ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আন্দ্রেই তারকোভস্কির ডায়েরি-- ১৯৭৩ (প্রথম পর্ব)

অনুবাদ : রুদ্র আরিফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১
আন্দ্রেই তারকোভস্কির ডায়েরি-- ১৯৭৩ (প্রথম পর্ব)

কিংবদন্তি সোভিয়েত-রাশিয়ান ফিল্মমেকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি [৪ এপ্রিল ১৯৩২-২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৬]। কবিপুত্র ও অভিনেত্রী মায়ের এই সন্তানকে বিবেচনা করা হয় ফিল্ম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কবি হিসেবে।

অকালপ্রয়াত এই ধ্যানীর নির্মিত ফিল্ম ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’, ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’, ‘সোলারিজ’, ‘মিরর’, ‘স্টকার’, ‘নস্টালজিয়া’, ‘স্যাক্রিফাইজ’ ইত্যাদি সারা পৃথিবীর ফিল্মমেকার, ফিল্মপ্রেমী ও সমালোচকদের কাছে একেকটি অনবদ্য টেক্সট হিসেবে গণ্য হয়।

তারকোভস্কি তার জীবনের নানা বাঁক, আবেগ, অনুরাগ, ক্ষোভ, হতাশা ও ব্যক্তিগত খুটিনাটি অনেক কিছু টুকে রাখতেন ডায়েরিতে। ‘টাইম উইদিন টাইম’ নামে প্রকাশিত সেই ডায়েরিও বিবেচিত হচ্ছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম টেক্সটবুক হিসেবে। সেখান থেকে ১৯৭৩ সালকে হাজির করা হলো এখানে।


 ৯ জানুয়ারি

কমিটির কাছে রিভাইজড স্ক্রিপ্ট পাঠানো হয়েছে পরশু। সিজভ কথা দিয়েছেন, প্রডিউসের ব্যাপারে পরিষ্কার করার জন্য তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রশ্ন তুলবেন তিনি। প্রভু, সহায় হোন!

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/Tarkovsky11220110911155753.jpg
 ২৪ জানুয়ারি

একটা সময় ছিল, যখন আমি ভাবতাম, প্রত্যেক দর্শকের জন্য অন্যান্য আর্ট ফর্মের চেয়ে আলাদা হিসেবে [সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক হয়ে] ফিল্মের একটা সামগ্রিক প্রভাব ও অভিন্নসত্ত্বা আছে। এটি প্রথমত ধারণকৃত ইমেজের একটা সিরিজ; যে ইমেজগুলো ফটোগ্রাফিক ও দ্ব্যর্থহীন। এর কারণ হলো, এটিকে দ্ব্যর্থহীন হয়ে প্রকাশ্য হতে হয়; এটি একজনকে ধারণ করতে যায় এবং একইভাবে যতজন দেখে-- তাদের সবাইকেও তা-ই করে। [একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে অবশ্যই তা করে। ]

কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। একজনকে একটি মূলসূত্র নিয়ে কাজ করতে হবেই- যেটি মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করবে। ‘সামগ্রিক’ ইমেজটিকে অবশ্যই ব্যক্তিগত হয়ে উঠতে হবে। [সাহিত্য, পেইন্টিং, কবিতা, মিউজিকের তুল্য। ]
মৌলিক তত্ত্ব, মানে প্রধান প্রেরণা যেমনটা ছিল- আমার মনে হয় সেটা হলো, যতটা সম্ভব অল্প করে দেখানো; আর এই অল্প থেকেই দর্শকেরা বাকিটার, সমগ্রের ধারণা পাবে। আমার দৃষ্টিতে, সেটিকে সিনেমাটোগ্রাফিক ইমেজ গঠনের বুনিয়াদ হতে হবে। আর কেউ যদি সেটিকে প্রতীকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে, তাহলে ফিল্মে প্রতীক হলো প্রকৃতির ও বাস্তবতার প্রতীক। প্রসঙ্গটি অবশ্যই বিশদের নয়; বরং গোপনীয়তার।


২৬ জানুয়ারি

কদিন ধরে আমাদের সবার অসুখ। তিন সপ্তাহ ধরে বিছানায় আমি। নিজেকে আবারো খুঁজে পাচ্ছি প্রতীক্ষা ও অনিশ্চয়তার মৃত্যুবৎ পরিস্থিতিতে। এ কথা আমি বলছি ‘দ্য ব্রাইট ডে’র অনুমতি পাওয়ার প্রসঙ্গে। কাজ করার অনুমতি না পাওয়াটা মর্মযাতনার।
সাসা মিসুরিন বুদ্ধিটা বরং ভালোই দিয়েছেন : কাজাখ স্টুডিওর জন্য আয়েসভের ‘আবালো’ অবলম্বনে স্ক্রিপ্ট লেখা।
আমাকে শুধু সতর্কভাবে এগোতে হবে; কোনোকিছু আঁকড়ে ধরে থাকা যাবে না।
স্ত্রাগাতস্কি ভাইদের সায়েন্স ফিকশন ‘রোডসাইড পিকনিক’ পড়লাম এইমাত্র; এটা কারো জন্য একটা অসাধারণ স্ক্রিপ্ট হতে পারে।
সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টুডিওগুলো থেকে কিছু টাকা আয় করতে পারলে আমি আমার ধারদেনা শোধ করতে পারতামÑ এর পরিমাণ ৮ হাজার রুবলে দাঁড়িয়েছে। এমনকি আর্টিস্টিক ডিরেক্টরশিপের দোহাইয়ে আইৎমাতভের গল্প অবলম্বনে শর্টফিল্ম বানানোর প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে এখন আমার আফসোস হচ্ছে। সবকিছুর আগে আমাকে নিয়মিত মাসিক স্যালারির বন্দোবস্ত করতে হবে। ভবিষ্যতে আর বোকামি করা যাবে না।

