মৃতরা
সব কিছুই কাছাকাছি, মাটি আর মানুষের মতো―শুধু আলাদা হয়ে গেছে তাদের ভাষা
চাঁদ খুব নিচু দিয়ে হাঁটছিল রাংতা পায়ে
হাওয়া একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
মাটির নৈকট্যে চলে আসি আমরা
বুঝতে চেষ্টা করি স্থিরতার কথাবার্তা
তারা কথা বলছে বিলম্বিত লয়ে
আরও যেন বলতে চাইছে, ‘বরফের শকটে চড়ে আমাদের বর্ণমালাহীন দেশে চলে আসো। ’
রহস্য
প্রতিটি মানুষের কিছু নিস্তব্ধ রহস্য থাকে
নিদ্রঘোরে রহস্যরা তাকে ঘিরে অধিবৃত্ত রচনা করে।
দ্যাখো, জানাশোনার বাইরে তোমাদের বাগানের মুক্তাঝুরি
আর জীবন থেকে ঝরে পড়া দু-চারটি রহস্যপাতার গান
করোটি জুড়ে স্তব্ধ ক্ষতচিহ্নের ওপর রেখে যায় আগুনের সংকেত
আর বিচলিত নিদাঘের প্রাণ।
বন্দরের দিকে আদলহীন তুমি অকস্মাৎ বায়ু আক্রমণে
হয়েছিলে জীবনতাড়িত, তোমার বিকেল আর অন্তর্বৃত সকালেরা
খেয়ালের মতো দীর্ঘ হতে থাকে
ভরে ওঠে ডাকাবুকো রেশমবেলায়, এইবেলা
সংগীতহীনের গান, শব্দনিয়ন্ত্রিত এই জলীয় সন্ত্রাস
এইসব জেনেশুনে
ভুল দিকে চলে গেছে সাদা নাবিকের দল
মেসমারিজম, আমরাও পতঙ্গের অনুকূলে সংঘবদ্ধ
জাহাজের গতি দেখে দেখে, বুঝি রহস্য-অতল
প্রতিটি মানুষের এক চান্দ্ররহস্য থাকে
মৃত্যু হলে রহস্যরা
বিবাগি জাহাজের মতো পোতাশ্রয় ছেড়ে চলে যায়
তোমাকে যাত্রির মতো একা রেখে
অবেলায়...
হংসধ্বনি
সব গান শেষ হলে সুর ভাসে হংসধ্বনি রাগে
একা বসে প্রতিধ্বনি জমা করি আর ভাবি―
মেঘগুলি কতকাল ধরে চলে গেছে পৃথিবীর গন্তব্যের দিকে।
পত্রপুষ্পে দিন হয় ফড়িঙের, দোয়েলের,
মানুষের সম্পর্কের কাছে পড়ে থাকে অস্পষ্টতা
কেউ মনে মনে হয় একা, রহস্যউতলা
অতল মনের আহ্বানে, সে তো জানে পাতাদের লেখা
অবিরত ছায়া দিয়ে রাখে যদিবা সময় এসে
অসময়ে ব্যথা দিয়ে যায়, তাই ভাবি পুনর্বার:
তোমার ভেতর আমি বড়ো দীর্ঘ―একা
আমার ভেতর তুমি বড়ো দীর্ঘ―একা
ছায়া জমে পাতাদের ফাঁকে
উতল হয়েছে ঝাউবন, কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি নেই
পথের গভীরে পথ থেমে যায়, বৃষ্টিদেহমাখা।
নিশীথে
এখন মধ্যরাতে আমি খোঁজ করি পিঁপড়েদের কবর;
গত হয় শনিবার―আমাদের বিশ্রাম দিন, অন্তরিক্ষে ডুবে থাকার দিন।
কাল রবিবার নক্ষত্ররা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের
মনোলোকের স্বপ্নসংগতিতে, সেখানে দেখব পাকা পাকা স্কিটসোফ্রেনিয়ার ফল।
সোমবার মনোযোগ সহকারে আত্মাদের জামাকাপড়গুলো পরিষ্কার করব
বাগানে ঘুরে বেড়াবে আত্মারা, ঈশ্বরের সবুজ শামুকেরা।
মঙ্গলের বারবেলায় এক প্রস্থ ঘুমিয়ে নেব যেন রাতে মুক্তমনে আকাশভ্রমণে যেতে পারি
দেখা করতে পারি দেবতাদের ছেলেমেয়েদের সাথে।
বুধবার লিখব উপরিতলের গদ্য আর অন্তস্তলের কবিতা
যে কবিতা একইসাথে গান গায় ও গন্ধ ছড়ায়।
বিষ্যুদবারে গান শুধু গান―পিয়া কে নজরিয়া, জাদু ভর...
