ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব-৩]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব-৩]


[দুনিয়াজুড়ে সাড়া জাগানো এবং দীর্ঘদিন ধরে বেস্ট সেলার, জেলপালানো কয়েদির মনোমুগ্ধকর আর শিহরণ জাগানিয়া কাহিনী ‘প্যাপিলন’ফ্রান্সে জন্ম নেয়া হেনরি শ্যারিয়ার ওরফে প্যাপিলন লিখিত বাস্তব এই ঘটনা নিয়ে একই নামে হলিউডে সিনেমাও হয়েছে।

 

১৯৩১ সালের অক্টোবরে ফরাসি আদালত কর্তৃক বিনা অপরাধে (প্যাপিলনের দাবি মতে) খুনের আসামি হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৪ সালের জুলাই পর্যন্ত পরবর্তী ১৩টি বছর হেনরি শ্যারিয়ারের জীবন কেটেছে জেল পালানো এবং আবারো জেলে ফেরার মধ্যে দিয়ে। তবে সত্যিকারার্থে প্যাপিলন জেলমুক্ত হন ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর। এদিন এল ডোরাডো কারাগার থেকে প্যারালাইসিস আক্রান্ত আরেকজন প্রতিবন্ধী কয়েদি পিকোলিনোসহ মুক্ত হন প্যাপিলন।

হেনরি শ্যারিয়ারের দীর্ঘ ১৩ বছরের ফেরারি এবং জেল-জীবনের  হৃদয়স্পর্শী, দুর্ধর্ষ, মানবিক আর আবেগমথিত অমানবিক সব অভিযানের কাহিনী লেখা হয়েছে প্যাপিলন-এ।

এরপরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে শ্যারিয়ার রচিত দ্বিতীয় বই ‘ব্যানকো’ তে। স্পেনীয় দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে জন্মভূমির মুক্তি আনয়নকারী মহান নেতা সিমন বলিভারের দেশ এবং বর্তমান সময়ের আলোচিত নেতা হুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনিজুয়েলা’একজন নাগরিক হিসেবে শুরু হয় তার নয়া জীবন। প্যাপিলনের শেষ পৃষ্ঠায় ছিল এল ডোরাডো পেনাল সেটলমেন্টের অফিসার প্যাপিলনকে ‘গুড লাক’ বলে বিদায় জানাচ্ছেন।

আর ব্যানকো’কাহিনী শুরু ঠিক এর পর থেকে। প্যাপিলনের মতই ব্যানকো-উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনায় জমজমাট, শ্বাসরুদ্ধকর আর এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত। যারা প্যাপিলন পড়েননি তাদেরও নিরাশ করবে না এই কাহিনী। এখানে প্যাট্রিক ও’ব্রায়ান-এর করা ব্যানকো’ইংরেজি অনুবাদের সংক্ষেপিত বাংলা রূপান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই অনুসরণ করা হয়েছে, যেমন- ফরাসী শব্দ ‘পাপিলঁ’-কে করা হয়েছে প্যাপিলন, আবার লেখক অঁরি শারিয়ারকে করা হয়েছে হেনরি শ্যারিয়ার। ]


http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/sketchbook 4-2-0920111003185713.jpgবিগ শার্লট কিভাবে ধরা পড়েছিল ঘটনাটা আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম-- লিটল লুই নামে এক লোক গোপনে পুলিশকে ওর কীর্তিকথা ফাঁস করে দেয়। এবং সাঁতে-তে আমাদের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, শার্লট কথায় কথায় বারবার শপথ করছিল যে সে প্রথম সুযোগেই লিটল লুইকে খালাস করে দেবে। অথচ আজ বিকেলে পুরনো স্মৃতিচারণের সময় সে তার নামও মুখে আনেনি। আর আমার নিজের ক্ষেত্রেও- হায় যীশু, কী আশ্চর্য! আমাকে ফাঁসানো পুলিশ, মিথ্যা স্বাক্ষী গোল্ডস্টেইন, এমনকি প্রসিকিউটিং কাউন্সিল, কারও সম্পর্কেই একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। আমার তো অবশ্যই এদেরকে ভুলে যাওয়ার কথা না। ! এসব পাপিষ্ঠ-পাষ-দের কথা তো সারাক্ষণ আমার ঠোঁটে ঠোঁটে থাকার কথা। আমি তো শুধুমাত্র একজন শ্রমিক থেকে কৃষকের পেশায় পদোন্নতির জন্য জেল থেকে বেরুইনি!

