প্রখ্যাত ইরাকি ঔপন্যাসিক মাহমুদ সাঈদ। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে ইরাকের মসুলে।
সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টির শাসনামলে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। ‘জানকা বিন বারাকা’ (১৯৭০) সহ বেশ কয়েকটি উপন্যাস বাজেয়াপ্ত করার কারণে ১৯৮৫ সালে পাকাপোক্তভাবে তিনি ইরাক ত্যাগ করেন। দ্য ইন্ড অব দ্য ডে লাইট (১৯৯৬), দ্য বার্ডস অব লাভ এন্ড ওয়ার (১৯৯৭), দ্য বিউটিফুল ডেথ (১৯৯৮), টু লস্ট সোল (২০০৬) তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ। মাহমুদ সাঈদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সাদ্দাম সিটি’ (২০০৩) অনূদিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভাষায়। এখানে তুলে ধরা হলো তার ‘দ্য ট্রেন’ গল্পের অনুবাদ।
ওরা চারজন একসাথে হাঁটছিল। হাঁটছিল স্কুলের বাচ্চাদের মত পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে। তবে বড়জন ছিল ব্যতিক্রম। বয়স হবে হয়তো বারো, সবার পেছনে থেকে চাকাওয়ালা লাগেজটা ও টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর হাঁটা, তারপর বিশ্রাম। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা । চারজন হঠাৎ দাঁড়াল। বিশাল স্টেশনের বাতিগুলোর ম্লান আলো ওদের সম্মোহিত করেছিল। ওরা আরো একবার থামল যখন ওদের অনুসন্ধিৎসু চোখে খেলনা ভর্তি একটা ঠেলা গাড়ি ধরা পড়ল। খেলানার প্রাচুর্য দেখে ওদের চোখের আয়তন বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। অসংখ্য খেলনা ছিল ওটাতে- বেলুন, চাবির রিং, পুতুল আর তুলো দিয়ে বানানো অসংখ্য ছোট ছোট জীবজন্তু।
‘দেখ দেখ... ডাইনোসর... গরিলা... কুকুর... কী সুন্দর একটা গাড়ি...`
‘আহ! জলদি চল, ট্রেন ছেড়ে দেবে তো। ’ বড় বোন এভাবেই ওদের টেনে নিয়ে গেল। ট্রেনের দিকে দৌড়ে যাবার সময় বাচ্চাগুলো চারপাশে তাকাচ্ছিল আর জামা ধরে টান দিয়ে বোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। ‘সানা, এরকম খেলনা কি মসুলেও পাওয়া যায়?’
আমি হাসলাম। সব বাচ্চাই এক রকম; সব জায়গাতেই। সানার উত্তর আমার কানে এল না।
তিন-চার বছর বয়সী ছোট বোনের হাত চেপে ধরে ঝাপসা হলুদ আলোর বাতির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের দিকে সানা নামের মেয়েটি খুব দ্রুত এগিয়ে গেল। এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর সাথে কে আছে এ চিন্তা তখনো আমার মাথায় আসেনি, বয়স বাড়লে মানসিক বৈকল্য অবধারিত! তবে একটু বাদেই এক মহিলাকে ওদের পেছনে লক্ষ্য করলাম। হাঁটার গতি হ্রস্ব হওয়ায় উনি এতক্ষণ আমার চোখে পড়েননি। পায়ের গতি কমিয়ে আমাকেও এক সময় থামতে হল। গত চল্লিশ বছরে এই প্রথম মসুলগামী কোন ট্রেনে চড়ছি। জংধরা বগিগুলোর নম্বর বেশ কড়া নজরেই পরীক্ষা করলাম। দেখে মনে হল, ধাতুর সংখ্যাগুলো দু-একদিন বাদেই খুলে পরবে, তাছাড়া ওগুলোর উপর সাদা রঙের অমার্জিত আস্তরও ছিল। পেয়েছি... এটাই ২৩৫ নম্বর বগি। আমি উঠে পড়লাম।
