ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

তদন্ত

গাজী তানজিয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১
তদন্ত

থানার সহকারী তদন্ত কর্মকর্তা দুইশো চুরাশি নম্বর ফাইলটা হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করছে। ক্লিন মার্ডার।

ঠিক সন্ধ্যা বেলায়। পুকুরে ঝপ করে কিছু পড়ে যেতে শুনলেন প্রথম ও তখন পর্যন্ত একমাত্র সাক্ষী। তিনি তার ব্লাড সুগারের মাত্রাটা কমিয়ে আনতে বৈকালিক জগিং করছিলেন। এমন একটা প্যাচের মধ্যে পড়ে বেচারার সুগারের মাত্রা এখন ২২ ছাড়িয়ে গেছে।

কলেজের পুকুরের পাশ ধরে হাঁটছিলেন কেন?
ওটাই আমার বাড়ির পথ। আমার বাড়িরটা একটু ভেতরে। ওই ন্যারো রোডটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে।
কিন্তু পুকুরপাড় তো আর রাস্তা হতে পারে না।
না মানে আমি শর্টকাটে পার হই আর কি।
ডায়াবেটিক কন্ট্রোলে আনতেও ফাঁকিবাজি!
না মানে!
ডায়াবেটিক পেশেন্টকে তো ডাক্তার সকালে হাঁটতে পরামর্শ দেন, আপনি বিকেলে হাঁটেন কেন?
ভয়ে।
মানে, কিসের ভয়?
এই নিরাপত্তার অভাব আর কি। হাইজাকার টাইজাকার...।
কিন্তু বিকেলে হাঁটতে গিয়েও তো গেলেন ফেঁসে।
সবই কপাল!
ঠিক আছে ওসব বাদ দেন, আপনি কি দেখলেন বলেন।
আমি তেমন কিছুই দেখি নাই। ওই রাস্তা ধরে জোরে জোরে হাঁটছিলাম, হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার... তারপর ঝুপ করে পুকুরে ভারী কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে দু’তিন জনের দুদ্দাড় দৌড়ে যাবার মতো কিছু একটা শব্দ।
তার পর?
তার পর তো সবার জানা।
সবার জানা না, আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি, আপনি কি জানেন?
বললাম তো, শব্দ শব্দ।
শুধু শব্দ, দেখেন নাই কিছু?
না।
কেন?
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল।
শব্দের পর কি হলো?
রাস্তায় কয়েকজন পথচারী ছিলেন, তারাও ছুটে এলেন।
আর সাথে সাথেই সেল ফোনে বিষয়টা থানায় ইনফরম করি।
হসপিটালে জানান নাই?
জানিয়েছি।
ভিকটিমকে কি আপনি চিনতেন?
দেখি নাই কখনো, নাম শুনেছিলাম। দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই হয় নাই।
দেখা কিভাবে না হয়ে পারল? সে কলেজের ভিপি। আর আপনি ওই রোডের বাসিন্দা। সকাল বিকেল হাঁটাহাঁটি করেন রাস্তায়। দেখা না হয়ে পারে!
ডায়বেটিকের কারণে আনেকদিন ধরে আমার চোখের আবস্থা ভালো যাচ্ছে না। চেনা মানুষদেরই চিনতে পারি না। তার ওপরে...।
চেনা মানুষদের চিনতে পারেন না , নাকি যারা দৌড়ে গিয়েছিল তাদের না চিনতে পারার এটা একটা কৌশল?
ভদ্রলোক জবাবে কিছুই বললেন না। তার সৌম্যদর্শন চেহারা নিয়ে স্থির বসে রইলেন।
কি বলছেন না যে কিছু?
এটা আমার দুর্ভাগ্য যে এর বাইরে আর কিছুই বলতে পারছি না।
এভাবেই একে একে সব সাক্ষী পিছলে যাচ্ছে। এ রকম কয়েকটা সহজ বাক্যের বাইরে আর কেউ কিছু দেখেনি। কেউ কিছু জানে না। একই ভাঙ্গা রেকর্ড। শিট্!

ভিকটিমের কেইস হিস্ট্রি কি বলে? প্রশ্ন করলেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।     
ভিকটিমের কেইস হিস্ট্রি তো জটিল স্যার। কলেজের ভিপি ফার্স্টটার্ম চলছে। তবে জয়টা সহজ ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে ১৫২ ভোটে পরাজিত। কিন্তু তারপরও বিজয়ী ঘোষিত।
পরাজিত  অথচ বিজয়ী ঘোষিত। কিভাবে?
ওই সহজ ফরমুলা, লোকাল ক্ষমতাবানের খাস ক্যাডার ছিল।
একে মারার সাহস কে করল?
সেটাই তো কথা স্যার।
বাদ দাও। গো এহেড। বিজয়ী ঘোষিত কিভাবে হলো?



