ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

গল্প

কুয়াশার ধূম্রজাল চিরে...| ইব্রাহিম নোমান

কিশোর গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৭
কুয়াশার ধূম্রজাল চিরে...| ইব্রাহিম নোমান ছবি: সংগৃহীত

সকালের আকাশটা কুয়াশায় ঢাকা। সূর্যের দেখা পাওয়া কঠিন। আলস্যের চাদর মুক্ত করে কুয়াশার ধূম্রজাল চিরে পুব আকাশে সূর্য নিজেকে জানান দেয়ার অপেক্ষায়। কোমল সূর্যরশ্মিতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো মুক্তোদানার মতো ঝলমল করে। গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ আর পাখিদের কলরব আন্দোলিত করে গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে। কী স্নিগ্ধময় গ্রামবাংলার শীতের সকাল!

শহুরে জীবনের কথা বাদ দিলে গ্রামীণ জীবনে শীতের সকাল অনেকটা স্মৃতিময় হয়ে ওঠে। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার আলস্য জড়িয়ে থাকে শরীরজুড়ে।

চোখ খুললেও শরীর নামতে চায় না বিছানা থেকে।

কুয়াশা ভেদ করে যখন সকালের প্রথম সূর্যটা উঁকি মারে; তখন ঝলমল করে ওঠে চারপাশ। চাঞ্চল্য ফিরে পায় মানুষ। কর্মব্যস্ত মানুষ ছোটে কাজে। বৃদ্ধ-শিশুরা সকালের রোদে গা পেতে দেয় পরম আনন্দে। শীতের তীব্রতায় বা শৈত্যপ্রবাহে আগুন জ্বেলে চারিদিকে বসতে দেখা যায় কখনো কখনো।

শীতের সকাল উপভোগ্য হয় পিঠা-পায়েসে। বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি হয় শীতকে ঘিরে। রাতে পিঠাগুলো তৈরি করে খেজুর রসে ভিজিয়ে পরদিন সকালে পরিবেশন করার রেওয়াজ আছে গ্রামাঞ্চলে। হালকা রোদ গায়ে মেখে শীতের পিঠাপুলি আস্বাদন বহু বছরের পুরনো রীতি বা ঐতিহ্য।

শহুরে জীবনে শীতের সকাল আমাদের প্রলুব্ধ না করলেও গ্রামীণ শীতের সকাল আমাদের কাছে স্মৃতিময় হয়ে ওঠে। সারা বছরের স্বাভাবিক পোশাকের চেয়ে ভারি পোশাক আমাদের জন্য অপরিহার্য হয় তখন। কিছু বাড়তি অনুষঙ্গ যুক্ত হয় শরীরের সঙ্গে। কেননা শহরের চেয়ে গ্রামের শীত যেন আগে আসে। নভেম্বরের শুরু থেকেই গ্রামাঞ্চলে শীতের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। তবে শহরে ডিসেম্বরের আগে শীত তেমন অনুভূতই হয় না।

গ্রামাঞ্চলে শীতের সকালে আড্ডাটা জমে ওঠে। রাস্তার পাশে, চায়ের দোকানে, খোলা মাঠে ভিড় জমতে থাকে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যুক্ত হয় সে আড্ডায়। ছয়টি ঋতুর মধ্যে তাই শীতকালটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। স্মৃতিময় হয়ে থাকে সবার কাছে। যদিও দরিদ্রের শীতের সকাল হাড়কাঁপানো আর বিত্তশালীর শীতের সকাল আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। তবু আমরা চাই শীত আসুক! আসুক প্রাকৃতিক সমৃদ্ধি! শাক-সবজিতে ভরে উঠুক গ্রামের মাঠ কিংবা আঙিনা।

এক শীতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই। পুবের জানালা চিরে সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে উঠি। কিন্তু কনকনে শীতের কারণে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে আছি। হঠাৎ হিমেল বাতাসে ভেসে আসা মিষ্টি গন্ধ আমাকে মুগ্ধ করে। কৌতূহল নিয়ে বাইরে এসে দেখি উনুনে খেজুর রস জ্বাল দেয়া হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে শীতের নানা পিঠাপুলি।

শিশিরভেজা মেঠোপথে একদল শিশু খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গী হলাম। কিছুটা পথ এগোতেই চোখ দুটি জুড়িয়ে গেল সরিষাখেত দেখে। যেন হলুদের চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কী অপরূপ প্রকৃতি!

