ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ঈদ সংখ্যা : সাহিত্যের রাজনীতি, সংস্কৃতির বাণিজ্য

সৈকত হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১১
ঈদ সংখ্যা : সাহিত্যের রাজনীতি, সংস্কৃতির বাণিজ্য

[প্রতি বছর বহু ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশে। এর মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা যেমন হচ্ছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে বিপুল সংস্কৃতিবাণিজ্য এবং সাহিত্যরাজনীতিও জমে উঠেছে।

বাংলানিউজ দফতরে পাওয়া এবং বাজার থেকে তুলে আনা এক ডজন ঈদ সংখ্যার আলোকে একটি মূল্যায়ন করেছেন কবি ও সমালোচক সৈকত হাবিব]

বাংলা ভাষার সাময়িকপত্রে ঈদ সংখ্যার চর্চা নতুন নয়, বরং এটি বিশ শতকেরই প্রায় সমান বয়সী। সে অর্থে এটি আমাদের শত বছরের একটি ঐতিহ্য। যেহেতু ওই সময়ে কলকাতা ছিল বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী, সেহেতু এটি শুরু হয়েছে কলকাতা থেকেই। পরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও ঈদ সংখ্যা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়।

তবে ঈদ সংখ্যার পেশাদারি রূপটি বোধহয় সংগঠিত হয়েছে দেশ বিভাগোত্তর পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায়। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান ছিল মুসলিম-গরিষ্ঠ রাষ্ট্র, এবং মুসলমান মধ্যবিত্তের শিক্ষা, ক্ষমতা ও আধিপত্য ওই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, সেহেতু তার ‘নিজস্ব’ সংস্কৃতি বিস্তারে সে নানারকম ধর্মপ্রভাবিত উপাদানকেও ব্যাপক মাত্রায় গ্রহণ করে। ঈদ সংখ্যার চর্চা এরই একটি প্রয়াস। যদিও এটি ধর্মবিস্তারের পরিবর্তে সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিস্তারে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেছে। কারণ সাহিত্য ছিল এর প্রাণ। তবে যেহেতু সেটি ছিল পাকিস্তানি আমল এবং ‘মুসলমানদের দেশ’, তাই আজকের দিনের মতো সেক্যুলার চেহারা তার ছিল না, যদিও বহু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সে সময়ের ঈদ সংখ্যাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।

ঈদ সংখ্যার সেক্যুলার চেহারাটা আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়সী। তথাকথিত পাকিস্তানি ধর্মীয় শৃঙ্খল ভাঙতেই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী কাল থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করে আসছিল, যা পরে সংবিধানেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিতে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে সামরিক শাসন এবং ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকদের হাতে সেই আদর্শ ভূলুণ্ঠিত হলেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এই রূপটি আজও প্রায় অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশে ঈদ সংখ্যার আজকের বিপুল জনপ্রিয়তার কথা বলতে হলে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যার কথা। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছিল ‘পূর্বাণী’। পরে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় ‘চিত্রালী’, ‘রোববার’, ‘সচিত্র সন্ধানী’র মতো কাগজের ঈদ সংখ্যা এবং ছোট-বড়, ভালোমন্দ বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। প্রসঙ্গত, আমরা এখানে বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত সাপ্লিমেন্ট ঈদ সংখ্যার আলোচনা করছি না, বরং আমাদের আলোচ্য ঈদ ম্যাগাজিন।  

        
কিন্তু আজকের একুশ শতকী ঈদ সংখ্যার যে বিপুল আধিপত্য, বাজার ও বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং সাহিত্যকেন্দ্রিক রাজনীতি, এর চেহারা অনেকটাই নতুন। যদিও অন্তরে-বাহিরে এখনো ‘বিচিত্রা’র প্রভাবই সবচে বেশি। স্বাধীনতার পরের বছর প্রকাশিত ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যা ধীরে ধীরে দেশি ফ্যাশন, বিনোদনসহ অনেক বিচিত্র বিষয় ঈদ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করে, আজকের প্রায় সব পত্রিকার ঈদ সংখ্যার অনিবার্য অনুষঙ্গ। এমনকি ঈদে ফ্যাশন নিয়ে প্রচুর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে, যার সূচনা করেছিল ‘বিচিত্রা’।