‘রেজাল্ট ডিক্লেয়ার হওয়ার আগে টোটাল স্ক্রুহিটিনি বোর্ড চুপ চাপ হতভম্ব! এতো কিছু করেও ভোট পেল না! তাও ব্যবধান এতো বেশি। কিভাবে ডিক্লেয়ার করি বলেন তো স্যার?

প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা চিন্তিত। কি সিদ্ধান্ত দিয়ে আবার কি প্যাচে পড়েন। বাইরে হাওয়া গরম। দু’গ্রুপের ছেলেরাই মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছে। উত্তেজিত ভঙ্গিতে দ্রুত পা নাড়তে নাড়তে প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা বললেন, এখনই ডিক্লেয়ার করার দরকার নাই। ডিলে করেন।
কিন্তু কলেজের সামনে মাঠ ভর্তি জড়ো হয়েছে প্রতিপক্ষ প্যানেলের ছাত্র সমর্থকরা।
বললাম তো একটু ডিলে করেন। ক্ষমতাধর এইমাত্র ফোন করলেন। পদ্ধতি একটা বের হয়েছে। ও এখুনি অবজেকশান পেপার জমা দিচ্ছে।
কি অবজেকশান স্যার? নির্বাচন ফেয়ার ছিল। কোনো গোলমাল কারচুপি হয় নাই।
‘আপনাকে অত সাফাই গাইতে হবে না। আপনাদের নির্বাচনী বিধিমালাটা হাতের কাছে রাখেন শুধু। মিনিট পঁচিশের মধ্যেই অবজেকশান লেটার এসে যাবে। ’
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/Eric_Tore_-_3120110930193948.jpg
তারপর কি হলো?
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যে ১৫২ ভোটে এগিয়ে আছে সে গুরুতর নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘন করেছে। রাতারাতি সে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েরও ছাত্র হয়ে গেছে।
একই সাথে দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র!
হ্যাঁ স্যার। গুরুতর অপরাধ। নির্বাচনী বিধিমালার চরম লঙ্ঘন।
কিন্তু রাতারাতি সে উন্মুক্তের ছাত্র হয়ে গেল কিভাবে?
ক্ষমতাবানের ক্ষমতা সম্পর্কে তখনো মানুষ জানে নাই পুরোপুরি। জাতীয় নির্বাচনের তখন মাত্র ছয়মাস পার হয়েছে। জানান দেয়ার এ কেবল একটা নমুনা মাত্র।
তাহলে সন্দেহের তালিকায় একজনকে পাওয়া গেল।
কার কথা বলছেন, স্যার?
তুমি যা ভাবছ তা না। চাকরির ভয় আমারও আছে। সন্দেহের তালিকায় আসছে বিজয় রক্ষার্থে ব্যর্থ ভিপি।
এসিস্ট্যান্টের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
ভিপি রিপনের বিরুদ্ধে একটা রেপ কেইস ছিল। রেপ কেইস ও!
এতে এতো বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, স্যার। এটা ওদের ছাত্র সংগঠনের খানদানি ট্রাডিশান। এটা না থাকলে বরং...!
কিন্তু সেই কেইসের বাদীর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?

সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট ০% হলেও আপাতত সন্দেহের তালিকা থেকে একে বাদ দেয়া যাবে না স্যার। আর প্রতিদিন বিকেলে নাকি চা খেতে বাদাল যেত।
বাদাল কেন? শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চা খেতে যাওয়া!
হ্যাঁ কনডেন্সড মিল্কের চা-এ সুখ পাওয়া যেত না। খাঁটি গরুর দুধের চা না খেলে ডাইলের ফিলিংটা ঠিক জমে না।
ওহ্ আই সি। বাদাল তো ফেনসিডিলের আখড়া।
তাহলে আর বলতেছি কি স্যার!
ওখানে কতক্ষণ থাকতো প্রতিদিন?
এই ঘণ্টা দুয়েক বা কখনো তার কম। কিন্তু যে সময়টায় ও মার্ডার হয়, আই মিন রক্তাক্ত অবস্থায় পুকুরে পড়ে যেতে দেখেছে লোকজন। সেই সময়টায় কিন্তু প্রতিদিন ও বাদাল থাকত দলবল সহ।
তাহলে ওই দিন কেন ওই সময়ে ওখানে...?
বাদালে যে চায়ের দোকানে ও চা খেত সেই দোকানদাদের ভাষ্যমতে, আগের দিন নাকি ঘন ঘন ফোনে কথা বলছিল। বারবার বলছিল রেট জানো তো এক ট্রাক ৫০০ টাকা।
এক ট্রাক মাত্র পাঁচশো টাকা! সেইটা কি জিনিস?
দোকানদারেরও তো সেই জিজ্ঞাসা। ছাই ও তো এতো কম দামে মিলবে না। তাছাড়া ছাই হইলেও ট্রাকে তুলতে কস্টিং এর চেয়ে বেশি পড়বে। তাই কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে ভয়ডর ফেলে প্রশ্ন করেছিল, ‘ভাই একটা কথা বড় জানতে ইচ্ছা করতাছে যদি অভয় দেন জিগাই?’
ভিপি রিপন বলল, কি?
মানে ৫০০ টাকায় এক ট্রাক পাওয়া যায় জিনিসটা কি? যদি জানতে পারতাম বিরাট উপকার হইত।
হো হো করে হেসে উঠেছিল রিপন। সেই হাসি তার সাগরেদদের মাঝেও সংক্রামিত হয়েছিল।
আরে বেটা মানুষ, মানুষ। মানুষের দাম ছাইয়ের চাইতেও কম। মিছিলের জন্য ভাড়া করা এক ট্রাক মানুষের দাম ৫০০ টাকা। বুঝলা মিঞা!
‘নেতার মিটিং তাই লোক নিয়ে যেতে হবে। হাজার হাজার লোক লাগবে বুঝলা মিঞা, হাজার হাজার। ’

মিটিংটা যেন কবে ছিল?
ঘটনার তিন দিন পর।
তাহলে কি প্রতিপক্ষের কেউ?
না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সম্ভাবনা কম। এক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় আসে দলীয় গ্রুপিং।
কিভাবে?
এই অঙ্ক তো সরল। মিটিং-এ ও বেশি লোক সমাগম করলে দলের ভেতরের প্রতিপক্ষের ক্ষতির স¤ভাবনা বেশি।
গ্রুপিং ছিল?
ছিল না! কয়েকটা গ্রুপ।
আর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের? কেউ? সেভাবে রিভেঞ্জ নিতে পারে না? কেউ হিটেড হয় নাই, রেকর্ড কি বলে?


স্যার খুনটা হয়েছিল কলেজে।
হ্যাঁ।
কিন্তু রেকর্ড বলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মি কেউ তো ঢুকতেই পারত না কলেজে। একবার একজনকে কি করেছিল একথা তো সবাই জানে।
কি করেছিল যেন?
ওই যে কলেজের পুকুরে চুবিয়ে , জামা-কাপড় খুলে নিয়ে, খবরের কাগজ পরিয়ে জুতা গলায় ঝুলিয়ে সারা কলেজ মাঠে ঘোরাল। তারপর জুতা মুখের কাছে ধরে ওর দলের লিডারের নামে অকথ্য গালি গালাজ করিয়ে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করিয়ে নেয়।
ওই ছেলে একখন কোথায়?
 সে কলেজ ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে চলে গেছে। লজ্জায়, ভয়ে। জিডি করতে এসেছিল। থানা জিডি নেয় নাই।
সেও কি ভয়ে! হা-হা-হা। হাসিতে হতাশা ঝরে পড়ে অফিসারের।
তারপর একেও সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। এরপর কে আছে?
ওর নামে জিডি করেছিলেন প্রফেসর রাজ্জাক।
জিডি?
হ্যাঁ।
কেন?
ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
কোথায়, কেন?
সে এক বিরাট ইতিহাস।
পা’টা ল¤বা করে ছড়িয়ে দিয়ে সিগারেটে একটা গাঢ় টান দিয়ে বললেন, সিনিয়র আইও। বলেন, বলেন ইনভেস্টিগেশনের স্বার্থে সব ইতিহাসই তো শুনতে হবে।