চল্লিশ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। আগে সিট ছিল কাঠের। এখন ছিড়ে ক্ষতবিক্ষত হলেও চামড়া দিয়ে মোড়ানো, কিছুটা আরামদায়ক। বারো-তেরো জন যুবক আমাদের কেবিনে বেশ শোরগোল করছিল। লাল-সাদা-কালো চেকের গেঞ্জি দেখে বুঝা যাচ্ছিল কোন এথলেটিক টিমের সদস্য। আমার ডানপাশের দুটো সিটে বসেছিল সানা ও সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি। ওদের উল্টো দিকে বসেছিল অন্য দুজন পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আর দশ বছরের একটি ছেলে। ছেলেটি বসেছিল দুই সারি সিটের মাঝখানে সরু রাস্তা ঘেষে। আমি ওর পাশেই বসেছিলাম তবে অন্য সারিতে। পুরনো সামরিক কোট পড়া একজন বয়স্ক লোক আমার বামে বসা ছিলেন। কালো ছেঁড়া বিশমাগ*১ দিয়ে তার মুখ ছিল ঢাকা। চেহারা দেখার উপায় ছিল না, তাই বুঝতে পারিনি তিনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি ঘুমাবার চেষ্টা করছিলেন। ওদের জীবনে এটাই প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। বড় বোন সানা ছাড়া বাকি তিন জনই ছিল উৎফুল্ল; কথাবার্তায় প্রগলভ। জানালা দিয়ে কাছের নোংরা প্লাটফর্ম আর দূরের আকাশের দিকে ওরা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। ওরা বসেছিল মেরুদণ্ড সোজা করে; সব কিছুতেই তখন উত্তেজনা; কেউ একজন মুখ নাড়লেই প্রত্যেকে আলোড়িত হচ্ছিলো সহর্ষে। কিন্তু সানা ছিল চিন্তামগ্ন।
হঠাৎ ঐ মহিলার কথা আমার মনে পড়ল। তিনি বসেছেন কোথায়? তাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। তবে কি তিনি ওদের কেউ নন! অবশ্য ডানে ঘুরে বগির দরজার দিকে তাকাতেই তার দেখা মিললো। একটা আঙ্গুল বাকিয়ে তিনি আমাকে ডাকছিলেন; তার চোখে ছিল দুঃখ-মাখা অনুনয়। আমি বুঝতে না পারায় একইভাবে তিনি আবারো ইশারা করলেন। আমি প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম, ‘আমি?’ কিন্তু তিনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বললেন।
আমি ক্ষান্ত হলাম, তারপর উঠে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেয়ে বুঝলাম তার বয়স পঞ্চাশ। চিকন শরীর; মুখ দেখে বুঝা যায় অবহেলা আর সীমাহীন দুঃখ-যন্ত্রণা তার সৌন্দর্যকে ম্লান হতে বাধ্য করেছে। তার রঙজ্বলা বোরখার উপর গোল ছাপওয়ালা ওড়না জড়ানো ছিল। ওড়নার দু’দিকের দুটি ধুসর পাড় তার পুরো বক্ষদেশে লেপ্টে ছিল শৈল্পীকভাবে । একেবারে আদর্শ বাজা*২ ড্রেস। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি খুব সাবধানে ট্রেন থেকে নেমে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমিও নামলাম। তার চোখ অশ্রুসজল। তিনি বললেন, ‘দেখে বোঝা যায় আপনি একজন সহৃদয় মানুষ। ’
তিনি আমার হাত ধরলেন। আমি হাসলাম; ততক্ষণে তার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে। ‘দয়াকরে আমার জন্য একটি কাজ করে দিন। আমি মিনতি করছি... অনেকটা ফিসফিসিয়ে তিনি কথাগুলো বললেন।
‘কী করতে হবে?
‘আগে কথা দিন কাজটি করবেন...
‘কাজটা কী তা জানার আগেই কথা দেব?
‘খুব সহজ কাজ। মসুল স্টেশনে ওদের চাচা সালেহ না আসা পর্যন্ত ওদের সাথে থাকবেন। ’
‘এটা তো খুব সহজ কাজ। ’
‘বলুন থাকবেন কিনা?’
বোরখার পকেট থেকে ছোট একটি কোরান বের করে তিনি বললেন, ‘প্রতিজ্ঞা করুণ। ’
আমি হাসলাম। ‘এভাবে প্রতিজ্ঞা করার প্রয়োজন নেই, আমি থাকব। ’
‘না, প্রতিজ্ঞা করুন। ’
আমার হাতে চুমু দেবার জন্যে তিনি ঝুঁকে পড়লেন।
‘এসবের প্রয়োজন নেই। ’
‘প্রতিজ্ঞা করুন। ’
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম।
‘ওদের চাচা না আসা পর্যন্ত আপনি ওদের ছেড়ে যাবেন না?’
