঘোষিত। খুবই তাৎপর্যময় যে আমি এখন খুব বড়ো, একটি উজ্জ্বল কক্ষে বিছানায় শোয়া, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে নেমে পড়ি এবং বিস্ময়করভাবে বুঝে ফেলি যে আমি বড় হচ্ছি। আমার ছিল একটি পুতুল যাকে আমি দিয়েছিলাম সবচেয়ে সুন্দর একটি নাম : করিন স্পিননা। আতি তাকে কখনোই মাতৃত্বময়তায় দেখিনি। সে ছিলো কমরেডের চেয়েও বেশি অথবা আমার প্রেমিকার মতো: যার প্রেমে আমি পড়েছি এমন কেউ।

আমরা বাস করতাম স্টকহোমের সোডার এলাকায় সুইডেনবগ্সগাটন-৩৩ (এখন যাকে বলা হয় গ্রিন্ডসগাটন)-এ। তখনও বাবা বেঁচে, কিন্তু চলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে। আমাদের পথ ছিলো খুবই ‘‘আধুনিক’’ - ঠিক শুরু থেকে আমি পরিচিত ‘‘ডু’’ (ফড়) ফর্ম ব্যবহার করতাম মা-বাবার কাছে। দাদু-দিদারা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো, ঠিক ঘরেই কর্ণারে ব্লেকিন গোগাটনে তারা থাকতেন।

আমার মাতামহ কার্ল হোলমার ওয়েস্টাবার্গ ১৮৬০-এ জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একজন জাহাজের নাবিক এবং আমার ৭১ বছরের বড় এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একইভাবে তাঁর মাতামহের মধ্যেও ছিল একই বয়সের ব্যাবধান, যিনি জন্মেছিলেন ১৭৮৯-এ, যখন বাস্তিল দুর্গ পতনের সময়, আনজালা বিদ্রোহের সময়, যখন মোৎসার্ট লিখলেন তাঁর ক্ল্যারিনেট কুইনটেট। দুই সমান পদক্ষেপ ফিরে আসে, দুই দীর্ঘ পদক্ষেপ আদৌ বেশি দীর্ঘ নয়। আমরা ইতিহাস স্পর্শ করতে পারি।
মাতামহের কথাবার্তা ছিলো ঊনবিংশ শতাব্দির আদলের। অধিকাংশ প্রকাশই, এখন, আশ্চর্যজনকভাবে মনে হবে সেকেলে ধরনের। কিন্তু তাঁর কথনে আর আমার শ্রবণে তা ছিলো একেবারেই স্বাভাবিক। তিনি ছিলেন ফর্সা ছোট আকারের মানুষ যার ছিল সাদা গোঁফ আর গোচরযোগ্য বাঁকা নাক-  ‘যেনো এক তুর্কি’, যেমন তিনি বলতেন। তাঁর মেজাজ ছিল প্রাণবন্ত এবং আলোড়িত করতে পারার মতো সাবলীল। মাঝে-মাঝে তাঁর উত্তেজনা খুব মারাত্মক মনে হতো না বরং যেভাবে শুরু হতো সেভাবেই তার শেষ হতো। তিনি গোঁ ধরার মতো আগ্রাসী একেবারেই ছিলেন না। সবসময় নিরাপদ দিকে থাকতেন এমনকি যখন কেউ তাদের অনুপস্থিতিতে সমালোচিতও হতো সাধারণ আলাপচারিতায় : ‘‘ তোমাকে অবশ্যই মানতেই হবে যে ‘ক’ খুবই ধুর্ত”। ‘‘হয়তো, কিন্তু সত্যিই আমি কিছু জানি না তার সম্পর্কে...”।

বাবা-মার বিচ্ছেদের পর, আমি ও মা ৫৭ ফকুনগ্যাগাটনে নিম্নমধ্যবিত্তদের একটি ফ্ল্যাটে চলে আসি। এখানটায় বহু রকমের মানুষজন খুবই গাদাগাদি করে বসবাস করতো। এখানে আমার জীবন-স্মৃতি তিরিশ বা চল্লিশের একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো নিজেদের সাজিয়েছিলো যা ছিল চরিত্র বিচারে যথার্থ তালিকা। ছিলো সুন্দর দ্বার রক্ষিণী ও তার শক্তসামর্থ্য ল্যাকনীয় স্বামী যাকে আমি ভক্তি করতাম কারন অনেক কিছুর মধ্যে সে গ্যাসে বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল আর তা তাকে দিয়েছিল মেশিনের সাহসী ঘনিষ্ঠতা। যারা এখানে বসবাস করতো না তাদের যাওয়া-আসার জন্য এখানে ছিল একটি সরু পথ। মাঝে-মধ্যে যারা মাতাল হতো তারা সিঁড়িপথে রসের কথা বলতো। সপ্তাহে অনেকবার ভিখিরীরা বেল বাজাতো। তারা পোর্চে নির্বাকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো। মা তাদের জন্য সেন্ডউইচ বানাতো--- তিনি টাকা না দিয়ে তাদেরকে পাউরুটি দিতেন।