শুকনো এ ঋতুতে এ সময়টা শুকিয়ে আসে খাল বিলের পানি। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও বা খটখটে চর জাগে। আর তাই গ্রামের দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা মেতে ওঠে অল্প পানিতে মাছ ধরার উৎসবে। সেইসঙ্গে খাবারের খোঁজে খাল-বিল আর মাঠে-ঘাটে ঝাঁকে ঝাঁকে নামে সাদা বকের ঝাঁক। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদাফুলের মত বসে থাকা বকের শুভ্রতা সেও এক অপরূপা দৃশ্য।
 
গ্রামও শহরের হাঁট-বাজারগুলোতে সবজীপসারীর ডালায় ডালায় থরে থরে সাজানো শীতের সব্জী ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, শালগম, ওলকপি, গাজর, টমেটো চোখ জুড়ায়, মন ভরায়।
শীতের আরেক স্বর্গীয় সৌন্দর্য বিরাজ করে সরিষা ক্ষেতে। মাঠের পর মাঠজুড়ে ফুটে থাকা হলুদ সরিষার ফুল যেন বিছিয়ে রাখে হলুদ ফুলেল চাদর। আর সেই ফুলকলিদের উপর উড়ে চলা রঙিন প্রজাপতি আর মৌমাছিদের মেলা মন হরণ করে। মটরশুঁটি আর সবুজ ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকে শিশির বিন্দু। সকালের রোদের আলোকছটার নানা রঙ ছড়ায় তাতে হীরক দ্যুতি। একসময় সেই রঙিন জলমোতি টুপ করে ঝরে পড়ে মাটির কোলে।

পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেনো সে সৌন্দর্য্যরে তুলনা হয় না বুঝি আর কিছুর সাথেই এই মর্ত্যলোকে!

ছোটবেলায় খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। ফলে শীতের প্রভাব আমাকে খুব একটা বিচলিত করতে পারেনি। আবার আমার বেড়ে ওঠা শহরে। শহরে ইট-কাঠ-পাথরের দেয়াল আর অহরহ গাড়ির অবিরাম ছুটোছুটিতে শীতের প্রভাবটা গ্রামের তুলনায় একটু কম অনুভূত হয়। আধুনিক প্রতিযোগিতার যুগে জীবন গাড়িকে সচল রাখতেই শহুরে যান্ত্রিক ছুটে চলা। কিন্তু শহরের তুলনামূলক কম শীতকে উপেক্ষা করে গ্রামের হাড়কাঁপানো শীত অনেক বেশি উপভোগ্য। শীত এলেই মনে পড়ে ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা। গ্রামের সেই শীতের সকাল আজও হৃদয়কে টানে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির খুব কাছে।

মাঘের এই দিনগুলোতে উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে শীতবুড়ির হিমশীতল নিঃশ্বাস। ধরণী হঠাৎ হয়ে পড়ে জড়সড়। বিবর্ণ হলুদ পাতারা চুপিসারে খসে পড়ে পথের ধুলায়। শীতের দীর্ঘ রাতের কুয়াশার আবরণ গায়ে মেখে সুবহে সাদিকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। তখন গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভাঙে মানুষের। ঠাণ্ডা পানিতে অজু করে নামাজে দাঁড়ায় বড়রা। ছোটরা লেপের নিচে দাদা-দাদির গা-ঘেঁষে গল্প করে, ছড়া কাটে মিষ্টি সুরে। ছোটবেলার অনেকেরই শীতের স্মৃতিগুলো এমনই। বর্তমানে শহর এবং গ্রামে শীতের আবহগুলো সত্যিই ভিন্ন রূপ তৈরি করে আমাদের মাঝে।

গ্রামের কৃষকরা সেই সকালবেলা শীত উপেক্ষা করে লাঙ্গল-গরু নিয়ে ছোটে মাঠের দিকে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গেলেই তারা হারিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে, গাছিরা খেজুর গাছ থেকে পেড়ে আনে রসের হাঁড়ি। গাছতলাতেই গাছের মালিকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে রস। তারপর ভাগের রস কাঁধে করে ছোটে বাড়ির পথে। সেই সকালেই রস জ্বাল দিয়ে তারা তৈরি করে গুড় আর পাটালি। রোদে উঠোনে পাটি বিছিয়ে ছেলেমেয়েরা কাঁচা রসে চুমুক দিয়ে কাঁপে থরথরিয়ে। তবু খেজুরের কাঁচা রস তাদের চাই-ই চাই। কোনো মা আবার সেই ভোরবেলা ওঠে ভাঁপা পিঠা তৈরি করে লেপ-কাঁথার নিচ থেকে ডেকে তোলেন তাদের ছেলেমেয়েদের। গরম পিঠার লোভে ছেলেমেয়েরাও হৈ হৈ করে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। গ্রামে যারা বাস করে বলতে গেলে তারা প্রায় সবাই গরিব। শীতের সকালেও খালি পায়ে থাকে অনেকে। শীত নিবারণের জন্য তেমন কোনো গরম কাপড়ও তাদের নেই। যে কারণে শীতের সকালে প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতেই ছোট-বড় সবাইতে খড়কুটা জ্বালিয়ে শরীর থেকে শীত তাড়াতে দেখা যায়। তবু শীতের সকালটা দুর্লভ এক মজার মতোই মনে হয় সবার কাছে।

শহরের শীতের সকাল গ্রামের মতো নয়। এখানে সকালের মিষ্টি আলো ফোটার আগেই কাকের কা-কা রবে শহরবাসীর ঘুম ভাঙে। তবু লেপের নিচে মিষ্টি উত্তাপে আবার ডুবে যায় গভীর ঘুমে। যদিও এখানে গ্রামের মতো শীত এত তীব্র নয়। শহরে কল-কারখানা, গ্যাসের চুলা আর অতিরিক্ত ঘন বসতির কারণে এখানকার মানুষ বুঝতেই পারে না হাড় কাঁপানো শীতের কি যন্ত্রণা। তবু বস্তি, ফুটপাত আর রেল স্টেশনের খোলা জায়গায় যেসব মানুষ ঘুমায়, তারা ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। তাই তো সকালে সূর্যের তাপ তাদের শরীরের হিম কুয়াশা চুষে না নেয়া পর্যন্ত তারা জাগতে পারে না। কেউ আবার জেগে ওঠে ছেঁড়া কাগজ জ্বেলে আগুন পোহায়।

শীতের সময় যেন পোশাকের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় শহরবাসীর মধ্যে। ঘুম থেকে ওঠে তারা নাশতা খেয়ে, এক কাপ চা পান করে দিনের কাজ শুরু করে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়। গ্রামের মতো এখন শহরেও দেখা যায় সকাল-বিকাল রাস্তার মোড়ে মোড়ে চিতই আর ভাঁপা পিঠা তৈরি করছে কেউ কেউ। বিক্রিও হয় প্রচুর। শহর এলাকাতেও অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে থাকে প্রতি বছর। মিরপুর চিড়িয়াখানার লেকে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ঝিলে অগণিত অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয় গোটা এলাকা। শহরবাসী পরিবার-পরিজন নিয়ে কাক ডাকা ভোরে পাখি দেখতে চলে যায় ঝিল আর লেকের ধারে।

শীতের সকাল দাগ কেটে যায় প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যে। আবার অপেক্ষায় বছর গড়ায়, নানা সাজে সাজা শীতের এমন মধুর সকালের জন্য। স্মৃতিরা কখনো আনন্দের কখনো বেদনার। বেদনাময় স্মৃতিও মানুষের সহমর্মিতা বা সহযোগিতায় আনন্দময় হতে পারে। হতে পারে সবার জন্য মঙ্গলময়। তাই তো তীব্র শীতে মানবতার ডাকে দরিদ্রের পাশে দাঁড়ান বিত্তশালীরা। একই আঙিনায় শীতের চাদরে জড়াজড়ি করে উপভোগ করেন সুখময় স্মৃতি। তাই বলি, শীত হোক মঙ্গলময়! শীতের সকাল হোক স্মৃতিময়!

[লেখক: শিশু সাহিত্যিক, সাংবাদিক]

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৭
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।