‘আমি যাব না। ’
তিনি হাসলেন। ‘ আমার মন ঠিকই বলেছিল। আপনি একজন হৃদয়বান মানুষ। ’ আমি না জানতে চাইলেও তিনি বললেন- হানাকে জন্ম দিতে গিয়ে ওদের মা তিন বছর আগে মারা যান। জানেনই তো, অবরোধের কারণে দেশে কোন জীবাণুনাশক নেই। ওদের বাবারও ক্যানসার ধরা পড়ে একই বছর। পরিত্যাক্ত ইউরেনিয়াম সেল নাকি স্ত্রী হারাবার যন্ত্রণার কারণে তার ক্যানসার হয়েছিল তা কে জানে! তাজি সেনা ঘাটির একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি। জানেন নিশ্চয়ই, কুয়েতের সাথে যুদ্ধের সময় ঐ ঘাটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস হল তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তার বাড়ির মালিক ছয় মাসের ভাড়ার দাবি ছেড়ে দেননি। ওদের সব কিছু বিক্রি করে আমরা ভাড়া পরিশোধ করে দিয়েছি। বাগদাদে ওদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ’
‘ওদের চাচাকে আপনি চেনেন?’
‘না। কিন্তু তিনি স্টেশনে আসবেন। ’
‘আপনি নিশ্চিত?’
দুই হাত প্রশস্ত করে তিনি বললেন, ‘কেন আসবেন না? আমি তাকে তিনবার টেলিফোন করেছি। শুধু টেলিফোন বিল দিতেই আমার খরচ হয়েছে দশ হাজার দিনার। তার নম্বর জোগার করতে আমাকে দোজখের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। তিন মাস; অনেক দীর্ঘ সময়। আল্লাহ রহম করেছিলেন আমাকে। ’
মাথা নুইয়ে তিনি আমার সহানুভূতি প্রার্থনা করলেন। তার চোখ উপচে তখন জল গড়িয়ে পড়ছিল। ‘ আজকালকার সমস্যা তো জানেন... অপহরণ, বোমাবাজি, খুন... দয়া করে ঐ মাসুম বাচ্চাগুলোকে ওদের চাচার হাতে তুলে দেবেন। ’
ট্রেন ছাড়ার হুইসেলে ওরা জানালার দিকে ঝুঁকে পড়ল; হতাশও হল দ্রুত। কারণ বাইরে দেখার মত তেমন কিছুই ছিল না। কাজিমিয়া স্টেশনের বাতিগুলো ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছেÑ যত দূর গেলে সবকিছু অধরা হয়ে যায়। অন্ধকারে খেজুর গাছগুলোকে সুঁইয়ের মত মনে হচ্ছিল। আমাদের ট্রেন বাগদাদের উপকণ্ঠ ছেড়ে যাওয়া মাত্রই রাস্তার সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। কারণ বাতিগুলো এখন আর শুধু পথিককেই পথ দেখায় না, পথ দেখায় শত্রু বিমানগুলোকেও। বাচ্চাগুলো জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে আনলো। ট্রেনের একঘেয়ে শব্দে ওদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা থাকলেও কিছু খাবারের ঘ্রাণ তাতে বাধ সেধেছিল- শিক কাবাব, ডিম, প্যাকেটজাত আম, আরো অনেক কিছু। তরুণ এ্যাথলেটরা গাল ভরে স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছিল, একে অন্যকে খোঁচা মেরে কথা বলছিল আর পেপসি ও সেভেন-আপ এর ক্যানে টোস্ট করছিল।
আমার পাশে বসা বাচ্চা দুটো সানাকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। আর সানার পাশের ছোট্ট মেয়েটিও আবদার করল কিছু একটা । সানা উঠে উপরের সেল্ফ থেকে একটা ব্যাগ নামিয়ে আনলো। এ-সময় তিন ভাই-বোনের কারোরই চোখের পলক পর্যন্ত পরছিল না। সানা ব্যাগ থেকে কাপ আর একটি তোয়ালের ভেতর থেকে চার খণ্ড রুটি বের করলো। ঐ ভদ্র মহিলাই ওদের জন্য রুটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সানা তিন ভাই-বোনের হাতে রুটি দিয়ে নিজের অংশটুকু আবারো তোয়ালে দিয়ে প্যাঁচিয়ে রাখলো। ব্যাগটা সেল্ফে রেখে রেস্টরুমে থেকে ও কাপ ভরে পানি নিয়ে এল। সেই পানিতে রুটি ভিজিয়ে তিনটি অভুক্ত শিশু তাদের পাকস্থলীকে শান্ত করল।
ছেলেটি বলল, ‘কাল সালেহ চাচার বাড়িতে আমরা অনেক কিছু খাব। ’
অ্যাথলেটদের হাতে কোল্ড ড্রিংস দেখে ওর পাশের মেয়েটি বললো, ‘আমরা পেপসি খাব। ’
‘সেভেন-আপ। ’
‘অরেঞ্জ জুস। ’
‘চাচার মেয়ের সাথে আমরা খেলব। ’- এ কথা বলেই মেয়েটি সানার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, ‘ওর নাম কী?’
