ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সময়, এক আলেয়ার ফুল

চল্লিশ বছরে আমাদের সিনেমার অর্জন-বিসর্জন

নূরুল আলম আতিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১১
চল্লিশ বছরে আমাদের সিনেমার অর্জন-বিসর্জন

‘...মস্তিষ্কে সামান্য সাধ নিয়ে ক্লিষ্ট প্রজাপতি
পাখাময় রেখাচিত্র যে নিয়মে ফুটিয়ে তুলেছে
সে নিয়ম মনে রাখো...’         -বিনয় মজুমদার

সময়, এক আলেয়ার ফুল। মানুষ বাঁচে তার সময়ে, স্মৃতিতে আর শ্রুতিতে, বাঁচে তার কর্মে।

হাজার বছর ধরে এই ভূখণ্ডের মানুষ অনেক নিগ্রহ সহ্য করে অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের ওঁঙ্কার শুনেছিল বছর চল্লিশ আগে, প্রায় আমারই জন্মমুহূর্তে। ‘এয়ার রেইডের সাইরেন’ ঢেকে দিয়েছিল কানের পর্দা, চোখ মেলেই ‘ট্রেঞ্চের’ ভয়ার্ত মুখমালা। ধুলিমাখা শৈশবে নানুবাড়ির মাঠে দেখেছিলাম যুদ্ধের ছবি, স্থানীয় দর্শকমুখে সেটা ছিল ‘পাবলিসিটি’; সম্ভবত: চীন-জাপানের যুদ্ধভিত্তিক কোনো প্রপাগাণ্ডা ফিল্ম। ১৯৭১ সালে জহির রায়হান নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখেছি অনেক পরে, কৈশোর পেরিয়ে। ততোদিনে জেনেছি, স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের আর্ত চেহারাটা হাজির ক’রে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কীভাবে জনমত তৈরি করেছিল ছবিটি। ফিল্ম সোসাইটিতে আনাগোনায় দেশ বিদেশের ডকুমেন্টারি ছবি দেখার সুবাদে জেনেছি শৈল্পিক বিচারেও ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) কেন অনন্য।

৭১’র পর চল্লিশ বছর পেরিয়েছে; পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্য উঠেছে হাজারেও বেশিবার, অজস্র নদীপ্রান্তের বিস্তীর্ণ সবুজে ঘাসফুল ফুটেছে অনেক। চলুন এই চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের সিনেমায় কি কি ফুল ফুটলো তার নমুনা পরখ করে দেখি। ফুল বিভিন্ন কোনোটা রঙ, রূপ, সৌগন্ধে আমোদ বিলায়, আবার কোনোটা বিষাক্ত। কোনো কোনো ফুল আবার ভুলেরও জন্ম দিতে পারে। আর হ্যাঁ, এই লিখন স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কোনো ইতিহাস নয় মোটে, বরং একজন চলচ্চিত্রকর্মীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশ মাত্র।



কৈশোর কেটেছে মফস্বলে, টাঙ্গাইল শহরে। ফড়িংয়ের ওড়াওড়ি দেখেছি ঢের। আমার বয়স তখন ছয় কি সাত, ভাইটি এক বছরের ছোট। হঠাৎ ধাতব শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে আকাশে হেলিকপ্টার আবিষ্কার করি। জীবনে প্রথম হেলিকপ্টার দেখা, অনেকটা ফড়িংয়েরই মতো দেখতে। আকাশ থেকে ছর-ছর করে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজ নেমে আসছে। যেন সুতা কাটা ঘুড়ি একেকটা। দৌড়! কে কয়টা কুড়াতে পারি। এখন বুঝি, ঐসব রঙিন কাগজগুলো ছিল সরকারি লিফলেট। নীল আমস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনের পায়ের ছাপ মুদ্রিত চাঁদের ছবির যে বইটি ছিল, সেই বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রেখেছিলাম রঙিন সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের নির্দেশমালা। হেলিকপ্টারের শব্দ মুছে যেতেই কানে আসে ব্যান্ড পার্টির বিউগল, কর্নেট আর সানাইয়ের ঝংকার। ব্যান্ড পার্টির পেছনে বাঁশ আর চাটাইয়ের প্ল্যাকার্ড হাতে একটি ছোটখাটো প্রসেশন যেন। প্ল্যাকার্ডে মুদ্রিত আছে কিছু রঙচঙে মুখ, বেশ বড় সড় সব মুখচ্ছবি, তারা সিনেমার নায়ক-নায়িকা। তাদের মুখপানে চেয়ে পায়ে পায়ে মিছিলের অংশ হয়ে যাই দুই ভাই এবং একসময়ে আবিস্কার করি বাড়ির রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি! খান আতাউর রহমানের সুজন সখী (১৯৭৫), ছবিটি ‘রওশন টকিজ’এ মা-খালাদের সাথে দেখতে গিয়ে পোস্টারের নায়ক-নায়িকাদের চিনে ফেলেছিলাম।

