ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের খোঁজ মিলল ১৮ বছর পর

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১১
কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের খোঁজ মিলল ১৮ বছর পর

‘শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে/ এবার নিষ্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে/গিয়ে, দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব/ অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই পুড়ে ছাই। ’-- এ কবিতার লাইনগুলো যিনি লিখেছিলেন তিনি অনেক বছর ছিলেন নিরুদ্দেশ, লোকচক্ষুর আড়ালে।

তিনি আশির দশকের কবি বিষ্ণু বিশ্বাস।

সম্প্রতি ১৮ বছর পর মিলল তার সন্ধান, তিনি রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা।

আশির দশকের এ কবি  জন্মগ্রহণ করেন ঝিনাইদহ জেলার বিষয়খালিতে ১৯৬২ সালের ২৯ মে। ঝিনাইদহের নলডাঙা ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৭৯’ সালে এস এস সি এবং ৮১ সালে ঝিনাইদহ সরকারি কে সি কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে। সেখানে পড়ার সময় তিনি যুক্ত হন ছোটকাগজ ‘পেঁচা’ সম্পাদনার সঙ্গে। পরে ৮৫ সালে অনার্স পাশ করে চলে আসেন ঢাকায়।

এখানে এসেই ভিড়ে যান সমসাময়িক ঢাকার কবিদের সঙ্গে। এলোমেলো বোহেমিয়ান জীবনযাপন করতে গিয়ে যেন হোঁচট খান। অনেক সময় আর্থিক সংকটেও পড়েন। এরই মধ্যে শুরু হয় ভারতে বাবরি মসজিদ হামলা। এর প্রভাব পড়ে তখন বাংলাদেশেও। রাষ্ট্রের ওই পরিস্থিতিতে বিষ্ণু কি রকম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেলেন।

একটা সাদা গাড়ি অথবা ছুরি হাতে কেউ তাকে তাড়া করে ফিরছে--- এ রকম ভীতিবিচলিত হয়ে বেরিয়ে পড়তেন মাঝে মাঝে। অসংলগ্নতা বেড়ে যাওয়ায় তাকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় মনোচিকিৎসকের কাছে। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত। ডাক্তার সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ওপর জোর দিলেন। কিন্তু সব নজরদারি ফাঁকি দিযে হঠাৎ তিনি উধাও হয়ে যান। এরপর মাঝে মাঝেই তিনি এভাবে উধাও হয়ে যেতেন আবার ফিরে আসতেন।

ইতোমধ্যে ১৯৯৩ সালে একদিন তিনি চলে যান পশ্চিমবঙ্গে, তারপর বহু বছর তার তেমন কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।

২০১০ সালে হঠাৎ শোনা যায় তিনি বনগাঁয় আছেন। শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ এবং কথা একদমই বলেন না। পশ্চিমবঙ্গের কবি তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বিষ্ণুর খোঁজ জানান। সম্প্রতি কবি বিভাস রায়চৌধুরী তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি  মোবাইল ফোনে তার কয়েকটি ছবিও তুলেছেন। ছবি দেখে অবাক হতে হয়, তার আগের কান্তিমান চেহারার সাথে বতর্মানে ভাঙাচোরা বিধ্বস্ত  চেহারার অনেক ফারাক। বিষ্ণু যখন নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে, তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর। বর্তমানে তার বয়স ৪৯। ছবিতে সেই বয়সের ছাপ পড়েছে। চুল দাড়ি পেকে গেছে, অযতেœ অবহেলায় ভাঙ্গা গালে রুগ্নতার ছাপ।

কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের এক চিঠির মাধ্যমে জানা গেল, কলকাতা থেকে কবি ও সঙ্গীতকার মিতুল দত্তসহ  ঢাকা থেকে তাঁর বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা চেষ্টা করছেন তাঁর চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের। আমরা কামনা করছি খুবই শিগগিরই কবি বিষ্ণু বিশ্বাস ফিরে আসবেন স্বাভাবিক জীবনে।        
                               