‘জানি না। ’
ছেলেটি চট করে বলল, ‘চল্ আমরা ওর নাম দেই ‘জানি না’। ”
ওরা এক সাথে হেসে উঠল।
‘ওর বয়স কত?’
‘জানি না। ’
ছেলেটি বলল, ‘চল্ ধরে নেই ওর বয়স ‘জানি না’। `` ওরা আবারো এক সাথে হেসে উঠল।
এরপর পাঁচ বছরের মেয়েটি বলল, ‘ও নিশ্চয়ই জানি না’ স্কুলে পড়ে। ”
যথেষ্ট ধ্যানের সাথেই আমি ওদের দেখছিলাম, ওদের নিষ্পাপ হাসি-আনন্দে গোপনে ভাগ বসাচ্ছিলাম।
‘সালেহ চাচার কথা সবসময় মেনে চলবি’ সানা বলল।
‘মেনে চলব। ’ ওরা সমস্বরে উত্তর দিল। আমার মনে হল, এই উপদেশ বাণী এর আগে বহুবার ওরা শুনেছে।
‘চাচীর কথাও শুনবি। ’
‘শুনব। ’
‘কাওথার আন্টির মেয়ে জায়নার মত চাচার মেয়েকে জ্বালাতন করবি না। ’
‘করব না!’ ওরা আবারো হাসিতে ফেটে পড়ল।
চার ভাই-বোন দেখতে প্রায় একই রকম, হালকা বাদামী চুল, দুধ-সাদা গায়ের রঙ, ডাগর চোখ, নীলাভ মনির চারপাশটা হালকা সবুজ আর পাতলা গোলাপরঙা ঠোট। অসাধারণ। হাতে থাকা ম্যাগাজিনটা আমি পড়তে শুরু করলাম। ছেলেটি- যে আমার কাছাকাছি বসেছিল, আমার দিকে ঘুরে বসল। ‘আমার বাবা প্রায়ই এই ম্যাগাজিনটা পড়ত: মডার্ন সায়েন্স। ’
আমি হাসলাম। ‘আর তুমি? কখনো পড়ার চেষ্টা করেছ?’
‘এটা কঠিন। আমি তো কেবল ফোর্থ গ্রেডে পড়ি। আমি শুধু ছবিগুলো দেখতাম। ’
‘দিয়া, অযথা প্রশ্ন করে উনাকে বিরক্ত করিস না’- ওর বোন বাধা দিল।
‘না না, মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। ’
সানা ছোট বোনকে নিয়ে রেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ফিরে এসে পাঁচ বছরের বোনটির তন্দ্রা কাটাবার জন্য কনুই দিয়ে আলতো করে খোঁচা দিল। ‘রাজা! উঠ, ঘুমাবার আগে আমার সাথে রেস্ট রুমে চল। ’
এরপর এল দিয়ার পালা। ‘তুই-ও আমার সাথে চল। ’
‘আমি এখন আর ছোট নই। আমি পুরুষ। আমার যখন ইচ্ছা হবে আমি তখনই যাব। ’
সানা ওকে তাগাদা দিয়ে বলল, ‘চল বলছি। ’
‘যাও’ আমি বললাম।
‘ফিরে এসে দিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এর আগে কখনো মসুলে গিয়েছেন?’
‘চল্লিশ বছর আগে’ আমি হেসে উত্তর দিলাম।
আমার কথা শুনে ও খিলখিল করে হাসল। তবে ওকে কিছুটা কৌতুহলী মনে হচ্ছিল। আমার ধারণা, কেউ যে চল্লিশ বছর বেঁচে থাকতে পারে ওর সেটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ‘চল্লিশ বছর?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তাহলে তো আপনি সব কিছুই ভুলে গেছেন!’
‘আমি ঠিক নিশ্চিত নই। হয়তো সব কিছু বদলে গেছে। হয়তো অনেক কিছু আগের মতই আছে। কালকেই সব বুঝতে পারব। ’
‘মসুলে কি বাগদাদের মত ফুটবল মাঠ ছিল?’
