ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সুফিয়া কামাল নারী জাগরণে ভাস্বর

লতিফা নিলুফার পাপড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৮ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১১
সুফিয়া কামাল নারী জাগরণে ভাস্বর

ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল তার প্রায় সবটুকুই অধিকার করেছিল পুরুষ। স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে আমাদের বাঙালী সমাজে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে বহুল প্রচলিত বাধা ও কুসংস্কারগুলোকে অনায়েসে জয় করতে পেরেছিলেন যিনি, তিনি সুফিয়া কামাল।



বাংলাদেশের নারী জাগরণে সুফিয়া কামাল এক চিরভাস্বর নাম। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন, নারী বিষয়ে রাষ্ট্রের সকল মহলের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে তার অবস্থান সর্বদাই ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। আজ থেকে একশ বছর আগে জন্মাকালে তখনকার একটি জমিদার পরিবারের একটি মেয়েকে তার ভেতরকার সম্ভাবনাকে বিকশিত করবার জন্য কত কষ্ট করতে হয়েছে তিনি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এই মানুষটির ছিল না তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অথচ নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত, হয়ে ওঠেন একজন পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষ। হয়তো তার নিজস্ব বোধই তাকে অনেকের চেয়ে আলাদা করেছে। শিক্ষিত, উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সমাজে নিজ আসন করে নিয়েছেন সহজেই। তিনি ভালবেসেছিলেন দেশকে, দেশের নিসর্গ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি মানুষকে। তাইতো নিজে থেকেই অপরিসীম দায় কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। তার সারাজীবন ছিলো মানুষের জন্যে নিবেদিত।

কিশোরী বয়সে সুফিয়া কামাল যখন উদার ও সংস্কারমুক্ত প্রথম স্বামীকে হারালেন তখনও তিনি অনুশাসনের জালে আটকে পড়েননি। বালিকা বধুটি বৈধব্যের যন্ত্রনা নিয়ে অন্তরের মুক্তির স্বরূপটি বাঁচিয়ে রেখে কাব্যসাধনা করে গেছেন। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের সাধনা করে গেছেন। তার লেখাতে বোঝা যায় তিনি স্বমহিমাকে কর্তব্যমাত্র মনে করেছিলেন- কিছুটা নিজের প্রতি, কিছুটা সমাজের প্রতি। কারণ জীবনে প্রথমবার স্থানচ্যুত হয়ে গিয়েও রিক্ততা ও শূণ্যতাকে সাথে নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘর বেঁধে আবার ফিরে আসেন নিজের তৈরি করা জীবনে। হয়তো জীবনকে বোঝার ও জীবনের দায়িত্ব বইবার অসাধরণ ক্ষমতাই তাকে এতটা সাহসী করে তুলেছিলো।

সারাটা জীবন বিবেকের সত্য কথাগুলো স্পষ্টভাবে বলেছেন। লেখার ক্ষেত্রে, ভাষণের ক্ষেত্রে তিনি এতটাই পরিমার্জিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যে তা এখনকার একবিংশ শতাব্দীতে একেবারেই বিরল। একজন সফল নারী সংগঠক, একজন কবি, সমাজ সংস্কারক, মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী তথা মুসলিম নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃত বেগম রোকেয়ার আদর্শে বলীয়ান নেত্রী সুফিয়া কামাল আমাদের সমাজ-জাতি-মানুষকে ছন্দময় ও সাবলীল গতিতে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।

SufiaKamalmm‘সাঝের মায়া’র মত অত্যন্ত রোমান্টিক কবিতা সংকলনের স্রষ্টা হয়েও এই মানুষটি যে কতবড় একজন নারীবাদী ছিলেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ছিল আপোষহীন। সেই হিন্দু মুসমাল দাঙ্গা থেকে শুররু করে ভাষা আন্দোলন, মুসলিম পরিবারে মেয়েদের আইনগত অধিকার রক্ষার আন্দোলনে, বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে তার যে সাহসিকতা রূপ পরিচয় মেলে তা অবর্ণনীয়। জীবনের শেষ সময়ে এসেও এ দেশের মানুষের অভিভাবক কবি সুফিয়া কামাল যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সারাজীবন শুধু একটাই সাধনা ছিল যে, মানুষ মানুষের মতো যেন বেঁচে থাকে। তার প্রতিটা কর্মে-বাক্যে তিনি সব সময় মানুষের মর্যাদার প্রতি কিংবা সংবেদনশীলতার দিকটা সব সময় লক্ষ্য রেখেছেন। তার লেখায় তাই নৈতিকতা ও মূল্যবোধশাণিত হয়েছে বারবার। সীমাহীন কর্মপ্রেরণা ও নিজস্ব চিন্তধারনা থেকে অসহায়-দুস্থ নারীদের পাশে দাড়ানোর জন্য একদিন গড়ে তুলেন নারী সংগ্রামের নতুন ধারা। নারী জাগরন ও মুক্তির লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জন্ম দেন। বর্তমানে তার প্রাণের এই সংগঠনটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আর এর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। ঘরে বাইরে নির্যাতিত নারীদের পাশে দাড়ানোই ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মহিলা পরিষদের কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করেলও এর গতিপথ কেউ রুদ্ধ করতে পারেনি। অথচ আজ যখন দেখি প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়ে বড় শত্রুরা এই সংগঠনের ভেতরে অবস্থান করে এর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায় তখন বড় ভয় হয়। কারণ এই মহিলা পরিষদের রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস। আমার মনে পড়ে সেই ১৯৯২ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ছাতকছড়ায় ফতোয়াবাজরা যখন নুরজাহানকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়েছিল তখন এই মহিলা পরিষদের শক্তিশালী ভূমিকা অপরাধীদের শাস্তি প্রদানে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে; তা প্রশ্নাতীত। সমাজের প্রতিটা মানবতাবিরোধী কাজে এই সংগঠন যদি পাশে থাকে তা হলেইতো কবি সুফিয়া কামালের আত্মা শান্তি পাবে।

আমরা তো মনে করি একটি জীবন মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়। সত্যি কি যায় ? স্মৃতির মুকুরে কি বাধা পড়ে না চলে যাওয়া জীবনের ছন্দময় জরুরী দিকগুলো ? হ্যাঁ কবি সুফিয়া কামাল সেই চলে যাওয়া মানুষদেরই একজন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চরণে তাইতো বলি ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে/ বন্ধু, হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে। ’

২০ জুন কবি সুফিয়া কামালের শততম জন্মদিন। শততম জন্মদিনে আমাদের অফুরন্ত শ্রদ্ধা।
                                                                      
   
বাংলাদেশ সময় : ১৪৫১, জুন ২০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad