ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ : অর্ধশত বছর পরের পাঠ

ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫২ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১১
মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ : অর্ধশত বছর পরের পাঠ

মাইকেল মধুসূদন দত্তের (জন্ম : ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪; মৃত্যু : ২৯ জুন ১৮৭৩) আবির্ভাব ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে। উনিশ শতকের শুরুতে এ ভূখণ্ডে ঘটে নানান পরিবর্তন; বাংলার নবজাগরণের সে এক বিরাট শুভ সময়! ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন-মানবতা-ইতিহাস প্রভৃতির প্রভাব ভারতবাসীর জীবনে সামগ্রিকভাবে আমুল পরিবর্তনের আবহাওয়া প্রবাহিত করলো।

আত্মমুক্তির আবাহন আর সংস্কারমুক্তির চিন্তা তখন ভারতকে আন্দোলিত করেছিল। মধুসূদন সে জলবাতাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; সে সব প্রবণতা আত্মস্থ করেছিলেন বেশ দ্রুত। এছাড়া উনিশ শতকি দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা-স্পৃহাও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে।

মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল আধুনিক কবি। কবিতার বিষয় ও শৈলীতে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনাকারী কবি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারণার ভারতীয় সংস্করণ, দেশমাতার প্রতি অমিত ভালোবাসা, মহাকাব্য রচনা, অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি ও তার যথার্থ প্রয়োগ, সনেট রচনা, পত্রকাব্য রচনা, সফল ঐতিহাসিক নাটক, ট্র্যাজেডি ও কমেডি সৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে ও ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন এবং সৃজন-প্রয়াস বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে দান করেছে অভূতপূর্ব মর্যাদা ও সৌন্দর্য। বাংলা সাহিত্যে প্রথম মঞ্চসফল নাটক রচনার জন্যও তিনি সবিশেষ পরিচিত। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং এক অর্থে একমাত্র মহাকাব্যের মর্যাদায় আসীন; বাংলা ভাষায় সনেট সৃষ্টি ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত মধুসূদন অবিকল্প ব্যক্তিত্ব! পত্রকাব্য রচনায়ও তিনি দেখিয়েছেন পথপ্রদর্শকের প্রণোদনা। শেষ বয়সে আর্থিক প্রয়োজনে রচিত ফরমায়েসি নাটক ‘মায়াকানন’ ছাড়া তাঁর সাহিত্যকৃতির কোথাও কোনো দুর্বলতার ছাপ আজও চিহ্নিত হয়নি।

ইউরোপের প্রতি মাইকেলের প্রবল এবং আপাত অস্বাভাবিক ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়েছে; তিনি যে-কোনো উপায়ে এশিয়া পরিত্যাগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য তাঁর এ মানসিক অবস্থার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল সাহিত্যশিল্প চর্চায় ইউরোপের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অনুকূল আবহাওয়া। ইংরেজি ভাষাদক্ষতা ছিল মধুসূদনের বিশেষ যোগ্যতা। অল্পবয়সে কলেজে পড়ার সময়ে এ বৈশিষ্টের কারণে তিনি পরিচিত ও পণ্ডিতজনদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যশালার জন্য রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নবতী নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনি সবিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, বিশেষত ইংল্যান্ডপ্রীতির কারণেই কবি মধুসূদন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন; বিয়েও করেছিলেন খ্রিস্টান মহিলাকে; একজনকে নয়, দুজনকে। ধর্ম পরিবর্তন করে তিনি নামের আগে মাইকেল শব্দটি যুক্ত করেন। আসলে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে সারা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ও শিল্পভুবনে নিজেকে হাজির করা এবং খ্যাতি অর্জনের নেশা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল এই বাঙালি নাট্যকার-কবি শ্রী মধুসূদন দত্তকে। জানা যায়, তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, সংস্কৃত, তেলেগু, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় ভাষাও শিখেছিলেন এবং পাশ্চাত্য চিরায়ত সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলেন। মধুসূদনের যখন জন্ম তখন ভারতে সরকারি কাজকর্মের ভাষা ছিলো ফারসি। ১৮৩৫ খিস্টাব্দ থেকে আদালত এবং সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে চালু হয় ইংরেজি। তখন স্বাভাবিকভাবেই এদেশে ইংরেজি শেখার চাহিদা বাড়তে লাগলো!- এই সহজ সত্যটি, মধুসূদনের সাহিত্যপাঠের সময়, আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

