ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কবির চিরকালের মূর্তি

সৈকত হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১১
কবির চিরকালের মূর্তি

আজকের দিনে কি কবিতা ক্রমশ তার মূল্য হারিয়ে ফেলছে? তার হাত ধরে কবিও? যদিও পৃথিবীকে গভীর শুশ্রূষা দিয়ে চলেছে কবিতা বহুকাল, এমনকি লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারের আগে থেকে, তবু আজ কী হলো পৃথিবীর, সে কেবলই কবিতা থেকে দূরে-দূরে সরে যাচ্ছে?

আজকের পৃথিবীর সাহিত্য যেন অনেকটাই কথাসাহিত্য-নির্ভর হয়ে পড়েছে, বিশেষত উপন্যাস। এই ব্যস্ত পৃথিবীতেও তাই শত শত পৃষ্ঠার উপন্যাস পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে।

মিডিয়ার বেস্ট সেলার তালিকার দিকে-দিগন্তে কেবলই উপন্যাস আর উপন্যাস, মাঝেসাঝে অন্য কিছু : আত্মজীবনী, রাজনৈতিক বই, নন-ফিকশনের নানান ধরন। কিন্তু এখানে কোথায় কবিতা? এমনকি নোবেলের মতো বিশ্বসাহিত্যের মোড়ল পুরস্কারটি আর অন্যান্য যত দামি সাহিত্য পুরস্কার, সেখানেও উপন্যাস আর ঔপন্যাসিকেরই জয়জয়কার। এসব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কথাসাহিত্য ক্রমশই বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে, আর কবিতা আন্তর্জাতিকতা থেকে সরে হয়ে পড়েছে দৈশিক ও আঞ্চলিক।

তাই বলে কি কবিতার মৃত্যুঘণ্টা বেজে চলেছে দিকে দিকে? তা-ও তো নয়। আজও কত-শত তরুণ স্বপ্ন বুনে চলেছে কবিতার ভেতর দিয়ে, কবিতার ডানায় ভর দিয়ে জীবনের বিস্তীর্ণ-কুটিল পথে ভেসে চলেছে। এ কেবল বই, পত্রপত্রিকা বা ছোটকাগজে কবিতার প্রকাশ দেখে মনে হয় না, বরং ব্লগ-ফেসবুকের মতো নতুনতর মুক্ত প্রকাশমাধ্যমে প্রযুক্তিপ্রবণ-তরুণদের রাজ্যেও বিস্তর দেখতে পাওয়া যায়।

তবু, কোথাও যেন মনে হয়, পৃথিবীর কী ওলটপালট হয়ে গেছে আজ। কবিতা সাহিত্যের রাজ্যে অপেক্ষাকৃত কমজোরি হয়ে পড়েছে হয়তো পাঠ ও প্রভাবের দিক থেকে। নইলে শিল্প-সাহিত্যের মক্কা প্যারিসেও কবিতা কেন আর মহার্ঘ্য নয়? আর এখনো যেসব কবির নাম উচ্চারিত হয় পৃথিবীজুড়ে, জীবিতদের মধ্যে, তারা প্রায়-সবাই পঞ্চাশ-ষাট দশকেরই মানুষ। আমাদের সমকালের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোনো কবির নামই তো শুনি না, কালেভদ্রে দু-একজন ছাড়া।    

এইসব যখন ভাবি, যখন মনে হয়, পৃথিবীটা কবি ও কবিতার জন্য বড় অচেনা ও রূঢ় হয়ে উঠেছে, তখন নিজের অজান্তেই সামনে এসে দাঁড়ায় শামসুর রাহমানের মুখ। আমাদের এই দরিদ্র ভূগোলে তিনি ছিলেন কবি। ইতি-নেতি সর্ব অর্থেই তিনি ছিলেন কবি। তবে তিনিও ছিলেন অন্য পেশাজীবী, সাংবাদিকতা করে জীবন চালিয়েছেন বহুদিন, যে রকম অন্য একটা-দুটো কাজ করে বেঁচে থাকতে হয় এই ভূগোলের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত লেখক-কবিকে (কারণ কেবল লিখে বাঁচার কোনো উপায় তো রাখেনি রাষ্ট্র ও সমাজ)। তবু যে গুটিকয় মানুষ আমাদের বাংলাভাষী ভূগোলে ছিলেন সম্পূর্ণ কবিতাজীবী, তিনি তাদেরই গভীর-সহোদর। কবিতার জন্য বাঁচা, কবিতার অন্তহীন পিপাসা, কবিতার ভেতরে জগৎ ও জীবন দেখা, কবিতায় সমকালের স্বপ্ন-সংগ্রাম-ইতিহাসকে সজীব রাখা,  নিজের জাতি ও ভূগোলের নিবিড় কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা, সর্বোপরি রক্ত-মাংস-মগজে কবিতাময় হয়ে জীবনযাপন করা এই এইসব যখন দেখি শামসুর রাহমানে, তখন খুব আশাবাদী হতে ইচ্ছে হয়। নিজের ভেতর শক্তি-প্রেরণা-সাহস পাই। মনে হয়, যদিও বড় কঠিন কবিতার জন্য বেঁচে থাকা, কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। আর প্রকৃত কবির পথ কবেই বা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল, এমন কি রাজানুকূল্যের যুগেও!