শুক্রবার অপেক্ষা করছে এক অস্থিঘর, ভেঙে ফেলার অসম্ভব-সব দৃশ্যপট
তারপর সব দিনক্ষণ শেষ হলে
অপেক্ষা করব সেই সময়ের যখন অদৃশ্য পাতাপত্রে ঢেকে যাবে আমাদের জীবন
হারানো ফোনোগ্রফের গান
আজ অঘ্রানের দুধসাদারাতে, দেখো, প্রান্তরে বিব্রতকারী জোছনারা সপাটে নেমে আসে। পাখিরাও আসে চাঁদের আঙরাখা পড়ে। কোন দূর থেকে এসব পাখিরা আসে! এসব পাখিরা আসে চাঁদরং ঝরাতে ঝরাতে! তাদের মনের রং হারানো গানের মতো। চিত্রদীপ এসব পাখিরা আজ খুঁটে খুঁটে জোছনার মেওয়াফল খায়, ডুবে থাকে সারগর্ভ জোছনার বিহ্বলে। কোথা থেকে তারা আসে আর ভূমিগর্ভে চিত্রপট ছড়ায়!
আমারও জোছনা ছিল দীর্ঘকাল―বায়োস্কোপে, সাইফার সংকেতে। কালসিন্ধু জেনেছিল এ রহস্য,তাই বুঝি চাঁদরাতে মন ভারী হয়, বের হই উদভ্রান্ত এ জোছনার খোঁজে। দেহ খোঁজে জোছনার সমাধি। জোছনায় ভরে ওঠে মন,
বুঝতে চেয়েছি তার ভাষা, ধ্বনিস্তর, অন্বয়ী প্রস্বর। আজ এই অসম্ভব মাঠের কান্তিতে আমার তো জানা হলো রাতের তানমন আর খেরো এই জীবনখাতার কথা ।
কিন্তু কে কাকে শেখায় ভাষা আজ। মূলত ভাষাহীন, স্বভাবদোষে শব্দচিত্র আঁকি। কে বলে সে ভাষা? শরবিদ্ধ হলে থমথমে ব্যথা জীবনের নৈদাঘে শব্দহীন কুরুক্ষেত্র হয়, ছড়ায় হাহাকার
আর গোপন মাছিরা করে ভূগোলবিস্তার।
০২
মনে করো তোমার জীবন ডুবোজাহাজের লগবই। বৃত্তান্ত আছে কিন্তু ধারণা নেই, ভ্রমণ আছে কিন্তু মাইলেজ নেই।
আমিও একদিন ডুবোজাহাজের সংকেত হব, একটু উঁচু করে রাখব মহাকালের পেরিস্কোপ। সন্ধিপত্রহীন এই জীবন, শুধু ভ্রমণে ভরে আছে নেপথ্যের আর-সব ডাকপাখির যাওয়া-আসা।
মৃত্যু এক পার মাতাল। জীবনের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে জমে যে-কুঁজো পূর্ণ হয়, একটানে সে তা পান করে। জীবনের ফোটা ফোটা বোধ জমে যে-নিস্তব্ধতা জলপথ রচনা করে, মৃত্যু তার বেড়ি হয়। আহা জীবন, তোমার জন্যে আমার মনস্তাপগুলো বেড়ে যায়, তোমার জন্যে ভাবনিমগ্ন মেঘেরা আজ রজনির প্রান্তদেশে থমকে দাঁড়ায়।
কুমার চক্রবর্তী
কবি, অনুবাদক ও গদ্যকার
বাংলাদেশ সময় ১৪৩০, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১১