তিতাস একটি নদীর নামটাঙ্গাইল শহরে তখনও ঘোড়ায় টানা এক্কা-গাড়ির প্রচলন ছিল। পরহেজগার নানার নজর এড়িয়ে মা-খালা’রা আব্রু রক্ষা করে এমন একটি গাড়িতে চেপে বসেছিলেন, যেটা ছিল শাড়ি-কাপড়ে মোড়ানো, আমার ছটফট লাগছিল পর্দার ওপাশে ছুটন্ত ঘোড়াটিকে একনজর দেখবার জন্যে। যাহোক, পরবর্তী পরিণতি ভালো হয়নি। বুড়ো নানার কাছে ধরা খেয়েছিলাম সবাই, তাঁর বাঁকা লাঠির হাত থেকেও রেহাই মেলেনি। তবু কন্যাদের সিনেমা নিয়ে স্বপ্ন, গালগপ্পের কমতি ঘটেনি। একে-অন্যের মাথার উকুন বাছতে বাছতে তাদের বলতে শুনেছি কবরীর সাজ-পোশাকের সুখ্যাতি, শাড়ী পড়বার রীতি, কানপাশা ঝুমকা’র কথা; রাজ্জাকের চুলের কাটিং, ফারুকের পুরুষালি গলার স্বরভঙ্গি, মায়া হাজারিকার কুটিল চেহারা, রওশন জামিলের দুর্দান্ত অভিনয় ইত্যাদি ইত্যাদি কতো যে কথা। ‘মায়ের চেয়ে আপন কেহ নাই’, ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’, ‘বন্ধু তুমি শক্রু তুমি’, ‘সত্যের জয় হবেই’, ‘দেশ আমার মাটি আমার’ এইসব ধারণার প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমা তাদেরকে নিজেদের সংসার-জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শুধু প্ররোচনাই দেয়না, বিনোদনের এক দুর্নিবার উৎস হয়ে ওঠে।   আর এতোদিনে জেনেছি, এই সামান্য ব্যক্তিগত অনুভূতিমালা বাংলাদেশের সিনেমার উত্থান-পতনের ইতিহাসে এক নতুন পাঠের সূচনা করতে পারে। কারণ,এই মা-খালারা, মহিলারা হলে গিয়ে সিনেমা দেখলে বাংলা সিনেমা বেঁচে থাকে, তারা মুখ ফেরালে আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়ে।



‘...বালুময় বেলাভূমি চিত্রিত করার পরেকার
তরঙ্গের মতো লুপ্ত, অবলুপ্ত তুমি, মনোলীনা।
এতোকাল মনে হতো, তুমিও এসেছ অভিসারে
চাঁদের উপর দিয়ে স্বচ্ছ মেঘ ভেসে ভেসে গেলে
যেমন প্রতীতি হয়, মেঘ নয়, চাঁদ চলমান। ...’         - বিনয় মজুমদার

আমরা বলছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে এই চল্লিশ বছরে সিনেমার অর্জন, বর্জন, বিসর্জন, সংযোজনের কথা। তবু আবারও ব্যক্তিগত কথামালায় ফিরে আসি। সিনেমা-প্রেমে নিজেকে যুক্ত করবার কথা।

