ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সুফিয়া কামালের একাত্তরের দিনলিপি

ভূমিকা : ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৮ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১১
সুফিয়া কামালের একাত্তরের দিনলিপি

১৯১১ সালের ২০ জুন জন্মগ্রহণ করেন সুফিয়া কামাল। এ বছর পালিত হচ্ছে তাঁর জন্ম শতবর্ষ।

‘সওগাত’ পত্রিকায় ‘বাসন্তী’ নামের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ১৯২৬ সালে সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা শুরু সুফিয়া কামালের।

ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় তিনি পরিচিত হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও শরৎচন্দ্রের মত মহান সাহিত্যিকদের সাথে।

১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। এ বইটির মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায়।

তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে গল্প সংকলন- কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭), কাব্যগ্রন্থ- মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), শান্তি প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)। ভ্রমনকাহিনী-  সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮) এবং স্মৃতিকথা-একাত্তুরের ডায়েরি (১৯৮৯)।

১৯৭১ সালে লেখা সুফিয়া কামালের দিনলিপিতে উঠে এসেছে একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নানা মুহূর্ত। যা ওই সময় আতঙ্কগ্রস্ত, বিধ্বস্ত জীবনকে উপলব্ধি করতে পাঠকদের সহায়তা করে। এ দিনলিপি লেখা প্রসঙ্গে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি বারান্দায় বসে বসে দেখেছি পাকিস্তানী মিলিটারীর পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানী মিলিটারীরর ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লোক বসে থাকতো। রাস্তার মোড়ে, উল্টো দিকের বাসায় সবখানে ওদের পাহারা ছিল। ’

কেমন কেটেছিল ১৯৭১ সালে সুফিয়া কামালের জন্ম মাস জুনের দিনগুলি। ডায়েরিতে দেখা যায়, জুন মাসের প্রথম ১৩ দিন তিনি কিছুই লেখেননি। তবে ১৪ তারিখ  থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনই তিনি দিনলিপি লিখেছেন। পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো সুফিয়া কামালের একাত্তুরের দিনলিপির জুন মাসের পুরোটাই।

১৯৭১
১৪ জুন, সোমবার

রাত ১১ টা
আজ বড় একটি স্মরণীয় রাত আমার। ওরা মামা বাড়ি গেল। আল্লাহ যেন সহিসালামতে ইজ্জত বাঁচিয়ে রাখেন। মরার জন্য ভয় নেই। কত ঘর খালি হয়ে গেছে, সোনার সংসার ছাই হয়ে গেছে অসুরের হাতে। আল্লাহ ইজ্জত রেখে যেন ওদের মৃত্যু দেন। ছোটনদের চিঠি পাচ্ছি না। চাটগাঁয়ের খবর, সিলেটের খবর কিছুই জানি না। এ কোথায় বাস করছি। ২টা হেলিকপ্টার উড়ল। বোমারু প্লেন উড়ছেই। কোথায় নাকি প্লেন পড়েছেÑ কি জানি। একই তিক্ততার কথা আর লিখতে ইচ্ছা করে না। লুলু টুলু মুক্তিযুদ্ধে গেল আগরতলা হাসপাতালে।

১৫ জুন, মঙ্গলবার

রাত ৯টা
সন্ধ্যা ৭টায় যেন বুকটা হালকা হয়ে গেল। আল্লাহর কাছে শোকর। খবর যা পেলাম ভালো। আরও আনন্দ বোধ করলাম আলভীকে দেখে। আজও সারাদিন বোমারু প্লেন-এর শব্দে শুতে পর্যন্ত পারলাম না। কোথায় যে কি হচ্ছে বোঝা যায় নি। আশা করে আছি আল্লাহ সব ভালো করবেন। কি দীর্ঘ নিঃসঙ্গ দিন। বেঁচে থাকুক দেশের ছেলেমেয়েরা। আবার বাংলা ভরে উঠবে। গরম খুব পড়েছে। খবর পাওয়া গেল, ইকবাল ও তার ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে। কি মর্মান্তিক।