আমরা বাস করতাম সবচেয়ে ওপরে ৬ষ্ঠ তলায়। আমাদের ঘরটির ছিল চারটি দরজা আর একটি চিলেকোঠায় যাওয়ার পথ। ওপরে আর যে বসবাস করতো তার নাম অর্ক যিনি পেশায় ছিলেন একজন প্রেস ফটোগ্রাফার। একজন প্রেস ফটোগ্রাফারের পাশে বসবাস এক অর্থে ছিলো খুবই ভালোলাগার ও রোমাঞ্চকর।

আমাদের আরেকজন নিকট প্রতিবেশী ছিলেন, তিনি অবিবাহিত, এমনও শুনেছি আড়াল থেকে- তিনি ছিলেন মধ্যবয়সী, তার গায়ের রঙ ছিলো হলদেটে ধরনের। তিনি বাড়িতেই কাজ করতেন, টেলিফোনে এক ধরনের দালালের কাজ সেরে নিতেন। ফোনে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি উৎফুল্লিত অট্টহাসি হাসতেন, যা দেয়াল ভেঙে আমাদের ফ্ল্যাটে এসে পড়তো। আর এক ধরনের পুনপৌনিক আওয়াজ--- বোতলের ছিপি খোলার আওয়াজ আসতো। তখন বিয়ারের বোতলে ধাতব মুখ ছিলো না। এই সব উল্লসিত শব্দ, অট্টহাসি আর ছিপি খোলার আওয়াজের সাথে মাঝেমধ্যে লিফটে দেখা হওয়া বিবর্ণ ভুতুড়ে মুখঅলা সেই বৃদ্ধকে মেলানো কঠিন হতো। কয়েক বছর পর সে হয়ে উঠলো সন্দেহগ্রস্ত আর তার মদমত্ততা ধীরে ধীরে কমতে লাগলো।

একবার দেখা দিল এক সহিংসতা। আমি তখন ছোট। একজন প্রতিবেশীর স্ত্রী তার মদ্যপ এবং হিংস্র স্বামীটিকে ঘরে আটকিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিলো। স্বামীটি দরজা ভাঙতে চেষ্টা করলো আর ধমক দিতে শুরু করলো। আমার মনে হয়েছে সে আর্তনাদ করে বলে উঠলো : ‘‘ যদি আমি কাঙসোলেমেনই যাই তাহলে থোরাই গ্রাহ্য করি ’’। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কাঙসোমেন বলতে কী বোঝালো; মা বললো সেখানে পুলিশ হেডকোয়ার্টার অবস্থিত। তখনকার দিনে শহরের ওই অংশটাকে ভীতিকর স্থান হিসেবে সকলে মনে করতো। [পরবর্তীকালে যখন আমি সেন্ট এরিকস হাসপাতাল পরিদর্শনে যাই এবং দেখি ফিনল্যান্ডের যুদ্ধাহতদের, ১৯৩৯-৪০ এর শীতে, যেখানে তাদের চিকিৎসা হচ্ছিল, তখন এই অনুভূতিটা প্রগাঢ় হয়েছিলো। ]

মা কাজের উদ্দেশে সকালেই বের হয়ে যেতেন। তিনি ট্রাম বা বাসে যেতেন না--- তাঁর জীবনের পূর্ণবয়স্কতায় তিনি সোডার এবং ‘ওস্টারমালম’-এর মধ্যবর্তী এলাকায় এদিক-ওদিক বিচরণ করতেন। তিনি হেডভিগ লিওনোর স্কুলে চাকরি করতেন এবং বছরের পর  বছর ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর শ্রেণী-শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক যিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই নিবিষ্ট থাকতেন। কেউ হয়তো তখন ভাবতো যে তাঁর পক্ষে অবসর গ্রহণ অসম্ভব হবে কিন্তু তা নয়, পরবর্তীকালে অবসর নিয়ে তিনি যেন বেঁচে যান।