তবে ঈদ সংখ্যায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয় এই শতাব্দীর শুরুতে, যখন দৈনিক পত্রিকাগুলোও ঢাউস ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। এর সূচনা করে গোলাম সারওয়ার সম্পাদিত ‘দৈনিক যুগান্তর’, ২০০০ সালে। এমনকি ২০০১ সালেও শুধু ‘যুগান্তর’ই ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে। ২০০২ থেকে অন্য দৈনিকগুলোও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এখন অবস্থা এমন যে, দেশের সবচে কম পঠিত জাতীয় দৈনিকই শুধু নয়, রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন আঞ্চলিক দৈনিকও ঈদ ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। এখন ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়।

একটি বিষয় লক্ষণীয়, দেশের সবচে বড় মিডিয়া-মোড়ল বলে দাবিদার দৈনিকটিও, যাদের প্রচারসংখ্যা চার লাখের বেশি বলে মনে করা হয়, তারাও ঈদ সংখ্যা দশ হাজারের বেশি ছাপে না। তাই এই বিপুলসংখ্যক পাঠকের জন্য বিভিন্ন দৈনিক আবার ছোট ছোট ম্যাগাজিন প্রকাশ করে থাকে এবং তারা সগর্বে ঘোষণা দিয়ে থাকে, ‘পাঠক, এটি আপনাদের জন্য আমাদের বিনামূল্যে উপহার। পৃথকভাবে বিক্রয়ের জন্য নয়। ’

কিন্তু এই যে ঈদে এত আয়োজন আর পাঠকপ্রীতি, এর নেপথ্যে কী, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবা? আপাতদৃষ্টে, নিশ্চয়ই। কিন্তু সে কোন সংস্কৃতি, কী সাহিত্য? এর মধ্য দিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির কল্যাণ কতটা হয়, আর কতটা হয় বাণিজ্য ও রাজনীতি? এর চূড়ান্ত লক্ষ্যটাই বা কী?

কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি এ বিষয়ে কথা বলতে গেলেও অনেক অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করতে হয়। আমাদের মূলধারার সংবাদমাধ্যম বহুকাল ধরেই আর জনগণের মুখপত্র নেই। বরং মিডিয়াশক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠীস্বার্থ, বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারই হয়ে উঠেছে এর মূল কাজ। তাই আজকের সংবাদপত্রগুলো বিষয়ে-বৈচিত্র্যে-পৃষ্ঠায় অনেক বিস্তৃত হলেও  একটি সুস্থ সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনে খুব বড় ভূমিকা রাখছে না। এ কথা এদের সাহিত্য সাময়িকীগুলোর ব্যাপারেও প্রযোজ্য। দেশের প্রায় সব বড় পত্রিকারই সাহিত্য সাময়িকী রয়েছে, এগুলোতে রয়েছেন অনেক ‘সুযোগ্য’ সম্পাদক। কিন্তু যত সংখ্যায় সপ্তাহান্তে সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ হয়, তাতে কতটা ‘সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়, তা বোধহয় আতশকাচ দিয়ে দেখতে হবে। অন্যদিকে সাহিত্য সম্পাদক নামধারীদের অনেকেই যতটা না ‘সম্পাদক’, তারচে বহুগুণে ‘লেখা সংগ্রাহক’। তাদের কাজ মূলত ‘বিখ্যাত’ বা ‘পরিচিত’ লেখকদের লেখা আনা, পৃষ্ঠায় বসানো এবং বানান ‘পরীক্ষা’ করে ছাপানোর জন্য পাঠানো।  

