ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

‘আমার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই’ - আল মাহমুদ

সাক্ষাৎকার : ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১১
‘আমার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই’ - আল মাহমুদ

১১ জুলাই কবি আল মাহমুদের ৭৫তম জন্ম দিন। ১৯৩৬ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে।

জন্মদিনকে সামনে রেখে ৮ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় তার বর্তমান বাসস্থান মগবাজারে যাই। সেখানেই তার সঙ্গে কথা হয়।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে আল মাহমুদের তিনবার সাক্ষাৎকার নিলেও এবারের মতো প্রশ্নের উত্তর দিতে এতটা স্বল্পবাক কখনো দেখিনি। তার সাথে কথা বলে মনে হলো শারীরিক অবস্থা যেন অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। তিনি কানে এতটাই কম শুনতে পান যে, একেকটা প্রশ্ন তাকে করতে হয় কয়েকবার করে। তাছাড়া স্মৃতিশক্তিও যেন আগের মতো আর অতটা সবল নেই।   প্রশ্নের উত্তরগুলি দিচ্ছিলেন খুবই অল্প কথায়। ৮ জুলাই শুক্রবারের বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকিগুলোতেও দেখলাম, প্রশ্নের জবাবে আল মাহমুদের পূর্বের সেই ধার যেন নেই। আল মাহমুদ হয়ে গেছেন স্বল্পবাক। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো আল মাহমুদের সাথে আমার সেদিনের কথোপকথন।

কেমন আছেন ?
আল মাহমুদ : এই...খুব একটা ভালো না...।

এর আগে তিনবার আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এবার চতুর্থবারের মতো আপনার মুখোমুখি হলাম। আপনার সাথে কিছু ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করতে চাই।
আল মাহমুদ : ঠিক আছে প্রশ্ন করো...

চোখের সমস্যার কারণে আপনি তো অনেক বছর ধরেই ডিকটেশন দিয়ে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ- উপন্যাস লেখেন। এভাবে নিজের হাতে কলম না ধরে বিষয়গুলো মেনটেইন করেন কিভাবে?

আল মাহমুদ : মেনটেইন করা খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত এখনও চিন্তার কোনো গোলমাল বা জটিলতা সৃষ্টি হয়নি।

উপস্থিত কবিতা বানানোর ক্ষেত্রে আপনি মুখে বলে বলে তাৎক্ষণিক ছন্দটা রক্ষা করছেন কিভাবে? এভাবে কি কবিতা লেখা সম্ভব?
আল মাহমুদ : কবিতা সম্ভব না। এভাবে কবিতা লেখা কষ্টসাধ্য। এভাবে লেখা উচিতও না, এটা বুঝি। কিন্তু আমার এছাড়া তো উপায়ও নাই।

almahmudতারপরও দেখা যায় অনেক সময় কবিতাটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটা কিভাবে?
আল মাহমুদ : বলতে পারো, এটা আমার একটা গুণ। চাইলেই কবিতা বানানো যায় এটা বিশ্বাস করি না। সেটা তো আমার সৌভাগ্য এভাবে লিখেও লেখাটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যদি না দাঁড়াতো তাহলে আমি লিখতাম না।

আপনি কি আগে থেকে কোনো একটা থিমকে মাথায় রেখে কবিতা লেখেন? নাকি কবিতাটি আপনার মধ্যে আসার পর থিম দাঁড়িয়ে যায়?
আল মাহমুদ : কবিতা এমনিতেই তো আসে না। চিন্তা করতে হয়, কল্পনা করতে হয়- তারপর গ্রো করে।
এটা আগে থেকে কিছু বলা যায় না। থিম মাথায় রেখে কিংবা এমনিতে কবিতা আসা- দুটো পদ্ধতিতেই লেখা হয়। আমি যখন লিখি চিন্তা ভাবনা করি, লিখতে বসে কাটাকাটি করি।   ওটার মধ্য থেকে একটা কবিতার ধারণা পাওয়া গেলে তারপর ওটাকে কবিতা বলি।

এখন তো আর আপনি কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কাটাকাটি করতে পারেন না। ডিকটেশন দিয়ে লেখালে তো আর ওইরকাম কাটাকাটি করা যায় না। এখন কিভাবে হয় কবিতাটা?