স্বপ্ন দুই রকমের হয়। প্রথমটা হলো, জাদুকরিভাবে স্বপ্নদর্শী তার স্বপ্নের ঘটনাগুলোকে নির্দেশিত করতে পারে। যা হচ্ছে কিংবা যা হতে যাচ্ছে- তার সবকিছুর মাস্টার সে নিজে। সে এক প্রবল ক্ষমতাবান। দ্বিতীয়টা হলো, স্বপ্নদর্শীর বলার কিছুই থাকে না; সে প্যাসিভ। সে তার সঙ্গে করা হিংস্রতা এবং আত্মরক্ষায় অপারগতার কারণে ভোগে। সে যা চায় না, ঠিক তা-ই ঘটে তার সঙ্গে; সেগুলো অধিক বীভৎস ও যন্ত্রণাময়। [-কাফকার গদ্য অনুসারে। ]

‘একজন পেইন্টারের উদ্ভাসনের মুহূর্তগুলো মোটেও তার সচেতনতার ভেতর দিয়ে আসে না [অন্য আর্টিস্টদের এই ব্যাপার থেকে তারো বেশি আসে]। তার আবিষ্কার এমনকি তার নিজের কাছেও রহস্যময় হয়ে ওঠে; মন্ত্রণার দীর্ঘ পথের উপসরণী হয়ে ওঠে এবং তার কাজের মধ্যে এত দ্রুতই ঢুকে যায় যে, সংকটকালকে টের পাওয়ার ফুসরত পান না তিনি। তিনি যদি এসবের জন্য অপেক্ষায় থাকেন, এগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেন, এসবকে পেছনে থামিয়ে রাখেন, তাহলে এগুলো রূপকথার সোনার মতো ধূলিতুল্য হয়ে উঠবে। ’ -- রিলকে, ‘স্ত্রীর কাছে পত্র’ [সেজানের কাছে], ২১ অক্টোবর ১৯০১।


২৭ জানুয়ারি

 হায়, জীবন বিষাদি কী যে! রাষ্ট্রের রেফারেন্স ছাড়া যারা একে [জীবনকে] বয়ে নিয়ে যেতে পারে, আমি তাদের ঈর্ষা করি। আসলে, থিয়েটার ও ফিল্মের [টেলিভিশনকে আমি গণ্য করব না, কারণ এটা আর্ট নয়] মানুষ ছাড়া সবাই প্র্যাকটিক্যালি স্বাধীন। অবশ্যই তাদের বেতনভাতাও স্বাধীন; তারা অন্তত কাজ করতে পারে।
কর্তৃপক্ষ কী যে হাঁদারাম! তাদের কি আসলে সাহিত্য, কবিতা, মিউজিক, পেইন্টিং, ফিল্মের দরকার আছে? অবশ্যই না। বিপরীতে, এসব ছাড়া জীবন কতই না সহজতর হবে!
বরিস লিওনিদোভিচ [পাস্তারনাক] ঠিকই বলেছেন, আমি আরো অন্তত চারটি ফিল্ম বানাতে পারতাম। আমি প্রথমটা বানিয়েছি- ‘সোলারিজ’। এটা বাকি তিনটাকে ত্যাগ করেছে। এই তো!
কাজ করতে চাই আমি, এরচেয়ে বেশি কিছু চাই না । কাজ! এটা নিশ্চিতভাবেই পাগলামি ও অপরাধ যে, ইতালিয়ান প্রেস যাকে জিনিয়াস বলে ডাকে, সেই ফিল্মমেকারই কি-না বেকার।
অকপটে বললে, আমি মনে করি, মাঝারি মানের যে মানুষেরা ধীরে ধীরে ক্ষমতায় জায়গা করে নিয়েছে, তারাই আমার জন্য এটা করেছে। সর্বোপরি, মাঝারি মানের মানুষেরা শিল্পীদের সহ্য করতে পারে না। এবং আমাদের বসেরা মানুষ হিসেবে মাঝারিমানের।
‘দ্য ব্রাইট ডে’ যদি বানাতে পারি, তাহলে এই ফিল্মটির একটি ট্রিটমেন্ট আমি করব কিংবা অন্তত স্ক্রিপ্ট লিখব- দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে। এ বড়ই গরম সময়...।
নাকি আমি শুধু বলব, নরকে যাক এইসব?
সবচেয়ে সুন্দর গাছ কোনটা? দেবদারু নিশ্চয়ই? এটাই কেবল দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। সবচেয় দ্রুত বাড়ে কোনটা? সাদা উইলো নাকি রূপালি পপলার? রূপালি পপলার গাছ সুন্দর আছে!
ফিদিয়ার কাছ থেকে কখন যে গাড়ি পাব- সেটা ভেবে অবাক হই। একটাই সম্ভাবনা আছে। আমি নিশ্চিত, নিজে কখনো কিনতে পারব না। ফলে আমার জীবনকে আমি গ্রামযোগ্য করে তুলতে চাই!