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই ‘সম্পাদক’রা লেখকের লেখা নয়, নাম ছাপে, যাদের বাজারমূল্য আছে। অথবা ছাপে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব। খুব অনুসন্ধান করে লেখক তৈরি কিংবা নতুন লেখকদের ভালো সৃষ্টিকে তুলে আনার ধৈর্য যেমন সাহিত্য সাময়িকীগুলোর নেই, ঈদ সংখ্যাগুলোর তো আরো আগেই নেই। কারণ এর উদ্দেশ্য শতভাগ বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির মোড়কে। সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে নিজস্ব রাজনীতি আর মানসিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। অথচ এখানে বিস্তর সুযোগ রয়েছে উন্নত সাহিত্য ও সংস্কৃতি তৈরির। কারণ, এখানে দৈনিকের মতো স্থান সংকুলানের সংকট নেই, বরং প্রতিটি বড় দৈনিকেরই পৃষ্ঠাসংখ্যা গড়ে ৫০০ পৃষ্ঠা। কাজেই এখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ অনেক। আর এতে কোনো কাজ যে হচ্ছে না, তাও নয়। কিন্তু প্রতি বছর হাজার হাজার পৃষ্ঠা খরচ করার তুলনায় তা খুবই সামান্য। এর বিচারের ভার কোনো মনোযোগী ঈদ সংখ্যার পাঠকের হাতে দেওয়া যেতে পারে যে, গত পাঁচ বছরে তিনি যতটা ঈদ সংখ্যা পড়েছেন, ঠিক তত পরিমাণে কয়টা ভালো গল্প-উপন্যাস পড়েছেন।  

অন্যদিকে ভালো ‘সম্মানী’ পাওয়া যায় বলে লেখকরা এই বাণিজ্যের অন্যতম সুবিধাভোগীতে পরিণত হয়েছেন। যেহেতু বাজারে নাম রয়েছে, বাজারমূল্যও বেশ, তাই তারাও বছরের বিস্তর গল্প-উপন্যাস-কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি লিখে পাতা ভরিয়ে দিচ্ছেন। তাতে সাহিত্যের স্বাস্থ্য যা-ই হোক, তাদের পকেটের স্বাস্থ্য ভালোই থাকে এই ঈদের মরশুমে। অবশ্য সব লেখকই এরকম ‘ভাগ্যবান’ নন, বরং বহু মেধাবী লেখকও এ থেকে বঞ্চিত হন।

এসব কথার মধ্য দিয়ে আমরা বলতে চাই না যে, ঈদ সংখ্যায় ভালো সাহিত্য থাকে না, কিংবা সব লেখকই সাহিত্য তৈরি না করে কেবল সাহিত্যপণ্য তৈরি করেন। তবে সাধারণ প্রবণতাটা যে এরকম, তার জন্য গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না।

কাজেই আমরা যখন এ বছরের ঈদ সংখ্যাগুলোর মূল্যায়ন করব, তখনও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, এই প্রবণতাই শক্তিশালী বলে মনে হবে।

যেহেতু এ বছরের অধিকাংশ ঈদ সংখ্যাই এ সপ্তাহের মধ্যে বেরিয়েছে, এবং আমাদের আলোচ্য পত্রিকাগুলোর মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা হাজার পাঁচেকের বেশি, তাই আমরা পাঠ-আলোচনা করতে পারছি না, বরং মোটা দাগে একটু পরিচিতি এবং সাধারণ প্রবণতা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

সামান্য সচেতন পাঠকও লক্ষ করে থাকবেন যে, খুব বিখ্যাত, বিশিষ্ট বা পুঁজিবর্ধক লেখক ছাড়া সব পত্রিকারই নির্দিষ্ট কিছু লেখক আছেন, যারা প্রতি বছরই ফিরে ফিরে আসেন। এটা আমাদের মিডিয়ার গোষ্ঠীতন্ত্রের একটি উদগ্র প্রকাশ। পাঠক আমাদের দেশের মিডিয়া-মোড়লদের ‘ব্রাহ্মণ’ ঈদ সংখ্যাটির কয়েক বছরের কবিতা অংশটির দিকে নজর দিন। দেখবেন, সেখানে গত কয়েক বছর ধরে একই মুখের রাজত্ব চলছে। মাঝে মাঝে দু-একটা মুখ উঁকি-ঝুকি দেন বা যুক্ত হন। তাদের সংখ্যা-নির্বাচনেও ব্রাহ্মণত্ব স্পষ্ট, মনে হবে বাংলাদেশে এদের বাইরে কেউ ভালো কবিতা লেখেন না, এবং তাদের ‘নির্বাচন’ই খাঁটি। এই প্রবণতা অন্যদের মধ্যে থাকলেও তাদের চক্ষুলজ্জা বা বিবেচনাবোধ বোধহয় একটু বেশি। তাই তাদের কবির সংখ্যাও বেশি।