 আমি এ দেশে থাকার জন্য এখানকার আইন-কানুন মানার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করেছি এবং আমি আমার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই রক্ষা করবো। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে আমি আমার প্রতিশোধ পরিকল্পনা ত্যাগ করেছি। কারণ, তোমাকে অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না প্যাপি, যে কী কারণে আজ তুমি এখানে, এই দেশে! এটা শুধুমাত্র তের বছর গারদের ভেতরে থেকে প্রতিশোধের পরিকল্পনা ফাঁদার ফলই নয়, বরঞ্চ এটা তোমার একটা ধর্মও, আর ধর্মটা এমনি এক জিনিস যা তোমার কখনোই ত্যাগ করা উচিৎ নয়।
                 
শার্লটের ছোটখাটো ‘কালো-মেয়ে’ মানুষটি খুবই প্রিয়দর্শীনি, ঠিক আছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি এটা ভেবে যে তারপরও কি বিগ শার্লট বড় কোন শহরে গিয়ে সভ্যতার শেষ প্রান্তের এই আটপৌড়ে জীবন থেকে ভাল থাকতে পারে না! আসলে হয় তো আমিই অনভ্যস্ততার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকায় দেখতে পারছি না যে বন্ধুর এখনকার জীবনটায় সত্যিকার জীবনের আনন্দ মিশে আছে। অথবা হয় তো শার্লটই বড় শহরের জীবনাচারের ঝুট-ঝামেলা আর দায়িত্বের বোঝা যা ওই নাগরিক জীবন অজান্তেই চাপিয়ে দেয় মানুষের ঘাড়ে, তা বহন করতে ভীত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হলো- এটা যেন শার্লটের পক্ষে চিৎ হয়ে থুথু ফেলার মতই একটা বিষয়ে দাঁড়িয়েছে।     
           
শার্লটের বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ- মোটেই একজন বৃদ্ধ মানুষ নয় সে। বেশ লম্বা, খুবই শক্তিশালী, শক্তসমর্থ একজন কর্সিকান কৃষকের মতই গড়ন যার তরুণ বয়স কেটেছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর আর উপাদেয় খাবারের স্বাদ নিয়ে। এখানে এসে সে ভালমত রৌদ্র-ভাজা হয়েছে। আর মাথায় যখন সে তার খড়ের বাঁকানো কার্নিশওয়ালা হ্যাটটা পড়ে, তখন তাকে সত্যি দারুণ আকর্ষণীয় লাগে। মনে হয় সে যেন এই নিষ্কলুষ কুমারী ভূমির আদিবাসীদেরই এক উৎকৃষ্ট নমুনা। সে এমনভাবে এখানকার মাটি আর মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে যে তাকে কোনোমতেই এখন আর আলাদা করা যাবে না এদের থেকে। মোদ্দা কথা, সে এখানকার সত্যিকারের মানুষ হয়ে গেছে।
                 
সাত বছর সে এখানে আছে, এখনও সজীব তরুণ, মঁমার্তের সিন্দুক ভাঙ্গা সেই মার্কামারা ঘুঘু।    
              
মনে হচ্ছে বড়সর মায়াবী চোখের অধিকারিনী ওই স্বাস্থ্যবতী নিগ্রো মেয়েটি শার্লটের মত পুরনো সমুদ্র অভিযাত্রীর জন্য বেলাভূমির উপযুক্ত সঙ্গীনিই বটে। বড় ঘরটিতে আমি একটি সেলাই মেশিন দেখেছি। শার্লটের গায়ের ছোট ছোট চমৎকার ওই পোশাকগুলো নিশ্চয় কনচিটাই তৈরি করেছে।  
              
শহরে গিয়ে শার্লটের আবাস না গড়ার কারণ হয় তো সে নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি, অন্যদিকে এখানে তো সে একটা নিরাপদ জীবন কাটাতে পারছে। তুমি এক ওস্তাদ লোক শার্লট! একজন দাগী অপরাধী চরিত্র পাল্টিয়ে কী রূপ ধারণ করতে পারে তুমি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। অবশ্য সেই সঙ্গে আমি সেইসব লোকদেরকেও অভিনন্দন জানাচ্ছি যারা তোমার দুনিয়াটাকে শুধু পাল্টে দিতেই সাহায্য করেনি, তারা তোমাকে একটি মানুষের জীবন কী রকম হতে পারে বা হওয়া উচিৎ-- সে সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে দিয়েছে।
              
তারপরও এই ভেনেজুয়েলানরা আমার কাছে রীতিমত বিপদজনক, তাদের ঔদাত্তপূর্ণ অতিথিপরায়ণতার জন্য। মানবিক সদিচ্ছা আর দয়ার মাঝখানে ঘিরে থেকে সারাক্ষণ জীবন যাপন, খুব শিগগিরই কোন মানুষকে এ ব্যবস্থায় বন্দী করে ফেলে-- যদি সে নিজেকে ধরা পড়তে দেয় এই জালে। কিন্তু আমি তো মুক্ত, মুক্ত, মুক্ত।   আমি চাই এভাবেই মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে জীবন কাটাতে, চিরদিনের জন্য।
                
মনোযোগী হও, প্যাপি! সব কিছুর ওপর খেয়াল রাখবে, কোন মেয়েকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে। যখন তোমার নারীর ভালোবাসার প্রয়োজন ছিল তখন তোমাকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘ সময়ের জন্য। কিন্তু তারপরও, সৌভাগ্যক্রমে দু’বছর আগে জর্জটাউনে আমার একজন মেয়েমানুষ হয়েছিল, আমার প্রিয়া হিন্দুনি, ইন্দারা। তাই জেল থেকে বের হয়ে আসা অন্যান্য কয়েদীদের মত বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি ততটা সহজভেদ্য নই, যেমনটি ঘটেছিল শার্লটের ক্ষেত্রে; আমার ক্ষেত্রে তা আশা করা যায় না।
                