কৈশোর পেরিয়ে কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় কাজিন রুমি ভাইয়ের সাথে ধানমন্ডির শংকরে অস্থায়ী বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে যাবার সুযোগ ঘটেছিল। আলেকজান্দ্রার ক্লুগে’র ওয়েজেস অব ফিয়ার দেখে রীতিমত চমকে যাই। পরিচয় ঘটে মোরশেদুল ইসলাম, ইফতেখারুল ইসলাম টিটন, জাকির হোসেন রাজু এরকম আরও কারও কারও সাথে। যারা ‘চলচ্চিত্রম’ নামে একটি চলচ্চিত্র সংসদ পরিচালনা করেন। দেশ-বিদেশের ছবি দেখবার লোভে সেখানে নাম লেখাই। বাংলাদেশের সিনেমার সার্বিক উন্নতির আকাঙ্খায় সেই ১৯৬৩ সালে সূচিত হয়েছিল পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির, পরবর্তিতে যার নাম হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি’। এই দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে যেই মানুষটি আজ অবধি সিনেমার জন্য জীবনপাত করে যাচ্ছেন তাঁর নাম মুহম্মদ খসরু। ততোদিনে মুহম্মদ খসরু ততোটা নিঃসঙ্গ নন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তৈরি হয়েছে প্রায় শত খানেক ফিল্ম সোসাইটি। এই ফিল্ম সোসাইটিগুলির উদ্যোগেই ১৯৭৮ সালে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খায় পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে সতীশ বাহাদুরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়; চলচ্চিত্র চর্চার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রণয়নের জন্য। একটি ফিল্ম আর্কাইভের জন্ম হলো, কিন্তু হায়! সেটি আজো কোনো পূর্নাঙ্গ চেহারা পেল না; আর ফিল্ম ইনস্টিটিউট কেবল ‘স্বপ্নের বোঝা’ হয়েই থাকলো। ব্যর্থতার দায়টুকু সরকারেরও।

ততদিনে চলচ্চিত্রের পাঠশালায় নাম লেখানোর সুবাদে, বিবিধ পাঠচক্রে এবং অ্যাপ্রিসেয়েশন কোর্সের অংশ হিসেবে ‘এদেশের রূপালী পর্দার সোনালী অতীত’-এর কিছু নমুনাও দেখা হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে এ. জে. কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (১৯৬০); এ ছবিতে জহির রায়হান শিক্ষানবীশী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁকে আমরা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চলচ্চিত্রকার হিসেবে হাজির হতে দেখবো। শুধু সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারই নন, বাংলাদেশের একেবারেই নিজস্ব জায়গা-জমিনটুকুর পত্তন নেবার মানসিক চিন্তার রূপকারও তিনি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে আসা অগ্রবর্তী দলের যুবক রায়হান এদেশের চলচ্চিত্রের বরফ গলাতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন আরেকটি ফাল্গুন রচনা করতে। তৎকালীন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে উর্দু ছবির হিড়িকের মধ্যেও ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৬৯), ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১)-এ তাঁকে উদীয়মান বাংলাদেশের ‘জাতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা’ অন্নেষণ করতে দেখি।

নদী এদেশের প্রাণ। বাংলার কৃষকেরা নদীকে মায়ের মতোই দেখেছে চিরকাল। শিল্পী মুর্তাজা বশীরের চিত্রনাট্যে সাদেক খান নির্মাণ করলেন ‘নদী ও নারী’ (১৯৬৫)। নদী ও নারীর যোগসূত্র তাঁরা অনেক সংবেদনশীলতার সাথে চিত্রিত করেছিলেন রূপালী পর্দায়। শিল্পগুণ বিচারের বাইরেই ছবিটি একটি জাতীয় ভাবনার ভাষাচিত্র হয়ে রইলো। এবং কাকতালীয়ভাবে একই বছর সালাহউদ্দিন নির্মাণ করলেন ‘রূপবান’ (১৯৬৫)। রূপবান একটি অনন্য ঘটনা। কবিগান, যাত্রাগান, পালাগান’র সঙ্গে পরিচিত বাংলাদেশের নিম্নবর্গের কৃষককূল পরিচিত থাকলেও রূপবান’র কারণে তাঁরা সিনেমা হলে ঢুকলেন। এতোকাল সিনেমা হলগুলো ছিল বিত্তবানদের বিনোদনের জায়গা। রূপবান-রহিম বাদশার প্রেম কাহিনী দেখতে গ্রামের মানুষ শহরমুখো হলেন। শোনা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে নৌকা সহযোগে থাকা-খাওয়া’র বন্দোবস্ত সমেত ‘রূপবান’ দেখতে এসেছিলেন তারা। পরিণত বয়েসে রূপবান দেখেছি। চলচ্চিত্রের বিশেষ কোনো গুণের সন্ধান না পেলেও রূপবানকে সময়ের জরুরী অনুষঙ্গ হিসেবেই পাঠ করি।

যাই হোক, ষাট দশকে এদেশের চলচ্চিত্রে বেশ কিছু অর্জন পাই সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান, বেবি ইসলাম প্রমুখ গুণী নির্মাতাদের হাত ধরে। ইদানীং সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমরা ঘুরেফিরে ষাট দশকের সিনেমার কথাই বলি। প্রবণতাটুকু ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’-এর মতোই অসহায়ত্বের প্রকাশ মাত্র। প্রয়োজন নতুন সিনেমা নির্মাণ, সময়ের নতুন নির্মিতির।