 অন্যদিকে সব বিখ্যাতরা সব পত্রিকায় লিখেন না বা লিখে উঠতে পারেন না। আবার তাদের ‘সেরা’ লেখাটি পাওয়ার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে, এর মধ্যে যাদের সঙ্গে যে লেখকের ‘ক্ষমতা’সম্পর্ক, অন্তরঙ্গতা পরন্তু অর্থসামর্থ্য থাকে, তারা অগ্রাধিকার পান। আবার অনেক লেখককে ফরমায়েশও দেওয়া হয়, এর চাহিদার শীর্ষে থাকে উপন্যাস। কারণ উপন্যাসের বাজার ‘ভালো’। কোনো কোনো উপন্যাসের জন্য বিজ্ঞাপনদাতারা প্রতি পৃষ্ঠার জন্যও স্পন্সর করে থাকেন। কারণ কর্পোরেট পুঁজি জানে ব্যবসায় ও মুনাফার জন্য কীভাবে শিল্প-সাহিত্যকে ব্যবহার করতে হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে লেখক বুঝে চাহিদা জানানো হয়।

এ বছর এ প্রতিযোগিতায় সম্ভবত এগিয়ে ‘কালের কণ্ঠ’। বিরল ঔপন্যাসিক হিসেবে হাসান আজিজুল হকের এবারের একমাত্র উপন্যাসটি (সাবিত্রী উপাখ্যান) প্রকাশ করেছে তারা। তাদের ঔপন্যাসিকের তালিকায় আরো আছেন দেবেশ রায়, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, জাকির তালুকদার ও সালমা বাণী।

গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের ঈদ সংখ্যাগুলোতে ভারতীয় লেখকদের লেখা ছাপানোর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় লেখকদের লেখা ছাপানোর ব্যাপারে এগিয়ে আছে ‘অন্যদিন’, ‘যুগান্তর’, ‘সমকাল’। অন্যদিকে সিরিয়াস লেখকদের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল অধুনালুপ্ত ‘আজকের কাগজ’। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছেন শামীম রেজা। শামীম রেজা এখন ‘কালের কণ্ঠ’র সাহিত্য সম্পাদক। তিনি তার সেই ট্র্যাডিশনটি এখানেও ধরে রেখেছেন।   বেশ কজন ভারতীয় লেখক জায়গা পেয়েছেন এই ঈদ সংখ্যায়।

সাড়ে ৫০০ পৃষ্ঠার ‘কালের কণ্ঠে’ আরও আছে হুমায়ুন আহমেদের ভ্রমণ-উপন্যাস; রাবেয়া খাতুনের আত্মজীবনী; আবদুশ শাকুর, ফরিদুর রেজা সাগর এবং নাট্যকার সাঈদ আহমদ-পত্নী পারভীন আহমদের স্মৃতিকথা; ‘ইতিহাসের নায়িকা’ শিরোনামে নারীশাসক রাজিয়া সুলতানা এবং ইলা মিত্রকে নিয়ে মূল্যায়ন; খন্দকার মাহমুদুল হাসান ও হারুন রশীদের দুটি বিশেষ নিবন্ধ।

অনুবাদের ক্ষেত্রেও ‘আজকের কাগজে’র একটি বিশিষ্টতা ছিল, এখানেও সেটি আছে। অনুবাদগুলো করেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, শরীফ আতিক-উজ-জামান, দুলাল আল মনসুর। আছে মোস্তফা কামালের কল্পবিজ্ঞান; মোস্তফা মামুনের কিশোর উপন্যাস; বিপ্রদাস বড়ুয়া, মিহির সেনগুপ্ত, শাইখ সিরাজ, ফিরোজ আহমেদ ও পলাশ দত্তর প্রবন্ধ এবং বেশ কিছু কবিতা, গল্প ও ভ্রমণ।