আমি হাসলাম। ‘না, মাঠের মত কোন ফাকা জায়গা পেলে আমরা সেখানেই খেলতাম। ’
‘আর এখন?’
‘হয়তো দু-একটা আছে। অন্তত স্কুলগুলোতে থাকার কথা। ’
‘আমার ক্লাসে আমিই সবচেয়ে ভাল ফুটবল খেলি, টপ অফেনসিভ প্লেয়ার। ভবিষ্যতে আমি ইরাকের জাতীয় দলে খেলব। ’
আমি হাসলাম। ‘তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। ’
‘কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন? আপনি কি আমাকে কখনো খেলতে দেখেছেন?’ খুব সিরিয়াস হয়েই ও আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘না, তা দেখিনি। তবে লক্ষ্যে অনড় থাকলে তুমি যে কোন কিছু অর্জন করতে পারবে। ’
দিয়া এবার কিছুটা ফিসফিস করে বলল, ‘আমার বাবাও তাই বলত। ’ খুব দ্রুত ওর চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটে উঠল। ও বলল, ‘আমি বাগদাদ ছেড়ে যেতে চাইনি। ওখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু আমরা থাকব কোথায়? আমরা তো বাড়ি ভাড়া দিতে পারি না। ’
‘ঐ বোরখা পড়া মহিলা কী হন? যিনি তোমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে গেলেন?’
‘কাওথার আন্টি, তিনি আমাদের প্রতিবেশী। স্কুল টিচার। উনার স্বামীও আগে স্কুল টিচার ছিলেন। ’
‘তিনি তোমাদের আত্মীয়?’
‘না। সালেহ চাচা ছাড়া আমাদের আর কোন আত্মীয় নেই। তাকে আমরা কখনো দেখিনি। মসুলেও কি বাগদাদের মত বোমা ফাটছে?
দিয়ার এই প্রশ্ন আমাকে প্রচন্ড নাড়া দিলো। ‘হ্যাঁ... সারা ইরাকের মতই। ’
ও কিছু বলল না। এমন রূঢ় বাস্তবতার কথা শুনে ওর স্বপ্নভরা চোখ দুটো শূন্য হয়ে গেল। দিয়া বারবার হাই তুলছিল। ঘুমের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ও হার মানল। ঐ ঘুম আমার মধ্যেও সংক্রমিত হতে বেশি সময় নেয়নি। আধা জাগ্রত অবস্থায় আমি সানাকে দেখছিলাম। নিজের চোখ বুজবার আগে ও ভাই-বোনদের চাদর দিয়ে ঢেকে দিল; ওদের হেলেপরা শরীর সোজা করে দিল।
‘গাধা। ’
আমি জানি না ঠিক কে ঐ শব্দটা করেছিল। তবে গাধার ডাক শুনবার আগেই অ্যাথলেটদের অট্টহাসি আর সেই সাথে বাচ্চাগুলোর শোরগোল আমার কানে এল। আমি চোখ খুললাম: ওরা জানালায় হুমরি খেয়ে পরেছে; একটা গাধা চিৎকার করছিল বটে তবে মুহূর্তেই চোখের আড়াল হয়ে গেল; কিছু মাটির ঘর-বাড়ি দেখলাম, সেগুলোও অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর দুপাশে চোখে পড়ল সাদা মর্মর পাথর শোভিত অসংখ্য শুষ্ক পাহাড়। যুদ্ধ আর অবরোধে ইরাকিরাও এখন এই পাহাড়গুলোর মত! ‘হামাম-আল-আলিল’ ট্রেনের এক কর্মচারী চিৎকার করে সামনের স্টেশনের নাম ঘোষণা করল। এর কিছুক্ষণ পরই আমাদের ট্রেন একটি টানেলে ঢুকল। আলো বিদায় নিল, অন্ধকার জেগে উঠল। আকস্মিক অন্ধকারে ভয় পেয়ে তিন বছরের মেয়েটি চিৎকার শুরু করল। ‘ভয় নেই সোনা’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সানা ওকে সান্তনা দিল। ও নিজেও হয়তো ভয় পেয়েছিল।
ওদের অভয় দিতে আমি বললাম, ‘চিন্তা করো না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা টানেল থেকে বের হয়ে যাব। ’
‘টানেল কী?’