 

‘ক্ষম ক্ষম অপরাধ,
দাসের পানে একবার চাও হে দয়াময়।
বড় সংকটে পড়িলে দয়াল
    বারে বারে ডাকি তোমায়। ’    - লালন ফকির

shimana-peria, সীমানা পেরিয়ে সিনেমারি একটি দৃশ্যআবার শুরু করা যাক ১৯৭১ থেকে। ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১), ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ (১৯৭১), ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ (১৯৭১) এই ছবিগুলির মাধ্যমে পাকিস্তানী জান্তার নিরীহ বাঙালী নিধনের বয়ান জহির রায়হান ও তার সহযোদ্ধারা সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হলেন। উপদ্রুত বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশে রূপ নিলো। চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা এগারো জন’ (১৯৭২), সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী’ (১৯৭২), খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ (১৯৭৩), হারুন অর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ (১৯৭৬) মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্রের নমুনা। বলা ভালো, বেশিরভাগ যুদ্ধোত্তর চলচ্চিত্রে পাকিস্তানীর আর্মি দ্বারা বাঙালী নারীর ধর্ষিত হবার চিত্রায়ণ ব্যবসায়িক লাভালাভের সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি কুরুচিরও পরিচায়ক। মূলতঃ এই সকল ছবি যতোটা না চলচ্চিত্রিক প্রকাশ, তারওচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধের হ্যাঙওভার।   এইক্ষেত্রে অবশ্য ‘মেঘের অনেক রং’ আরেকটু বেশি মনোযোগ দাবি করে, তার শৈল্পিক আকাঙ্খা প্রকাশের সদিচ্ছার কারণে। এতোদিনে আমরা জানি, মুক্তির যুদ্ধে এদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ও নিম্নবর্গের মানুষের অংশগ্রহণই সংখ্যার দিক থেকে বেশি ছিল। তবু হায়, খেটে খাওয়া কৃষক-মজুর-গরিব মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গুরুত্ববাহী কোনো নমুনাই দেখা গেল না ওইসব যুদ্ধের ছবিতে; বরং কৈশোরক আবেগে বিজয় নিশান উড়িয়ে দেয়া হলো, কোনরকম সমাজতাত্ত্বিক অথবা চলচ্চিত্রিক অনুধাবনের বাইরে। বাঙালী জাতির জীবনে হাজার বছরের অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ, তার প্রতি সুবিচার করতে পারলেন না স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারেরা। ততোদিনে জহির রায়হান উধাউ!

সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮) দেখে কৈশোরে বুক ভাসিয়েছি, আর আজ দেখি আমাদের সিনেমা নিজেই যেন এক ‘ডুমুরের ফুল’। স্বাধীনতা পরবর্তীতে চলচ্চিত্র বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় যে পরিমাণ কালো টাকা, তার দাপটে সুস্থ মস্তিষ্কের সংবেদনশীল শিল্পী ও কর্মী বাহিনীর ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকা দায় হলো। এবং যার থাবা প্রতিদিন বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। তবু কিছু মানুষ; এদেশকে ভালোবেসে, সিনেমাকে ভালোবেসে সততার সাথে কিছু নির্মিতির চেষ্টা করেছেন। এঁদেরই কেউ কেউ এক পর্যায়ে অভিমান ক’রে সরে গেছেন, কেউ’বা মেনে নিয়েছেন জীবনের দায়, আবার কেউ আপোস করেছেন নিজের অজান্তেই। এই প্রবণতায় আমরা আলমগীর কবিরের কাছ থেকে পাই ‘ধীরে বহে মেঘনা ’(১৯৭৩), ‘সূর্যকন্যা’ (১৯৭৬), ‘সীমানা পেরিয়ে’ (১৯৭৭), নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’ (১৯৭৫), কবীর আনোয়ারের ‘সুপ্রভাত’ (১৯৭৬), সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’ (১৯৭৭), মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ (১৯৭৯), আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমনি’ (১৯৭৬), ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৮) ইত্যাদি সত্তরের দশকে বাংলাদেশের সিনেমার উল্লেখযোগ্য অর্জন। স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশের আর একটি বড় অর্জন ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩) ও রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ (১৯৭৬)।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে ধীরে ধীরে ভারতীয় সিনেমার নকল নির্মিতি শুরু হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র অঙ্গণে রাজনৈতিক সচেতনতা বির্বজিত ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসন ক্রমেই এদেশের সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিকে কবজা করে ফেলে। আশির দশক থেকে সামরিক শাসককূলের সরাসরি হস্তক্ষেপে তা আরো স্পষ্ট চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনেমাকে তারা একটি অপসংস্কৃতির শিরোনাম করতে সমর্থ হলো, আর দর্শক ঘরে ফিরে গেলেন। ততদিনে ভিসিপি’র কল্যাণে এদেশে বানানো ভারতীয় নকল ছবির বদলে ঘরে বসেই তারা হিন্দি ছবির টাটকা স্বাদ নিতে শুরু করলেন। তবুও চেষ্টা থেমে থাকেনি। একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরিতে ব্যর্থ হলেও বিদেশে চলচ্চিত্র শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু তরুণ তাদের সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন ও সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল কাজ করেছেন সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯)তে, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর ছাত্র এবং এক সময়ের জহির রায়হানের সহকর্মী আলমগীর কবিরের কথাতো আগেই বলেছি। এই ধারায় যোগ হলেন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর ছাত্র সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী ঘুড্ডি (১৯৮০), বাদল রহমান এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০) প্রমুখ ছবি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব, সিনেমা নিয়ে কারো কারো নাক উঁচু মানসিকতা বিভেদের দেয়াল তুলে দিতে সক্ষম হলো; এদিকে সুযোগসন্ধানী মতলববাজেরা সার্বিক পরিস্থিতি হাতিয়ে নিতে সক্ষম হলো। শুভবুদ্ধির মানুষগুলোকে হয় বিদায় নিতে হলো, নইলে নিস্ক্রিয় হয়ে যেতে হলো।