২৯ জানুয়ারি

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/diary1120110911151358.jpg

 

 ৫ ফেব্রুয়ারি ‘সোলারিজ’ মুক্তি পাচ্ছে মস্কোতে। ‘দ্য অক্টোবর’ কিংবা ‘দ্য রাশিয়া’য় নয়, প্রিমিয়ার হবে ‘দ্য পিস’-এ। বসেরা আমার ফিল্মকে সেরা পর্দায় দেখানোর মতো যথেষ্ট ভালো মনে করেন না। তাদের জন্য অনেক জ্বালা আছে। তারা ‘দ্য রাশিয়া’তে হারামজাদা গেরাসিমভের ফিল্মই দেখাক।
আমি অবশ্যই তাদের কাছে কোনো অনুগ্রহ চাইব না; এমনকি প্রিমিয়ারেও যাব না।
এখন এটা বোঝার সময় হয়েছে যে, তোমাকে কারোর দরকার নেই। সেই মতে আচরণ শুরু করতে হবে। তোমাকে এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি তারকোভস্কি। আর এখানে তারকোভস্কি একজনই; যিনি এই পৃথিবীতে গেরাসিমভদের চেয়ে আলাদা; যার নাম বিরাট...। আমার কাজ হলো ফিল্ম বানানো; এবং তথাকথিত শিল্পীদের মধ্যে চলা সাধারণ হাউকাউয়ে নিজেকে কোনোভাবেই না জড়ানো।
তারাসভ ফোন করেছিলেন। ‘দ্য পিস’-এ প্রিমিয়ারের আয়োজকরা তারসঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। লারিসা পরিস্থিতিকে খোলাসা করেছে। আর বলেছে, আমি সত্যিই অসুস্থ, প্রিমিয়ারে যেতে পারব না। ব্যাপারটা আগামীতে আমার জন্য কী বয়ে আনছে, সেটা জানতে অবশ্যই ‘দ্য ব্রাইট ডে’ বানাব আমি। [এই ফিল্মটাকে ঠিক কী নামে যে ডাকব, সেটা এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। ]

ছোট ছোট প্লট ও গল্প, অভিনয় ও পর্দায় দেখানো- এ হলেই তাকে ফিল্ম বলা সম্ভব নয়। ফিল্মের কোনো কিছুই তার মধ্যে নাই। সিনেমাটোগ্রাফিক কাজ হলো সর্বোপরি সেই কাজ, যে কাজটি অন্য কোনো আর্টফর্মে করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, এটি ফিল্মের মানেকে সৃষ্টি করতে পারবে; এবং শুধুমাত্র ফিল্মেরই।
ওহ, আমার সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করার মতো কেউ যদি থাকতেন, এ সময়সীমার মধ্যে আমি যতটা পারি ততটা ফিল্ম যদি আমাকে বানাতে দিতেন! আমি যে ফিল্ম বানাতে চাই!
আমি আর সময় নষ্ট করব না। আমার ধারণা, এই পাঁচ বছরের কোর্সে সাতটা ফিল্ম বানাতে পারব আমি।


৩১ জানুয়ারি

ঝুঁকিপূর্ণ জীবন আমাদের প্রত্যেককে দেয় সন্তর্পনে নিরূপনের ভূমিকা,
আমাদের চেতনায় কেবলমাত্র সেইসব  বিষয়আশয়ের উন্নয়নের পরিবাহী নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করেÑ যা আমাদের ভূমিকার সীমাবদ্ধতার মধ্যে বড় হয়ে ওঠে। আমাদের চেতনার অন্য ক্ষেত্রগুলো বিনষ্ট হয়। এ কারণেই যোগসূত্রের অভাব ঘটে। এখানে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ঘটনাগুলো মিলিত হয়ে ভয়, অনাস্থা, নৈতিক হীনতা ও আশাবাদের মৃত্যুকে হাজির করে।


১ ফেব্রুয়ারি

লারোচকার জন্মদিন আজ। আর আমি অসুস্থ। একটা ফুটা পয়সাও নেই আমাদের। বেচারি লারোচকা! রাগ করো না; আমরা তোমার জন্মদিন পালন করব কিছুদিন পর, যখন আমরা সামলে উঠতে পারব।
একটা আইডিয়া : টেলিভিশনের জন্য ‘দ্য ইডিয়ট’। সাত পর্ব। রঙিন। লাপিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে। কোনো দালালের সঙ্গে নয়, এবং অদরকারি কমকর্তার সঙ্গেও নয়। আইডিয়াটা খারাপ না!