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/butterfly 22220111004160938.jpgইন্দারা সুন্দরী আর আকর্ষণীয়া ছিল সত্য, কিন্তু ওর জন্যই আমি জর্জটাউনে আরাম আয়েশের জীবন কাটাতে যাইনি! শান্তির জীবন যদিও অনেক সময় একঘেয়েমি ধরনের শান্ত-স্থির হয়ে পড়ে, তারপরও বলতে হয় এটাই আসলে সুখের জীবন, যা মানুষের চিরন্তন চাওয়া- কিন্তু কথা হলো এ জীবন তো আমার জন্য নয়: এটা অন্তত আমি খুব ভাল করে জেনে গেছি।
                
অ্যাডভেঞ্চার! অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যেই আমি জীবনের স্বাদ খুঁজে পাই, পূর্ণাঙ্গভাবে বেঁচে থাকি! এই কারণেই আমি জর্জটাউন ত্যাগ করি এবং অবতরণ করি এল ডোরাডোয়। আমি যে আজ এখানে, ঠিক এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি এটাও সেই কারণেই, সেই অভিযানেরই যাত্রাপথ মাত্র, অন্য কিছু নয়।
               
ঠিক আছে! এখানকার মেয়েরা সুন্দরী, উষ্ণ রক্তের তপ্ত হৃদয়া এবং চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টিকারিনী। আমিও নারীপ্রেমবিহীন থাকতে পারবো না। এখন এই জটিলতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমারই। নিজেকে এখানে অন্তত এক বছর থাকতে বাধ্য করতে হবে, যেহেতু আমি তা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে যত কম শিকড় ছড়ানো যাবে তত সহজেই আমি এই দেশ এবং এর চমৎকার হৃদয়ের মানুষগুলোর বন্ধন ছিন্ন করে যেতে পারবো। আদপে তো আমি একজন অভিযাত্রী। তবে এমন একজন অভিযাত্রী যে তার যাত্রাপথে প্রয়োজনে বিভিন্ন দিকে গতিপথ পরিবর্তন করে--আমাকে অবশ্যই সৎপথে টাকা রোজগার করতে হবে, অন্ততপক্ষে এমন পন্থায় যাতে কারো ক্ষতি না হয়। প্যারিস, হ্যাঁ, এটাই আমার লক্ষ্যবিন্দু: একদিন প্যারিস, যে মানুষগুলো জীবন যন্ত্রণার অভেদ্য নরককুণ্ডে আমাকে নিক্ষেপ করেছিল, তাদের ঋণ সুদাসলে পরিশোধের জন্য আমাকে আসতেই হবে তোমার কাছে!
          
এখন আমি অনেকটা শান্ত। আমার চোখ দুটো চাঁদের গায়ে নিবদ্ধ। চাঁদটা নিষ্কলুষ বিশাল বনবীথির মাঝে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। বনটাকে মনে হচ্ছে কালো কালো মাথার বিশাল এক সমুদ্র, বিভিন্ন উচ্চতার গাছের সারি এই সমুদ্রে উঁচু-নিচু নানান মাপের ঢেউয়ের সৃষ্টি করেছে-- এই ঢেউগুলো কোথাও মিলিয়ে যায়নি দৃষ্টি পথে। একসময় ঘরে ফিরে এসে বিছানায় এলিয়ে দিলাম শরীরটাকে।
            
প্যারিস, প্যারিস, যদিও তুমি এখনো আমার থেকে অনেক দূরের পথ। কিন্তু ততটা দূরে নয় যে সেখানে আমি আর কোনোদিনই পৌঁছাতে পারবো না, একদিন অবশ্যই পৌঁছাবো তোমার আঙ্গিনায়, তোমার পিচঢালা পাষাণ পথে আমার পদধূলি দিতে।  

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/desert1_opt3120111003184947.jpg

(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ) 

খনিতে

এক সপ্তাহ পর, মকুপিয়া খনিতে চাকরি জুটে গেল, এজন্য ওই কর্সিকান মুদি দোকানদার প্রোসপেরির চিঠিটিকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। খনিতে শ্যাফ্ট-এর পানি টেনে উপরে তোলার জন্য যে পাম্প ব্যবহৃত হয়, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেলাম।

খনিটা দেখতে কয়লা খনির মতই। একই রকম ভূ-গর্ভস্থ গ্যালারি। জম-জমাট কোনো স্বর্ণ নেই খনিতে। স্বর্ণ পাওয়া যায় একেতো অপরিশোধিত অবস্থায়, তার ওপর অনুপাতে এর পরিমাণও খুবই অল্প। বেশ শক্ত এক ধরনের শিলার ভিতরে স্বর্ণ পাওয়া যায়। প্রথমে ডিনামাইটের মাধ্যমে এই কঠিন শিলা ভাঙ্গা হয়, তারপর বড় বড় খণ্ডগুলো স্লেজ হ্যামার দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। এই টুকরোগুলোকে ট্রাকে তোলা হয়, ট্রাক লিফটে করে মাটির ওপরে চলে আসে। এরপর ক্র্যাশারে ফেলে টুকরোগুলোকে বালির চেয়ে মিহি গুড়োয় পরিনত করা হয়। পানিতে মিশ্রিত তরল কাঁদার মত এই বস্তুকে পাম্পের সাহায্যে অয়েল রিফাইনারির রিজার্ভয়ারের সাইজের বিশাল ট্যাঙ্কে তোলা হয়-- ট্যাঙ্কগুলোর  মধ্যে সায়ানাইড থাকে। সায়ানাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এই তরল কাঁদা প্রক্রিয়াজাত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী তরল পদার্থ হিসেবে স্বর্ণগুলো ট্যাঙ্কের তলার দিকে চলে যায়, বাদবাকি বর্জ্যগুলো উপজাত হিসেবে উঠে আসে উপরের দিকে। ওদিকে প্রচণ্ড তাপে সায়ানাইড স্বর্ণের উপাদানসহ বাষ্পীভূত হতে থাকে; এগুলো পরিশোধিত হয়ে চিরুনির মত ফিল্টারের ভেতর দিয়ে স্বর্ণ ছাঁকা হতে থাকে। এরপরই সংগ্রহ করা যায় বিশুদ্ধ স্বর্ণ--খণ্ড খণ্ড বারে রূপ দেওয়া হয় এগুলোকে ইচ্ছেমত ওজন আর সাইজে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ২৪ ক্যারেটের পূর্ণমান যাচাই করা হয়।

কিন্তু এই বারগুলো রাখা হয় যেখানটায় সেই মহামূল্যবান গুদামের গার্ডটা কে? সত্যি কথা কি, আমি এখনো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারিনি। সাইমন এই গার্ডের দায়িত্ব পালন করছে! কোন সাইমন? একসঙ্গে বিগ শার্লটের সঙ্গে ভেগেছে যে-- সেই অকৃত্রিম সাইমন!
 
ডিউটি শেষ করে আমি পুরো এলাকাটা ঘুরেফিরে দেখতে গেলাম। একসময় স্টোরে ঢুকে গেলাম এবং প্রাক্তন দাগী কয়েদী সাইমন কর্তৃক সুশৃংখল লাইনে সাজানো স্বর্ণ বারের বিশাল স্তুপের ওপর দৃষ্টি বোলাতে লাগলাম। ঘরটাও খুব একটা মজবুত না। শুধুমাত্র কনক্রিটের তৈরি একটা স্টোর হাউস যার দেওয়ালগুলো সাধারণ বাড়ি-ঘরের চেয়ে পুরু না, আর মেঝে হচ্ছে কাঠের।

‘সব ঠিক তো সাইমন ?
: ঠিক আছি। আর তোমার খবর কি প্যাপি? শার্লটদের সঙ্গে ভাল কাটছে তো?
‘হ্যাঁ, আমি ভাল আছি। ’
: তুমি এল ডোরাডোতে ছিলে আমি জানতামই না। জানলে আমিই তোমাকে বের করে নিয়ে আসতাম।
‘সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তুমি কি সুখে আছো এখানে?
: হ্যাঁ ভাল, তুমি তো জান, আমার একটা বাড়ি আছে। শার্লটের মত বড় না, তবে ইট-সিমেন্টের তৈরি। আমি নিজেই এটা তৈরি করেছি। এবং আমার একজন তরুণী স্ত্রী আছে, খুবই মিষ্টি। যখনি তোমার মন চায় চলে এসো, আমাদের দেখে যাবে-- মনে রেখ আমার বাড়ি তোমার নিজেরই। ভাল কথা, শার্লটের কাছে জানলাম তোমার বন্ধু নাকি অসুস্থ। আমার স্ত্রী ইদানীং ইনজেকশন দেওয়া শিখেছে, যদি তার সাহায্যের দরকার পড়ে তোমাদের, আসতে ইতস্তত করবে না কিন্তু।
            
আমরা আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম। বোঝা গেল সেও শার্লটের মত পুরোমাত্রায়ই সুখী জীবন যাপন করছে। সাইমনও ফ্রান্স বা মঁমার্তে সম্পর্কে কোনো কথা বললো না, যদিও সেই দেশের, সেই স্থানের সে অধিবাসী ছিল। ঠিক যেন আরেক শার্লট। অতীতের কোন আলামত নেই আর এখন ওদের মাঝে। একটা বিষয় বেশ গুরুত্ববহ ওদের জীবনাচারে, তা হলো বর্তমান-- স্ত্রী, সন্তান আর গৃহ। সাইমন দিনে বিশ বলিভার আয় করে। বাড়িতে পোষা মুরগি যে ডিম দেয় তাতে ওদের ভাল সাশ্রয় হয়, অন্যথায় সাইমন আর ওর বউয়ের পক্ষে বিশ বলিভারে দিন গুজরান করা কঠিন হতো।  

আমি মাটিতে পড়ে থাকা স্বর্ণগুলোর ওপর দৃষ্টি বুলালাম। মাত্র এক ফুট চওড়া চারটি দেওয়াল আর একটা কাঠের দরোজার আড়ালে কী অযত্নেই না এগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। এমন একটা দরজা যা স্টিলের ডান্ডা দিয়ে জোরে গোটা দুই-চার দিলেই বিনা প্রতিবাদে খুলে যাবে। স্বর্ণের এই বিশাল সঞ্চয়, গ্রাম প্রতি সাড়ে তিন বলিভার বা আউন্স, প্রতি পঁয়ত্রিশ ডলার হিসেবে এর  দাম পড়ে সাড়ে তিন মিলিয়ন বলিভার বা এক মিলিয়ন ডলার। আর এই অভাবিত সম্পদের পাহাড় একেবারে হাতের কাছে পড়ে আছে অনাদরে। এগুলো হাতিয়ে নেওয়া যে কারো পক্ষেই ছেলেখেলার নামান্তর মাত্র।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/gold120111004161719.jpg‘অদ্ভূত না! আমার স্বর্ণসম্ভারের প্রাচুর্য? আহ্, প্যাপিলন?’
‘এটা আরো অদ্ভূত হবে যদি এখান থেকে এগুলোকে সরিয়ে নেয়া যায়। যীশু, কি বিশাল সম্পদ!’
‘হতে পারে; কিন্তু কথা হলো এগুলো আমাদের নয়। এটা হচ্ছে পবিত্র আমানত, যেহেতু তারা আমার ওপর বিশ্বাস করেছে এগুলো দিয়ে। ’
‘তোমাকে বিশ্বাস করেছে, হক কথা, কিন্তু আমাকে তো না। এরকম জিনিস চোখের সামনে পড়ে থাকায় তুমিও নিশ্চয়ই লালচ অনুভব করো?’
‘এটা এমনি এমনি বেওয়ারিশ পড়ে থাকছে না, কারণ আমি এগুলোকে পাহারা দিচ্ছি। ’
‘হতে পারে। কিন্তু তুমি তো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই এখানে ডিউটি দেও না। ’
‘না। শুধুমাত্র সন্ধ্যা ছ’টা থেকে পরদিন সকাল ছ’টা পর্যন্ত। কিন্তু দিনের বেলায় আরেকজন গার্ড থাকে। তুমি বোধ’য় চেন ওকে। আলেক্সান্দ্রে, পোস্টাল অর্ডার জালকারী। ’
‘ওহ্, হ্যাঁ! চিনি তাকে। ঠিক আছে সাইমন, আবার দেখা হবে। তোমার পরিবারকে আমার শুভেচ্ছা জানিও। ’
‘তুমি বেড়াতে এস। ’
‘অবশ্যই আমি যাব। সিয়াও। ’

আমি দ্রুত চলে আসলাম ওখান থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই প্রলোভনের ছায়া থেকে নিজকে সরিয়ে আনলাম। এটা অবিশ্বাস্য! যে কেউ বলবে যে এই খনির কর্তাব্যক্তিরা লুণ্ঠিত হওয়ার জন্যে যেন ব্যাকুল হয়ে আছে। এমন একটা গুদাম যে কোনো লুন্ঠন থেকে নিজকে রক্ষা করতে পারবে না। আর ওদিকে এক কালের দুর্ধর্ষতম দু’জন দাগী অপরাধী এগুলোর পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। আমি আমার এই পতিত জীবনে এ ধরনের দৃশ্য আর দেখিনি।

গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে চললাম ধীরে ধীরে। শার্লটের শ্যাঁতো যে জায়গায় অবস্থিত সেখানে পৌঁছতে হলে আমাকে এ পথেই যেতে হবে। আমি সময় নষ্ট করছিলাম; বিগত আট ঘণ্টার চাকরির সময়টা কঠিনই ছিল। ভূ-গর্ভস্থ দ্বিতীয় গ্যালরিতে বাতাসের পরিমাণ খুবই কম। তার ওপরে জায়গাটা ভেন্টিলেটর থাকা অবস্থায়ও ছিল গরম আর ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে।
 
আমার পাম্প তিন-চার বার নষ্ট হয়েছে এবং বারবারই আমাকে তা ঠিক করতে হয়েছে। দুপুরে খনিতে নেমেছি আর এখন রাত সাড়ে আটটা। আঠারো বলিভার উপার্জন হয়েছে। যদি আমি মজুর শ্রেনীর ধারণায় ভাবি, তাহলে এই রোজগার খুব একটা খারাপ না। মাংসের দাম কিলো প্রতি আড়াই বলিভার, চিনি ০.৭০ বলিভার, কফি ২ বলিভার। সব্জির দামও বেশি নয় : ০.৫০ বলিভার, চালের কিলো আর শুকনো সীমের বীচিও একই দর। সস্তায় জীবন যাপন করা যায়, সত্য। কিন্তু এইভাবে দিন গুজরান করার মানসিকতা কি আমার মধ্যে আছে?