matirmoina, মাটির ময়না সিনেমার দৃশ্যমধ্য আশিতে আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে ১৬মি.মি. এ স্বল্প বাজেটের চলচ্চিত্রের একটি তরুণতর নির্মাতাদল তৈরি হলো। আমরা দেখা পেলাম মোরশেদুল ইসলাম (আগামী, চাকা, দীপু নাম্বার টু, দুখাই ইত্যাদি), তানভীর মোকাম্মেল (হুলিয়া, নদীর নাম মধুমতি, অচিন পাখি, লালন ইত্যাদি), তারেক মাসুদ (আদম সুরত, মুক্তির গান, মাটির ময়না, রানওয়ে ইত্যাদি), মানজারে হাসীন মুরাদ (রোকেয়া ইত্যাদি), শামিম আখতার (ইতিহাস কন্যা, শিলালিপি, সে ইত্যাদি), আবু সাইয়ীদ (আর্বতন, শঙ্খনাদ, নিরন্তর ইত্যাদি), এনায়েত করিম বাবুল (চাক্কি), তারেক শাহরিয়ার (কালিঘর) ইত্যাদি আরো অনেকের চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা, নর-নারীর মানবিক সম্পর্ক নিয়ে তৈরি এই ছবিগুলো অপেক্ষাকৃত চলচ্চিত্র ভাষাম-িত হওয়ার কারণে এক শিক্ষিত, সমাজ সচেতন, নাগরিক দর্শককূলের নজর কাড়লেও দেশের প্রচলিত সিনেমা-দর্শকদের অগোচরেই থেকে গেল। এবং মূলধারার এফ.ডি.সি’র ছবি আর বিকল্প ধারার ছবি নামে দুইটি মেরুকরণ ঘটে গেল। আখেরে ব্যাপারটা যে ভাল হয়নি তা বোধ করি পাঠক-দর্শক আপনিও মানবেন।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সিনেমা দেশ-বিদেশের সমালোচকের মনোযোগ আকর্ষণ এবং বিদেশী ফেস্টিভ্যালে স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার অর্জন তবু এইসব বিকল্প ধারার নির্মাতার হাত ধরেই। মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯) তাসখন্দ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে; মোরশেদুল ইসলামের আগামী (১৯৮৪) ও চাকা (১৯৯৩) যথাক্রমে দিল্লী ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও ফ্রান্সের ডানকার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে; তারেক মাসুদের মাটির ময়না (২০০২) কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ফেস্টিভ্যালে; আবু সাইয়ীদের নিরন্তর (২০০৬) গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে; গোলাম রব্বানী বিপ্লবের স্বপ্নডানায় (২০০৭) কোরিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরষ্কৃত হয়। এবং দেশের মূলধারার সিনেমাকরিয়ে ও সিনেমাদর্শক এর খোঁজ খবরও রাখলেন না।