sufia-nazrul

১৬ জুন, বুধবার

রাত ১১ টা
আজ ১লা আষাঢ়। আমার জন্ম মাস। দিনটি গেল রোদে বৃষ্টিতে আলো ছায়ায়। সন্ধ্যাটি গোধূলি রঙিন। আষাঢ়ের কান্না ভরা সুর জীবনব্যাপী আমার ত রইলই। যদিও দেশের দশের ভালো খবরটুকু পেতাম, আজ কত ভালো লাগত। কোথায় আমি। কোথায় মেয়ে তিনটি। বয়সের সাথে সাথে সবাই চায় শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম, ছেলে মেয়ে বৌ জামাই নাতি পুতি নিয়ে সুখের সংসার। আমি কি চাই নি তা? এখনও চলছে সংগ্রামী জীবন। তবু ক্ষোভ করব না। বাছাদের আমার ভালো হোক। ডেমরার ফেরি বন্ধ, কোথায় কি হচ্ছে কোনো খবরই নেই। লুলু বিলকিস বানুর চিঠি এলো লন্ডন থেকে। কিন্তু আমেরিকার চিঠি নেই।

১৭ জুন, বৃহস্পতিবার

রাত ১১টা
আজ ছোটনের চিঠি পেলাম। ও মাষ্টার ডিগ্রী পেয়ে গেছে, এম. এস. এসি। পরম দুঃখের দিনে এটাই চরম সান্ত¦না। আল্লাহর কাছে শোকর। আবার আমেরিকায় পাকিস্তান এমব্যাসিতে টেলিভিশনে আমার ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে সুফিয়া কামাল অল রাইট। আহা, কি দরদ! আমি বেঁচে আছি, ওরা বাঁচিয়ে রেখেছে আর কি। মারি ঝাড়–! জিকির ছেলেটা, ইকবাল বাবুর খবর নেই, ছায়ানট এর ইকবালকে পরশু ধরে নিয়ে গেছে, কি যে ব্যথা মনে। ওগো অকরুণ! এখনও তোমার রহমত নাজেল করবে না? কি রহমান তুমি, মানুষের বুক যে ভেঙ্গে যাচ্ছে, থামাও এবার তোমার রোষ।

১৮ জুন, শুক্রবার

রাত ৯টা
অসহ্য গরম। ভিতরে বাইরে এ কি দহন জ্বালায় সারা দিন রাত কাটছে। আমার গানের পাখিরা এখন কোথায় কি করছে। যার হাতে সঁপেছি তারই দৃষ্টি তলে ওরা মঙ্গলে কুশলে থাকুক। নানা দিক থেকে নানা উড়ো খবর পাচ্ছি। আল্লাহ জানেন কবে শান্ত শান্তি কল্যাণের বার্তা আসবে।

১৯ জুন, শনিবার রাত ১১টা
সকাল থেকে জঙ্গী প্লেনগুলো খুব উড়েছে, ২টা পর্যন্ত পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপর সন্ধ্যা ৭টায় প্লেনের শব্দও শোনা যায় নি। কি হলো বুঝতে পারা গেল না। ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি খুব গেছে ময়মনসিংহ-এর দিকে। কোথায় কি হচ্ছে আল্লাহ জানেন। অসহ্য গরম। সারাদিন কাটে, এরকম সন্ধ্যায় পাখি দুটির জন্য মন বড় কেমন করে। আল্লাহর হাতে সঁপেছি, মন কেমন করে কেন যে বুঝতে পারি না।

২০ জুন, রবিবার

বেলা পৌনে ১টায় কওসর এল সিলেট থেকে। নাকে মুখে চারটি খেয়ে চলে গেল, দেড়টায় দাদীকে দিয়ে জুনেদের সাথে এয়ারাপোর্টে যাবে। আড়াইটায় ওদের প্লেন, চাটগাঁ যাবে। আল্লাহ মায়ের কোলে নিয়ে ভালোয় ভালোয় পৌঁছে দেন। জঙ্গী প্লেন আজ ৮টা থেকে আবারও উড়ল, কিন্ত কম। আলুর ফোন পেলাম, ওরা ঢাকায়ই আছে। আমার পাখিরা যেন আল্লাহর রহমতের ছায়ায় ভালো থাকে।

