ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

টিস্যু বিক্রেতা

মূল : কাপকা কাসাবোভা, অনুবাদ : পাভেল মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৭ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১১
টিস্যু বিক্রেতা

কবি, গল্পকার ও ভ্রমণলেখক কাপকা কাসাবোভা। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৩ সালে বুলগেরিয়ার সোফিয়ায়।

তার শৈশব কেটেছে বুলগেরিয়াতে। পরে তিনি কর্মসূত্রে বসবাস করেছেন ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডে। বর্তমানে স্থায়িভাবে  আছেন স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে।

তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘অল রোডস লিড টু দ্য সি’ (১৯৯৭), ‘ডিসমেম্বারমেন্ট’ (১৯৯৮), ‘লাভ ইন দ্য ল্যান্ড অফ মিডাস’ (২০১১), ‘টুয়েলভ মিনিটস অফ লাভ’, ‘এ ট্যাঙ্গো স্টোরি’ (২০১১)। ২০০৮ সালে তার ‘স্ট্রিট উইদাউট এ নেম : চাইল্ডহুড অ্যান্ড আদার মিস অ্যাডভেঞ্চার ইন বুলগেরিয়া’ সারা বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছিল। এখানে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা হলো তার ‘টিস্যু সেলার’ গল্পটি।

তার ছিল নীল চোখ। তার চাউনিটা অনেকটা বলিউডের নায়কের মতো। কিন্তু সে বলিউডের কোনো নায়ক নয়। সে ছিল একজন টিস্যু বিক্রেতা। বোম্বের ব্যস্ত পথে পাঁচ নং ট্রাফিক লাইটের নিচে টিস্যু বিক্রি করত। তার শক্ত কাগজের তৈরি খাড়া টিস্যুবক্সে রঙিন কালি দিয়ে পাশ্চাত্য ঢঙে বড় বড় অক্ষরের উদ্দিপ্ত বাক্য লেখা থাকতো। সেগুলোতে থাকত নানান আশার বাণী।

সে রাস্তার পঞ্চম সারি ধরে হেলেদুলে এগিয়ে যেত। টিস্যুর বাক্স নিয়ে গাড়িগুলোর কাচের দিকে উদাসিনভাবে বসে থাকা যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতো, যাত্রীরা তার প্রতি উদাসীন, মুষ্টিবদ্ধরত, অবজ্ঞাভরা চোখে তাকাতো এবং তাকে টিস্যুর মতো তাচ্ছিল্যপূর্ণ কোনো বস্তু মনে করতো। যাত্রীদের বিরক্তিই যেন তার প্রাপ্য। সে সেদিন দুটি লাল বাতির মধ্যে দাঁড়িয়ে তপ্তরোদ সহ্য করছিল। ভাবছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে সরে যাবে। হঠাৎ সে একটি চকচকে জিপগাড়ি দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেল, ভেতরে একজন মেম বসে। দৌড়ে তার কাছে গেল।

টিস্যু বিক্রির জন্য মেমসাহেবের প্রতি অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে কাকুতি মিনতি করল, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। অন্যান্য দিনের মতই তার ভাগ্যে জুটলো উদাসিনতা, তাচ্ছিল্য এবং নির্দয়তা। জিপটি তখনও চলে যায়নি, প্রথম সারিতে থেমে। তার মধ্যে ভয় কাজ করছিল, একটু পরেই সবুজবাতি জ্বলে উঠবে। হয়ত তার আজকের টিস্যু বিক্রির প্রথম এবং সর্বশেষ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু মেমসাহেবের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, পেছনের সিটে নির্বিকারভাবে বসে আছেন। জিপের ড্রাইভার কপাল থেকে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছে। টিস্যু বিক্রেতা মেম সাহেবের দিকে চিৎকার দিয়ে করুণভাবে আবারও বলতে শুরু করলো- ম্যাডাম বিশ রুপি। ড্রাইভার তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো। মুহূর্তেই টিস্যু বিক্রেতার হাত থেকে একটি বাক্স পড়ে গেল, সে তার মুক্ত একটি হাত দিয়ে মেমসাহেবের গাড়ির গ্লাসে আঘাত করতে থাকলো।