২ ফেব্রুয়ারি

‘দ্য ইডিয়ট’ হবে কয়েক কিস্তির। দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে ফিল্ম ‘ফাদার সার্জে’ও হবে টেলিভিশনের জন্য। ‘দ্য ইডিয়ট’কে সাত পর্বে বানানোটা ভালোই হবে।
এই মুহূর্তে আমি অবশ্যই টাকা কামানো নিয়ে ভাবব। আমি আর সাসা মিসুরিন দ্রুতই অর্ডারি স্ক্রিপ্ট লিখতে পারব। যদি আমরা তিন ঘন্টার স্ক্রিপ্টের দুই-তিনটা কন্ট্রাক্ট ফিক্সড করতে পারতাম! ভ্যালেরি কে. সাহায্য করছেন। ইতোমধ্যে তিনি মলদাভিয়ার কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আমার জানা মতে আগেয়েভ এখন কাজাখস্তানে। তার জন্য স্ক্রিপ্ট লেখাটা কারো জন্যই কোনো ঝুঁকির ব্যাপার না।
কিরিলিন আজ ফোন করেছিলেন। মস্কোতে ডিস্ট্রিবিউশনের ইনচার্জ তিনি। সামনে প্রিমিয়ার, অথচ আমি অসুস্থ- এ নিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন মনে হলো। আমাদের আলাপের উপসংহার হলো, তিনি রকাচভের সঙ্গে কথা বলেছেন। ‘সোলারিজ’-এর প্রিমিয়ার নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করতে তারাসভ কোনো পরোয়া করেননি। খুব ভালো। অনেককে নরকে পাঠাতে হবে, সেটাই তাদের প্রাপ্য।


৪ ফেব্রুয়ারি

কাজ আগানোর ব্যাপারে বাস্কাকভ মত দিয়েছেন বলে গুজব আছে। সেটা হলে, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শুরু করতে যাচ্ছি।
ইস, আমি যদি সুস্থ হয়ে যেতাম! জ্বরটা ভয়ানক নাছোড়বান্দা।
‘দ্য ইডিয়ট’ পড়ছি আবারো। এটা দিয়ে ফিল্ম বানানো সহজ হবে বলে মনে হয় না। স্ক্রিপ্ট লেখা খুব কঠিন হবে। উপন্যাসটি রূঢ়ভাবে ‘দৃশ্য’ ও ‘দৃশ্য বর্ণনা’র মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে; পক্ষান্তরে, প্লটের ডেভেলপমেন্টের প্রশ্নে যা ঘটেছে, তার যেকোনো হিসাবই গুরুত্বপূর্ণ। এইসব ‘বর্ণনা’কে অবশ্যই কোনোভাবে একদম ফেলে দেওয়া যাবে না। এগুলোকে কিছু কিছু দৃশ্যের মধ্যে জুড়ে দিতে হবে।
তবে তা পরে হবে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘দ্য ব্রাইট ডে’। দস্তয়েভস্কির কাজের মধ্যে সবচেয়ে নিবিড়ভাবে সংগঠিত, সবচেয়ে সুদৃশ্যভাবে সাজানো, অ্যাডাপশনের জন্য নিজেকে সবচেয়ে প্রস্তুত করে রাখা কাজটি হলো ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। কিন্তু লিওভা কুলিদজানভ ইতোমধ্যে এটা করে ফেলেছেন।
‘দ্য ব্রাইট ডে’ নামটা আমার পছন্দ না। নিস্তেজ। ‘মার্তিরোলজি’ নামটা ভালো- যতক্ষণ না কেউ এটার মানে বুঝে; আর যখন তারা বুঝবে, তখন এটা মেনে নেবে না। ‘রিডেম্পশন’ কিছুটা নীরস, এটা ভেরা পানোভামার্কা নাম। ‘কনফেশন’টা দাম্ভিক। ‘হোয়াই আর ইউ স্ট্যান্ডিং সো ফার অ্যাওয়ে’টা ভালো, তবে অস্পষ্ট।
‘...প্রায় সব বাস্তবতা, এমনকি সেটার নিজস্ব অপরিবর্তনীয় বিধান থাকা সত্ত্বেও সেটা প্রায় সবসময়ই ভিন্নতর এবং অভাবনীয়। আর আসলে যত বাস্তবতা, ততই অসম্ভাব্য। ’ [‘দ্য ইডিয়ট’-এ লেবেদেভ]।


৫ ফেব্রুয়ারি

যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে ‘গ্র্যান্ড প্রাইজ’ জিতেছে ‘রুবলেভ’।
সেটা ছিল ফেস্টিভ্যালের ফেস্টিভ্যাল এবং আমার জানা মতে ’৭১ ও ’৭২ সালের পুরস্কারবিজয়ী সব ফিল্ম দেখানো হয়েছে সেখানে। ‘রুবলেভ’ ছাড়া আমাদের এখান থেকে সেখানে ‘টেম্ড ফায়ার’ ও ‘ডাউনস্ আর কুয়াইট হেয়ার’ পাঠানো হয়েছিল। এগুলো অবশ্যই কিছুই জিতেনি। এগুলো পুরস্কার জিতেছে কেবল এদেশেই; কারণ, সেই পুরস্কারের আয়োজন করেছে আমাদের কর্তৃপক্ষ। ফেস্টিভ্যালে যেসব বিদেশি ফিল্ম দেখানো হয়েছে, তাতে আমি অবাক। স্বভাবত আমি শুনেছিলাম দ্য ইউনিয়ন ও দ্য কমিটি- উভয়ের স্বাতন্ত্রের কথা।
উরুসেভস্কি কাল ফোন করেছিলেন অভিনন্দন জানাতে। রেডিওতে তিনি ঘোষণা শুনেছেন। আমার বসেরা এখনো জঘণ্য আচরণ করছেন।
‘অবৈধ’ ‘রুবলেভ’র চতুর্দশ আন্তর্জাতিক পুরস্কার।