আল মাহমুদ : যেটা ডিকটেশন দিয়ে লেখাই সেটা অন্যরকম হয়। এটাও কবিতা তবে অন্য প্রসেসে লেখা হয়েছে। এটা হয়... এটা হয় এবং খুব কমই হয়।

ডিকটেশন দিয়ে এ পর্যন্ত কবিতার বই লিখেছেন কয়টি?
আল মাহমুদ : ডিকটেশন দিয়ে কবিতার বই কমই লিখেছি। তবে উপন্যাস লিখেছি বেশি। বেশিরভাগই ঈদসংখ্যার জন্য।

আপনার গল্প-উপন্যাসে নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে যৌন উপস্থিতিটা যেন একটু বেশিই থাকে। প্রেম বলতে আপনি আসলে কি বোঝেন?
আল মাহমুদ : যৌন দিকটা হয়ত থাকে এবং এটা একেবারে এড়িয়েও যাওয়া যায় না। এটা এড়িয়ে গেলে কিছুই থাকে না। আমি প্রেমের সম্পর্ক বলতে নর-নারীর সম্পর্কটাকেই বুঝি। শরীর এবং মানসিক দুটো ব্যপারই বুঝি। সম্পূর্ণ শারীরিকও না, সম্পূর্ণ মানসিকও না। দুটো মিলেই হয়। আমার গল্প-উপন্যাস আসলে আমার জীবনের ভেতর থেকেই এসেছে।

রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের ‘ডাক্তার জেকিল’ ও ‘মিস্টার হাইডে’র মত প্রত্যেকের মানুষের মধ্যেই দ্বৈত সত্তা থাকে? একটি পজিটিভ সত্তা, অপরটি নেগেটিভ। আপনার মধ্যে কোনটার প্রাধান্য বেশি বলে মনে করেন।
আল মাহমুদ : আমার মনে হয় যে পজিটিভ ধারণাই বেশি।

বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে একজন কবি হিসেবে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
আল মাহমুদ : আমার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই। সময়ের কারণেই বর্তমানে দেশের এরকম হয়েছে। আবার সময়ই সমাধান করে দেবে। আমি রাজনৈতিক লোক নই। রাজনৈতিকভাবে কোনো কিছু চিন্তা করি না। আমি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ লোক। আমি কোনো দল করি না। কোনো দলের প্রতি আমার পক্ষপাত নেই। কে গেল আসলো কিছুই যায় আসে না।

mahmud_shamsurআমরা দেখেছি, কোনো বিশেষ একটি দল ক্ষমতায় আসলে আপনার অবস্থা তুলনামুলকভাবে ভালো থাকে। আবার অন্য দল আসলে উল্টোটাও ঘটে। যেমন বর্তমান সরকারের আমলটা আপনার জন্য আসলে পজিটিভ না।
আল মাহমুদ :  আসলে মানুষ তা ধরে নেয়। কথা হলো যে, আমি তো আর কোনো দলীয় পক্ষপাত করি না। তারপরও মানুষ আন্দাজ করে কিছু। সেটা থেকে বিরত রাখতে পারি না।

‘সোনালী কবিনে’র কবিতাগুলো যখন লিখছিলেন সেই সময়টা সম্পর্কে বলুন। আপনি সনেট আকারেই বা কবিতাগুলো লিখতে গেলেন কেন?
আল মাহমুদ : ওই সময় সম্পর্কে বলতে পারব না। আমার ঠিকমত মনেও নেই। ওই বইয়ের কবিতাগুলো লেখার সময়, আমার মনে একটা কবিত্বের ধারণা সৃষ্টি হলো তাই লেখা। সনেট আকারেই কবিতাগুলো আসছে।

হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা বা শহীদ কাদরীর সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
আল মাহমুদ : আজাদ, ছফার সাথে কাদরীর তুলনা হয় না। শহীদ অন্যরকমের মানুষ। ওদের সাথে তার অনেক ফারাক।

হুমায়ুন আজাদের সাথে আপনার কখনো কবিতা নিয়ে কথা হতো না?
আল মাহমুদ : আজাদের সাথে কবিতা নিয়ে কথা হতো না। আজাদ আমাকে দেখলে বলত, মাহমুদ ভাই আসেন সিগারেট খাই...