এখন পর্যন্ত বিষ্ণু বিশ্বাসের প্রকাশিত কবিতার বই মাত্র একটি ‘ভোরের মন্দির’। আশির দশকে প্রকাশিত প্রসূন, গাণ্ডীব, পেঁচা এবং নব্বই দশকে প্রকাশিত নদী, দ্রষ্টব্য ইত্যাদি ছোটকাগজে তার কবিতা প্রকাশিত হত। বিষ্ণুর নিরুদ্দেশের পর তার বন্ধুদের আগ্রহে নিশাত জাহান রানার ভূমিকাসহ ২০০১ সালে প্রকাশ করা হয় ‘ভোরের মন্দির’।

সেখান থেকে কয়েকটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

কালো মেয়ে

শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে
এবার নিষ্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে
গিয়ে, দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব
অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই পুড়ে ছাই।

তারপর আমাদের নিমগাছটির পাশে নদী
কদমগাছটি আছে অন্যদের মুঘলের ঘাটে
তুমি আছো কালো মেয়ে সন্ধ্যা স্নানের ঝংকৃত দূরে
আমি ভালোবেসে ভুলে তোমাকে জ্বালিয়ে দিই নাই।

১৯.০৬.৯১

বলবার ছিল

জায়গা ছিল না কোনো কথা বলবার, শুনবার।
সমুদ্রের ধারে যেতে পথের বাদাম গাছগুলি
মিহি কথার কৌতুকে পাথর ফুলের ধাক্কা দিল
আমি কী বলেছিলাম, তোমরা যারা শুনেছো বেশি
 শোনাবে--একটু খানি। আমি ভুলে গেছি জন্ম আছে।
কিছু যন্ত্রণার কথা যেভাবে বলেছি মনে নেই
একটু আনন্দ কথা, গোলাপি স্তম্ভে স্থির রয়েছে
অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্র দেখি বালির স্তূপে।

গল্পের কুমার

ধরাতলে একদিন পৃথিবী এনেছে ধারাজল
দেবতা-চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।
বেড়াতে এসেছে এক গল্পের কুমার অসময়ে
তার অবসর ছিল। স্রোস্বতী কিনারে দেখেছে
নীল বাঁদরের হাট। দীর্ঘক্ষণ পলক পড়েনি
দেবতা-চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।
এমন গল্পের কবি অন্ধ হলে সৃষ্টি স্থিতি লয়
নিশ্চিহ্ন আলোর সখা, তোমাদের শোনা কোন গান
পাথরে স্থির হয়েছে। জ্যোতিষ্কের পরশ পাথর
সীমাহীন ঘটমানে, নিয়তির চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে
নীল পশমি ছাগল। হাটবারে হাটে বাঁধা থাকে।
পাইকারি কথামালা। শোরগোল গন্ডোলায় ভেসে
চলে যায় চলে যায় তারাদের পৈশুন্য আঁধার
ধরাতলে একদিন পৃথিবী এনেছে ধারাজল
দেবতা-চোখের আলো ক্রমে নিভে হয়েছে সকাল।


রাতের সঙ্গীত
(রুকু ও কমলকে)

গভীর সমুদ্রের নোনা হাড় নোনা দাঁতে তৃষ্ণা আমার
জল দেবে একটু আমাকে শীতল জলের প্রাণ?
শ্যাওলা শাড়ির বহু বহু নারী
তোমাদের ঝর্ণাধারা
শত শত পতাকার মতো হলদে সঙ্গীত হবে
যখন ভোর হবে, ভোরের আকাশের নীল চোখে
গান বন্ধ হোক, আপাতত থেমে যাক
কোলাহল কলস্বরে কাটে দুপুর বিকাল
গভীর রাতে আদ্য জলের তৃষ্ণা
আমার নোনা হাড় নোনা দাঁতের।