৬ ফেব্রুয়ারি

তারা বলছেন, ‘সোলারিজ’ উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে। একটা সিটও খালি ছিল না। বেরিয়েও যায়নি কেউ। আসলে শেষ হওয়ার পর কেউ কেউ নাকি চিৎকার করে বলেছে, ‘তারকোভস্কি দীর্ঘজীবী হোন’! দেখা যাক কী হয়।
‘দ্য ব্রা ই ট ,   ব্রা ই ট  ডে’ ।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/nostalgia11120110911154019.jpg

৭ ফেব্রুয়ারি

‘...দ্বিতীয় তীরটি নিও না কখনো। তুমি যদি দ্বিতীয় তীরের উপর ভরসা করো, তাহলে প্রথমটার ব্যাপারে উদাসীন থাকবে। তোমাকে সবসময় ভাবতে হবে যে, তুমি একটা মাত্রই সুযোগ পাবে, আর তোমার এই এক ও একমাত্র তীর দিয়েই টার্গেটকে হিট করতে হবে!’ ৯২। ‘নোটস টু রিলিভ টিডিয়াম’, কেঙ্কো-খোশি।
‘কাজটা করবে কি করবে না- এই নিয়ে যদি তুমি চিন্তায় থাকো, তাহলে নিয়ম বলে, সেটা না করাই ভালো...’। -বুড্ডিস্ট জুডো সেকশনের নেতাদের সংকলিত সংলাপ থেকে, ১২৮৭।


১৭ ফেব্রুয়ারি

রস্ততস্কি ফোন করলেন এইমাত্র। সম্প্রতি তিনি যুগোস্লাভিয়া থেকে ফিরেছেন। তিনি বললেন, তিনি জানতেন না যে ফেস্টিভ্যালে তিনি একাই যাচ্ছেন। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
গত দুই বছরের সব পুরস্কার বিজয়ী ফিল্মের ফেস্টিভ্যাল ছিল এটা। ‘দ্য গডফাদার’ দেখানো হয়েছে। তারা বলেছেন, মাফিয়া এটাকে প্রমোট করেছে। কথাটা সত্যি হতে পারে।
এ ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন হয়েছে ‘রুবলেভ’ দিয়ে। দর্শক রেটিংয়ে ১৪ নম্বর জায়গা দেওয়া হয়েছে এটিকে। ‘দ্য গডফাদার’ ও আরো দুটি পেয়েছে হাইয়ার মার্ক।
আন্তর্জাতিক সমালোচক গোষ্ঠী ‘রুবলেভ’কে সবমিলিয়ে প্রথম স্থান দিয়েছেন। ১৬০ জন [আমার জানামতে] সমালোচকের প্রত্যেকেই তাদের ভোটে ‘রুবলেভ’কে প্রথম স্থান দিয়েছেন।
রস্ততস্কি আরো জানালেন, উৎসবটি ছিল প্রো-আমেরিকান। কে জানে? বেচারা বুড়ো রস্ততস্কি?


১৮ ফেব্রুয়ারি

আগে ‘স্থির’ করে তারপর যায় ভাবতে, এবং শুধুমাত্র তারপরই কাজটা তারা মনেপ্রাণে করেÑ এই অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয় কলঙ্কে ভোগেনি- এমন পারফরম্যান্স কখনোই দেখিনি আমি।
চারপাশে ভয়ংকর জিনিসপত্র ও অস্বাভাবিকতা, চিন্তা বা অন্তর্জগতের অনুপস্থিতি, ভগ্নচিন্তাগত অক্ষমতা, যেকোনো চিন্তার প্রয়োজনে চরম শব্দের অসামর্থ্য; আর তা স্রেফ শব্দের নিজের দোহাইয়ে নয়। এইসব পরম্পরাকে হতে হবে শব্দ, কার্য ও অন্তর্জগতের সমলয়। দৃশ্যত, এইসব জিনিস জড়ো করতে হবে ‘দ্য রাশিয়ান স্কুল অব অ্যাক্টিং’য়ে।
আর তারা ধারণ করে এক ভিত্তিগত ভ্রান্তি, মিথ্যে, অবিশ্বাস।