সব ধরনের পাঠকের জন্যই পড়ার কোনো না কোনো উপাদান আছে ‘কালের কণ্ঠে’র এই সংখ্যাটিতে। এর প্রচ্ছদ করেছেন মাহবুবুল হক। সম্পাদনা নির্বাহী মাসুদ হাসান।

‘কালের কণ্ঠ’ সম্পর্কে শেষ করার আগে সম্পাদকীয়-র একটি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত। আমরা জানি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে ‘সম্প্রদায়’ বলা হয়। কিন্তু সম্পাদকীয়র প্রথম বাক্যটিতেই আছে ‘মুসলমান জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ’। তাহলে ‘জাতি’র কি সংজ্ঞা বদলে গেছে?

অনেক আয়োজন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে সাড়ে ৬০০ পৃষ্ঠার এবারের ‘সমকাল’ ঈদ সংখ্যা। বিষয় বৈচিত্র্য আর লেখক-তালিকা দুটোর ক্ষেত্রেই সমকাল বেশ এগিয়ে আছে।

এগারটি উপন্যাস, দুটি আখ্যান, ছয়টি নিবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক দুটি লেখা, তিনটি স্মৃতিকথা, ১৭টি গল্প, তিনটি ভ্রমণ, দুটি রম্য, কবিতা, বিনোদন, ফ্যাশন, রেসিপি, খেলা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ জমকালো আয়োজন তাদের।

সমকালের বিশেষ আয়োজনের মধ্যে রয়েছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হুমায়ুন আজাদ ও জিয়া হায়দারের চিঠিপত্র এবং ‘বিপন্ন প্রকৃতি’ ও ‘চিত্রশিল্পীর জগৎ’ শিরোনামে দুটি ক্রোড়পত্র।

সমকালের লেখক তালিকায় আছেন কবীর চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মোজাফফর আহমদ, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, মুনতাসীর মামুন, হুমায়ুন আহমেদ, রাহাত খান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবুল বাশার, বুলবুল চৌধুরী, নাসরীন জাহান, ধ্রুব এষ, সৈয়দ ইকবাল,  ওয়াসি আহমেদ, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, ড. রেজা খান, ইনাম আল হক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, রফিকুননবী, মনিরুল ইসলামসহ অনেকে।

‘সমকাল’ ঈদ সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন মাহবুব আজীজ। প্রচ্ছদ আনিসুজ্জামান সোহেল।

সচরাচর যা করে থাকে, এবারও তা-ই করেছে ‘যুগান্তর’। বেশ কিছু উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা-স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, ছড়া, রম্য রচনা, খেলা ও বিনোদন নিয়ে তাদের আয়োজন। তাদের লেখক তালিকায়  অনেকের মধ্যে আছেন আছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আন্দালিব রাশদী, কিন্নর রায়, অভিজিৎ সেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ফারুক চৌধুরী, কামাল হোসেন, এম আর খান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, পবিত্র সরকার, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অনুপম সেন, জামাল নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মফিদুল হক, শাহরিয়ার কবির, ওমর কায়সার, শাহনাজ মুন্নীসহ অনেকে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম পত্রিকার মধ্যে ‘ইত্তেফাক’ গত বছর তিনেক ধরে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করছে। তবে এবারই প্রথমবারের মতো এতে পেশাদারিত্ব ও বৈচিত্র্যের ছাপ দেখা গেছে। আত্মকথা, ডায়েরি, খণ্ডস্মৃতি, ফিরে দেখা, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, সাক্ষাৎকার, ভিন্ন রচনা, মুক্তগদ্য, নিসর্গ ইত্যাদি শিরোনামে বেশ কিছু ভিন্ন ধরনের রচনা প্রকাশ করেছে তারা। এর বাইরে আছে গল্প-কবিতা-উপন্যাস শিশুসাহিত্যসহ নানা কিছু।