তাঁর রচিত সাহিত্য : নাটক- ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০), ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১), ‘মায়াকানন’ (১৮৭৪); কাব্যনাট্য : ‘রিজিয়া’ [অসমাপ্ত] মহাকাব্য : ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১); কবিতাগ্রন্থ : ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০),‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২), ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (১৮৬৬); গদ্য : ‘হেক্টর-বধ’ (১৮৭১)। এছাড়া তিনি ইংরেজিতে গ্রন্থ রচনা করেছেন। মাদ্রাজে থাকাকালে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি। তাঁর প্রথম কাব্য ‘ক্যাপটিভ লেডি’; গ্রন্থটি বাজারসাফল্য বা পাঠকপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। ১৯৪২ সালে বিলেতের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কবিতা পাঠানোর আগেই কলকাতার পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছিল; অবশ্য সেগুলোতে বায়রন-শেলি-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-রিচার্ডসন-কীটসের প্রভাবে রোম্যান্টিক ভাবধারাই প্রকাশ পেয়েছিল; পাশ্চাত্যপ্রেম আর নীলনয়না নারীর প্রতি আকর্ষণই ছিল তাঁর তখনকার সৃজন-কল্পনার মূল ভিত্তি! ১৯৪৬ সালের পর, মাদ্রাজে থাকাকালে (একটি বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকুরিসূত্রে; অবশ্য ওই বিদ্যাপীঠে কোনো প্রধান শিক্ষক ছিলেন না এবং পদও ছিল মাত্র একটি) প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নে।

madhu

কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যশালার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তিনি অনুভব করেন যে আন্তর্জাতিক নাট্যপরিসর থেকে বাংলা নাটক অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাই তিনি তাঁর ভাষায় রচিত নাটকের দৈন্যদশা দূর করার জন্য পাশ্চাত্য ও সংস্কৃত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নাটক চর্চা শুরু করেন। অতঃপর মধুকবি বেলগাছিয়ার রাজাদের অনুরোধে ও আনুকূল্যে হাস্যরসসমৃদ্ধ ছোট আকারের নাটক (এ ধরনের নাটককে প্রহসন বলা চলে) লেখায় মনোযোগ স্থাপন করেন। অল্প সময়েই ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রচনা করেন তিনি। এই প্রহসনগুলোতে তিনি বিশেষভাবে পাশ্চাত্য নাট্যরুচি অনুযায়ী বাস্তবানুগ পরিবেশনা উপস্থাপন করতে সমর্থ হন।

নাট্যকার মাইকেল ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ গ্রন্থটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। সম্ভবত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার আগাম সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তিনি আর সে নাম রাখতে পারেননি। হিন্দু সমাজকে আক্রমণ করার কোনো অভিপ্রায় হয়তো তাঁর ছিল না। তাই তিনি কেবল ব্যক্তিপ্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে বৃদ্ধ জমিদারের চরিত্রকেই সামনে এনেছেন।

প্রহসন সাধারণভাবে কমেডি জাতীয় সৃষ্টি। সমাজের বিবিধ অনাচারকে আঘাত করা এবং অনাচারের প্রকোপ থেকে সমাজ ও সামাজিক মানুষকে মুক্ত রাখার উপায় বাতলে দেওয়ার জন্য রহস্যমণ্ডিত ও হাস্যরসঘেরা এই ক্ষুদ্রাকৃতির নাটক লেখা হয়ে থাকে। চিত্রের ও ঘটনার অসামঞ্জস্য, আকস্মিকতা, অতিরঞ্জন প্রহসনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই প্রকৃতির নাটকে গভীর উপলব্ধির প্রকাশ থাকে না; তামাশা, পরিহাস আর চটুল সংলাপের উপস্থিতি থাকে। তবে দর্শক নাটকের বিষয় নিয়ে ভাববার সুযোগ পায়, সচেতনও হয়ে ওঠে কখনো কখনো।

মধুসূদন বিশেষভাবে ভারতের গ্রাম ও শহর জীবনে জেঁকে-বসা অশালীনতা আর অনাচারকে পাঠকের সামনে হাজির করার জন্য দুটি পরিপ্রেক্ষিতে দুটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন। আলাদা আলাদা কাহিনী দুটির মধ্য দিয়ে তিনি পুরো সমাজকেই উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। গ্রামের আর শহরের জীবন-পদ্ধতি ও মান ভিন্ন; তাই ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাসে তিনি আঁকতে চেয়েছেন বাস্তবতার স্বরূপ।

‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে তিনি তুলে ধরেছেন আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত তৎকালীন শহরবাসীর মদাসক্তিজনিত বেপরোয়া জীবনের চিত্রাবলি। পুরুষের ঘরের বাইরে আড্ডা-মদ-বারবনিতার প্রতি আকর্ষণ আর তদজনিত ঘরের বধূদের বাসনা-কামনা-স্বপ্ন-সাধ অপূরণের যন্ত্রণা নাটকটির বিষয় হয়েছে লেখকের বিশেষ অভিনিবেশের কারণে। সম্ভবত সমাজের বিনষ্টিকেই তিনি উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কাহিনীটির পটভূমি কলকাতা নগর। অপরদিকে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটিতে মধুসূদন সামন্তব্যবস্থার অধীনে থাকা গ্রামীণ সমাজের জমিদারদের দৌরাত্ম আর নারীলোলুপতার কথা শুনিয়েছেন তাঁর পাঠককে। এই কাহিনীতে ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে। সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু জাতির ধর্মবোধ এবং উচ্চবিত্ত-ক্ষমতাবানদের ধর্মের প্রতি গোপন-অনীহার বিষয়াদি নাট্যকার প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত সফলতার সাথে। এখানে মূলত ভণ্ড ধার্মিক বৃদ্ধদের চরিত্রের স্বরূপ পরিবেশন করতে চেয়েছেন তিনি। কাহিনীর পটভূমি ভারতের নিভৃত গ্রাম।

নাট্যকার মাইকেল ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ গ্রন্থটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। সম্ভবত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার আগাম সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তিনি আর সে নাম রাখতে পারেননি। হিন্দু সমাজকে আক্রমণ করার কোনো অভিপ্রায় হয়তো তাঁর ছিল না। তাই তিনি কেবল ব্যক্তিপ্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে বৃদ্ধ জমিদারের চরিত্রকেই সামনে এনেছেন।

ভক্তপ্রসাদ বাবু, পঞ্চানন বাচষ্পতি, আনন্দ বাবু, গদাধর, হানিফ গাজি, রাম, পুঁটি, ফতেমা, ভগী, পঞ্চী- প্রহসনটির চরিত্ররা প্রত্যেকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে ও ভূমিকায় উজ্জ্বল।

sonali_dorshonir

জমিদার ভক্তপ্রসাদ প্রজার প্রতি আন্তরিক নয়; খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর। বিন্দুমাত্র সহানুভূতি প্রদর্শন করে না এই জমিদার। অবশ্য ভক্তপ্রসাদের এই আচরণের মধ্য দিয়ে আমরা জমিদারি প্রথার একটি সাধারণ ছবির সাথেই পরিচিত হই। ইংরেজের তাবেদার লাভ আর লোভের প্রতি নিমগ্ন জমিদাররা তাদের স্বজাতি প্রজাদের ওপর নির্মম আচরণই করেছে বরাবর। বর্তমান নাটকে হানিফ গাজি যখন তার ফসলের দুরবস্থার কথা অবগত করে খাজনা মওকুফ বা অন্য কোনো সম্ভব সহযোগিতা চাইলে ভক্ত সাফ জানিয়ে দেয় ‘তোমাদের ফসল হৌক আর না হৌক তাতে আমার কি বয়ে গেল। ... কোম্পানীর সরকার তো আমাকে ছাড়বে না। ’

জমিদারের অমানবিকতার আরো ছবি মিলবে এ নাটকে। যেমন বাচষ্পতির উক্তিতে ‘যে বিঘে কুড়িক ব্রক্ষ্মত্র ছিল তা তিনি কেড়ে নিয়েছেন, আর এই দায়ের সময় গিয়ে জানালেম, তা তিনি বল্যেন যে এখন আমার বড় কুসময়, আমি কিছু দিতে পার্বো না;’

জমিদার ভক্তপ্রসাদ নারীলোলুপ। কিশোরী-যুবতী-বৃদ্ধা, হিন্দু-মুসলিম কোনো জাতবিচার করে না সে; নারীদেহের প্রতি তাঁর প্রবল-অস্বাভাবিক ঝোঁক। নাট্যকার অত্যন্ত কৌতুকাবহ পরিবেশে পরিবেশন করেছেন ভক্তপ্রসাদের নারীলিপ্সার ছবি; ভক্তের এ বিষয়ক অনুভূতির কথা জানাচ্ছেন মধুসূদন- ‘হাঁ, স্ত্রীলোক- তাদের আবার জাত কি? তারা তো সাক্ষাৎ প্রকৃতিস্বরূপা, এমন তো আমাদের শাস্ত্রেও প্রমাণ পাওয়া যাচ্যে; বড় সুন্দরী বটে আঁ?’

সমাজে একটি সুবিধাভোগী শ্রেনী রয়েছে, যারা অন্যের অপকর্মের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গোছানোর জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে। এ প্রহসনের গদা এমনই এক চরিত্র। জমিদারের নারীসঙ্গকে সহায়তা করার জন্য সে বাগিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভক্তদের অপকর্মকে প্রশ্রয় ও প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পেছনে গদাদের ভূমিকা অনেক। সমাজের নিরীহ ও বিপন্ন নারীদেরকে গদারা সবসময় পণ্য বানিয়ে একরকম বিক্রি করেছে নারীলোভী পুরুষরূপী পশুদের কাছে। দরিদ্র-অসহায় প্রজার ঘরের লক্ষ্মীকে দাঁড় করিয়েছে সম্মানহীনতার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। নারীর সম্ভ্রমকে লুটিয়ে দিয়েছে বিনা দ্বিধায়। গদার মুখে পাঠক শুনতে পায় চিরায়ত এই ভণ্ডামির কথামালা- ‘কত্তাটি এমনি খেপে উঠলেই তো আমরা বাঁচি,- গো মড়কেই মুচির পার্বণ। ’

গদার কণ্ঠে আমরা আরো শুনতে পাই দুর্নীতিপরায়নদের জীবন-পদ্ধতির আড়ম্বরতা সম্বন্ধে অভিব্যক্তি। মানুষ কেন অন্যায় করে, কেন অন্যের ধন-সম্পদ নিজের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে, তার একটি সরল বিবরণ নাট্যকার তুলে ধরেছেন গদার অনুভবের মাধ্যমে। জমিদারের অনুপস্থিতিতে তাঁর গদির ওপর বসে গদা বলছে- ‘আহা, কি আরামের জিনিস। এই বাবু বেটারাই মজা করে নিলে। যারা ভাতের সঙ্গে বাটি বাটি ঘি আর দুদ খায়, আর এমনি বালিশের উপর ঠেস দিয়ে বসে কাদের কত্যে সুখী কি আর আছে?’