‘লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায়
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। ’        - বিনয় মজুমদার

মূলধারা এবং বিকল্পধারার টানাহেঁচড়ার কারণে দুইপ্রজন্মের তরুণনির্মাতাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনুপস্থিতির সুযোগে পুরো ফ্যাক্টরিটাই একটা সংবেদনহীন, দেশকাল-ভাবনাবিহীন, দুই নন্বরির আখড়ায় পরিণত হতে থাকলো। আর যাঁরা ইন্ডাস্ট্রির দিকে ফিরেও তাকাননি, তাঁদের এখানেও তৈরি হলো না কার্যকরি কোনো বিকল্প ধারা। ইদানিং আবারও দু’চারটি ছবির দর্শক আনুকূল্যে এফডিসি একটু চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। তবু বাংলাদেশের সিনেমার সার্বিক পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি ঘটেনি; না আর্টে, না ইন্ডাস্ট্রিতে। আর্টের নামে গণবিচ্ছিন্নতা আর এক-নায়কনির্ভর ইন্ডাস্ট্রিও বেশি দিন টিকে থাকবার কথা না। প্রয়োজন নতুন পথ খোঁজার। কেউ বলছেন ইন্ডাস্ট্রির নবায়নের কথা, কেউ বলছেন টেলিভিশন প্রডিউসড্ সিনেমার কথা, কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সিনেমা বানানোর কথা, কেউ বলছেন স্বল্প বাজেটে ডিজিটাল ফর্মাটে সিনেমার সম্ভাবনার কথা। সকলের দাবি একটাই, ভালো সিনেমা। বাংলাদেশের সিনেমার একটি জাতীয় চরিত্র তৈরি হোক; যাতে ক’রে ঐ সিনেমা একনজর দেখলেই চিনে নেয়া যাবে এদেশের মানুষের অর্šÍগত আকাঙ্খার কথা, তার দিনানুদৈনিক জীবনযাপনের কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে, ব্যাপারটা ঘটবে কী ক’রে? মত আর পথের অমিলের মাঝখানে রয়েছে টাকা আর ক্ষমতার খেলা।

monpura, মনপুরা সিনেমার দৃশ্যএকটা সুন্দর মানবিক সম্পর্কজাত যৌনতাকে যারা নিতে পারেন না তারাই আবার শুধু টাকা কামানোর উপায় হিসেবে অসুস্থ যৌনাচার আর নৃশংস ভায়োলেন্সকে দিব্বি চাউড় করে দিতে পারেন। যেকোনো উপায়ে টাকা কামাতে হবে, নতুবা কালো টাকা সাদা করতে এই ইন্ডাস্ট্রিতে চালান করে দিতে হবে। প্রযোজক-পরিবেশদের এই দুষ্টচক্রের বাইরে আছে আরেক আপদ; সেটি প্রদর্শন ব্যবস্থাপনা। দর্শক অভাবের কারণে অনেক হল-মালিক ই চাচ্ছেন হল ভেঙে দিয়ে তুলনামূলক লাভজনক শপিং কমপ্লেক্স বানাতে। অবস্থা যে খুব সঙ্গীন, যাঁরা এই পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে জড়িত তারা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন।

সিনে-বাণিজ্যের আকালের কারণ হয়ত মিডিয়াবুম, টিভি-ভিসিপি, হাল আমলের ডিভিডি, ইন্টারনেট, মুভিক্যামেরাসহ সেলফোন ইত্যাকার নানান নতুন অনুষঙ্গ। তারচেয়েও বেশি যেটা, তা হলো আমাদের এদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদল; যে সমাজকাঠামোয় আমরা আর সামাজিক ঐক্য স্থাপনের জন্য একত্রিত হই না। ঘরে-ঘরে আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আমাদের বিচ্ছিন্নতার এই মিষ্টি সুযোগটি করে দিয়েছে। যদিও সকলে জানি, একত্রে অন্ধকার ঘরে বড় পর্দায় ‘ল্যার্জার দ্যান লাইফ’-এর অভিজ্ঞতার সাথে এর কোনোটাই তুলনীয় নয়। কিন্তু তবু কেন হলে যাই না আমরা? হলের পরিবেশ, রাস্তার যানজট, বাইরে নানা ধরনের দুর্বৃত্তের হাতে পড়বার আশংকা এবং সর্বোপরি রুচিশীল ছবির অভাবের কথা বারবার উচ্চারিত। সিনেমার ম্যাজিকের কথা কিন্তু আমরা সকলেই স্বীকার করি। তবু আমাদের সিনেমা হয় না। সিনেমা দেখা হয় না। কারণ আমরা সবকিছুই অনায়াসে পেতে চাই, পেতে অভ্যস্তও। তাহলে কী উপায়?