নোট : পকরোভস্কি আমাকে জানালেন, অনুরোধপত্রের প্রেক্ষিতে তিনি তার প্রয়াত বাবার ম্যানুস্ক্রিপ্ট গামজাতভের হাতে তুলে দিয়েছেন; এবং দুই বছরের ভালো পার্টের জন্য এটি এখন গামজাতভের কাছে আছে। তিনি এটা ফেরত দেবেন না; এবং ততদিনে বইটির ক্ষমতা নিয়ে দাগেস্তানে দুটি ডক্টোরিয়েল থিসিস লেখা হবে। এটির শিরোনাম, ‘দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স অব দ্য মাউন্টেইন পিপল অব দ্য নর্থ-ইস্টার্ন কোকাসাস ইন দ্য ফার্স্ট হাফ অব দ্য নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি’। বেশিই বড়!
‘রুবলেভ’-এর প্রস্তাবনায় অনেক ইতিহাসবিদই [কেবলমাত্র ইতিহাসবিদ] সমালোচনামুখর হয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, প্রয়াত সেভেচেভ এ কাজে আমাকে প্রেরণা দিয়েছিলেন। [ইয়ামসচিকভের মাধ্যমে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ]
আমি বারবার এটাই উপলব্ধি করি যে, ফিল্মে একতার [সমগ্রতার নামে] মূলসূত্রই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ; আর তা সম্ভবত অন্য যেকোনো আর্টফর্মের চেয়ে বেশি, অনেকবেশি। আমি যেটা বোঝাচ্ছি, বলার সময়ও সেই স্পটেই হিট করছি। একটি উদাহরণ বিষয়টিকে স্পষ্ট করবে : ‘দ্য ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ যদি সেরকম কাঠামোগত আদর্শের নিকটবর্তী হয়ে থাকে, তাহলে দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘দ্য ইডিয়ট’ এ থেকে বেশ দূরে। এটি অধিক ‘বিচ্ছিন্ন’।

‘...আমরা সেই সুবিধাগুলো উপভোগ করেছি, যেগুলো লেখকদের দিতে সমাজ যথেষ্ট প্রস্তুত; আর তা সেই লেখকদের, যারা কিনা এর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আমাদের জানা মতে, তারা কোনো কিছুর অধীন নন এবং কারো বাধ্য নন- নিজ মন ও বিবেকের হুকুম ছাড়া। ’ [১৮৬২- ১৮৬১ ও ১৮৮২ মধ্যকার সময়ে স্ত্রাখভের উক্তি। ]

‘...সে সময় হার্জেনের প্রতি তার [দস্তয়েভস্কির] আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ; এবং তার ‘উইন্টার নোটস অন সামার ইমপ্রেশন্স’-এ এই লেখকের কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে; পরে অবশ্য তার জীবনের শেষদিকে তিনি রাশিয়ান মানুষকে বোঝার কিংবা তাদের জীবনধারার নিশ্চিত রূপরেখা সমর্থনের ক্ষেত্রে অক্ষমতার দায়ে হার্জেনের প্রতি প্রায়শই ক্ষোভ ঝেড়েছেন। শিক্ষাদীক্ষা থেকে পাওয়া অহমিকায় তার ছিল সহজবোধ্যের প্রতি কাঁচারকম খুঁতখুঁতে অবজ্ঞা- হার্জেনের এইসব বৈশিষ্ট্য ফিওদর মিখাইলোভিচকে উত্তেজিত করেছিল, এমনকি তিনি এগুলোর দোষ দেখেছিলেন গ্রিবয়েদভের মধ্যেও এবং ভর্ৎসনা করা বাজে লেখকদের মধ্যে- কেবলমাত্র আমাদের বিপ্লবীদের মধ্যেই নয়। ’

‘...ফরাসিরা নম্র, ‘সৎ’, সুশীল, তবে ‘মেকি’; আর টাকাই তাদের কাছে সবকিছু। ’ [স্ত্রাখভকে লেখা একটি চিঠি থেকে; প্যারিস, ২৬ জুন ১৮৬২। ]

‘...ফিওদর মিখাইলোভিচ কোনো মহান পর্যটক ছিলেন না; প্রকৃতি কিংবা ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি কিংবা শিল্পকর্মের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না- সম্ভবত তা চরম অসাধারণ কিছু না হলে। তার সকল মনোযোগ ধাবিত হতো জনতার প্রতি; তাদের স্বভাব ও চরিত্র নিয়ে কাজ করতেন তিনি, এবং যথাসম্ভব রাস্তার জীবনের একটা জেনারেল ইমপ্রেশন নিয়ে। একদা তিনি আমার কাছে তার কিছু অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি গাইড বইয়ের সাহায্য নিয়ে বিখ্যাত স্থানগুলোকে দেখতে যাওয়ার গড়পড়তা গ্রহণযোগ্য পথকে অবজ্ঞা করেন। ’ [স্ত্রাখভ, স্মৃতিচারণ। ]

‘...সব বিবেচনা করে আমি বলব, এই ব্যাপারে [মদের ব্যাপারে : তারকোভস্কি] ফিওদর মিখাইলোভিচ ছিলেন অসাধারণরকম সংযত। আমার দেখা বিশ বছরে কখনোই কোনো আসরে তার মধ্যে মাতাল অবস্থায় মদের প্রভাবে একবারো প্রতারণামূলক আচরণের লক্ষণ দেখিনি। মিষ্টির প্রতি সম্ভবত তার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল; তবে সাধারণত তিনি খুবই পরিমিত খাবার খেতেন। ’ [ঐ]

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/Stalker-3120110911155331.jpgমারিয়া দিমিত্রিয়েভনা মারা যান ১৮৬৪ সালের ১৬ এপ্রিল, যক্ষ্ময়।
জানি না কেন, তবে খুৎসিয়েভের বিলম্বে নিজের উপর আমার অসাধারণরকম রাগ লাগছে। টেলিভিশনে আরামদায়ক পদ পেয়ে তিনি বদলে গেছেন। তিনি আরোবেশি মনোযোগী হয়েছেন। বয়স তার বাচ্চামিকে একদমই কমাতে পারেনি। আর পরিচালক হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে একেবারেই অপেশাদারী। তার সব আইডিয়া ছোটমাপের- ঠিক যেন তরুণ প্রবর্তকের মতো।
তার ফিল্মগুলোকে আমার কাছে একেবারেই বিরক্তিকর লাগে- যুদ্ধশেষ নিয়ে বানানো শেষেরটা ছাড়া। সেটি অবশ্য প্রচুর ফন্দি-ফিকিরে ভরা, এবং তার নায়ক বিতৃষ্ণকর। আপনার মনে হবে, পোলিশ বন্দিশিবিরটি যেন কোনো ডোবা থেকে ভাড়া করে আনা। আর পর্যটক ও ধ্বংসস্তূপের ছোট নকশাগুলোও ঠিকমতো হয়নি। বাজে ব্যাপার হলো, তিনি কিছুটা প্যাথেটিক।
‘দ্য ইডিয়ট’ পাঠে আমার মনোযোগ ব্যর্থ হওয়ার পর আমি আরেকবার ‘অ্যা র ইয়ুথ’ পড়ব বলে ঠিক করেছি। ‘দ্য ইডিয়ট’ নিয়ে লাপিনের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত হয়েছে। এই মাসের শেষের দিকে আমি সম্ভবত পূর্ব জার্মানিতে যাচ্ছি। এটিকে আমি পারলে চেষ্টা করব একটি যৌথপ্রযোজনার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে; কিংবা পুরোপুরি একটা জার্মান প্রোডাকশন করতে?
টমাস মান নিয়ে ভাবাটা কি কাজের হবে? একটা উপন্যাসিকা দিয়ে শুরু করে একটা কিংবা দুইটা বই পুনর্পাঠ করব আমি। ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন’ হলে কেমন হয়? না, এটা মনে হয় এর জন্য সঠিক সময় নয়।
সেক্ষেত্রে ‘ডক্টর ফস্টাস’।


১৯ ফেব্রুয়ারি

ইউসুভের মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘সোলারিজ’-এ তার সঙ্গে কাজ করাটা ভয়ানক কঠিন হয়ে উঠেছিল। সবকিছুর উপরই বিরক্ত এবং ক্ষেপা ছিলেন তিনি। প্রতারণায়, বদমেজাজে সবাইকে জ্বালিয়ে বেড়িয়েছেন। সবাইকে পাগল করে ছেড়েছেন। আর মিশা রমাদিন, ভি. ফিওদরভনা ও আমার- আমাদের সবার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। পরে অনেকেই আমাকে জানিয়েছেন যে, আমার রিঅ্যাক্টের ধরণ দেখে তারা নাকি অবাক হয়েছেন। তারা ভেবেছিলেন, আমি এটা বুঝতে পারিনি। আসলে, আমি কেবল এমন ভাব করার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম যে, আমি কিছু বুঝিনি; কারণ, তা না হলে গোলমাল ছাড়া আর কিছুই হতো না এবং কাজ করতে পারতাম না আমরা। দানেলিয়ার শেষ ফিল্ম ‘হাকলবেরি ফিন্’-এ ঠিক তা-ই ঘটেছে।

ভাদিম সবসময়ই চেয়েছেন সাফল্য ও পেশাদার যশ। একটা ইতর তিনি। অরিজিনাল কিংবা স্বতন্ত্র যেকোনো কিছু তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করেন। বরং বলা চলে, ঈর্ষা করেন। মজার ব্যাপার হলো, বুদ্ধিজীবি-সম্প্রদায়ের প্রতি তার আচরণ জনসাধারণকে প্রতিনিধিত্ব করে। সৃষ্টিশীল মানুষদের নিজস্ব চেতনার বহিঃপ্রকাশের প্রতি তার শ্রেণীগত অবজ্ঞা আছে। তিনি ভালোবাসেন নিজেকেই। তিনি যে অপরিহার্য নন- সেটা যখন পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।

তিনি যে ইতোমধ্যে একজন ‘মাস্টার’ হয়ে গেছেন- সেটা আমরা ‘সোলারিজ’ বানানোর সময়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে তিনি কেবলমাত্র নিশ্চিত হয়েই সেইসব জিনিস ব্যবহার করে কাজ করতেন- যেগুলো শুরুর দিকের কাজকর্মে অর্জন করেছেন। ফলে তিনি এই অর্জনগুলোকে চিরস্থায়ী করতে চাইতেন, এবং এর বাইরে চোখ দিতেন না।

এটা খারাপ। এখন হয় তার নিজেকে অব্যাহতি দিতে হবে এটা মেনে যে- তিনি জিনিয়াস নন, যে ফিল্মিকাজগুলো করেন সেগুলো রাষ্ট্রীয় ও লেনিন প্রাইজের প্রতি ভাগ্যনির্দিষ্ট, এর ফলে সম্মান অর্জন করেন নিজের আত্মসম্মান ও স্বাতন্ত্রিকতা হারানোর প্রতিদানে; নয়তো তার নিজেকে হয়ে উঠতে হবে ফিল্মমেকার [এটা তিনি ভালোবাসতেন; তবে তিনি তা বলতে অনিচ্ছুক- সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি ভয়ঙ্কর ধোঁকাবাজ একটা] এবং বানাতে হবে সস্তা ফিল্ম। এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে : বন্দারচুক, ভলচেক, সাত্রভ, গুবেঙ্কো, খ্রাব্রোভিতস্কি, মোনাখভ- এ রকম অসংখ্যজন।

মুরাস্কো [ফটোগ্রাফার] জানালেন, ভাদিম যখন দানেলিয়ার সঙ্গে ফিল্মে কাজ করছিলেন, তখন তাদের খুবই বাজে একটা সময় গেছে। আর্টিস্ট হিসেবে ভাদিম নিজের যথেষ্টরকম বিনাশ করে ফেলেছেন। তার এই পচন ইনোচকার কারণে ব্যাপক মাত্রা ছাড়িয়েছে; এই নারী চান তার স্বামী রাতারাতি অর্থ, সম্মান ও খ্যাতি কামাক।

তার [ভাদিম] আর আমার সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ায় আমি খুবই খুশি হয়েছি । ক্ষতিটা ভাদিমের হয়েছে : তিনি আশা করেছিলেন, কথার বরখেলাপ করে তিনি উৎরে যাবেন; সেই মুহূর্তে সেটি আমার জন্য মারাত্মক ছিল, কারণ, সেখানে আমার সঙ্গে কাজ করার মতো আর কেউ ছিল না, ফলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাব। তিনি সত্যিকারেই আশা করছিলেন, এমনটা হবে।
আসলে আমি আর গোসা রারবার্গ শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি; আর অন্যকোনো ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কাজ করাটা তো আমার জন্য কখনোই সহজ, প্রীতিকর ও আকর্ষণীয় ছিল না। নতুন মেথডের জন্য পরস্পরের অন্বেষণের প্রতি আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আছে। এটা আমাকে প্রকৃত কাজের একটা স্বাদ দিচ্ছে।
ফলে, ভাদিমের স্থানচ্যূতি ঘটেছে।


১৮ মার্চ

এখনো আমরা শুরু করতে পারিনি। দিভিগুবস্কিকে নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। লন্ডন ফেস্টিভ্যালে ‘সোলারিজ’ ১৯৭২ সালের বেস্ট ফিল্ম প্রাইজ জিতেছে। ‘রুবলেভ’ ইতোমধ্যে ছয়টি প্রাইজ জিতেছে, আর ‘সোলারিজ’ তিনটি। যত তাড়াতাড়ি পারি, আমাকে কাজে বসতে হবে। সময় বয়ে যাচ্ছে...।


২৩ মার্চ

ইদানিং আমার কী যেন কী হয়েছে। আজ ‘সেই’ অনুভূতি বিশেষরকম শক্তিমান ও অর্থপূর্ণ হয়ে আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি অনুভব করতে শুরু করেছি, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় হয়েছে এখন।

নিশ্চয়তা হলো, এটি প্রথমত আমার নিজের নিশ্চয়তা [যেটি অবশ্যই ভ্রান্তিকর ও দূরগামী হতে পারে- দ্বান্দ্বিকতায়- মামুলি বিপর্যয় হতে গিয়ে]; আর দ্বিতীয়ত আমি যে বিষয়আশয় নিয়ে কাজ কারতে যাচ্ছি, সেগুলো সাদামাটা, তবে একইসঙ্গে অসাধারণরকম নিগূঢ়; সাধারণ ও মামুলি- যে পয়েন্টে একটা বিহ্বল হবে না, ম্যাটার থেকে সরে যাবে না।
এমনকি আমি একে আদর্শিক উপাদান বলতে পারি। কারণ, আমি একে যথেষ্ট ভালো বুঝি ও জানি। একে নিয়ে খুবই সতর্ক আমি। প্রশ্ন কেবল একটাই- আমি কি এটা করতে পারব? আমি কি আত্মার সঙ্গে নির্ভুলভাবে গঠিত শরীরকে পরিপূরিত করতে পারব?
 
মাকে দেখতে গিয়েছিলাম কাল। ম্যারিনা গেছে রিগার উপকূলে। লারিসাকে নিয়ে তারসঙ্গে আমার ঝগড়া হলো- সিরিয়াসলি এবং শক্ত ভিত্তিতে।

(চলবে)


বাংলাদেশ সময় : ১৫০০, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad