[বিশ্বখ্যাত সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার [সুইডিশ উচ্চারণে থোমাস ত্রান্সত্রোম্মের]। বহুদিন ধরে নোবেলের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম থাকলেও এ বছর তিনি পেলেন বিশ্বের সবচে সম্মানজনক এই সাহিত্য পুরস্কারটি।
এখানে ট্রান্সট্রোমারের একগুচ্ছ কবিতা ইংরেজি অনুবাদ থেকে ভাষান্তর করেছেন জুয়েল মাজহার ও কুমার চক্রবর্তী]
সূর্য-দৃশ্য
বাড়িটার পেছন থেকে সূর্যটা বেরিয়ে আসে
সে দাঁড়ায় গিয়ে রাস্তার ঠিক মাঝখানটায়
আর আমাদের ওপর ছাড়ে তার
লাল হাওয়ার নিঃশ্বাস
তোমাকে ছেড়ে আজ আমাকে যেতেই হবে, ইন্সব্রুক
কিন্তু আগামীকাল
ঝলমলে এক সূর্যের দেখা মিলবে
অর্ধমৃত,ধূসর বনের ভেতরে
যেখানে আমাদের বাঁচতে হবে গতর খেটে
[Landscape with Suns, ভাষান্তর : জুয়েল মাজহার ]
মধ্যশীত
একটি নীলাভ আলো
আমার পোশাকে ছড়ায় রোশনাই।
মধ্যশীত।
বরফের তাম্বুরা বেজে যায়।
বন্ধ করি আমি দু’নয়ন।
রয়েছে পৃথিবী এক নরম-নীরব
রয়েছে ফাটল এক
যার মধ্য দিয়ে
মৃতেরা পাচার হয় সীমান্তের এপারে-ওপারে
[Midwinter, ভাষান্তর : জুয়েল মাজহার]
এপ্রিল এবং নীরবতা
বসন্ত রয়েছে পড়ে ফাঁকা।
মখমল-কালো ছবিহীন পয়োনালি
আমার পাশে বয়ে চলে অতি ধীরে।
আর হলুদাভ
ফুলের জেল্লা জ্বলে।
আমার ছায়ার ভেতরে বাহিত আমি
কালো বাক্সে বেহালা যেনবা এক।
যে কথা আমি বলতে চাই শুধু
ঝলমলিয়ে আমার হাতছাড়া
সে যেন রুপো
বন্ধকী দোকানের।
[April and Silence, ভাষান্তর : জুয়েল মাজহার ]
গাছ ও আকাশ
একটি গাছ হেঁটে চলেছে বৃষ্টিতে,
পেছনে আমরা, বাদামি-রঙা অঝোর ধারায় যায় ছুটে
তার কতো কাজ; বৃষ্টিতে সে জীবন কুড়ায়
ফলবাগানের কালো পাখিটার মতো
বৃষ্টি থামলে গাছটিও থেমে যায়
মেঘহীন রাতে এই তো সে, আমাদেরই মতো
শান্ত-নীরব সেই ক্ষণের অপেক্ষায়, যখন ওই
মহাশূন্যে কোমল তুষার পাপড়ি তার দ্যায় মেলে
[ The Tree and the Sky, ভাষান্তর : জুয়েল মাজহার]
নাম
গাড়ি চালানোর সময় ঘুম এসে গেলো আমার, আর আমি পথের ধারে
গাছের নিচে নিজেকে রেখে দিলাম। পেছনের সিটে নিজেকে ঠেসে ঘুম গেলাম।
কিন্তু কতক্ষণ? কতটা সময়। অন্ধকার নেমে আসলো। হঠাৎ জেগে উঠলাম,
আর বুঝতেই পারলাম না আমি কী ছিলাম। সম্পূর্ণ সচেতন, কিন্তু কোনো কাজ
হলো না। কোথায় আমি? কে আমি? আমি এমন একটা কিছু যে ঠিক
পেছনের সিটে জেগে উঠলো, আর বস্তায় ঢোকানো বেড়ালের মতো নিজেকে
ঘুরিয়ে আতঙ্কেও ভিতর ছুড়ে দিলো। আমি কে?
অনেক পরে জীবন যেন আমার কাছে ধরা দেয়। দেবদূতের মতো
নিজের নাম আমার কাছে এসে পড়ে। দূর্গ-দেয়ালের বাইরে ঢোল ভেঙে
পড়লো (যেন তা লিউনোরা প্রস্তাবে) আর পদক্ষেপ যা আমাকে রক্ষা করবে
তা তাড়াতাড়ি দ্রুত দীর্ঘ সিঁড়িতে নেমে আসে। এই আমার আসা! এই আমি!
কিন্তু নঞর্থকতার নরকের পনের সেকেন্ড যুদ্ধের কথা ভুলে
যাওয়া অসম্ভব, একটি প্রধান মহাসড়ক থেকে
কয়েক ফুট দূরে যেখানে গাড়িগুলো
তাদের আলো জ্বলে পিছলে যায় অতীতে।
[দ্য নেইম, ভাষান্তর : কুমার চক্রবর্তী]
স্টেশন
একটি রেলগাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। কামরার পর কামরা স্থির
কিন্তু একটি দরজাও খোলে না, কেউ নামছে না উঠছে না।
খুঁজে পাওয়ার মতো সেখানে কি কোনো পথ নেই? যেখানে
তালাবন্দি লোকের কোলাহল যারা এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে।
তারা স্থিও জানালাগুলো দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
আর বাইরে একটি মানুষ একটি হাতুড়ি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে।
সে চাকায় আঘাত কওে, ফলে মৃদু আওয়াজ ওঠে। শুধু
ঠিক এখানে ব্যতীত! এখানে কম্পন বোধাতীত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত :
যেনো বজ্র নির্মোঘ, এক গির্জার ঘণ্টার শব্দ, এত জল-পথে
পৃথিবী প্রদক্ষিণের শব্দ, যা পুরো রেলগাড়ি আর প্রতিবেশী
আর্দ্র পাথরকে তুলে ধরে। সব কিছুই গান ধরেছে। শুধু
তুমি তা স্মরণে রাখবে। আর এগিয়ে যাবে!
[স্টেশন, ভাষান্তর : কুমার চক্রবর্তী]
যাত্রাপথে গোপনতা
ঘুমিয়ে পড়া একটি মানুষের মুখে দিনের আলো ঝাঁপিয়ে পড়লো
তাঁর স্বপ্ন অধিক প্রোজ্বল,
কিন্তু সে জাগলো না।
সূর্যের প্রখর অস্থির আলোর ভেতর
অন্য সকলের মাঝে হেঁটে চলে যাওয়া মানুষটির মুখে
অন্ধকার আঘাত হানলো।
অবিশ্রান্ত বর্ষণের মতো, তা ছিল গভীর অন্ধকার।
এমনি একটি কক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম যার গর্ভে প্রতিটি মুহূর্তে--
যেনো একটি প্রজাপতি জাদুঘর।
আর সূর্য আগের মতই এখনো প্রখর
তার অধৈর্য তুলি পৃথিবীতে অনুক্ষণ এঁকে যাচ্ছিল জীবনের ছবি।
[ভাষান্তর: কুমার চক্রবর্তী]
শেষরক্ষা
একটি ছোট নোঙরের মতো আমি পৃথিবীর মেঝেতে ঘুরপাক খাই
আমার আর বোঝার কিছু নেই।
ক্লান্তি, ক্রোধ,-- এসবের শেষ চাই।
জল্লাদের পাথরগুলো একত্রিত করে, ঈশ্বর বালির ওপর লিখে রাখেন কবিতা।
শান্তঘর।
চাঁদের আলোয় আসবাবপত্রগুলো দ্রুত ওড়ার জন্য প্রস্তুত।
একটি শূন্য সাজশয্যাহীন অরণ্যের মাঝ দিয়ে
ধীরে-- আমি আমার আত্মার ভিতরে চলে যাই।
[ভাষান্তর : কুমার চক্রবর্তী]
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১১