 মেমসাহেব তার দিকে ইতস্তত ভঙ্গিতে তাকালেন। সে এবার পুনরায় চিৎকার করে করুণ স্বরে বলল, ম্যাডাম পনেরো রুপি। তারপর সে তার মুখ কাচের ভেতর ঠেসে ধরল। ওই অবস্থায়ই আরেকটি বাক্স রাস্তায় পড়ে গেল, কিন্তু সেটা ঝুকে তোলার ঝুঁকি সে নিল না।

মেমসাহেব ছোট কাগজের টুকরায় কিছু লিখল এবং তার ড্রাইভারকে দিল। গাড়িটি কিছুক্ষণের জন্য থেমে থাকলো। কিন্তু ঘৃণিত সেই সবুজ সংকেত তার বিরুদ্ধে যেন, শয়তান ট্রাফিক সিগনাল ছেড়ে দিল। সে জিপটির পেছনে দৌড়াতে লাগল। জিপটি শুরুতে ধীরে ধীরে চলছিল, সাথে সাথে সেই শাদা মুখের মেমসাহেবটিও। যে মুখটি তার দিকে বিষ্মিত হয়ে তাকিয়েছিল।

সে হাজারও গাড়ির শব্দের ভেতর চিৎকার করতে থাকলো- ম্যাডাম...। তারপর দুই বাহু দিয়ে বাক্সগুলো ধরার চেষ্টা করলো। দ্রুত দৌড়ানোর জন্য বাম বগল মুক্ত করলে কয়েকটি বাক্স আবার পড়ে গেল। চারদিকে বিকট স্বরে হর্ন বাজার শব্দ। কিন্তু সে তার চেয়ে বিকট শব্দে ডেকে উঠল- ম্যাডাম, ম্যা...ডা..ম। সে  কোনোভাবেই চাচ্ছিল না শাদা জিপ গাড়িটি দৃষ্টির বাইরে চলে যাক। যদিও গাড়িটি সহস্র গাড়ির ভেতর ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছিল।

দৌড়াতে দৌড়াতে তীব্র রোদে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। তার জন্য এটা ছিল টিস্যু বিক্রির ওই দিনের প্রথম এবং শেষ সুযোগ। সে দৌড়াচ্ছিল এবং রাস্তায় পড়ে যাওয়া বাক্সগুলোর কথা ভাবছিল- যদি সেগুলো চাকায় পিষ্ট হয়ে যায়! পরে ভাবলো পিষ্ট হোক, ঐ রকম বাক্স বিক্রির জন্য আরো আছে। যেন বাক্সগুলো পিষ্ট হলে তার কোন আক্ষেপ নেই। ঠিক তখনই ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা। জিপ গাড়িটি মোড় ঘুরিয়ে রাস্তা পরিবর্তন করে তার দিকে ফিরে আসতে লাগল।

সে অবাক দৃষ্টি নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তখন তার মাংস ভেদ করে যেন গাড়ির ধোঁয়া, শব্দ আর কাচের টুকরো ঢুকে যাচ্ছিল। কিন্তু কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছিল  না। সে আবার গাড়িটির কাছে গেল। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। অথবা সে ভাবছিল এ নিঃশ্বাসের কি কোন মূল্য আছে ?

মেম সাহেব তার গাড়ির কাচ নিচের দিকে নামিয়ে টিস্যু বিক্রেতার হাতে ৫০ রুপি দিল। সে ভাবল ৫০ রুপি! তারপর মেম সাহেবের কোলে দুটি বাক্স তুলে দিয়ে মুঠোর মধ্যে কাগজের নোটটি ধরে রাখলো। তার শুষ্ক মুখ দিয়ে ফিসফিসিয়ে শব্দ বের হল। সে বলল, ধন্যবাদ ম্যাডাম। মেম সাহেবের পাতলা ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তীব্র গরমেও টিস্যু বিক্রেতার ভেতর স্বস্তির অনুভূতি খেলা করলো। হয়ত মেম সাহেবও পুলকিত হয়েছিলেন টিস্যু বিক্রেতার ওই অনুভূতিতে।

কিন্তু টিস্যু বিক্রেতা এরপর আর কিছুই দেখল না। একটি ট্রাক হঠাৎ করে তাকে পেছন থেকে মাড়িয়ে দিয়ে গেল। বিষয়টি এত অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটল, যেমনটি ছিল এই গরমের মধ্যেও বিচলিত হয়ে মেম সাহেবের টিস্যু কেনার জন্য তার কাছে ফিরে আসা!

kapka

কাপকা কাসাবোভা

বাংলাদেশ সময় ১৪০০, জুলাই ০৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।