এর লেখক তালিকায় আছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ, গোলাম সারওয়ার, নাসির আলী মামুন, নূরজাহান বোস, হাসান খুরশীদ রুমী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, কাজী আনোয়ার হোসেন, মুসা ইব্রাহিম,  রকিব হাসান, অদ্বয় দত্তসহ অনেক। পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার ‘ইত্তেফাক’ ঈদ সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন রাজীব নূর। প্রচ্ছদ আজহার ফরহাদ।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ধারার লেখকদের প্রাধান্য দিয়ে ঈদ সংখ্যার আয়োজন করে পাক্ষিক ‘অন্যদিন’। সেই ধারাবাহিকতা এবারও অক্ষুন্ন থাকলেও ভারতীয় লেখক হিসেবে আছেন কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পাঠকদের কথা মাথায় রেখে নানা আয়োজন করে থাকে অন্যদিন। এবারে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-শিশুসাহিত্যের পাশাপাশি আছে আবদুল মান্নান সৈয়দের অপ্রকাশিত রচনা, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ও চিত্রকলা, ফেরদৌসী রহমানের সাক্ষাৎকার, আবেদ খানের স্মৃতিকথা, ঈদের রান্না, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নিয়ে বেশ কিছু ফিচার। সাত শতাধিক পৃষ্ঠার অন্যদিনের সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। প্রচ্ছদ : শিল্পী শাহাবুদ্দিন।

শাহাদত চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ ‘বিচিত্রা’র যোগ্য উত্তরসূরি। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-স্মৃতিকথা-সাক্ষাৎকার-অনুবাদ-ভ্রমণ ইত্যাদি প্রথাগত বিষয়ের বাইরে এর আকর্ষণ গবেষণা এবং ভিন্নধর্মী ফিচার। সেই ধারাবাহিকতা এবারও অক্ষুন্ন রয়েছে। এ সংখ্যাটিতে আছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় লেখা। সাড়ে ৫০০ পৃষ্ঠার এই পত্রিকার সম্পাদক মঈনুল আহসান সাবের। প্রচ্ছদ সৈয়দ ইকবাল।  

‘জনকণ্ঠ’ তার নিজের ধারাবাহিকতায় এবারও প্রকাশ করেছে ঈদ সংখ্যা। প্রচলিত বিষয়গুলির সঙ্গে এবার জনকণ্ঠের বিশেষ আকর্ষণ বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক কবির কবিতা। আছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একগুচ্ছ প্রবন্ধ। সাড়ে ৫০০ পৃষ্ঠার এই ঈদ সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছেন হাশেম খান।

‘ভোরের কাগজ’ বেশ কিছু উপন্যাস, অনুবাদ উপন্যাস, গল্প, অনুবাদ গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, চিত্রকলা, কাব্যনাট্য, তথ্যপ্রযুক্তি, কবিতা ও ফিচার দিয়ে সাজিয়েছে তাদের সংখ্যা। এটা তার নিজস্ব ধারাবাহিকতা। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এই ঈদ সংখ্যাটি সম্পাদনা করেছেন রনজু রাইম। প্রচ্ছদ সব্যসাচী হাজরা।

প্রথার একটু বাইরে গিয়ে তাদের ঈদ সংখ্যা বের করেছে ‘সাপ্তাহিক’। বাংলাদেশের ঈদ সংখ্যাগুলোর প্রায় অনিবার্য উপাদান উপন্যাস। কিন্তু ‘সাপ্তাহিক’ এবার কোনো উপন্যাস প্রকাশ করেনি। বরং তারা বিভিন্ন থিমকে প্রধান্য দিয়েছে তাদের আয়োজনে। এবার তাদের থিম আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিকথা। এছাড়া রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশিদুল হাসানের ডায়েরি, সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গ ও প্রসঙ্গের লেখা, তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে আনিসুজ্জামানের মূল্যায়ন; গল্প, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, ভ্রমণ, কবিতা, ছড়া ও ফিচার। ৫০০ পৃষ্ঠার এ সংখ্যাটির সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা। প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ।