আমি দিয়ার কন্ঠ শুনতে পেলাম। ‘পর্বতের নিচ দিয়ে রাস্তা’ সামনে থেকে এক অচেনা পুরুষ কন্ঠ দিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিল। অ্যাথলেটদের কেউ হবে হয়ত।
আমিও চুপ রইলাম না, সাথে সাথে বললাম, ‘মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা মসুলে পৌঁছে যাব। ’
তবে আমাদের কথা আর বেশি দূর এগোয়নি। শুরু হলো মৌন থাকার প্রতিযোগিতা। ইতিমধ্যে টানেল পর্ব শেষ করে আমাদের ট্রেন বাইরের দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে। পুরো কেবিনে ছড়িয়ে পরেছে ভোরের হালকা আলো। আর দূর থেকে উঁকি দিচ্ছে শহরের একতলা ঘিঞ্জি ঘর-বাড়ি, রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট আর চিরচেনা আরবের অলস ধুলো।
‘আমারা মসুলে এসে গেছি, সালেহ চাচা আমাদের নিতে আসবেন!’ ওরা উল্লসিত, ওদের ভেতর-বাহিরে তখন আগুন। রাজা নামের মেয়েটি সানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সালেহ চাচা কি চাচী ও তার মেয়েকে নিয়ে আসবেন, না একাই আসবেন?’
‘জানি না। ’
দিয়া বলল, ‘ জানি না’ আসবে না। ও তো এখন স্কুলে। ’
ওরা আবারো হাসি-আনন্দে ডুব দিল, বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে কথা বলল। ট্রেন থামার আগ পর্যন্ত ওরা ছিল অক্লান্ত। তখন সকাল সাতটা। ট্রেন থামা মাত্রই অ্যাথলেটরা হুড়মুড় করে নামতে শুরু করল আর সানা ভাই-বোনদের একত্রে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত হল। দু হাত ছড়িয়ে ও এমনভাবে দাঁড়িয়ে রইলো যাতে কেউই একা একা নেমে যেতে না পারে। ওর এই প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমিও খুব দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পরলাম। স্টেশনের মূল প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই আমি ওদের উপর নজর রাখছিলাম। এটাই স্টেশন থেকে শহরে প্রবেশের একমাত্র পথ।
আমি যখন খুব ছোট তখন বাগদাদ ও মসুলের মধ্যে এই রেল সড়ক নির্মিত হয়েছিল। তখন ট্রেনই ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন। সে-সময় উজ্জ্বল মর্মর পাথরের দেওয়াল ঘেরা এই স্টেশনটি ছোট হলেও আমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন! নোংরা, অবহেলিত, পতনোন্মুখ। সোজা কথায়Ñ দৃষ্টিকটু।
ট্রেন থেকে নামার সময়ই মসুলের তীব্র শৈত্য আমার চামড়ায় দাঁত বসিয়েছিল। তাই রোদ পোহাবার জন্যেই আমার এই দূরে দাঁড়ানো। বাচ্চাগুলোর পক্ষে তখনো স্টেশন ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। একে অন্যের গা ঘেসে দাঁড়িয়ে ওরা হাড় কাঁপানো শীতের সাথে যুদ্ধ করছিল। হঠাৎ দেখলাম প্রত্যেকের হাতে একটি করে কাগজ। সানা কখন ঐ কাগজগুলো বের করল আমি লক্ষ্য করিনি। প্রতিটি কাগজে একটি শব্দই লেখা : সালেহ।
ওদের স্বাগত জানাতে গেট দিয়ে কেউই ঢুকল না। তবে পঞ্চাশ বছরের এক বৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী জোব্বা পড়ে আমার মত রৌদ্রে এসে দাঁড়ালেন। মোটা বেল্ট, কালো বিশমাগ আর সিল্কের ইকাল৩ দিয়ে এমন পোশাক এখনো কেউ পড়ে আমার তা জানা ছিল না। হিজাব পড়া গর্ভবতী এক তরুণী আর তার ডান কাধে ভর দিয়ে আসা এক বৃদ্ধাকে দেখে লোকটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। এরপর উনিশ-কুড়ি বছরের এক মেয়েকে নিয়ে বিশাল দেহী এক জোয়ান তাদের সাথে যোগ দিল। আচার-আচরণ দেখে মেয়েটিকে তার কন্যা বলেই মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাগদাদ থেকে আসা এক ভদ্র মহিলা ও দুই যুবককে আলিঙ্গন আর চুমু দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে তারা একসাথে ফিরে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল পুরো স্টেশন।