হানিফ সমাজের সচেতন ও প্রতিবাদী চরিত্রের প্রতিনিধি। সে অন্যায়ের প্রতি নিরাবেগ প্রতিবাদ জানাতে জানে; প্রতিবাদের কৌশল প্রয়োগ করতে জানে; শোষক-শাসকের প্রতি প্রবল ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে দিতে জানে। অশিক্ষিত ও পিছিয়ে-পড়া নিভৃত পল্লিতে হানিফের মতো সাহসী ও বুদ্ধিমান মানুষের উপস্থিতি যে জমিদারদের অন্যায়ের মোকাবেলা করার জন্য কত প্রয়োজন, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। মধুসূদন এমন একটি চরিত্র নির্মাণ করে নাটকটির পাঠককে তৎকালীন সমাজের প্রকৃত ছবি সম্বন্ধে বিশ্বস্ত ধারণা প্রদান করতে চেয়েছেন। হানিফ বলছে, ‘এমন গোরুখোর হারামজাদা কি হেঁদুদের বিচে (মধ্যে) আর দুজন আছে? শালা রাইওৎ বেচারীগো জানে মার‌্যে, ত্যাগের সব লুটে লিয়ে, তারপর এই করে। আচ্ছা দেখি, এ কুম্পানির মুলুকে এনছাফ (ন্যায়বিচার) আছে কি না। বেটা কাফেরকে আমি গোরু খাওয়ায়ে তবে ছাড়বো। বেটার এত বড় মকদুর (দুঃসাহস)। আমি গরীব হলাম বল্যে বয়ে গেলো কি? আমার বাপ দাদা নওয়াবের সরকারে চাকুরী করেছে আর মোর বুন কখনো বারয়ৈ গিয়ে তো কসবগিরি (বেশ্যাবৃত্তি) করেনি। ’

হানিফ বিপ্লবি চরিত্র। গ্রাম্য ভণ্ড ও নারীলোলুপ জমিদারকে শায়েস্তা করার জন্য স্ত্রীকে পর্যন্ত কাহিনিচিত্রের সামনে ঠেলে দিয়েছে। পরিবার ও ব্যক্তির মর্যাদার চেয়ে সমাজকে, অগণিত মানুষের মর্যাদা ও সম্ভ্রমকে সে বিবেচনায় রেখেছে বেশি। তাইতো ভক্তকে শায়েস্তা করার জন্য অন্ধকার রাতে শিবমন্দিরের সামনে তার স্ত্রীকে যেতে সকল সহযোগিতা করেছে সে। অবশ্য তার নাটকের জাল সম্বন্ধে টের পায়নি জমিদারের কোনো সহযোগীও। জমিদারতো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি গ্রাম্য প্রজা হানিফের কৌশল।

হানিফের স্ত্রী ফতেমা সাহসী নারী। আত্মমর্যাদা আর আত্ম-উপলব্ধিতে বলীয়ান এই রমণী নারী সমাজের সম্ভ্রম রক্ষায় বিরলপ্রায় ভূমিকা পালন করেছে। লম্পট জমিদারের নারীলোভের আতিশয্যকে; সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাবকে দূর করার জন্য ফতেমার ভূমিকা অতি অবশ্যই ব্যতিক্রমি।

madhu-ssmভণ্ড-প্রতারক-লম্পট জমিদার ভক্তপ্রসাদের মুখে আমরা শুনতে পাই সমকালীন সমাজ ও ধর্মাচার সম্বন্ধে উৎকণ্ঠা। নাট্যকার সম্ভবত লোকটির হঠকারিতাকে প্রকাশ করবার জন্য এই বাস্তবানুগ কৌতুকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকবেন। উদাহরণ : ‘আমার বোধ হয় অম্বিকাপ্রসাদ কখনই এমন কুকর্মচারী হবে না- সে আমার ছেলে কি না প্রভো! তুমিই সত্য! ভাল, আমি শুনেছি যে কলকেতায় না কি সব একাকার হয়ে যাচ্ছে? কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, কৈবর্ত, সোনারবেণে, কপালী, তাঁতী, জোলা, তেলী, সকলই না কি একত্রে উঠে বসে, আর খাওয়া দাওয়াও করে? বাপু, এ সকল কি সত্য?’

নারীলোলুপ ভক্তপ্রসাদ নিজের অপকর্মকে ধর্মাচারের আড়ালে ঢাকবার চেষ্টা করেছে। নিজেকে ধার্মিক হিসেবে প্রকাশ করবার একটি অসৎ ইচ্ছাও তার ভেতর ক্রিয়াশীল ছিল। যেমন সন্ধ্যায় নারীসঙ্গলাভের প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে কিংবা দরকারি প্রস্তুতি নিতে গিয়ে সে বলেছে- ‘যদি কেউ আসে তো বলিস যে আমি এখন জপে আছি। ’

প্রকৃতপক্ষে সে যে ধার্মিক নয় তা আমরা আরো পরিষ্কার করে জানতে পারি ফতেমাকে পাবার জন্য যখন তাকে শিবমন্দিরে হাজির হতে হলো, তখনকার তার অভিব্যক্তি থেকে। প্রথমে সে শিবমন্দিরের মধ্যে নারীসঙ্গলাভের ব্যাপারে কিঞ্চিত আপত্তি করলেও পরে একটি যুক্তি খাড়া করেছে। ভক্ত বলছে- ‘অ্যাঁ- মন্দিরের মধ্যে?- হাঁ, তা ভগ্ন শিবে তো হিন্দুত্ব নাই, তার ব্যবস্থাও নিয়েছি। বিশেষ এমন স্বর্গের অপ্সরীর জন্যে হিন্দয়ানি ত্যাগ করাই বা কোন ছার?’

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘বুড় সালিকের ঘারে রোঁ’ প্রহসনটির মধ্য দিয়ে তৎকালীন গ্রামসমাজের নষ্টামির ছবি এঁকেছেন; ব্যক্তির চরিত্রের দুর্বলতাকে কিংবা নীচতাকে তুলে ধরেছেন। সামাজিকের বোধোদয় ঘটাবার দিকে নাট্যকারের বিশেষ অভিনিবেশ ছিল বলেও ধারণা করা যায়। কাহিনির শেষে জমিদারের আত্ম-উপলব্ধি জাগ্রত করার চেষ্টার মাধ্যমে লেখকের সেরকম বাসনার কথাই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত ভক্তপ্রসাদের অনুশোচনা ও উত্তরণের বিষয়াদিকে উপস্থাপনের জন্য কতিপয় উদ্ধৃতি পরিবেশন করা হলো

ক) ভক্ত : ‘আমি যেমন কর্ম করেছিলেম তার উপযুক্ত ফলও পেয়েছি। আ হ্যা দেখ ভাই, তোমার হাতে ধরে বলচি, এই ভিক্ষাটি আমাকে দেও, যে এ কথা যেন কেউ টের না পায়। বুড় বয়েসে এমন কথা প্রকাশ হলে আমার কুলমানে একেবারে ছাই পোড়বে। ’

খ) বাচষ্পতি : ‘কত্তাবাবু, কর্মটা বড় গর্হিত হয়েছে অবশ্যই বলতে হবে; কিন্তু যখন ব্রাহ্মণে কিঞ্চিত দান কত্যে স্বীকার হলেন, তখন তার তো এক প্রকার প্রায়শ্চিত্তই করা হলো,’

গ) ভক্ত : ‘এ জঘন্য কর্মটাই আজ অবধি দূর কল্যেম। এততেও যদি ভক্তপ্রসাদের চেতনা না হয়, তবে তাঁর বাড়া গর্দভ আর নাই। ’

ঘ) ভক্ত : ‘তোমাদের হাতে আমি আজ বিলক্ষণ উপদেশ পেলেম। এ উপকার আমি চিরকালই স্বীকার করবো। আমি যেমন অশেষ দোষে দোষী ছিলাম, তেমনি তার সমুচিত প্রতিফলও পেয়েছি। ’

আমরা বোধ হয় অনুধাবন করতে পারি যে মধুসূদন আধুনিক মননের শিল্পী; সংস্কারক এবং ইতিবাচক প্রবণতার সফল রূপকার। কবিতায় যেমন, তেমন নাটকেও তিনি সিদ্ধহস্ত। আর প্রহসনের মাধ্যমে তিনি সরলপ্রাণ মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন। মানুষের অনুভবজ্ঞানকে নাড়া দেবার জন্য কিংবা ঔচিত্যবোধকে শাণিত করার জন্য তাঁর যে সৃজনকর্ম, তা আমাদেরকে আরো অনেককাল অনুপ্রাণিত করবে।

বাংলাদেশ সময় ১২২৫, জুন ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।