ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ : একের ভিতর অনেক

সৈকত হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১১
রবীন্দ্রনাথ : একের ভিতর অনেক

‘একজীবনে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শেষ করা যায় না’- বেশ আগে বলেছিলাম এক আলোচনায়। তাতে সভার অনেকে হো হো হেসে উঠেছিলেন।

কিন্তু পরে যখন কথাটা একটু দীর্ঘ করলাম, তাদের মুখ খানিক গম্ভীর হলো, এবং তাদের চোখে সম্মতির রেখা ফুটে উঠল। বলেছিলাম : রবীন্দ্রনাথ দশ বছর বয়সের আগেই তার লেখা শুরু করেছিলেন, এবং সেটি অব্যাহত ছিল তার মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত আশি বছর বয়স পর্যন্ত। তবে তথ্য হিসেবে এ কোনো আহামরি কিছু নয়। কিন্তু তথ্য হিসেবে যেটা জরুরি : রবীন্দ্রনাথ তার প্রায় শতাব্দীদীর্ঘ জীবনে চিন্তা-অভিজ্ঞতা-উপলব্ধির এমন সব ক্রমস্তর অতিক্রম করেছেন, তার দেখা এত সচল ও সর্বব্যাপ্ত, এবং এর প্রকাশও এত সংহত-সুনির্দিষ্ট-পরম্পরাপূর্ণ- তার সঙ্গে তাল রাখা যেমন দুরূহ, তেমনি ব্যক্তিপাঠকের পক্ষে এই পরম্পরাকে নিজের উপলব্ধির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য এক জীবনব্যাপী সাধনা আর অনুসন্ধান আর সময় দরকার। এ কেবল তার রচনারাশির কথা। এর বাইরে তার জীবনযাপন, ঘটনাবলি, কর্ম ও দর্শন, সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা, ভ্রমণ এবং অন্যান্য বিষয়ও যদি আমাদের আগ্রহের বিষয় হয়, তাহলে আরো বিপদ।

কাজেই একজীবনে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বোঝাপড়ার মতো পাঠ বড় বেশি পরমায়ু দাবি করে- তার তুলনায় আমাদের জীবন বড় নির্দয়ভাবে হ্রস্ব।

ওপরের কথাগুলো কেবল পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ বা তার সামগ্রিকতার জন্য। এবং আমার সভাবক্তব্য আমার জন্যই আতঙ্কজাগানিয়া। কিন্তু ও পথেই যেতে হবে কিংবা ওটাই একমাত্র উপায় তা তো নয়। বরং রবীন্দ্রনাথের ভেতরেই যেমন আছেন অনেক রবীন্দ্রনাথ, আবার আমাদের প্রত্যেকেরই আছেন নিজ নিজ রবীন্দ্রনাথ। কাজেই পূর্ণ হোক চাই খণ্ড, আমরা বেছে নিতে পারি আমাদের মতো করে, নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে।
 
আবার আরেকটা ব্যাপারও, আমরা রবীন্দ্রনাথের যে কোনো জায়গা থেকেই শুরু করতে পারি, এবং তা থেকেই কোথাও না কোথাও নিজের সঙ্গে খানিকটা বোঝাপড়াও করে নিতে পারি। রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক বিচারে তা খণ্ডিত হলেও আমাদের নিজের জন্য তা আপাত-পূর্ণাঙ্গও হতে পারে, আমাদের নিজস্ব চিন্তারসায়নে। এবং যদি তাতে দ্বিধাও তৈরি হয়ে থাকে, তার সমাধানও অনুসন্ধিৎসু হলে রবীন্দ্রনাথেই পাওয়া যেতে পারে বা তার সাহায্যে হতে পারে। তবে এর হয়তো দরকারও নেই, বরং যে সময়বিশ্ব ও বাস্তবভূগোলে আমরা অবস্থান করি, তার সঙ্গে মিলিয়েও একটা কোনো সিদ্ধান্তে বা গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যেতেই পারে : আমাদের সময়ের সঙ্গে তার সময়ের তুলনা করে, কিংবা রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী রচনা/মন্তব্য থেকে পরবর্তী/সর্বশেষ বিবেচনার সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে।