ঐ চার খুদে আদম সন্তান ছাড়া অন্য কেউ আমার চোখে পরছিল না। সত্যি বলতে কী, পুরো স্টেশনটাকে তখন খুব অসহায় মনে হচ্ছিল- মর্মর পাথরের প্লাটফর্মে অসংখ্য ছোট বড় গর্ত শুকনো কাদায় ভরে গেছে; পুরনো কাঠের বেঞ্চে দুই সেন্টিমিটার প্রস্থের একটি তক্তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অথচ এককালে এই স্টেশনই ছিল মসুলের অহংকার। বাচ্চাগুলো ইতিমধ্যেই ঐ বেঞ্চটাতে বসেছে, হানা সানার কোলে, রাজা ডানে; দিয়া দাঁড়িয়ে। সবার দৃষ্টি এই গেটের সাথে গাঁথা। ওদের হাত আর সালেহ লেখা কাগজের মধ্যে আগের মত আর সখ্য নেই।
রোদের প্রপাত সত্বেও মসুলে তখন হাঁড় কাঁপানো শীত। বহু কষ্টে স্টেশনের ইলেক্ট্রিক হিটার খুঁজে বের করে আমার হাত সেটার উপর ধরলাম। ফলাফল শূন্য। সামান্য তাপও জুটলো না। অথচ চল্লিশ বছর আগে এই হিটার সব সময় লাল হয়ে থাকত; দিনে দিনে সব কিছুই উচ্ছন্নে যেতে শুরু করেছে... এটাই বোধহয় আমাদের জীবন চরিত! হঠাৎ এক রোগা লোক কোত্থেকে যেন এসে এবরো-থেবরো প্লাটফর্ম ঝাড়ু দেওয়া শুরু করল। তাকে গেঁয়ো বলেই মনে হল; শহুরে জীবন তার অনার্যতা ঘোঁচাতে পারেনি। ‘ চলে যাও। আর কেউ আসবে না। চলে যাও। ’ কর্কশ স্বরে ভাঙ্গা আরবিতে সে চেঁচিয়ে উঠল।
ওদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। প্রতিকুল পরিবেশে আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তি ওদের মধ্যে জেগে উঠতে শুরু করেছে। হয়তো এ কারণেই বিনা বাক্য ব্যয়ে বন্য প্রাণীর মত ওরা এখন দলবদ্ধ। ওরা বারবার সানা আর ঐ বৃদ্ধের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন আমি গেটের বাইরে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ঐ ঝাড়ুদারের দিকে এগিয়ে গেলাম, তাকে একটা বিদেশি সিগারেট দিলাম। ‘ ওরা যদি আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকে তাতে আপনার কোন সমস্যা হবে না, হবে কি?’ লোকটিকে আমি এমনভাবে কথাগুলো বললাম যাতে ওরা কেউ না শুনতে পারে।
লম্বা ঝাড়ুটা বুকের মধ্যে ঠেস দিয়ে রেখে সে বললো, ‘যে কোন সময় ইন্সপেক্টার সাহেব চলে আসবেন। ’
‘সেটা আমি দেখব। ’
‘ওরা কি আপনার সাথে। ’
‘হ্যাঁ। ’
আমি তাকে সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। লম্বা একটা সুখটান দিয়ে সে চোখ বন্ধ করল। তার মুখে তৃপ্তি ফুটে উঠেছে। চোখ খুলে সে সিগারেটটা আরেকবার দেখল। এরপর আর কোন কথা না বলে হনহন করে ঢুকে গেল হল রুমের ভেতর।
আরো আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেল। সবচেয়ে ছোট মেয়েটি কাঁদতে শুরু করেছে: ‘সালেহ চাচা কখন আসবে? আমার ক্ষুধা পেয়েছে। ’
সানা ব্যাগ থেকে তার রুটির টুকরাটি যখন বের করছিল তখন বাকি তিন জন ঐ রুটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। ও তিন ভাই-বোনকে রুটিটি ভাগ করে দিল।
‘তুই?’ দিয়া সানাকে জিজ্ঞেস করল।
‘সালেহ চাচার বাসায় গিয়ে খাব। ’
‘কী খাবি?’
‘জানি না। ’
‘কাইমার... মধু?’
‘জানি না। ’
দিয়া হেসে বলল, ‘‘আমরা খাব আর ‘জানি না’ও আমাদের সাথে খাবে। ”
কিন্তু সেই রোগা ঝাড়ুদার সবার অলক্ষে আবারো হাজির হল। এবার খানিক চাপা স্বরে সে বলল, ‘তোমরা এখনো আছো। চলে যাও... আমাকে কাজ করতে দাও। ’
আমি তখনো বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে প্যাকেট থেকে আরো একটা সিগারেট তাকে দিলাম। সে কিছু বলার আগেই সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে তার হাতে কিছু দিনার গুজে দিলাম। আরো একবার সে উধাও হয়ে গেল।
‘সালেহ চাচার কথা সব সময়... ’
সানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওরা নিজেরাই বলল, ‘মেনে চলবো। ’
ওদের উল্টো দিকে মুখ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি বসে পড়লাম...
মুখ ধোয়ার জন্য হানাকে নিয়ে সানা রেস্টরুমে গেল। ফিরে আসার পর মেয়েটিকে আরো সুন্দর লাগছিল। এরপর ও রাজাকে বললো, ‘চল। ’
‘এখন না। ’
‘না, এখনই। ঘুম থেকে উঠার পর তুই মুখ পরিস্কার করিসনি। ’ সানা রাজাকে টেনে রেস্টরুমে নিয়ে গেল। ফিরে এসে দিয়াকে কিছুই বলতে হল না, ও একাই রেস্টরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। দিয়া সানাকে বলল, ‘আমার সাথে যাওয়ার দরকার নেই। ’ ফিরে এলে ছোট একটা চিরুনি দিয়ে সানা দিয়ার চুল আচড়ে দিল। দিয়া তখন টানা সুরে উঁ-আঁ শব্দ করছিল।
তখন নয়টার কিছু বেশি বাজে। ওরা তিনজন হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে ঘুরছিল, আর গাইছিল- ‘ও আমার রূপসী স্বদেশ...’
সানা উঠে রেস্টরুমে গেল। ওর অনুপস্থিতি টের পেয়ে ওরা খেলা বন্ধ করল। সানা যখন ফিরল তখন ওর চোখ লাল, সুন্দর মুখে চাপা যন্ত্রণার আঁচড়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা তখনো ওর মধ্যে ছিল। দিয়া, রাজা ও হানা সানাকে ঘিরে দাঁড়াল।
রাজা জিজ্ঞেস করল, ‘সালেহ চাচা কি আসবেন?’ সানা কোন উত্তর দিল না। দেখতে দেখতে সারে দশটা বেজে গেল। কেউ এল না। সানা গেটের দিকে নিরন্তর তাকিয়ে রইল। সাথে ওরাও। সানা আবারো রেস্টরুমে গেল। আমি বুঝতে পারলাম কিছুক্ষণ কান্না করে ও ফিরে আসবে।
‘চল খেলি’ দিয়া বলল। কিন্তু হানা কাঁদতে শুরু করল: ‘আমার ক্ষুধা পেয়েছে। ’ সানা বললো, ‘চল, তোদের সাথে আমিও খেলব। ’ ওরা একে অন্যের হাত ধরে আগের মত বৃত্ত তৈরি করল আর ঘুরে ঘুরে গাইতে থাকল, ‘ও আমার রূপসী স্বদেশ... ’। আমি অসহায়ের মত নিরবে হাসতে হাসতে গেটের বাইরে চলে গেলাম। ওদের এই নৃত্য সংগীত চলল অনেক্ষণ। ফিরে এসে আমি আবারো প্লাটফর্মে দাঁড়ালাম। সানার চোখে তখন নোনা জলের খেলা চলছে। ভাই-বোনদের সাথে ও আর খেলতে পারল না। বেঞ্চে বসে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ও ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বাকি তিনজনও সানাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সালেহ লেখা কাগজগুলো তখন আর ওদের হাতে নেই; মাটিতে।
ফুটনোট-
১. আরব পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ। মাথা ঢাকার জন্যে আরব পুরুষরা গ্রীষ্ম কালে সাদা এবং শীত কালে লাল-কালো চেকের বিশমাগ বা শুমাগ ব্যবহার করে থাকে।
২.আরব নারীদের সাধারণ পোশাক।
৩.দুম্বার চামড়া অথবা রেশমি সুতার তৈরি বিশেষ দড়ি। পুরুষদের বিশমাগ মাথায় আটকে রাখার জন্যে ব্যবহৃত হয়।
মাহমুদ সাঈদ
কথাসাহিত্যিক, ইরাক
বাংলাদেশ সময় ১৫১০, জুলাই ২২, ২০১১