প্রফেসর সাহেবের বাসা ছিল ভিপি রিপনের বাসার সামনে। সারাদিনই সেখানে ওর পার্টির ও কলেজের সাঙ্গ-পাঙ্গদের আনাগোনা। রাত তিনটার সময়ও মোটরসাইকেল ভর্তি করে লোকজন আসে তার কাছে। ক্ষমতাবানের খাস ক্যাডার বলে কথা। এলজিআরডি, রোডস এ্যান্ড হাইওয়েজ, পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গোটা সরকারি ডিপার্টমেন্টের টেন্ডার ভাগাভাগি, প্রাইমারি স্কুল টিচার, পুলিশ, পিওন-চাপরাশির নিয়োগের ঘুষের টাকার ভাগাভাগি সবই তো চলত ওখানে।
সে চলে চলুক, সেখানে প্রফেসর সাহেবের ইন্টারেস্টটা কি?
প্রফেসর সাহেবের ইন্টারেস্ট অন্যখানে, এনভায়রনমেন্ট পলিউশন রোধ।
এনভায়রনমেন্ট পলিউশন মানে? ওরা কি ধরনের পরিবেশ দূষণ করত। ওখানে বেআইনি কোনো কারখানা তুলেছিল নাকি? রেসিডেন্টসিয়াল এলাকায়?
কারখানাই বটে স্যার, তবে ভিন্ন কারখানা।
রোজ দুপুরবেলা ভিপি রিপন ওর বাড়িতে এক একজন তথাকথিত গার্লফ্রেইন্ড নিয়ে ঢুকত। বুঝতেই পারছেন গার্লফ্রেইন্ড কারা? এর মধ্যে পেশাদার, অপেশাদার, খ-কালীন প্রেমিকা, জোর জবরদস্তির প্রেমিকা সবরকমই ছিল। প্রফেসর সাহেবের স্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতেন। তিনিই একদিন তার স্বামীকে বললেন, পাড়ায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে তো আর বসবাস করা যাবে না। পাড়ার পরিবেশ তো একেবারে নোংরা হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ!
স্ত্রী ও এই লাগাতার অভিযোগের ফলশ্রুতিতে প্রফেসর সাহেব একদিন ভিপি রিপনের এক খ-কালীন প্রেমিকার চাচাকে ডেকে মেয়ে সামলানোর অনুরোধ করলেন।
 
মেয়ের চাচা গিয়ে তার মাকে জানালে ওই প্রেমিকার ওপর চরম উত্তম-মধ্যম চলে। প্রেমিকা যথারীতি তার প্রেমিককে ইনফরম করলে প্রফেসর সাহেবের ওপর খড়গ নেমে আসে। পরের দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ভিপি রিপনের ক্যাডাররা চ্যংদোলা করে তুলে নিয়ে তাকেই অনেকটা বলাৎকারের আইটেম হিসেবে প্রেজেন্ট করে।
এহেন গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে ভিপি রিপন তার কলেজের এই শিক্ষককে যথেষ্ট পরিমাণ শিক্ষা দেয়ার হুমকি দিয়ে তিন দিনের মধ্যে পাড়া ছাড়ার আল্টিমেটাম দেয়।
প্রফেসর সাহেব তখন ঘোর বিপদের কালো কালো মেঘ দেখতে পেলেন চারদিকে। ওদিকে পৈত্রিক বাড়িঘর ছেড়ে যেতেও মন সায় দেয় না। কেন যে স্ত্রীর কথা মতো এমন নির্বোধের মতো একটা কাজ করে বসলেন! এখন ঠেলা সামলাও। শেষে কি-না বাড়িটাই হাত ছাড়া হয়ে যায়। তাই উপায় অন্ত না দেখে শেষ পর্যন্ত প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে তিনি বাড়ি বাঁচাতে থানায় একটা জিডি করে ফেললেন।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/winter_morning1-120110930194215.jpgএতো সাহস তিনি পেলেন কোথায়! এক্ষেত্রে তো সবাই বাড়ি ঘর ছেড়ে পালানোটাই প্রেফার করে।
সাহসটা মূলত তার স্ত্রীই দিয়েছিলেন। প্রফেসর সাহেবের স্ত্রী তার কোনো এক আত্মীয় সূত্রে এসপি সাহেবের কাছে বিষয়টা জানিয়ে জিডিটা করার পারমিশান নিয়েছিলেন। তাই তার বা তার ছেলে-মেয়ের হয়ত প্রাণটা দিতে হয় নাই। তবে প্রফেসর সাহেব জিডি করতে এসে ওদের বেয়াদবির আরো কিছু নমুনা বলেছিলেন।
কি নমুনা? এর দেখি নমুনার শেষ নাই।
প্রফেসর সাহেবের কলিগ প্লাস ইউনিভার্সিটি লাইফের বন্ধু সেলিনা হক। ওই কলেজেরই ভাইস প্রিন্সিপল। তিনি তার এই জিডি করার খবর শুনে বললেন, ‘ভাই তোর তো অনেক সাহস। পানিতে থেকে কুমিরের সাথে ঝগড়া করছিস। আমিতো কিছুই পারলাম না। কত বড় বেয়াদব, আমি তোর কলেজের ভাইস প্রিন্সিপল আর আমাকে বলে কি না, ‘এই আপা, এই আপা, আপনি ঠোঁটে লিপিস্টিক দেন ক্যান? রাগে, অপমানে তখন আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল কষে একটা থাপ্পড় দেই। কিন্তু না তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলালাম। ওদের তো বিশ্বাস নেই যদি পাল্টা থাপ্পড় দেয়! তাই দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, তোর মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর লিপস্টিক কেন দেয়। ’
তারপর ওরা যেভাব হাসল তাতে করে সেলিনা আপা চোখ বন্ধ করলে এখনো নাকি সেই দৃশ্য দেখতে পান। তিনি তারপর কলেজে যান নাই দীর্ঘকাল। ছুটিতে ছিলেন। কিন্তু জিডি করেন নাই। এসব অপমানের জিডি হয় না।

