ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

গল্প

রাজত্ব তবে বিরিয়ানির | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৭
রাজত্ব তবে বিরিয়ানির | তানিয়া চক্রবর্তী রাজত্ব তবে বিরিয়ানির | তানিয়া চক্রবর্তী

বাংলাদেশ থেকে ফিরে ভারতে এসেই যার অভাব খেতে বসলেই অনুভব করছি তার নাম “বিরিয়ানি”! এ হেন রাজকীয় খাবারের প্রভাব চিন্তা-চেতনায় এমনভাবে প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা আসলে তা ছাপিয়ে যাচ্ছে। তবে দেশভিত্তিক নাম করে খাবারের ব্যাপ্তি কমানো ভুল হবে। আসলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিরিয়ানির প্রচলন প্রায় ৪শ বছর পুরনো; এর মধ্যে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য!

সভ্য সমাজের মানুষ যতো কর্মকাণ্ডেই বিস্তৃত হয়ে উঠুক না কেন দিনের চার ভাগ, কিংবা তার বেশি বারও সে এক নিদারুণ রসনা তৃপ্তির কাজে নিমগ্ন থাকে তা হলো, খাওয়া! জীবনের মৌলিক চাহিদার এক হলো খাদ্য এবং আমাদের জিহ্বা ভর্তি স্বাদকোরক থাকায় খাদ্যের ব্যাপারে আমরা রসনাসিক্ত চূড়ান্ত!

বিরিয়ানির আগমন পার্সিয়ান শব্দ “বিরিয়ান” থেকে কিংবা ভিন্ন মতে বিরিঞ্জি বা চাল থেকে “বিরিয়ান” শব্দের অর্থ রান্নার আগে ভাজা চাল। সাধারাণত লোকমুখে এটাই প্রচলিত যে, ইরান থেকে আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে উত্তর ভারত এরপর বাংলাদেশ আসে বিরিয়ানি।

ইংল্যাণ্ডের জনৈক লেখিকা ও গবেষক তার “কারি” বইতে অবশ্য বলেছেন, মুঘল আমলে পার্সিয়ান পদ্ধতি থেকে বিরিয়ানির আগমন। আইন-ই-আকবরি বইতে আবার দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের ভটকালি বিরিয়ানির উল্লেখ করা আছে। সেখানে বিশেষভাবে পেঁয়াজের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিরিয়ানির রকমভেদের ইয়ত্তা নেই- কাচ্চি, পাক্কি, চিকেন, মাটন, কিমা, হায়দ্রাবাদী, দিনদিগুল, বোম্বে, সিন্ধু, তাহির, মালাবার, ড্রাইফুট বিরিয়ানি ইত্যাদি।

১৮৫৬ সালে নবাব ওয়াজেদ আলী তার বাবুর্চি নিয়ে কলকাতায় আসেন, এর ফলে কলকাতাতেও বিরিয়ানির প্রচলন শুরু হয়। এখানকার বিরিয়ানির বিশেষ উপাদান ছিলো আলু, কারণ দরিদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেও এর খাদ্যাভাস এসে গিয়েছিল। সেই থেকে কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু অবশ্য ব্যবহার্য উপকরণ। বিরিয়ানিপ্রাচীন সনাতন ধর্মের কিছু লেখনীতেও “পুলাকার” নামক শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় যার অর্থ একদলা ভাত বা পোলাও জাতীয়। সংস্কৃত সাহিত্যেও পলান্নের কথা পাওয়া যায় তার রন্ধনপ্রণালীও খুব আলাদা কিছু নয়। মুঘল আমলে সম্রাট শাহজাহান ও বেগম মুমতাজ মুঘল সেনাদের খাদ্যের স্থান ও খাদ্য তদারকি করতে গিয়ে উন্নত খাবারের উপাদান হিসেবে মাংস, ভাত, ঘি এসব একযোগে রান্নার কথা বলেছিলেন, সেই থেকে বিরিয়ানির আগমন হয় বলেও মনে করা হয়। মুমতাজ নিজেই এই খাবার খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফলে তার খাদ্যতালিকার নিত্য বস্তু থাকত বিরিয়ানি।

এই নিয়ে অন্যগল্পও কথিত রয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তামিল সাহিত্যেও বিচ্ছিন্নভাবে “ওন সরু” বলে খাদ্যের উল্লেখ রয়েছে তবে এক্ষেত্রে উপাদান কিছু ভিন্ন যেমন- ভাত, ঘি, হলুদ, ধনে, লঙ্কা, তেজপাতা ও মাংস। বাংলাদেশের প্রধানত পুরান ঢাকার বিরিয়ানি বেশি জনপ্রিয়। তামার হাড়ি মুখে ময়দার প্রলেপ তারপর এর ভেতরে থাকা সুগন্ধি চাল, মাংস, বাদাম, উন্নত মশলা, জায়ফল-জয়িত্রী, দারুচিনি, জাফরান, ঘি প্রভৃতি উপকরণের নাম শুনেই তো ইন্দ্রিয় অস্থির হয়ে আসে বোধ করি। হাজী ও নান্নার বিরিয়ানি মানুষের মুখে মুখেই বহুদূর ছড়িয়ে গেছে যেভাবে জনপ্রিয় লখনউয়ের “দম পুখত” বিরিয়ানির নাম। লখনউয়ের নিজাম পরিবার থেকে বিরিয়ানির পর্ব সারা রাজ্যে ছড়াতে থাকে।