মা যেহেতেু কাজ করতেন তাই বাড়িতে কাজের লোকের প্রয়োজন ছিল; একজন ‘ঝি’ ছিল তাকে ডাকা হতো; সে রান্না ঘরের একটি ছোট অংশে শুতো। এই অতিরিক্ত অংশটা দুই রুম এবং রান্নাঘরবিশিষ্ট ফ্ল্যাটের সরকারী হিসেবের মধ্যে ছিলো না। যখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয় বছর, আমাদের ফ্ল্যাটে দক্ষিণ সুইডেনের স্ক্যানের এস্লোভ হতে আগত আনা-লিজা ঝি হিসেবে কাজ করতে আসলো। আমার বিবেচনায় সে ছিল খুব আকর্ষণীয়া- কুঞ্চিত স্বর্ণকেশী, টিকালো নাক, কথা বলতো কিছুটা স্কানিয় উচ্চারণে। সে ছিল খুবই হার্দিক মানুষ। এখনো যখন আমি এস্লোড স্টেশন দিয়ে যাই, কিছু একটা টান তার জন্য অনুভব করি। কিন্তু বাস্তবিক, এই জাদুময় জায়গায় ট্রেনে দ্রুত সরে পড়ি না।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/Transtromer younger20111009152816.jpgসে ছিল অঙ্কনে খুবই সিদ্ধহস্ত। ১৯৩৯-এর শেষের দিকে আমি বিরামহীনভাবে সারা বছর ধরে ছবি আঁকতাম। মাতামহ তখন মুদি দোকানে ব্যবহৃত ধূসর রঙের কাগজের রোল বাসায় নিয়ে আসতো, আমি সেগুলো গল্পের অলংকরণ করে ভরিয়ে ফেলতাম। আমি, নিশ্চিতই, পাঁচ বছর বয়সেই লিখতে শিখে গিয়েছিলাম কিন্তু তা ছিল এক মন্থর পদ্ধতি। আমার কল্পনা কিছু দ্রুত প্রকাশের উপায়  খোঁজ করছিলো। ঠিকঠাকভাবে আঁকতে আমার প্রচুর ধৈর্য ছিল না, আমি খুব তীব্র গতিতে ছবি আঁকার এক সংক্ষিপ্ত স্কেচ পদ্ধতি আবিষ্কার করি। ১৯৩৯-এর মাঝামাঝি এক দিনে মধ্য স্টকহোম থেকে আমি হারিয়ে যাই।

মা ও আমি গিয়েছিলাম স্কুলের  কনসার্টে। বের হওয়ার সময় প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে আমি মার হাত থেকে ছিটকে পড়ি। মানুষের ঢলে আমি অসহায়ভাবে চলে আসি একদিকে আর যেহেতু ছোট ছিলাম তাই আমাকে কেউ খুঁজে পেল না। তখন হটোরগেটে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম, নিরাপত্তাহীনভাবে। আমার চারদিকেই মানুষ অথচ সবাই ছিল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কোনো কিছুই রক্ষা পাওয়ার মতো ছিল না। এটাই ছিল আমার প্রথম মৃত্যুর অভিজ্ঞতা।

কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকার পর আমি ভাবতে লাগলাম। চিন্তা করলাম একা একা বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব : একেবারেই তা সম্ভব ছিল। আমরা বাসে এসেছিলাম, বাসে আসার সময় সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরের সব কিছু দেখেছিলাম। ডটনিং গাটান পেছনে ফেলে এসেছিলাম। এখন যা করতে পারি, তাহলো, হেঁটে হেঁটে একা একাই বাস স্টপে ফিরে যাওয়া।

আমি ঠিক পথেই ফিরছিলাম। এই দীর্ঘ পথের একটি স্মৃতি আমার মনে আছে- নরব্রোতে পৌঁছানোর পর দেখলাম সেতুর নিচে জলরাশি বহমান। এখানে রাস্তায় যানবাহন ছিল অত্যন্ত বেশি আর আমি রাস্তা পার হতে পারছিলাম না। আমি ঘুরে একজন লোকের দিকে তাকালাম যে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলো, লোকটা বললো, ‘এখন যানবাহনের প্রচণ্ড ভিড়’। সে আমাকে হাত ধরে রাস্তা পার হতে সাহায্য করলো।