পাথুরে ঢালুপথ বেয়ে আমি উপরের দিকে উঠছি ধীরে ধীরে। পায়ে রয়েছে খনি থেকে দেওয়া লোহার ছোট ছোট খুরা লাগানো ভারী বুট, কষ্ট হলেও আমি সহজেই পথ বেয়ে উঠছি। যদিও আমি সর্বান্তকরণে ভাবতে চাচ্ছি না, তারপরও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ পড়ে আছে বেশ অযত্নে। শুধুমাত্র কোন উদ্যোগী হাত এগুলোকে তুলে নেওয়ার অপেক্ষায়। রাত্রের অন্ধকারে সাইমনের ওপর হামলা করে ওকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা কঠিন কোন কাজই না, অর্থাৎ নিজের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এরপরে সম্পূর্ণ ‘রাজকোষ’ হাতের মুঠোয়, কারণ কর্তৃপক্ষ নিজেদের ঔদাসীন্যের চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েছে সাইমনের কাছে গুদামের চাবি রেখে দিয়ে। উদ্দেশ্য, বৃষ্টি নামলে যাতে ও ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। নিশ্চিত অপরাধমূলক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া আর কি বলা যায় একে!

সাইমনকে অজ্ঞান করার পর কাজ বাকি থাকে শুধু দুইশত স্বর্ণের ইটকে খনির বাইরে নিয়ে এসে ট্রাক অথবা টানা গাড়িতে বোঝাই করা। এরপর জঙ্গলের পথে অনেকগুলো গোপন জায়গা নির্ধারণ করতে হবে যেখানে একশ’ কিলোর একেকটি প্যাকেটে স্বর্ণগুলো পরপর লুকিয়ে রাখা যাবে। যদি এই কাজে ট্রাক ব্যবহার করি তাহলে এটা খালি হওয়ার পরপরই নদী যেখানে সবচেয়ে গভীর সেই পাড়ে নিয়ে যাবে-- এরপর ঝপাৎ! যদি টানা গাড়ি হয়! গ্রামের আঙিনায় প্রচুর পাওয়া যাবে। ঘোড়া? এটা একটু কঠিনই হবে যোগাড় করা, তবে অসম্ভব নয়। আটটা থেকে পরদিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি-- ব্যস, এরকম একটা রাত আমার দরকার পুরো কাজটা সেরে নিতে। এরই মধ্যে আমি ‘মুখটুখ মুছে’ নির্বিঘেœ নিজের ঘরে পৌঁছে বিছানায় ঢুকে সন্ন্যাসীর নিদ্রা দিতে পারি। গ্রামের আলোকিত আঙিনায় প্রবেশ করার সাথে সাথেই আমি সম্পদের ওই পাহাড় হাতিয়ে নিয়েছি আর বিগ শার্লটের শ্যাঁতোর আরামদায়ক বিছানায় চাদরের নিচে নিষ্পাপ ঘুম দিচ্ছি। এর সবটাই অবশ্য মনে মনে সারলাম।

‘বুয়েন্স নচেস, ফ্রান্সেস’ গ্রামের বার থেকে এক দঙ্গল লোক আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
হ্যাঁ, কি খবর? খুব জমিয়েছো! শুভরাত্রি, হোমব্রেস।
‘এসো আমাদের সঙ্গে একটু বসে যাও। বরফ দেওয়া একপাত্র বিয়ার টানো: আমরা খুশী হবো। ’
এদেরকে প্রত্যাখ্যান করা খুবই অভদ্রতা হবে। তাই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। এখন আমি এই সজ্জন আত্মাগুলোর মাঝে বসে আছি। এদের অধিকাংশই খনি শ্রমিক। তারা জানতে চাইলো ভাল আছি কী না, কোন বান্ধবী খুঁজে পেয়েছি কী না, কনচিটা পিকোলিনোকে ঠিকমত দেখাশোনা করছে কী না, আর ওষুধপত্র কেনার জন্য বা অন্য কোনো কারণে টাকার প্রয়োজন আছে কী না। এই সদাশয় উষ্ণ উপকারের প্রস্তাবগুলো আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনেলো।
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/saimahq_1316169391_2-320111004161322.jpgএকজন স্বর্ণখনি সন্ধানী আমাকে প্রস্তাব করলো- যদি আমি খনির ধরা-বাঁধা কাজ না করে স্বেচ্ছাধীন কাজ করতে চাই, তাহলে তার সঙ্গে যোগ দিতে পারি। ‘এটা কঠিন যাত্রা ঠিক, তবে এর ফলে তুমি একজন শ্রমিকের চেয়ে বেশি টাকা কামাতে পারবে। আর এই সম্ভাবনা তো সব সময়ে থাকছে যে, যে কোন সময়ে তুমি রাতারাতি ধনী হয়ে যেতে পারো। ’ আমি তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানালাম এবং আমার পক্ষ থেকে একদান হয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানালাম।

‘না ফ্রেঞ্চম্যান, তুমি আমাদের অতিথি। অন্য একদিন হবে, যখন তুমি ধনী হয়ে যাবে। খোদা তোমার সহায় হোন!

আমি শার্লটের শ্যাঁতোর দিকে ফিরে চললাম। ঠিক, এই সাধারণ মানুষগুলো যারা অতি অল্পতেই বেঁচে আছে-- তাদের মাঝে মিলেমিশে একজন সৎ আদর্শ মানুষে পরিণত হওয়াই সহজ। এরা প্রায় কোন কিছু ছাড়াই সুখী। এরা একজন মানুষকে সে কোত্থেকে এসেছে বা তার অতীত বৃত্তান্তের ব্যাপারে কোন রকম উদ্বিগ্নতা ছাড়াই তাকে নিজেদের একজন করে নিতে পারে।
বাড়িতে কনচিটা একা ছিল। শার্লট খনিতে-- আমি যখন কাজে যাই, সে তখন ফিরে আসে। কনচিটার আচরণে হাসিখুশী আর দয়াবতী একটা ভাব ফুটে উঠছিল।  
তোমার বন্ধু ঘুমুচ্ছে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াও করেছে। আর আমি টুমেরেনো হাসপাতালে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি ওকে ওখানে ভর্তি করানোর ব্যাপারে। টুমেরেনো কাছেই একটি শহরের মত। ছোট্ট, এই গ্রামটির চেয়ে শুধু একটু বড়।

আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার জন্য রেখে দেওয়া খাবার খেলাম। এই যে সমাদর তা এতই ঘরোয়া আর সাধারন সুখের ছোঁওয়ায় ভেজানো যে আমি খুব স্বস্তি বোধ করলাম; সোনার গুদাম দেখার পর থেকে মন যে লালচির রিপুতে আক্রান্ত হয়েছিল-- এই আন্তরিক আতিথেয়তার পরশ তার থেকে আমাকে মুক্তি দিল। আসলে আমার এখনকার মানসিক অবস্থার জন্য এটা খুবই  দরকার ছিল।

‘ওঠ, প্যাপি! দশটা বাজে। কেউ একজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ’
‘সুপ্রভাত, মঁশিয়ে, বয়স পঞ্চাশেকের এক প্রৌঢ় লোক; মাথায় হ্যাট নেই, সরলতায় ছাওয়া চোখ, জঙ্গুলে ধাঁচের ভ্রু-- আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘আমি ডা.বাউগ্রাট। * আমি এসেছি কারণ এরা আমাকে জানিয়েছে যে তোমাদের একজন অসুস্থ। আমি তোমার বন্ধুকে পরীক্ষা করেছি। ক্যারাকাসের হাসপাতালে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কিছুই করা যাবে না। আর তাকে সারিয়ে তোলা খুব কঠিন ব্যাপার হবে। ’  

তোমার জন্য একপাত্র ঢালবো ডাক্তার? শার্লট জিজ্ঞেস করলো।
: অসুবিধে নেই। ধন্যবাদ।
প্যাস্ট্রিজ ঢালা হলো। খেতে খেতে বাউগ্রাট আমাকে বললো, তারপর, প্যাপিলন, কেমন চলছে তোমার?
‘কেমন? ডাক্তার, ঠিক যেন আমি আমার জীবনের প্রথম পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমার মনে হয় আমি যেন মাত্র জন্ম নিলাম। অথবা কোন পথ হারানো বালকের মত আমার অবস্থা। ঠিক যে রাস্তাটায় আমার চলা উচিৎ সে রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছি না। ’
: রাস্তাতো অনেক পরিষ্কার। আশপাশে তাকাও, তাহলেই দেখতে পাবে। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের পুরনো সঙ্গী-সাথীরা ঠিক রাস্তায়ই গেছে। আমি ১৯২৮ সন থেকে ভেনেজুয়েলায় আছি। যতদিন এই দেশে আছি কখনো শুনিনি কারাভোগী প্রাক্তন অপরাধীরা নতুন কোন অপরাধ করেছে। তাদের প্রায় সবাই বিবাহিত, বাচ্চা-কাচ্চা আছে। আর তারা জীবন-যাপন করছে সৎভাবে। সমাজ তাদেরকে সাদরে গ্রহণও করেছে। অতীতকে তারা এমনই ভুলেছে যে তাদের কেউ কেউ এখন বিস্তারিতভাবে বলতেই পারে না যে কি অপরাধে তাদেরকে সাজা খাটতে হয়েছিল। ওগুলো সব ভুয়া, পুরনো অতীত, কুয়াশাচ্ছন্ন অতীতের কবরে সমাহিত লাশ যা কোন প্রয়োজনেই আসে না এখন।