অনেকে যেমন বলে, আরব বণিকদের হাত ধরে ভারতের কলকাতার মধ্যে বিরিয়ানির অনুপ্রবেশ হয়। অনেকে এই কথাও বলেন, তুর্কী-মঙ্গোল শাসক তৈমুর লঙয়ের হাত এই বিরিয়ানির আগমন হয় ভারতে, তারপর ক্রমান্বয়ে তা বাংলাদেশে আসে। পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানির কথা শোনেনি এমন খাদ্যরসিক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কাঁচা কথার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতেই কাচ্চি বিরিয়ানির ব্যবহার। উজবেকিস্তানে এখনও সেই প্রাচীন পদ্ধতিতে পোলাও, বিরিয়ানি তৈরি হয়ে থাকে। সেখানে বিরিয়ানির চালের গন্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চাল বেশী ফোটানো হয় না। বিরিয়ানিকাশ্মীরে তেহারি নামক বিরিয়ানি অতি জনপ্রিয়, এখানে আলু ও হাড়ের পরিমাণ বেশী থাকে। খিদেকে মনোরম অথচ কম খরচে বানানোর জন্য এই প্রক্রিয়া আসে, তা এখনও অব্যহত। ১৯৩৯ থেকে অবশ্য হাজীর বিরিয়ানি বাংলাদেশে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। জিরাকাশলা, সাম্বা, কালিজিরা প্রভৃতি চাল ব্যবহারে বিরিয়ানির রকমভেদ আছে, যদিও বাসমতী চালের ব্যবহার সবচেয়ে বেশী।

সৈন্যদের কাছে এই খাবার “one pot dish” নামে পরিচিত। পোলাও আর বিরিয়ানির পার্থক্য খাদ্যরসিকরা আশা করি জানেন। বিরিয়ানির দু’স্তর চালের মধ্যে মাংসের লুকোচুরি, চালের একত্রে রান্না, কিংবা সেদ্ধ বা কাঁচা থাকার খেলা, আর নিদারুণ সুগন্ধ তার মধ্যে মাঝে মধ্যে সাদা সাদা ডিমের সজ্জা— এসব একযোগে মুখের ভেতরে যে রসনা তৃপ্তি ঘটায় তাই বিরিয়ানি। আর এর উপাদানে মশলার ব্যবহারে একে পোলাও এর থেকে একটু রাজকীয় বলাই যায়, সঙ্গে থাকে রায়তা কিম্বা বোরহানি। আলাদা করে কারি পরিবেশনের তেমন প্রয়োজনীয়তা নেই। পোলাও এর অবশ্য সহকারী বন্ধু হিসেবে মাংসের কারি লাগে, আর সে নিজে একটু হালকাও হয়।

মুঘল আমল থেকে যে বিরিয়ানি এসেছে তা অনেকে মানতে নারাজ। অনেকেই বলেন, ইরানিদের হাত ধরে বিরিয়ানির আগমন আবার দ্বিমত আঁচ যে, আরব সাগরে আরব বণিকদের ব্যবসায়িক ভ্রমণের হাত ধরে দক্ষিণ ভারতে বিরিয়ানি আসে। লখনউয়ের গল্প তো আগেই বলেছি। ইরানে নাকি বিরিয়ানি পাতলা রুমালি রুটির মধ্যে ভরে দেওয়া হোতো, এটাই ছিলো প্যাকেট আর মানুষ সহযোগে খেত।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কোনো এক উপন্যাসে (নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) সম্ভবত একটা কথা বলেছিলেন তার সারমর্ম এই, ইন্দ্রিয়কে সুখী না করলে বোধহয় যাপনের খামতি থেকে যায়।

তিনি না হয় লেখকের দৃষ্টি থেকে বলেছিলেন, আমাদের ক্ষেত্রেও কি তা কম ন্যায্য! বিশেষত খাদ্যের ব্যাপারে বাঙালি বটেই। পেট ভর্তি খাবার মন ভর্তি করে বৈকি আবার তা যদি জিহ্বাকে খুশি করে অন্দরে আসে। বিরিয়ানি খাওয়ার মুহূর্তে প্রথমে তা চোখকে তুষ্ট করে, কিছু পূর্বেই সে ঘ্রাণকে আহ্বান করেছে এবারে চামচ কিংবা হাত যা দিয়ে মাংস, আলু, ডিম সহযোগে ভাতের উন্নত রূপ মুখে ঢোকালেন, আপনি মনুষ্যজন্মের রসনাতৃপ্তির রহস্যে ঢুকে পড়লেন! এ কী কম কথা!

বাংলাদশের আন্তরিকতা আর ভালোবাসার পাশাপাশি যদি আর কিছুর নাম করি তবে বিরিয়ানি অবশ্যই স্থান পায়। বিরিয়ানি এক প্রকার ছল করেই যেনো মন-মজ্জাতে ঢুকে  পড়ে। বাংলাদেশে কিছুদিন থাকাকালীন বন্ধুজনের আতিথেয়তায় বিরিয়ানি খেয়ে খেয়ে কিছুটা নিরাসক্ত হয়েছিলাম। ফিরে এসে দু’দিন যেতে না যেতেই আবার তার জন্য মন কেমন করছে, বুঝলাম এ সেই খাদ্য যে একবার একে উপভোগ করেছে তার এর থেকে সহজে নিস্তার নেই!

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।