ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

লেখক হুমায়ূনের উপন্যাসে সম্রাট হুমায়ূন

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১১
লেখক হুমায়ূনের উপন্যাসে সম্রাট হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদ কোনো ইতিহাসবিদ নন। তিনি ইতিহাস লেখেন না।

তবে ইতিহাস নিয়ে ভাবেন, পড়েন। এবারের ২০১১-এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল তার বই ‘বাদশাহ নামদার’। বইটি লিখিত হয়েছে মোগল সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে।

প্রশ্ন তৈরি হতেই পারে, হুমায়ূন কী ইতিহাসবিদ? তিনি কেন লিখতে গেলেন মোগল সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে? লেখক হুমায়ূনই বা কিভাবে তাকে উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন?  আসলে এ উপন্যাসেই প্রমাণ হয়ে গেলো, জনপ্রিয় ধারার লেখক হলেও হুমায়ূন আহমেদ যে ইতিহাসের মধ্যে প্রবেশ করেও তার চিরচেনা রসবোধ দিয়ে তৈরি করে ফেলতে পারেন এক অন্যরকম উপন্যাসের জগত।

উপন্যাসের শুরুতে লেখক ভূমিকায় এ ধরনের ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লেখার কারণ হিসেবে বলেন, ‘শৈশবে আমাদের পাঠ্যতালিকায় চিতোর রানীর দিল্লির সম্রাট হুমায়ূনকে রাখি পাঠানো- বিষয়ক একটা কবিতা ছিল। একটা লাইন এরকম: “বাহাদুর শাহ্ আসছে ধেয়ে করতে চিতোর জয়। ” এই কবিতা শিশুমনে প্রবল ছাপ ফেলেছিল বলেই শেষ বয়সে সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসব এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই।

সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। এই অর্থে হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতার জানেন না সেখানে সারা জীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টাও ছিল অদ্ভুত। বিচিত্র চরিত্র এবং বিচিত্র সময় ধরার লোভ থেকে ‘বাদশাহ নামদার’ লেখা হতে পারে। ’

শৈশবের স্মৃতি মনের মধ্যে দাগ কাটা কিংবা বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে- ঘটনা যাই-ই হোক না কেন, হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু লিখে ফেলেছেন ঐতিহাসি এক উপন্যাস।

উপন্যাস শুরু হয় বাঙ্গালমুলুক দিয়ে। যেখানে দেখা যায়, কিছু কাঁচা আম পোড়ানো হচ্ছে শরবত বানানোর জন্য। খাওয়ানো হবে সম্রাট বাবরকে। এখানে হমায়ূন আহমেদ ইতিহাস ঘেঁটে বের করে ফেলেছেন মোগল আমলের প্রাসাদে বঙ্গদেশ থেকে কোন ফলটি যেতো। কিভাবে ফলটিকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হতো অথবা কোন ফলটির কদর ছিল।

উপন্যাসের প্রথম পর্যায়ে সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ূনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় অলস এবং আরামপ্রিয় হিসেবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে একটু এগুতেই হুমায়ূনকে ভিন্নরূপে আবিস্কার করা যায়। কখনও সে যুদ্ধে চলে যাচ্ছে। কখনও কোনো দূর্গে গিয়ে আরাম করছে। কিংবা কখনও কখনও পিতার দূর্গেও আক্রমণের প্রস্তুতি চালাচ্ছে। যেমন, উপন্যাসের এক পর্যায়ে দেখা যায় হুমায়ূন পিতার কোষাগারে হামলা চালায়।

‘হুমায়ূন মীর্জা এর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর পিতার দিল্লীর কোষাগার দখল করে রাজকোষের সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেলেন বাদাখ্শানের দিকে। আগস্ট মাস, ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দ। এই কাজ তিনি কেন করলেন তা এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের কাছে রহস্যাবৃত। ’

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় সম্রাট বাবর এসব ঘটনায় খুব একটা বিচলিত হন না।   তবে স্ত্রীকে প্রশ্ন করেন এ বিষয়ে। পুত্রের শাস্তি হতে পারে এমন আতঙ্কে বাবরের স্ত্রী যখন সম্রাটকে দয়ালু বলে পিতার হৃদয়ে ভালোবাসার সৃষ্টি করতে চান; তখন সম্রাট বলে ওঠেন, ‘সম্রাটের কোনো পুত্র থাকে না। স্ত্রী থাকে না। আত্মীয় পরিজন থাকে না। সম্রাটের থাকে তরবারি। ’

পিতা হিসেবে সম্রাটকে কঠিন মনে হতে পারে। পিতা যখন সম্রাটের আসনে তখন পুত্রকে শত্রুর দৃষ্টিতে দেখতেই পারেন। কিন্তু যুগ যুগ ধরে রাজ পরিবারে ক্ষমতা এবং সিংহাসনই মুখ্য হয়ে এসেছে। তবে হুমায়ূন আহমেদ সম্রাট বাবরের পিতৃস্নেহ প্রকাশ করেছেন তাঁর উপন্যাসে। হুমায়ূন কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে বাবর নিজ দেহের বিনিময়ে পুত্রের সুস্থতা কামনা করেন। ঈশ্বর বাবরের দোয়া কবুল করে হুমায়ূনকে জীবন দান করেন এবং বাবরের পরিণতি হয় মৃত্যু।

বাবরের মৃত্যুর পরই উন্মোচিত হতে থাকে সম্রাট হুমায়ূনের নিজস্ব চরিত্র। তবে লেখক এ চরিত্রটিকে নির্মাণ করেছেন একজন প্রেমিক হিসেবে। হুমায়ূন একজন গভীর ভাবনার শিল্পী। তিনি ভালো ছবি  আঁকেন, কবিতা লেখেন। ভাগ্য নিয়ে ভাবেন। একজন ভাবুক হুমায়ূন ধরা দেয় উপন্যাসে। তরবারি আর রক্তপাতের আড়লে যে একজন প্রেমিক সম্রাট এ ভারতবর্ষ শাসন করে গেছেন সে বিষয়টিই হয়তো হুমায়ূন আহমেদ তার পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন।

পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনও এ উপন্যাসে মূখ্য হয়ে ওঠে। সম্রাটের কন্যা আকিকা বেগম আগুনে পুড়ে মারা যায়। কিন্তু মেয়ের উপস্থিতি সম্রাট টের পান। কন্যার স্মৃতির কথা মনে করলে ব্যাথিত হন। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল স্ত্রীর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। স্ত্রী হামিদা বানুর সঙ্গে তাঁর বিয়ের ঘটনাও বাদ যায়নি উপন্যাস থেকে। হামিদাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে সম্রাটের। কিন্তু সম্রাটকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় হামিদা বানু। সে সময় সম্রাট চঞ্চল হয়ে ওঠেন। নিজের ভেতরের সরল শিশুসুলভ মনটা বার বার সম্রাটকে বেদনায় জড়িয়ে ধরে। অভিমানের সঙ্গে তিনি বলে ওঠেন, হামিদা বানুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে না হলে তিনি কোনো খাদ্য গ্রহণ করবেন না।

ইতিহাসে হামিদা বানুর গুরুত্ব আছে। কারণ এই হামিদা বানুর গর্ভেই জন্ম নেয় সম্রাট আকবর। হামিদা বানু গর্ভবতী হওয়ার পরের সময়গুলো খুব চমৎকারভাবে উঠে এসেছে উপন্যাসে। এখানে দেখা যায়, হুমায়ূনকে ওই সময় হামিদা বানু বার বার অনুরোধ করছেন একটি কবিতা বলার জন্য। কিন্তু সম্রাট বলতে চাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে ঘোড়ায় চড়ার প্রশ্ন আসলে হামিদা বলেন, ‘আমি আপনার মুখ থেকে একটা শের না শুনে ঘোড়ায় উঠব না। ’
Humayun-ahmed-1
সে সময় বাদশাহ হুমায়ূন একটি কবিতা বলেন। কবিতাটি হলো-
‘একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্র হলো তার
প্রেমিকার মুখ।
আর জোছনা হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস। ’

এমন সব সরল রোমান্টিকতায় ভরপুর উপন্যাস ‘বাদশাহ নামদার’।   উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক - ‘হামিদা বানু বললেন, আপনি কি আমার ধারে একটু বসবেন? হঠাৎ পাখির ডাক শুনে ভয় পেয়েছি। হুমায়ূন স্ত্রীর পাশে এসে বসেছেন। তাদের গায়ে অবাক জোছনা গলে গলে পড়ছে। দু’জনই অপেক্ষা করছেন হিন্দুস্থানের অদ্ভুত পাখির ডাক আরেকবার শোনার জন্য। ’

ইতিহাসের মতো, উপন্যাসেও বলতে গেলে হুমায়ূন একজন পরাজিত সম্রাট। কোনোভাবেই যুদ্ধের ক্ষেত্রে তার কোনো বুদ্ধির প্রকাশ ঘটেনি। প্রকাশ ঘটেছে শিল্পের। শিল্পের জয় হয়েছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। সিংহাসন জয়ের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে তাঁর সেনাপতি বৈরাম খাঁ। কারণ, বৈরম খাঁ ছাড়া সম্রাট হুমায়ূন একজন পরাজিত সম্রাট ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি শের শাহ-এর সঙ্গে যুদ্ধে হেরেছেন। নিজের ভাইদের সাথে শত্রুতায় জড়িয়ে গেছেন। পারস্য সম্রাটের আশ্রয় লাভ করলেও তিনি ভুগেছেন। আর যুদ্ধে হেরে তো পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন।

তাই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এক সময়, বৈরাম খাঁকেই মনে হবে উপন্যাসের নায়ক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বৈরাম খাঁকে সম্রাট আকবরের হাতে নিহত হতে হয়। উপন্যাসটি সমাপ্ত হয়েছে বৈরাম খাঁর মৃত্যুতে এসেই।

উপন্যাসটি ঐতিহাসিক হলেও লিখিত হয়েছে ঝরঝরে হুমায়ূন আহমেদীয় ভাষায়। সহজ সরলভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়েছে ইতিহাসের নানা অজানা কথা। উঠে এসেছে বাদশাহ হুমায়ূন বিষয়ক নানা গল্প।

হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ, প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ, মূল্য ৩৫০ টাকা।

বাংলাদেশ সময় ১৬১০, জুলাই ২৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।