এখনকার পৃথিবী আমাদের আর দেয় না অবসর; দেয় না নিজের ভেতরকার ধ্যানী পৃথিবী, আত্মমগ্ন জগৎ কিংবা জীবনানন্দের ভাষায় নিজের ভেতরকার সারাৎসার আস্বাদ করার ফুরসত। আর ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে বিশ্বজুড়েই জীবনের চাবিটি আর আমাদের ব্যক্তিগত হাতে নেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। যদিও আগেও তেমন ছিল না, কিন্তু এরপর থেকে পুরোপুরিই বেহাত হয়ে গেল সব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-বৈশ্বিক নানামাত্রিক কারণে। আর এই চিরশোষিত, জনসংখ্যাকাতর, সম্পদসুষমাহীন স্বদেশ যেখানে দারিদ্র্য আর অস্তিত্বরক্ষার প্রতিদিনকার লড়াই, অন্তহীন অনিশ্চয়তা, সেখানে কবিতার মতো ‘অপ্রাপ্তি’র পথে হাঁটতে জীবন আমাদের ভয় দেখায়, সমাজ আমাদের চোখ রাঙায়, পরিবার হতাশ-মর্মাহত হয়।

কিন্তু প্রাপ্তি কি নেই, এত সব অপ্রাপ্তির পরও? কবির আজও সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্য ফুরিয়ে যায়নি। কবির সাংস্কৃতিক ক্ষমতাকে আজও সমীহ করা হয়, তার মিডিয়ামূল্য নানা কারণেই আছে। পাঠকের ভালোবাসা, নানা পারিতোষিক-পুরস্কার-খেতাব-প্রচার তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু সেসবই উপলক্ষমাত্র। তার কবিত্বের অবশেষ হিসেবে আসে। কিন্তু আজকাল যখন দেখি কবি নামধারীদের ক্ষেত্রে এসবই প্রধান হয়ে উঠে, ভালো কবিতা লেখার চেয়ে যেনতেনপ্রকারেণ কবিতাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন কবিযশোপ্রার্থীরা, প্রচারমাধ্যমে নিজেকে ভিখিরির মতো তুলে ধরেন, তখন বিবমিষা জাগে, ‘কবি’ নামে অরুচি আসে। যখন দেখি প্রবীণতম কবিটিও খেতাবের যুদ্ধে নিজেকে প্রাণপণ নিয়োজিত করেন, কবিরূপী ভাঁড়দের সমাবেশে নিজেকে প্রধান/শ্রেষ্ঠ ভাঁড়রূপে নিযুক্ত করেন, তখন মনে হয়, কবির তবে এই-ই পরিণতি! প্রচারলিপ্সা, খ্যাতিলোভ, ভাঁড়ামো, ক্ষমতার ননিমাখনের ভাগ পাওয়ার উদগ্র বাসনা, মেরুদ-হীনতা, চাটুকারিতা আজ যেন কবির নামের সঙ্গে কেমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে। অথচ আমরা যে কবির মূর্তি লালন করি, তিনি অন্য কেউ, তার চেহারা ভিন্ন।

এই যে প্রচারের মহামারী, ভোগ ও ভাগের কাড়াকাড়ি, খ্যাতিবাসনা, এগুলোর বন্য প্রকাশ দিয়ে আজকের দিনের বহু ‘কবি’ যেন অনেকাংশেই কবিতাকে ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হতে দিয়ে শুয়োরের মাংস করে তুলেছেন, আর তার কবি নামের ওপর লেপন করে চলেছেন কালিমা।

এই সব দেখে দেখে মনে হয়, কোথায় কবির সেই প্রফেটিজম, মনীষা, ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা আর ঋষিপ্রতিমতা। সবই যেন খেলো, ভাঁড়ামো আর নীচতা। কবিতার অন্তর্গত প্রাপ্তির বদলে বৈষয়িক প্রাপ্তির লোভ তাকে যেন খ্যাতিদস্যু, ভোগদস্যু করে তুলছে। যদিও এই চিত্র একমাত্র নয়, তবু অধিকাংশ।

এই সব মুহূর্তেও শামসুর রাহমান সামনে এসে দাঁড়ান, তাঁর স্নিগ্ধ-সৌম্য কবিকান্তি নিয়ে। কিন্তু এইসব বলে কি শামসুর রাহমানকে মানুষের বদলে দেবদূত বানিয়ে তুলছি? আমার এইসব ধারণা কি বড় সেকেলে নয়? কবির কি মানবিক দোষ থাকতে নেই?

কবি তো শেষ পর্যন্ত মানুষ, দোষেগুণে মিলিয়েই মানুষ কিন্তু বড় মানুষ। তাই মুশকিল হলো, কবির যে মূর্তি আদিকাল থেকে কিছুকাল আগে অব্দি আমার ধারণায় আছে, তার প্রেমিক-সাধক-তীব্র-দ্রোহী-মগ্ন-কোমল ও কঠিন রূপে, যেমনটি দেখি রুমি-রবীন্দ্রনাথ-গ্যাটে-জীবনানন্দ-নজরুল ও নেরুদায়, এমনকি পাস্তারনাক ও গিন্সবার্গে, দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া, আজকের প্রবীণ-নবীন কোনো কবিরই সেই চেহারা দেখা বড় দুর্লভ হয়ে উঠেছে। এইখানটাতেই মনে পড়ে শামসুর রাহমানকে।

samasur rahmanশামসুর রাহমান তার দীর্ঘ জীবনে বিস্তর লিখেছেন, তাই তার দুর্বলতাও বিস্তর (এটি রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও খাটে), অনেক মানবিক দুর্বলতাও রাহমানে ছিল। কিন্তু অর্ধশতাব্দীকালের কবিজীবনে নিজেকে, নিজের সময় ও স্বদেশকে যেভাবে তিনি পরতে পরতে দেখেছেন, ধারণ করেছেন, সহজ-নির্ভার প্রকাশ করেছেন, সর্বোপরি কবিতালিপ্ত থেকে জীবনের পথ হেঁটেছেন, এ কি খুব সহজ ব্যাপার? আমরা কি শামসুর রাহমানের কবিতার ভিতর দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনকেই পাঠ করি না : আমাদের ইতিহাসের, সংগ্রামের, অর্জনের, হারানো-প্রাপ্তি-স্বপ্নের? আর এর মধ্য দিয়ে কি তার সাধকপ্রতিম মূর্তিটিই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় না, যিনি কবিতার ধ্যানে মগ্ন এক ঋষি?

তাঁর জীবদ্দশায়, ৭৭তম জন্মদিনে (২০০৫) একটি ছোট্ট লেখা লিখেছিলাম ‘সংবাদ’ সাময়িকীর আহ্বানে। সেখানে বলেছিলাম, ‘শামসুর রাহমান বিপ্লবী বা বিদ্রোহী নন, ভবিষ্যদ্বক্তা নন, কিন্তু বিপ্লব-বিদ্রোহ-সংগ্রামের ভেতরের যে গভীর বাণী, তার নিবিড় অভিঘাত তিনি ধারণ করেছেন নিজের ভেতর। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে আমাদের জাতিরই অন্তর্গত স্বর, যা কেবল একজন গভীরতাচারী কবির পক্ষেই সম্ভব। ’
   
আর এই গভীরতা, এই ধারণক্ষমতা, যা তিনি লালন করেছেন তার ছোট্ট শরীরী অস্তিত্বের ভেতর, এটি তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়, করেছে সবার থেকে আলাদা। যদিও তিনি ছিলেন মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতায় মোড়ানো এক বাঙালি। অন্যদিকে তার সময়ে কবির চিরায়ত যে দায়, সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, তা তিনি পালন করেছেন কোমল দৃঢ়তায়, যেটুকু তার মধ্যবিত্ত মনের সাধ্যে কুলিয়েছে। আবার ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন বহু মানুষের আশ্রয়, তার মানবিক সত্তা বহু মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণেও সচেষ্ট ছিল।

আজও যে খুব সহজ সাধারণ ভাষায় কবিতা লেখা যায়, কবিতার ভিতর দিয়ে অগণন মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় আমরা সেটি ভুলতে বসেছি। ফলে আত্মরতি, কাঠিন্য আর স্বেচ্ছাচার হয়ে উঠেছে আমাদের কবিতার ভাষা, এটি আর ধারণ করছে না গণজীবনকে, ফলে তা হয়ে উঠছে জনবিচ্ছিন্ন। এসব কারণে মনে হয়, কবির যে মূর্তি আমরা আমাদের অবচেতনে লালন করি, আমাদের ভূখণ্ডে সেই মূর্তির সর্বশেষ রূপ বোধ হয় শামসুর রাহমান।


অন্যদিকে কবি যে আজও সর্বজনশ্রদ্ধেয়, তার উচ্চারণ যে আজও পৃথিবীর জন্য দরকারি, তিনি যে পৃথিবীকে শোনাতে পারেন মহাপৃথিবীর গান, অন্তরে জাগাতে পারেন বিশ্বাস ও শান্তি, পৃথিবীকে কোমল করে বলতে পারেন কঠিন কথা এবং যথেষ্ট দৃষ্টিগ্রাহ্য করে- এ দৃষ্টান্ত রেখে শামসুর রাহমান আজও কবিদের জন্য প্রেরণা হয়ে আছেন, যে প্রেরণা দেবার মতো আর একজন কবিও সম্ভবত এই মুহূর্তে জীবিত নেই। অথবা এমন কেউ কেউ হয়তো আছেন, যারা এখনো দৃষ্টিগ্রাহ্য নন, অথবা তিনি/তারা ধীরে ধীরে জীবিত হয়ে উঠছেন...

ই-মেইল : [email protected]

বাংলাদেশ সময় ২২১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।