থেমে থাক, লাল লাল বোতলে সৌগন্ধ স্থির
জলভারে
অপূর্ব অন্তর উৎসারিত শান্ত কান্ত জল
তোমাদের
আর নোনা হাড়ের আঘাতে ঝরুক আদর?
নোনা দাঁতে নোনা হাড়ে।
তারপরে
সাগরের অজানা গুহায় মানব আমি দাঁড়াব এসে
সম্মুখে তোমার তোমাদের
ঝর্ণাধারা
শাদা শাদা পতাকার মতো হলদে সঙ্গীত হবে
যখন ভোর হবে ভোরের আকাশের নীল চোখে।

ঈশ্বরের জন্মজন্মান্তর

আমাকে পেরিয়ে গেলে তুমি পাবে এক ধূলিপথ
ডানে বাঁয়ে সবখানে শিলীভূত পাখিদের শব
মৃত্যু যেখানে অমর অমেয় জলের স্বপ্ন ধোয়া
বাঁশপাতা খড়খড়ি ঊষর দানোর লোহাগড়।
হয়ত থামতে হবে, বহুবার অনাত্মীয় শোকে
তোমার সোনালি জামা, হলুদ গন্ধের শাড়িখানা
উড়িয়ে নিয়েছে ঝড়। শুধু স্বপ্নের আঁধার-গান
তারাদের নীল জলে তোমাকে দিয়েছে কামরতি
তোমাকে বিয়োতে পারো আদি ঊষা, প্রথম বাগান?
দ্বিতীয় ঈশ্বর তবে তৃতীয় ঈশ্বর জন্মদানে
আবার মিলিত হবে সোনালি জামা হলুদ গন্ধে।
এই অনুবর্তনের গল্পে যে পথে গিয়েছে ধূলিপথ
ডানে বাঁয়ে সবখানে জাম আম সবুজ কথক
আমাকে পেরিয়ে গেলে নিশ্চিন্ত কল্পতরুর গাছ।

এক বৃদ্ধের গল্প

সূর্য ধীরে নিভে গেল। আকাশে গোলাপি একটা রঙ আস্তে অন্ধকারে হারাল। এক
বৃদ্ধকে ঘিরে আমরা বসে আছি কিছু তরুণ তরুণী। বহুকালের প্রাচীন। ও আমাদের
কিছু বলবে ভেবেছে, অথবা,
আমরা কিছু শুনব অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা কোনো কথাই বলছি না।
তারপর একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ- বৃদ্ধটির। নাভীপদ্মে সঞ্চিত যেন বহুকালের
গাঁজাময় গেজানো ধোঁয়া সে অসীমে ফুঁকে দিল।
‘আমি নেই, হয়ত ছিলাম’, শুরু হল এইভাবে তার কথা।
সে মরে গেছে কি বেঁচে আছে, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না তখন।
কে জানে, সে হয়ত শেষ থেকে শুরু করেছিল। তবে তার গল্প শুরু হলো সে সময়
যে সময়টিতে কেউ আমরা আর তৈরি নই এই গল্পটি শোনবার জন্য।
কিন্তু শুরুতেই একটি প্রাচীন তরবারির কর্মসিদ্ধির কথা বলে, সে আমাদের থমকে
দিয়েছে। তারপর কবেকার ওর জীর্ণ ব্যাগ থেকে রাশি রাশি ঝরা পাতার মতো টাকা
-টাকা, একে একে, মুঠো মুঠো বের করল, আর তাতে আগুন জ্বালাল।
পৃথিবীর যতসব সুগন্ধি বৃক্ষের পত্র, পোড়া মাংস আর ধূপগন্ধের মতো,
চন্দন বনের হাওয়ায় কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেইসব।
আমরা আবার ব্যাকুল হলাম- কী বলে, শুনবো ভেবে ঠিক তখুনি
সে তার পলকা দাড়িতে কিছুক্ষণ হাত বুলালো, মাথা থেকে টুপিটি পকেটে নিল এবং
হাসল, তীব্র মৃদুস্বরে বলল, ‘এবার তোমরা’।
তারপর দ্রুত ভিড়ের ভেতর কোথায় সে ডুব দিল
 কোনদিন, তারপরে, তাকে আমরা আর দেখি নি।

২১/২২.১১.৯২

বাংলাদেশ সময় ২০১০, আগস্ট ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।