কিন্তু অপমানের কারণটা কি? প্রফেসর সাহেব বলেন নাই?
বলেছেন। উনিতো কলেজের ভাইস প্রিন্সিপল। কলেজের অনার্স বিল্ডিংয়ের রিপেয়ারের টেন্ডার ফেয়ার করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন কোনো চাপা টেন্ডার এ্যালাও করবেন না। আর এটাতো ওদের স্বার্থ বিরোধী, তাই...।
হুম্ বুঝলাম।
সন্দেহের তালিকায় কি তাকেও রাখা যায় স্যার?
কী যে বল তুমি? এরা কি খুন খারাপি করতে যাবেন? বড়জোর অভিশাপ দিতে পারেন। আর তাতে যদি কেউ খুন হয় তো ভিন্ন কথা। পেনসিলের উল্টো দিকটা কানে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন সিনিয়র আইও। নেক্সট কোনো ক্লু? আর একটা ক্লু আছে স্যার, এটাই এখন পর্যন্ত লাস্ট।
কি? বল তাড়াতাড়ি।
স্যার আপনার মনে আছে, ক্ষমতাবানের ভাইস্তার গ্রুপের সাথে ভিপি রিপনের গ্রুপের রামদা, হকিস্টিক, একে ফরটি সেভেন নিয়া শো-ডাউনের কথা?
ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ এইতো খুনের কিছুদিন আগের কথা। এই ধর মাস দুয়েক।
এলজিআরডি’র টেন্ডার ড্রপিং। শুধু তাই না ড্রাগ ডিলের কি একটা ব্যাপারও ছিল।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে।
স্যার ব্যাপারটা কিছু আঁচ করতে পারছেন? ব্যাপারটা কিভাবে কোনদিক দিয়া ঘটতে পারে? ক্ষমতাবানের খাস ক্যাডার হিসেবে ও যা দুর্নাম কুড়িয়েছিল তাতে করে ক্ষমতাবানের ভোটের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া টেন্ডারের টাকার হিস্যাও ঘরের বাইরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল সিংহভাগ। সব দিক বিবেচনায় ওকে সরিয়ে দেয়াই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ।
নইলে আমি আর আপনি দুই আইও আর ওর পরিবারের সদস্যরা ছাড়া আর কারো এই হত্যার বিচার নিয়া মাথা ব্যথা নাই কেন?
হ্যাঁ, ঠিক বলছ।
তবে স্যার একটা কথা।
কি কথা?
একটা জিনিস শিখলাম এই ইনভেস্টিগেশনে এসে।
কি শিখলা?
পথের কাঁটা এভাবেই সরাতে হয় সমূলে, নইলে টিকে থাকা যায় না।  
তবে চার্জসীট তো একটা দিতে হবে।
এই নিয়া কি ভাবলেন স্যার? কার কার নামে দিব?
নামের একটা খসড়া তালিকা পাও নাই?
হ্যাঁ ভিপি রিপনের দুই সাগরেদ সাগর আর পলাশ। সাথে আরো কিছু পোলাপাইন। কিন্তু ওরা হয়ত কিছু করে নাই।
ওরা করে নাই আমরা করব।
কি করব স্যার?
আমাদেরও তো কিছু ক্ষমতা আছে, তাই অ্যাপ্লাই করব।
কিভাবে স্যার? চাকরি বাঁচানো ফরজ না?
সে কথা কি আমি জানি না?
তাহলে?
এজাহারে ওদের কার কার নাম আছে তাদের বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ কর। তারা যে যে যোগাযোগে সাড়া দিবে, মানে মালকড়ি ঠিক মতো ছাড়বে তাদের নামে চার্জ গঠন হবে, তবে দুর্বল চার্জ।
আর যারা সাড়া দেবে না। তারাই হবে ...।
এইতো বুঝতে পারছ। তবে আস্তে আস্তে, এসব কথা এখানে বলা ঠিক হবে না। দেয়ালেরও কান আছে।


বাংলাদেশ সময় ১৮০০, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।