তারপর লোকটা আমাকে একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো। আমি ভেবেই পাই না কেন এই লোকটি এবং সব প্রাপ্তবয়স্করা, স্টকহোমে, একটি ছোট বালকের রাতের অন্ধকারে একা একা ঘুরে বেড়ানোকে স্বাভাবিক মনে করলো। কিন্তু তা-ই ঘটলো। সেই যাত্রায়--- যা মনে আছে--- গামলা স্টান পুরোনো শহর হয়ে স্লোসেন ও সোডার হয়ে এগিয়ে যাওয়া খুবই জটিল  ছিলো। সম্ভবত গন্তব্যের দিকে যাত্রা করছিলাম সেই রহস্যময় কম্পাসের সাহায্যে যা কুকুর ও গৃহপালিত কবুতরদের মধ্যে রয়েছে--  যেখানই তাদের ছাড়া হয় কোনো ব্যাপারই নয়, তারা ঠিক ঠিক ঘরে ফিরে আসে। আমি সে অংশের কিছুই স্মরণ করতে পারি না। শুধু আমার মনে আছে কীভাবে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ছিলো এবং যখন আমি শেষমেষ ঘরে ফিরে আসি তখন আমার মনে কি রমরমা অবস্থা। মাতামহ আমার সাথে দেখা করলেন। আমার চিন্তাক্লিাষ্ট ও বিধ্বস্ত মা পুলিশ স্টেশনে বসে আমার খোঁজ পাওয়ার অগ্রগতির খবর নিচ্ছিলেন।

মাতামহের দৃঢ় মানসিকতাই তখন তাকে রক্ষা করেছিল; তিনি আমাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করলেন। কিন্তু কোনো ব্যাতিব্যস্ততা বা ভান দেখাননি। প্রত্যেকেই একে নিরাপদ ও স্বাভাবিক হিসেবে অনুভব করলো।


জাদুঘর

শিশু হিসেবে জাদুঘরের প্রতি ছিল আমার অত্যন্ত অকর্ষণ। প্রথমেই বলতে হয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের কথা, কী অট্টালিকা! বিশাল, ব্যাবিলনীয়, অফুরন্ত। নিচের তলায় হলের পরে হল জুড়ে মমীকৃত স্তন্যপায়ী প্রাণী আর পাখিদের শরীর ধুলায় চেপে রয়েছে। আর খিলান জুড়ে হাড়ের গন্ধ যেখানে তিমি মাছ ছাদ থেকে ঝুলানো। তারপর একতলার ওপর : জীবাশ্ম আর অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা....

আমার যখন বয়স মাত্র পাঁচ বছর, তখন আমি এই প্রাকৃতিক ইতহাস জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম। প্রবেশের মুখেই দুটো হাতির কঙ্কাল সকলকে স্বাগত জানাচ্ছে। তারা যেন প্রবেশপথে দুই আশ্চর্যময় অভিভাবক। তারা আমার মনে এমনই অভূতপূর্ব ছাপ ফেলেছিল যে আমি একটি বিশাল অঙ্কন খাতায় তাদের একে ফেলি। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এসব দেখার পর কিছুকাল দেখার বিরতি পড়লো। এই সময় আমি কঙ্কাল দেখতে খুব ভয় পেতাম। সবচেয়ে খারাপ ছিল নর্ডিক গোত্র সংক্রান্ত শব্দার্থ অভিধানে মানুষ বিষয়ক প্রবন্ধে প্রদর্শিত হাড়সর্বস্ব ফিগারের ছবি দেখা। কিন্তু আমরা ভয় সাধারণত ছিল কঙ্কাল থেকে উদ্ভূত এবং মিউজিয়ামে প্রবেশপথে ঝোলানো হাতির কঙ্কালও এর ভিতর অন্তর্ভুক্ত। আমি আমার নিজের আঁকা কঙ্কালের ছবি দেখেও ভয় পেতাম এবং এজন্য স্কেচখাতা পারতপক্ষে খুলতাম না।

এখন আমার আকর্ষণ মোড় নেয় রেলওয়ে মিউজিয়ামের প্রতি। এখন তা গাবলি শহরের ঠিক বাইরের বিশাল প্রশস্ত এলাকা নিয়ে অবস্থিত কিন্তু তখন তা ছিল স্টকহোমের কেন্দ্রে ক্লারা জেলার ভিতরে খুব ছোট জায়গায় অবস্থিত। সপ্তাহে দুইদিন আমি আর মাতামহ সোডার থেকে নেমে হেঁটে সেখানে যেতাম।


মিউজিয়ামের কর্মচারীরা এক নবীন বালকের আগ্রহের ব্যাপারটি জেনে গেলো এবং একদিন আমি তাদের অফিসে ডাক পেলাম এবং ভিজিটর বুকে নাম লেখার অধিকার পেলাম। আমি হতে চেয়েছিলাম রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। আমি তখন ইলেকট্রিক অপেক্ষা বাষ্প-ইঞ্জিনের প্রতি আগ্রাহী হলাম অধিক। এক কথায় আমি ছিলাম অপেক্ষাকৃত কম টেকনিক্যাল আর অধিক আতুর রোমান্টিক।

কিছুদিন পর স্কুলবালক হিসেবে, আমি প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে ফিরে এলাম। আমি এখন এক শৌখিন প্রাণীবিদ, সত্যিাকারভাবে, যেন এক অধ্যাপক। পতঙ্গ ও মৎস্য বিষয়ক বইগুলোতে তখন হুমরি খেয়ে চোখ পেতে বসে থাকতাম।

আমি তখন আমার সংগ্রহ বাড়াতে লাগলাম। বাড়িতে কাপবোর্ডের ওপর তাদের রাখলাম। কিন্তু আমার করোটির ভিতর তারা বেড়ে এক বিশাল জাদুঘরে পরিণত হলো আর এই কাল্পনিক স্বপ্নময় জগত আর বাস্তবে দেখা পাওয়া যা আমি দেখেছি জাগতের দ্বৈরথ খেলায় মেতে উঠেছিল আমার মন।
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/transtr_mer_1_599747d20111009154917.jpg
 

প্রাইমারি স্কুল

কাটারিনা নোরা প্রাইমারি স্কুলে আমি লেখাপড়া শুরু করলাম আর আমার শিক্ষক ছিলেন মিস আর নামের একজন অত্যন্ত ফিটফাট সুবেশী অবিবাহিতা ভদ্রমহিলা যিনি প্রতিদিন নতুন পেশাক পড়ে স্কুলে আসতেন। প্রতি শনিবার স্কুল ছুটির পর প্রত্যেক বাচ্চাকেই একটি করে মিঠাই দিতেন তিনি। কিন্তু এ বিষয়টা বাদ দিলে, তিনি ছিলেন বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির।   চুল টানা আর ঘুষি দেওয়ার বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বদান্য, যদিও তিনি আমাকে মোটের ওপরে, কখনোই মারতেন না। আমি ছিলাম একজন শিক্ষকের ছেলে।

১ম ষান্মাসিকে আমার কাজ ছিল নিজের বেঞ্চে ঠিকঠাক বসে থাকা। আমি তখন লিখতে ও গুনতে পারতাম। আমাকে রঙিন কাগজ ঠিকমতো আকারে কাটার জন্য বসিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু তাদের অকার কী রকম ছিল এখন আর মনে করতে পারবো না।

আমি মনে করতাম যে সেখানে প্রথম বছর আমার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত ভালো কিন্তু সময়ান্তরে কখনও কখনও তা খারাপ হতে লাগলো। যে কোনো ধরনের গণ্ডগোল বা বাধা আসলে মিস আর ধৈর্য হারাতেন। আমারা কখনই ছোটাছুটি বা উচ্চস্বরে কথা বলতে পারতাম না বা কখনই ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতে পারতাম না। কোনো কিছু শেখার সময়ে অপ্রত্যাশিত কোনো কিছুই করতে পারতাম না। ছোট বাচ্চারা ভয়ে ও লজ্জায় কাপড় নষ্ট করলেও ক্ষমা পাওয়ার আশা করতে পারতো না।

আমি বলতে পারি যে একজন শিক্ষকের পুত্র হিসেবে আমি এ সমস্ত দুর্দশা হতে রক্ষা পেতাম। কিন্তু এই প্রতিকূলতা ও ভয়ের কারণে সৃষ্ট বিরূপ পরিবেশ আমি অনুভব করতাম। এসব কিছুর নেপথ্যে ছিল বাঁকা- নাসিকার ভয়ঙ্কর সেই প্রধান শিক্ষক। সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো কোনো সংশোধনী স্কুলে।

[চলবে]

 

বাংলাদেশ সময় ১৪৩০, অক্টোবর ০৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।