একসময় রসিকতা করে লোকেরা বলতেন, দেশে কাকের সংখ্যা বেশি না কবি’র। আজ হয়ত বলবেন সিনেমাকরিয়েদের কথা। ছবি আমাদের তৈরি করা হোক বা না হোক, ছবি বানাতে চান এধরনের মানুষের সংখ্যাও অগুন্তি। এটাও এক সম্ভাবনা। সমসাময়িক টেকনোলজি এই সম্ভাবনাকেই আরো সম্প্রসারিত করছে প্রতিদিন। যার উদাহরণ হলো নিত্যনতুন ভিডিও ক্যামেরা, কম্পিউটারে এডিটিং সফট্ওয়্যার। ছবি বানানোর জন্য একমাত্র উপায় ৩৫ মি.মি. কিংবা এফ.ডি.সি., মাদ্রাজের প্রসাদল্যাব কিংবা মুম্বাই-ব্যাংককের পোস্ট-প্রোডাকশন হাউজগুলো না। আবার ছবি যেকোনো রকম; কোনো একমাত্র মাপকাঠিতে তাকে ছাঁটলে হবে না। ছবি বানাতে টাকা লাগে জানি। আবার এও জানি, সব ছবি বানাতে কোটি-কোটি টাকা লাগে না, কোটি টাকার ক্যামেরাও লাগে না, ভিডিও ক্যামেরাতেও ভালো ছবি নির্মাণ সম্ভব। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের ‘সোনার বেড়ি’, ‘অন্তর্যাত্রা’,‘ রানওয়ে’, ইয়াসমিন কবিরের ‘পরবাসী মন’, ‘স্বাধীনত’া কিংবা তারেক শাহরিয়ারের ‘কালিঘর’ যার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ছবি বানানোর জন্য চাই মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় ঘিলু, তারও বেশি চাই- হৃদয়ের আকুতি; সিনেমার জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য।

টিভিবুমের কারণে আরো একটি ব্যাপার ঘটে গেছে গত বছরগুলোতে। সিনেমা নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন এদেশে টিভি’র নির্মাণ-কর্মীরা যাঁরা টিভিতে নাটক নির্মাণ করেন কিংবা টেলিভিশন প্রযোজিত সিনেমা। এই বিষয়ের ভালো-মন্দ নিয়েও রয়েছে নানান বিতর্ক। সুস্থ ধারার সিনেমার নামে সংবাদপত্রের লেখালেখিতে নতুন চলচ্চিত্র সংস্কৃতি তৈরি করবার আকাঙ্খার কয়েকটি নমুনা আমরা ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছি- হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমনি’, ‘দুই দুুয়ারী’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’; মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’, এনামুল করিম নির্ঝরের ‘আহা’, গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’, সামিয়া জামানের ‘রাণীকুঠির বাকি ইতিহাস’, সালাহউদ্দিন লাভলুর ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ ইত্যাদি। ‘মনপুরা’ আবার আরো একটি কারণে বাড়তি মনোযোগ দাবি করে। এই ছবিটি ‘রূপবান’ কিংবা ‘বেদের মেয়ে জোস্না’র মতোই দর্শক-হাইপ তৈরি করতে পেরেছে। সারা দেশের সব শ্রেণীর দর্শক অনেক কাল বাদে হলমুখি হয়েছিলেন। যদিও তা সার্বিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করার বদলে একক সাফল্য হয়েই থাকছে। ‘মনপুরা’র মনছোঁয়া গান, না ঝকঝকে ছবি-শব্দ, না একটা চিরপুরাতন প্রেমের গল্পের জন্য দর্শকের অনেক কালের ক্ষুধা নাকি প্রচারণা-পরিবেশনার ধরণ কোনটির কারণে এই হাইপ তৈরি হল- তা আমাদের ‘রূপালী সিনেমার সোনালী সুদিনে’র স্বার্থেই খতিয়ে দেখা উচিত।      

বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের সিনেমার অগণন কুসুমের মধ্যে এখনো আমরা খুঁজে ফিরছি অন্তরের নীলাভ আলো দিয়ে মুদ্রিত ছবিমালা। জয়তু বাংলাদেশের সিনেমা, জয়তু নবীন নির্মাতা।


‘আমি যাই।
প্রেম করো, এইবার
মৌমাছি তোমরা। ’        - জেন কবিতা, ইসা

নবীন চলচ্চিত্রকার, আপনি যদি সিনেমার সনাতন ধারণা থেকে একটু সরে এসে সময়ের পাঠ নেন তবেই আপনি আরো একটি সম্ভাবনার হৃদস্পন্দনটুকু টের পাবেন। ছবি ত ছবিই। আর ছবি ত মুখেরই ছবি; অন্তরের প্রকাশ যেই মুখচোখ, ভেতর-বাহিরের অবাধ চিত্রমেখলা। লংফিল্মের বদলে শর্টফিল্ম, কমার্শিয়ালের বদলে আর্টফিল্ম, ফিচারফিল্মের বদলে ডকুফিল্ম, থার্টিফাইভের বদলে ডিজিটাল ফিল্ম এইসব কুতর্ক দর্শক শুনতে চায় না। সকলের একটাই চাওয়া সেটা সি-নে-মা।

Third-Person-Singular-Number, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার সিনেমার দৃশ্যকুতর্কের বিষয় ছেড়ে আমাদের প্রয়োজন অন্যকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের অপকীর্তির হাত থেকে আত্মাকে রেহাই দেয়া আর সম্ভাবনার মাটিতে প্রোথিত করবার মতো বীজটুকু সংরক্ষণ। আমাদের মা-খালা’রা আজ আর নিয়মিত ছবি দেখেন না সিনেমা হলে গিয়ে। এবয়সী যে দু’চারজন যদিওবা হলে যান তারা যান বিশেষ কোনো উপলক্ষ্যে এই যেমন, হুমায়ূন আহমেদের ছবি বা বিশেষ আওয়াজ তুলেছে এরকম ছবি ‘মনপুরা’, ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’। এখন ভরসা পরবর্তি প্রজন্মের নির্মাতা। এবং দর্শক সারিতে হলমুখো তরুণ-তরুণীরা। আর হ্যাঁ, বাংলাদেশের সিনেমার পালাবদলের জন্য এদেশের তরুণরা যে মুখিয়ে আছেন তা আর নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই। ইন্ডাস্ট্রির রেগুলার সিনেমার পাশাপাশি স্বল্পবাজেটে, ফর্মুলামুক্ত স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের অপার সম্ভাবনার সূচনা করেছে ডিজিটাল ফর্মাট। পুরাতন হলগুলোর উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন নতুন ধরনের ছোটছোট ডিজিটাল প্রজেকশন হল নির্মাণ। এইসব হলগুলো হতে পারে ১৫০-২০০ সিটের। আর তার সঙ্গে থাকবে কফি বা পিজা শপ, থাকবে ইন্টারনেট, থাকবে ডিভিডি ও মিউজিক সেন্টার। টিকেটের মূল্য হবে কম। যেকোনো বড় কিংবা ছোট শহরেই এ ধরনের ছোট্ট হল নির্মাণ করা যেতে পারে। আর আমাদের নবীন নির্মাতারা যদি ধারাবাহিকভাবে ডিজিটাল ছবি নির্মাণের পথে হাজির থাকেন তাহলে এই মিনি-থিয়েটারগুলোতে দেশীয় ছবির কোনো অভাব থাকবে না। ক্রমে এটিই হয়ে উঠতে পারে দেশীয় চলচ্চিত্রের নতুন এক ধারা।

জাতীয় চলচ্চিত্র ভাবনার বিকাশের জন্য চল্লিশ বছর মোটেই কম সময় নয়। অনেক নদীই শুকিয়ে গেছে। অতএব এখনই সময়, নিজেরা জেনে যাবার, অন্যকে জানান দেবার বাংলাদেশের সিনেমার অসীম সম্ভাবনার কথা। সংকটের বয়ান যথেষ্ট হলো। সংস্লিষ্টরা যদি এখনই নজর না দেন তো আমাকে  শৈশবের ‘সুজন সখী ’র গল্পই করে যেতে হবে, পথ হারিয়ে বেপথে ঘুরে বেড়াবো, জীবনের অপার সম্ভাবনার গল্পগুলি আর রচিত হবে না। প্রিয় পাঠক, আসুন সকলে মিলে সময়ের ফুল ফোটাই রূপালী পর্দার আলেয়ায়।

nurul-alam-atiq

নূরুল আলম আতিক
চলচ্চিত্রকর্মী

বাংলাদেশ সময়  ১৭০০, জুন ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।