কেননা, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন সেই বাঙালি যিনি নিরন্তর সত্য-সন্ধান করে গেছেন; নিজের ভুল অবলীলায় স্বীকার নিজেই শুধরে নিয়েছেন (মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে তার তারুণ্যের ও পরিণত বয়সের লেখা দ্রষ্টব্য); আবার যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন, তা সময়-সমাজ-প্রচলের বিরুদ্ধে গেলেও তাতে অটল থেকেছেন (গান্ধীর চরকা-আন্দোলন সম্বন্ধে তার সংশয়, এমনকি যখন দেশজুড়ে সবাই ব্রতের মতো একে অনুসরণ করে চলেছিলেন)।

অন্যদিকে বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের এমন একটি সুনির্দিষ্ট অথচ অনিশ্চিত জায়গা আছে, যা মাত্র ছোট্ট একটি অনুচ্ছেদের ভেতরেই খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে, ১৯৫২ সালে :

‘বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হ’য়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে-মাংসে মিশে আছেন; তাঁর কাছে ঋণী হবার জন্য এমনকি তাঁকে অধ্যয়নেরও আর প্রয়োজন নেই তেমন, সেই ঋণ স্বতঃসিদ্ধ ব’লেই ধরা যেতে পারে- শুধু আজকের দিনের নয়, যুগে-যুগে বাংলা ভাষার যে-কোনো লেখকেরই পক্ষে। আর যেখানে প্রত্যক্ষভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘ’টে যাবে, সেখানেও, সুখের বিষয়, সম্মোহনের আশঙ্কা আর নেই; রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হ’য়ে, বিচিত্র হ’য়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে। ’
                                                                                               [সাহিত্যচর্চা]                                                                               

এই উক্তিটি ভক্তিগদগদ নয়, আবেগ থরোথরো নয়, বরং এর মধ্যে কবির দূরদৃষ্টি এবং সমালোচকের বৈদগ্ধ্যই বেশি অনুভব করা যায়। বুদ্ধদেব এই উক্তি করার প্রায় ষাট বছর পরও, এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শ বছর পেরিয়েও আমরা এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাকেই বরং প্রশ্নবিদ্ধ করব, কথা ক`টি এতই বাস্তব।

এখন নয়, বরং তার জীবদ্দশা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই আমাদের রক্তের গভীরের জিনিস। তাকে ছাড়া যেন আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর চলে না, যেমন করে বাতাস অদৃশ্য হলেও তাকে আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়। তাই বলছিলাম, বুদ্ধদেবের এ উক্তিটি কেবল সত্য নয়, একটি পরম সিদ্ধান্তের মতো, এর জন্য আমাদের চিন্তাভাবনারও বোধহয় দরকার নেই এ কারণে যে, আমাদের কেন্দ্র ও পরিধি, আমাদের বৃত্ত ও এর ভিতর-বাহির বড় বেশি রবীন্দ্রময়, বড় বেশি আমাদেরই দরকারে, প্রতিটি দিন। তবে অবশ্যই সে রবীন্দ্রনাথ অখ- নয়, বরং টুকরো টুকরো, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের নানা মাত্রা ও জ্ঞান, হিসাব ও বেহিসাবের মাপকাঠি, ব্যবহার ও অপব্যবহারের নানা হিসাব ও নিকাশে।

কিন্তু ওই যে বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথের ভেতরের আছেন অনেক রবীন্দ্রনাথ, আর আমাদের প্রত্যেকের আছেন ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ; কিন্তু এর বাইরেও তো আরো রবীন্দ্রনাথ আছেন। মোটা ও সূক্ষ্মভাবে তারও রকম-সকম বহু : রাষ্ট্রের রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বের রবীন্দ্রনাথ, পুবের রবীন্দ্রনাথ, পশ্চিমের রবীন্দ্রনাথ, সমাজের রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতির রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ, ভারতের রবীন্দ্রনাথ, প্রতিষ্ঠানের রবীন্দ্রনাথ, প্রতিষ্ঠানহীনতার রবীন্দ্রনাথ, বিজ্ঞানের রবীন্দ্রনাথ, যুক্তির রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতি ও পরিবেশের রবীন্দ্রনাথ... এভাবে একের ভিতর অন্তহীন রবীন্দ্রনাথকেও আমরা খুঁজে পেতে পারি। আর একেই নানাভাবে খুঁজে ও খুঁড়ে চলেছেন তার উত্তরসূরি কবি-লেখক-গবেষক-সমালোচকসহ নানা দেশের ও যুগের নানা জাতের মানুষ। আর ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে যা হয়ে গেছে গত একটা শতকে, সেগুলো পাঠ করার জন্যও আসলে আরেকটা জীবন দরকার।

Colour বলছিলাম, আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ রবীন্দ্রনাথের কথা। সে হিসেবে আমার নিজেরও এক রবীন্দ্রনাথ আছেন; অন্তর্গত, গভীর, ব্যক্তিগত এক রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সে কোনো স্থিরমূর্তি রবীন্দ্রনাথ নয়।   বরং সে এক বিস্তৃত বৃক্ষ হয়ে আমার ভেতরে হাজার বছরের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। আমি শুধু তার ডালে ও শাখায় উড়ে ও ঘুরে বেড়াই, কখনোই চূড়া ছুঁতে পারি না। অন্যদিকে এই বৃক্ষের এত পত্রালি এবং এসবের ভেতর এত এত বিস্ময়, মুগ্ধতা, সত্য, সুন্দর আর চিন্তা, বাস্তব, দৃষ্টি ছড়ানো যে, তা যেন হয়ে আছে কালের এক-একটি পৃষ্ঠা, তাকে বড় গহন-গভীর করে পাঠ করে অস্তিত্বের অংশ করে নিতে হয়।

তার জীবন ও সৃষ্টির ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী, এই প্রশ্নের চেয়ে বরং বলা ভালো, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ কী নন? রবীন্দ্রনাথ আমার এক গূঢ়গভীর আশ্রয়। রবীন্দ্রনাথকে মনে হয় গত হাজার বছর ও আগামী হাজার বছরের মধ্যে এক আশ্চর্য সেতু। অতীতকে পাঠ করার জন্য যেমন তাকে দরকার, আগামীর জন্যও তিনি প্রাসঙ্গিক শুধু নন, কখনো কখনো খুব জরুরিও। আর একটি জাতির যা কিছু উৎকর্ষ তা যদি কখনো কখনো, ইতিহাসের কোনো বিশেষ মুহূর্তে, কোনো একটি ব্যক্তির মাঝে সারাৎসার হিসেবে সঞ্চিত হয়, বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তার মতো আর কেউই নন। আবার একই সঙ্গে তিনি স্থানিক, অথচ বৈশ্বিক। দেশ-মহাদেশ আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-কে তিনি যেন একই হাতের তালুর মধ্যে পুরে নিয়েছেন।

কিন্তু তাই বলে কি তিনি কেবল পূজনীয় দেবতা, ভক্তিলোভী গুরুদেব? না, আমার রবীন্দ্রনাথ কেবল পূজার জিনিস হয়ে থাকার বিষয় নন। পূজা তার প্রাপ্য, ভক্তিও। কিন্তু সে তিনি দেবতা হিসেবে নন, বরং রক্তমাংস, বোধচেতনা, ইতিহাসঐতিহ্য আর তার সকল শিল্প ও মানবীয় গুণের ভেতর দিয়ে তিনি যে মানুষ হিসেবে কালদ্রষ্টা, সচেতন, যৌক্তিক, সঘন ও সচল, সেজন্যে। অর্থাৎ আজকের পৃথিবীতেও তার প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয়তা ও চলিষ্ণুতার ভেতর দিয়েই আমার আপনজন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ তার বচনের ভেতর দিয়েই এত অনির্বচনীয় হয়ে উঠেছেন যে, আমার বচনে তাকে তেমন করে ধরা যেন অধরাকেই ধরতে চাওয়ার দুঃসাহস। এ সামান্য লেখাটির মধ্য দিয়ে তার সূচনাই হলো কেবল। ভবিষ্যতে যদি বচনের শক্তিতে কুলোয় তাহলে আরো একটু নিবিড়ভাবে ধরতে চাইব আমার রবীন্দ্রনাথকে।  

আজ যখন আবার বাংলাদেশ-ভারত শুধু নয়, পৃথিবীর নানা কেন্দ্র ও প্রান্তে, জন্মের দেড়শত বছর উপলক্ষে, তিনি আবার রবির মতোই উদিত হচ্ছেন, তখন মনে হয় উনিশ শতকের রবীন্দ্রনাথকে একুশ শতকেও বড় বেশি প্রয়োজন। কারণ এই শতকটি প্রয়োজনকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়, অন্য সব কিছুর চেয়ে। আর রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে এসেও বিশ্বজুড়ে তার ‘প্রয়োজন’ অব্যাহত রাখতে পেরেছেন কেবল সৃষ্টি-চিন্তা-বিশ্বাসের শক্তিতে, তৃতীয়-পৃথিবীর মানুষ হিসেবে এ আমাদের জন্য বড় সুখের কথা।     

বাংলাদেশ সময় ১৯০৭, আগস্ট ০৬,২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।