‘হতে পারে আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম, ডাক্তার। আমার ঘাড়ে খুব বড়সর একটা দেনার বোঝা আছে যা ওই লোকগুলোকে বুঝিয়ে দিতে হবে যারা সকল ন্যায়বিচারের নিকুচি করে আমাকে দাগী আসামী হিসেবে কয়েদ খাটতে বাধ্য করেছে। এ ঋণ শোধ করতে আমাকে ফদ্ধান্সে ফিরে যেতেই হবে। আর সেজন্যে আমার প্রচুর টাকার দরকার। এটা এমন এক অভিযান, যাতে আমি কিছু টাকা জমিয়ে শুধুমাত্র অভিযানে রওনা করে আর ফিরে আসতে যাচ্ছি না। অবশ্য যদি কোন প্রত্যাবর্তন থেকে থাকে আমার এই মিশনে। এই অভিযান সে ধরনের সনাতন অভিযান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর আর এতে প্রচুর ব্যয় হবে। এবং তারপরই খোদার অভিশপ্ত এই নরককু- থেকে আমাকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন আসতে পারে... আমি ক্যারাকাসে যাওয়া মনস্থ করেছি। ’

: তুমি কি ভাবছো যে প্রতিশোধস্পৃহা শুধু তোমার একার মধ্যেই রয়ে গেছে? আমার জানা একটি ছেলের গল্প আগে শুনে নাও। ওর নাম জর্জেস ডুবোইস। লা ভিলেত্তির বস্তি এলাকার এঁদো গলির এক ছেলে, মদ্যপ বাবা, সার্বক্ষণিক মাতলামিতে উন্মাদ, ওদিকে মাকে ছ’টি শিশু সন্তান সামলাতে হয়: তাদের অবস্থা এতটাই হতদরিদ্র ছিল যে মহিলাকে উত্তর আফ্রিকান পানশালাগুলোতে খদ্দের খুঁজতে যেতে হত। জর্জেস ডুবোইসকে জোজো নামে ডাকা হতো।

দারিদ্রের নির্মম কষাঘাত জোজোকেও প্রভাবিত করে মারাত্মকভাবে। আর তাই মাত্র আট বছরের শিশু অবস্থা থেকেই সে কিশোর অপরাধী শোধনাগারগুলোর একটা থেকে আরেকটায় স্থানান্তর হওয়া শুরু করে। তার অপরাধ জীবনের শুরুটা হয়ছিল দোকানের বাইরে সাজানো ফল চুরি করা দিয়ে। তার প্রথম শোধনাগার ছিল এ্যাবি রোলেত’স হোমস। কিশোর বয়সে সে সত্যিকার দোজখে পড়লো। কারণ এবারই প্রথম বাস্তবিক কঠিন-কঠোর নিয়ম-কানুন আর নির্যাতনের আবহে নরক গুলজার হওয়া একটি শোধনাগারে দাখিল হলো জোজো। একথা তোমাকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন মনে করছি না যে রিফরমেটরিতে (শোধনাগারে) চৌদ্দ বছরের জোজোকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকা আঠারো বছরের মদ্দা দাগীগুলোর ছোবল থেকে নিজের পশ্চাদ্দেশ বাঁচিয়ে রাখার জন্য কী পরিমাণ তটস্থ থাকতে হতো। যেহেতু সে কিছুটা দুর্বল ধরনের বাচ্চা ছিল তাই এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে আত্মরক্ষায় তার একটাই অবলম্বন ছিল-- একটি ছোরা। এমনি ভয়ানক পরিবেশের মোকাবেলা করতে গিয়ে একদিন ওই ভয়ংকর আর বিকৃত তরুণ অপরাধীদের একজনের পেটে ছোরাটা ঢুকিয়ে দিল জোজো।
পরিণতিতে কর্তৃপক্ষ তাকে পাঠিয়ে দিল অ্যাসে’তে, যা ছিল দেশের সবচে’ কঠিন অপরাধী শোধনাগার। যেসব অপরাধীদের শোধরানোর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ আশা একেবারে ছেড়ে দেয়- একুশ বছর বয়স পর্যন্ত তাদেরকে এখানেই রাখা হয়। পরে এখান থেকে তাকে আফ্রিকান ডিসিপ্লিনারি আর্মিতে নিয়োগ দিয়ে পাঠানো হয়--কারণ তার যে অতীত তাতে সাধারণ আর্মিতে চাকরি অসম্ভব। অ্যাসে’র কর্তৃপক্ষ জেল জীবনে উপার্জিত কিছু ফ্রাঁ তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাড়তি আর যা দেয় তা হলো বিদায় সম্ভাষণ, অ্যাডিইউ!  
           
বি.দ্র - ** বাউগ্রাত বিশ শতকের মার্সেইলেসের সারা জাগানো অপরাধের নায়ক। তার ডাক্তারি চেম্বারের কাপবোর্ডের ভেতর থেকে এক লোকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বাউগ্রাত জবানবন্দিতে বলেছিল, একটি ইনজেকশনের মাত্রায় গড়বরের কারণে এই পেশাগত ভুলটি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোর্টের রায় ছিল এটা হত্যাকা-। আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়। কিন্তু শিগগিরই সে সায়েনের জেল থেকে পলায়ন করে ভেনেজুয়েলায় এসে নতুন জীবন শুরু করে।

[চলবে]

ব্যানকো [পর্ব-১], ব্যানকো [পর্ব-২]


বাংলাদেশ সময় ১৮২০, অক্টোবর ০৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad