ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কাগজের ফুল ও তারেক মাসুদের সঙ্গে সখ্য

সোহেল রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১১
কাগজের ফুল ও তারেক মাসুদের সঙ্গে সখ্য

বুধবার। সারারাত অফিস করে সকালে ঘুমুচ্ছিলাম বাসায়।

হঠাৎ মুঠোফোনের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। তারেক ভাইয়ের ফোন- ‘সোহেল, আজ তো তোমার ডে অফ। বিকেল তিনটার দিকে বাসায় এসো। কাগজের ফুলের স্ক্রিপ্ট শেষ। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ো। আমি ততক্ষণে চলে আসবো। ’

বিকেল তিনটায় গেলাম ফার্মগেটের মনিপুরী পাড়ার বাসায়। ড্রয়িং রুমের টেবিলে রাখা ‘কাগজের ফুলে’র স্ক্রিপ্ট। পড়া শুরু করলাম। ততক্ষণে আবার তারেক ভাইয়ের ফোন। ‘তুমি কি স্ক্রিপ্টটা পড়ছো? আমি সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছবো বাসায়। তোমার সাথে ডিটেল কথা বলব তখন, আমার স্বপ্নের এ ছবিটা নিয়ে। ’

বাবা মারা গিয়েছিলেন সোমবারে। বাবার দাফন ও অন্যান্য কাজ শেষে ফরিদপুর থেকে ফেরার পথে তিনি ফোনে বলছিলেন কথাগুলো।

১৯৪৭ এর দেশভাগের পটভূমিতে তৈরি কাগজের ফুলের স্ক্রিপ্ট। হিন্দু জমিদার রায় বাবু নদীর পাড়ে বাউল গানের আসর বসিয়েছে। ছবি আঁকিয়ে কিশোর মাযহারের প্রবল আগ্রহ দেখে কলকাতার আর্ট কলেজে তাকে ভর্তি করানোর আশ্বাস দেন রায় বাবু। মাযহারের বাবা আজহার সম্মতি না দিলেও খুব একটা বাধা দেয় না ছেলেকে কলকাতায় পড়তে যেতে। মাযহার কলকাতার আর্ট কলেজে ভর্তি হয়। পরিচয় হয় আর্ট কলেজের শিক্ষক শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে। পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ে  গণনাট্য আন্দোলনে। একপর্যায়ে সখ্য গড়ে ওঠে কলকাতার মেয়ে সহপাঠী মাধবীর সঙ্গে। ‘নবান্ন’ নাটক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। আসে রাজনীতি। নাটক নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিত্র। শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। অস্থির হয়ে পড়ে চারপাশ। হিন্দু-মুসলিমের দাঙ্গার মুখে পড়ে মাযহার ও মাধবী। বাংলাদেশে ফিরে আসে মাযহার। বাড়িতে দেখা হয় ছোট ভাই মিলন, বাবা আজহারের সঙ্গে। মিলনের খেলার সাথী আয়েশাকে ঘর থেকে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এক মৌলভী। প্রতিবাদ করে মাযহার। আবার কলকাতায় ফিরলে মাযহার দেখে দাঙ্গায় ক্ষত-বিক্ষত পরিবেশ। মানুষের নিরাপত্তা নেই কোথাও। সব কিছু পাল্টে যায়। মাধবীর ঘরে আশ্রয় পায় সে। ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে দু’জন। দেশ ভাগ হয়ে যায় ততদিনে। পুরনো মেসে গিয়ে মাযহার তার অসুস্থ বাবার চিঠি পায় দু’টি। মাধবীকে না জানিয়েই বাবার কথায় দেশে ফিরে মাযহার। রায় বাবুর চিঠি আসে। আজহার মারা যায়। বাবার কথা মতো আয়েশাকে বিয়ে করে মাযহার। তবুও ঠিক স্থির হতে পারে না সে।
Tareque-bhai-sm
দেশ বিভাগের ইতিহাস, মানুষের লোভ লালসা, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জমিদার প্রথা, বাঙালি মুসলমানের মন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, নাটক, চারুকলা, রাজনীতি, মানুষের বেচেঁ থাকার সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে কাগজের ফুলে মানবতার গান গেয়েছেন নিখুঁত বাস্তবতার আচঁড়ে।

স্ক্রিপ্ট পড়া শেষে গভীর একটা অনুভূতি কাজ করতে থাকল মনের ভেতর। একটা ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমি যেন পুরো ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। এমন অসাধারণ স্ক্রিপ্ট।

সন্ধ্যে ছুঁই ছুঁই। ফাঁকা বাসাটায় ছোটাছুটি করছিল নিশাদ। তারেক ভাইয়ের ছেলে। বয়স মাত্র এক বছর তিন মাস। আমার কোলে এসে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার উঠে গেল। বাসায় এলেন ক্যাথেরিন মাসুদ আর তারেক ভাইয়ের সহোদর নাহিদ ভাই। তারেক ভাই এলেন আরেকটু পর। বাসায় ঢুকেই বাবা বলে ডাক দিয়ে নিশাতকে কোলে নিলেন। চুমু খেলেন।

‘কেমন আছো সোহেল? পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় কাঁধে দায়িত্ব অনেক। সব শেষ করে আসলাম। বাবার কিছু স্মৃতিচারণ শেষে বললেন, কেমন লাগলো স্ক্রিপ্ট?`

সবিনয়ে বললাম, স্ক্রিপ্টের বিচার করার দুঃসাহস আমার হয়নি এখনো। তবে মনে হলো, আমি যেন ফেদরিকো ফেলিনি, তারকোভস্কি বা কিয়ারোস্তামির কোন একটা ছবির স্ক্রিপ্ট পড়ছি। অসাধারণ রিয়েলিস্টিক একটা স্ক্রিপ্ট।

আমার কথা শেষ না হতেই তিনি বললেন হুম, ঐ বিখ্যাত নির্মাতারা জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তববাদী চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। আমার কাগজের ফুলও অনেকটা এরকম। তুমি বলতে পারো-- মাটির ময়না, রানওয়ে, আর কাগজের ফুল আমার ট্রিলজি ফিল্ম।

তিনি আরও বলছিলেন, `অনেক বছর ধরে কাজ করছি এই ছবিটা নিয়ে। মাটির ময়না আর রানওয়ে হচ্ছে এ ছবিটির প্রস্তুতি ছবি। আমার জীবনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ। বাবার মৃত্যুটা যেন এখানে এসে আরও বাস্তব হয়ে উঠেছে। কাগজের ফুলের বাবা আজহার যেন অনেকটা আমারই বাবা। প্রথমত আমার বাবা ছিলেন প্রগতিশীল, গান-বাজনা-সংস্কৃতি নিয়েই থাকতেন। এটাকে বলা যেতে পারে তার জীবনের থিসিস। আর অ্যান্টি থিসিস হচ্ছে পুরো ধার্মিক একটা মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার এ বিশ্বাসের জায়গাটা ভেঙ্গে যায়। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না- এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। `

তারেক ভাই বলতে লাগলেন কাগজের ফুল নিয়ে:‌`অনেক গবেষণা পরিশ্রম করে বানিয়েছি এই স্ক্রিপ্টটা। আমাদের প্রজন্ম শুধু একাত্তর নিয়েই মেতে আছে। কিন্তু মূল শেকড় সম্পর্কে তাদের জানতে হবে। দেশের ইতিহাস জানতে গেলে প্রথমে দেশভাগের ইতিহাসটা জানতে হবে। এ ছবিতে আমি তার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এই ইতিহাস নিয়ে কিন্তু অনেকটা ইনটেনশনালি সে সময়কার লেখক-সাহিত্যিকরা কিছুই লেখেননি। `

তিনি বলেন, `স্ক্রিপ্টটি আমি কলকাতার কয়েকজন চলচ্চিত্র বোদ্ধাকে দেখালে তারা আমাকে বলেছিলেন, আর্টের দিকটা ফুটিয়ে তুলতে অনেক কঠিন হবে। আমি তবু অনেক গবেষণা করে সবটাই রেখেছি। এখন ফিন্যান্সিয়াল ও টেকনিক্যাল দু’দিকটাই রেডি। তবে কো-ডিরেক্টরিয়াল টিমটা এখনো গড়তে পারিনি ভালভাবে। `

`ছবিটির কাজ শুরু করেছিলাম মাটির ময়না বানানোর আগে থেকেই। কলকাতায় গিয়েছি এটি নিয়ে বহুবার। বাসাও একটা ভাড়া করেছিলাম। মানিকগঞ্জে শুটিং স্পট ঠিক করেছি। ওখানে  সেসময়কার কলকাতার চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য একটা ভাল জায়গা পেয়েছি। নদীতে বাঁধ তৈরি করেছি। এবারের বর্ষাটা আমাকে ধরতে হবে। সেজন্য রাতদিন কাজ করছি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে কয়েকটা সিকোয়েন্সের শুটিংও করে ফেলব। পরে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে লাগাতার তিন-চার মাস কাজ করবো। `
Eminent-filmmaker-Tarique
কাগজের ফুল নিয়ে তার স্বপ্নের কথা শুনে আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। বললাম, `তারেক ভাই, আমি ভাবছি জানুয়ারির দিকে সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি আপনার সঙ্গে কাজে নেমে পড়বো। ` অনেকটা ধমকের সুরেই তিনি বললেন,` না না। চাকরি ছাড়বে কেন? এখন যেভাবে কাজ করছো ওভাবেই করবে। আমি না হয় তোমাদের এডিটর আলমগীর ভাইকে বলে তোমার জন্য ছুটি চেয়ে নেবো। `

এমন সময় আমাকে কাগজের ফুলের মাযহারকে শিল্পী জয়নুল আবেদীনের করা একটি উপদেশ বাক্য শুনিয়ে বললেন, `আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেবে না কখনো। তুমি অফিস ছুটির দিনে আমার সঙ্গে কাজ করবে। বুঝতেই পারিনি এটিই যে হবে শেষ বিদায়। `

চলচ্চিত্র নিয়ে একটি অনলাইন জার্নাল করার স্বপ্ন ছিল তারেক ভাইয়ের। বলেছিলেন, `এটিতে কাজ করতে হবে তোমাকে। দেশের সিনেমা হলগুলো পুনরুদ্ধারে কাজ করছিলেন তিনি। এইতো কিছুদিন আগে, ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রানওয়ে’র প্রদর্শনী করতে তারেক ভাইয়ের সাথে গিয়েছিলাম। এসময় তিনি খুঁজে বের করেছিলেন সিনেমা হলে গিয়ে বোমায় আহত কিশোর মেহেদী মোস্তফা ও সলিমুল্লাহ বাবুকে। দুপুরের কড়া রোদের ভেতর পায়ে হেঁটে মূল রাস্তা থেকে অনেক দূর ভেতরে মেহেদীর বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি।

শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে শিল্পী-চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মিডিয়া কর্মী, ও স্বজনদের ভিড়। একটু পর পর চাপা কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে চারপাশ। কি দোষ করেছিলেন এই মানুষটা? কেন সড়ক দুর্ঘটনা? কেন বাঁচতে দিলো না এই খ্যাতিমান নির্মাতাকে? এদেশ কি পারবে আরেকজন তারেক মাসুদ বানাতে।

সাদা কাফনে মোড়া তারেক ভাই। কাগজের ফুল নিয়ে আর কোনো স্বপ্নের কথা নেই মুখে।   বেঁচে থাকার সব অর্থ মিছে করে দিয়ে চুপ মেরে ঘুমিয়ে গেলেন। পাশে দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা মিশুক মুনীর। তার পাশে মোস্তাফিজ, ওয়াসিম আর জামাল।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।