আহমদ ছফা তো নাকি আপনাকে চাচা বলে ডাকতেন ? তার সাথে আপনার চাচা-ভাতিজা সম্পর্ক হলো কিভাবে?
আল মাহমুদ : ছফা আমাকে চাচা বলে ডাকতো। ওর সাথে চাচা-ভাতিজা সম্পর্ক কখন কিভাবে হয়েছিল তা মনে নেই। কিন্তু আমাকে চাচা বলে ডাকতো।

(এই পর্যায়ে এসে আল মাহমুদ একটি সিগারেট ধরালেন। ) মাহমুদ ভাই, আপনি কি এখনো গোলডিফ সিগারেটই খান...  কোন বয়স থেকে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছেন?

আল মাহমুদ : আমি সাধারণত গোলডিফ খাই। অনেক পরে- বেশি বয়সে সিগারেট খাওয়া শুরু করি। বলতে পারো ৩০-৩৫-এ গিয়ে শুরু করি ধূমপান।

অত বেশি বয়সে গিয়ে হঠাৎ সিগারেট ধরার কারণ কি? লেখালেখির সাথে এই ধূমপানের কোনো সম্পর্ক আছে নাকি কিংবা কোনো প্রেম-ট্রেম জাতীয় কোনো ব্যাপার...
আল মাহমুদ : এখন তো আর মনে নাই অত কথা। নেশা এটা। কোনো কারণ নাই- অকারণ...

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের অনেক কবিই গান লিখেছেন। আপনি গান লেখেননি?
আল মাহমুদ : গান লিখি নাই। আমি আমার কবিতাতেই গানের অনেকখানি অনুভব করতাম। গান না লেখার এটা একটা কারণ হতে পারে।

সাহিত্যের মধ্যে কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা থাকে বলে আপনি মনে করেন।
আল মাহমুদ : সাহিত্যের সত্যটা সত্যই। এর মধ্যে কোনো মিথ্যা থাকে না। কল্পনা থাকে, রূপক থাকে, তবে এটাকে কেউ মিথ্যা বলে না। ওই অর্থে সত্যটুকুনই বেশি।

PhotoGalleryআপনি যে আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথাগুলো বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন তাকি পুরোপুরি সত্য? তাতেও কি কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন?

আল মাহমুদ : আত্মজীবনী বলতে ঠিক যা বোঝায় তা আমি লিখতে পারি নাই। এটা আমার হয়ে ওঠেনি। দুটো মিলিয়েই লিখেছি। জীবনের ঘটনা বললেও কল্পনা মিশ্রিত করে বলেছি। সব ঘটনা বাস্তব নয় কিছু কিছু বাস্তব আছে।

মৃত্যুচিন্তা আপানার লেখাতে কিভাবে এসেছে। এই মুহূর্তে আপনার মৃত্যুচিন্তা সম্পর্কে শুনতে চাচ্ছি।
আল মাহমুদ : মৃত্যুচিন্তা এক বিশেষ ধরণের বিষয়। আমার লেখাতে মৃত্যুচিন্তা আছে। মৃত্যু যেমন আছে, তেমনি মৃত্যুর ধারণাও আছে। তবে সেই মৃত্যুর ধারণা বা চিন্তা মানুষকে হতাশ করে না। মৃত্যুচিন্তা এখন মাঝে মাঝে আসে, তবে ওইরকম বেশি না।

আপনি আর কত বছর বাঁচতে চান?
আল মাহমুদ : যত দিন চিন্তার কার্যকারণগুলো নিজে বুঝতে পারি, ততদিন বাঁচতে চাই।

বাংলাদেশ সময় ১৯১০, জুলাই ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।