২১ জুন সোমবার

রাত ১১ টা
আখাউড়া টাংগাইল থেকে খবর আসছে, সেখানে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। মানুষের আনাগোনা ঢাকা শহরে বেড়ে গেছে, লোকের মুখে মুখে কত কথা কত গুজব ছড়াচ্ছে। আবার যা রটে তা অর্ধেক ত বটে বলে নিছক উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জঙ্গী প্লেনগুলো পাগলের মতো উড়ছে। মিসেস সেলিমা আহমদ মোশফেকাকে মামুনের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তা বিশ্বাস করছে না, কোনো পাগলা পীর নাকি বলছেন মামুন বেঁচে আছে, আর বৌটা তাই বিশ্বাস করছে। হায়রে আশা! আল্লাহ করে যেন এ আশা সফল হয়। শামীম রাতের ডিউটিতে অফিস গেল। মনটা ভালো লাগছে না। আল্লাহ নেগাহ্বান থাকুন।

sufia-mujib২২ জুন, মঙ্গলবার

রাত সাড়ে ৮টা
এইমাত্র একটি কামানের শব্দ শোনা গেল। কোন দিক, তা বোঝা গেল না। সিলেট এয়ারপোর্টে প্লেন নামতে পারেনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত জঙ্গী বিমান উড়ছে। কওসর চাটগাঁ থেকে কোনো খবর দিল না। মেয়ে দু’টির কোনো খবর নেই। আল্লাহ ভরসা। ভালো আছে আশা করছি। কাফেরদের হাতের ছোঁয়া যে ওদের গায়ে লাগবে না, এও পরম নিশ্চিন্ততা। আজ ঝুনুরা এল। আমার পাখিরাও একদিন ফিরে আসবে আশা করছি। আলভীর ফোন আজ আর পাইনি।

২৩ জুন, বুধবার

রাত ৯টা
মেঘলা আষাঢ়ের আকাশ। বর্ষণ নেই, বিষণ্ণ ম্লান। আজ পারভিনরা এসেছিল। কতদিন পর যে ওদের দেখলাম। বাচ্চাদের খবরও আজ পেলাম ওরা ভালো আছে। সেবাব্রত, মেয়েদের শ্রেষ্ঠ ব্রত। ওরা জয়যুক্ত হোক। জয়যুক্ত হোক আমার সূর্য সন্তানরা। জঙ্গী বিমানের হামলা যে কোথায় চলছে? দিনভর উড়ছে, মারছে, মরছেও ত। কবে এর শেষ হবে। আল্লাহ রহমানুর রহিম এবার শেষ কর এ কুফরি জুলমাত।

২৪ জুন, বৃহস্পতিবার

রাত সড়ে ৮টা
আল্লাহর রহমতেরও ত অন্ত নেই, তাই আজ সাড়ে ৭টা উনি অফিস গেলেন, আর সাড়ে ৯টায় টংগি থেকে আবু তৈয়ব সাহেব ফোন করে বল্লেন, ফার্মগেটের মিলিটারী গাড়ির সাথে একসিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে ফোন করতে। একসিডেন্ট, আবার মিলিটারী গাড়ি, বুক যে কি করে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই প্রশান্তি বোধ করলাম। বেশি কিছু হয়নি। এমারজেন্সিতে আধ ঘণ্টা ফোন করেও কোনো না পেয়ে শামীম বের হচ্ছিল। উনি এসে গেলেন। খুবই সামান্য দুর্ঘটনা। আল্লাহর কাছে শোকর। কাল রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও থেকে কেউ এলও না, কোনো খবরও কারুর নেই। আল্লাহ যেন যে যেখানে আছে, সহি সালামতে রাখেন।

২৫ জুন, শুক্রবার

রাত ১০টা
কার থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ ২৫ জুন। তিন মাস হল জুলুম চলছে। এতক্ষণেও ঢাকায় কি হবে কেউ জানত না। অতর্কিত হামলা শুরু হয়েছিল রাত ১টা বাজতে ৫মিনিট বাকি থাকতে। কি ভয়ানক, কি জঘন্য, কি নৃশংস সে আক্রমণ। দিনের পর দিন রাতের পর রাত ত কাটল। এখনও পাশব শক্তির অবসান হল না। আজ মন বড় অস্থির। কারুর কোনো খবর নেই। কোথায় কোন মায়ের বাছারা আজও আছে না নেই তাই বা কে জানে। যে যেখানে আছে আল্লাহ যেন হেফাজত করেন।

২৬ জুন, শনিবার

রাত ৯টা
গতকাল গেল ১০ই আষাঢ়, আমার জন্ম দিন, তাই বুঝি অঝোর ধারা ঝরছে আজও। কিন্তু জন্ম দিনটি ছিল আমার নওয়াব বাড়ির ‘পুণ্যাহ’ উৎসবের দিনে। সোমবার বেলা ৩টা আমার জন্ম। ১৯১১- আর আজ ১৯৭১-কি দীর্ঘ দিন, দুঃসহ আর কতকাল এ অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াব। শুধু অভিশপ্তইত নয়। কত যে সম্পদও পেলাম। কিন্তু যা চাইলাম তা পেলাম কই। যা আশা করিনি, তাত আল্লাহ প্রচুর দিলেন। আজ এ অনিশ্চিত জীবন, কোথায় নিশ্চিত সংসার। কোথায় আমার দেশের সন্তুান, কোথায় শান্তি। দলে দলে সবাই অজ্ঞাতবাসে কি করে দিন কাটাচ্ছে আল্লাহই জানেন। আজ কদিন কারুর খবর নেই। সারা দিন বোমারু বিমান কোথায় আগুন জ্বালিয়ে আসছে, আতঙ্কিত ঘৃণায় ভরা এ দিন।

২৭ জুন, রবিবার

রাত ১০টা
আল্লাহর কাছে হাজার শোকর। আজ অনেক খবর পেলাম। জন্মদিনের উপহারও পেলাম। জীবনে এই প্রথম জন্মদিনের উপহার। যারা দিল তারা যেন জীবনে শান্তি পায়। ওরা যেন দীর্ঘায়ু ও জয়যুক্ত হয়। বৃষ্টির বিরাম নেই। আজ মি. নভিকভ ও মিসেস নভিকভ এসেছিলেন, আমাকে মস্কো যাবার দাওয়াত দিলেন। এখন আমি এ দেশ ছেড়ে বেহেস্তেও যেতে রাজী নই। আমার দেশ, আমার দেশের মানুষেরা শান্তি পাক, সোয়াস্তি লাভ করুক- এ দেখে যেন আমি এই মাটিতেই শুয়ে থাকতে পারি।
এত রাতেও প্লেন উড়ছে। শয়তানের পাখা ঝাঁপটাচ্ছে- দেখা যাক কত কাল এ ঝাঁপটানি চলে।

২৮ জুন, সোমবার

রাত ৯টা
প্রেসিডেন্টের ভাষণ হবে, ভাষণ হবে বলে কদিন থেকে উৎকণ্ঠিত থাকার পর ৫৫ মিনিটের যে ভাষণ শোনা গেল- তাতে না আছে আশা,  না আছে আশ্বাস, না হরিষ নি বিষাদ। এ কোন অবস্থায় ‘পাকিস্তান’ চলছে। লজ্জা এবং গ্লানিকর এই অবস্থার অবসান কবে কি করে কেমন হবে আল্লাহ জানেন। সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি গেল। মনটা ভালো নেই। আল্লাহ সবার ভালো করুন।

সূত্র : একাত্তরের ডায়েরী- সুফিয়া কামাল

বাংলাদেশ সময় ১৭৪০, জুন ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।