গত দু বছর ধরে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করছে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। প্রচলিত ঈদ সংখ্যার সব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেছে তিন শতাধিক পৃষ্ঠার এ সংখ্যাটি। আছে উপন্যাস, গল্প, কবিতা, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাজনীতি, রম্য, ভ্রমণ, নাটক, অনুবাদ, ফিচার ইত্যাদি। সম্পাদক শাহজাহান সরদার। প্রচ্ছদ হাশেম খান।

এবারই প্রথম ছোটকাগজ থেকে বাণিজ্যিক ঈদ সংখ্যার দিকে মোড় নিল শিল্প ও সাহিত্যের কাগজ ‘ডাকটিকিট’। অফসেট কাগজে ছাপা প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার এ ঈদ সংখ্যাটিতে প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণ ও নবীনদের অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, দুর্লভ রচনা, সাক্ষাৎকার, অনুবাদ, পত্রসাহিত্য, ছড়া, নাটক, ভ্রমণ ইত্যাদি সাহিত্যকেন্দ্রিক লেখা স্থান পেয়েছে এতে। নতুন হিসেবে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও তাদের আয়োজনকে অভিনন্দন জানাতে হয়।

এবারই প্রথম রাজশাহীর দৈনিক ‘সোনার দেশ’ প্রকাশ করল ঈদ সংখ্যা। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এ হ্রস্বকায় ঈদ সংখ্যাটিকে যে কোনো মাঝারি জাতীয় দৈনিকের আয়োজনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। লেখক তালিকা থেকে বিষয়বিন্যাস সব কিছুর মধ্যে বেশ পেশাদারিত্ব রয়েছে। লেখক তালিকায় আছেন হাসান আজিজুল হক, শামসুজ্জামান খান থেকে শুরু করে মাকিদ হায়দার, রণজিৎ দাশ, জুলফিকার মতিন, ইমদাদুল হক মিলনসহ বহু নবীন-প্রবীণ লেখক।

বিষয় হিসেবে আছে ঈদস্মৃতি, প্রবন্ধ, রবীন্দ্রস্মারক গদ্য, কবিতা-অনুবাদ কবিতা, গল্প-অনুবাদ গল্প, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র ভাবনা, ফ্যাশন, ঈদের রান্না ইত্যাদি।

ঢাকাকেন্দ্রিকতার বাইরে এমন একটি আয়োজনকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। এই ঈদসংখ্যাটি সম্পাদনা করেছেন শামীম হোসেন। প্রচ্ছদ রাজীব রায়।

এবারের বিভিন্ন ঈদ সংখ্যায় কবিদের তালিকায় আছেন আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, সানাউল হক খান, অসীম সাহা, হাবীবুল্লাহ শিরাজী, নাসির আহমেদ, কামাল চৌধুরী, তুষার দাশ, ইকবাল আজিজ, জাহিদ হায়দার, আসাদ মান্নান, মোহাম্মদ সাদিক, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, খালেদ হোসাইন,  সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ফরিদ কবির, রেজাউদ্দিন স্টালিন, সরকার মাসুদ, হারিসুল হক, জুয়েল মাজহার, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, কামরুল হাসান, মজিদ মাহমুদ, চঞ্চল আশরাফ, হেনরী স্বপন, সরকার আমিন, রাজু আলাউদ্দিন, শামীম রেজা, মজনু শাহ, আলফ্রেড খোকন, সৈকত হাবিব, মোস্তাক আহমাদ দীন, মাহবুব কবির, সাখাওয়াত টিপু, জাফর আহমদ রাশেদ, রনজু রাইম, ফেরদৌস মাহমুদ, নওশাদ জামিল, চন্দন চৌধুরী, পিয়াস মজিদ, এমরান কবির, বিজয় আহমেদ, রুদ্র আরিফসহ শতাধিক কবি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : একই লেখক বিভিন্ন ঈদ সংখ্যায় লিখেছেন। তাই একই লেখকের নাম বারবার উল্লেখ করা হয়নি। বরং ব্যতিক্রমটাই উল্লেখ করা হলো।

ই-মেইল : [email protected]   

বাংলাদেশ সময় ২১৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।