ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কশেরুকার বয়াম | প্রজ্ঞা মৌসুমী

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
কশেরুকার বয়াম | প্রজ্ঞা মৌসুমী

তঃপর একদিন খুলেছিল ক্যাম্পের দরজা, দরজার ওপারের বীভৎসতা কত জন্মের শুদ্ধ আলোতে থমকে গিয়ে বলে উঠেছিল—জয় বাংলা। ধুলোতে, মাকড়সার জালে জড়োসড়ো হয়ে থাকা এতকালের বয়ামগুলোও যেন অকস্মাৎ একুশ লক্ষ দরজা পেরিয়ে, এক যাদুর আলোতে হয়ে ওঠে দরজার ওপারের সেইসব আগুনে মুখ, কখনো বা তারও আগের বঁধুয়ার মুখ।

অবশ্য স্বাধীন দরজার দিনে আলোও তো মুখোমুখি হয়েছিল বীভৎসতার। তাই এক তরুণী-এক উত্তরসূরি—বিহ্বলতায় যখন ছুঁয়ে ফেলে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গোপন বয়াম, তখন  ঘরের কোথাও সময়ের পোকাকে টেনে নেয় পুরনো মাকড়সা। আমরা ঘ্রাণ পাই গলে যাওয়া খুলি, থকথকে ভুঁড়ি, গর্ভবতী ময়নার রক্তক্ষরণের।

হয়ত এসব গন্ধবিভ্রম, আসলে ও ঘ্রাণ রাসমণির বাড়ির পেছনে ছড়িয়ে থাকা বকুল ফুলের। অত্যাচারের আশঙ্কায় বিহারী বাবুর একান্নটি সন্ধ্যায় দোলনকে বোরখা পরিয়ে আলতাফ মাস্টারের বাড়িতে রেখে আসা আর ভোরে নিয়ে আসার সময় কিংবা ভাগশেষে এপার হারিয়ে ফেলা বাহান্নতম ভোরে পিতা-কন্যার পায়ের কাছে ছুঁয়ে ছিল যে বকুল ফুলেরা, সেইসব বকুল ফুলের ঘ্রাণ। যন্ত্রণারা মিশে গেলে ঠিক বুঝি এমনই গন্ধ হয় ফুলে!



কেউ বলে কোনো এক ক্যাম্পের দরজার গভীরে ডুবে যেতে পারলেই আমরা পেয়ে যাব শামসুন্নাহার, চন্দ্রাবতী এবং আমাদের হারিয়ে ফেলা যাবতীয় আঁচারের বয়াম। রোদ-খাওয়া পাগল বিষ্ণু দৃশ্য বাড়ায়, বলে, বয়ামসুদ্ধ পুরো বাড়িটাই গায়েব হয়ে গেছে ঘ্রাণের চোরাবালিতে কেননা কেউ আর খুঁজে পায়নি সেই বাড়িটা, খুঁজে পায়নি সেইসব আশ্চর্য রঙা মোহনীয় বয়াম



অথবা এ যেন কৌটো থেকে বিলীন হওয়া নতুন রঙের ঘ্রাণ। আজহার, নাজমুল, সুসময়, চয়ন, আশফাক, শরীফ, আহসানুল—ওরা ছিল চল্লিশ/পঞ্চাশ হাজার দর্শকদেরই সাত জন, যারা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে বের হয়ে গিয়েছিল স্টেডিয়াম থেকে মার্চের প্রথম দুপুরে। দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে জেনারেলের ছুঁড়ে দেয়া সেই ফুল টসড বল ‘অধিবেশন স্থগিত’ তোলপাড় তুলেছিল স্টেডিয়াম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্বাণী থেকে গুলিস্তান, গুলিস্তান থেকে পল্টন ময়দান। সেই তোলপাড়ে উড়েছিল সাত ভীমরুল, সেরাতে ঠিক যেন এই ঘরেই ওরা লিখে গেছে গনগনে স্লোগান, বিক্ষোভ, গোপন পতাকা, অমোঘ মৃত্যু। কাঁচা রঙে দ্রোহ ছুঁয়ে গেলে বুঝি বা এমনই হয় তার ঘ্রাণ!

হয়ত সত্য নয় কোনো ঘ্রাণই অথবা অনিবার্য সত্য একেকটা ঘ্রাণ। মোহনীয় তৃষ্ণা জড়ানো এক তরুণীর—এক উত্তরসূরির খুঁজে পাওয়া আঁচারের গন্ধও তাই বড় সত্যি মনে হয়। জলপাই-বরই-তুঁতে-আম-লঙ্কা-আমলকী অজস্র পরিচয় ঘোর তুলে এক পরিচয়ে, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ অথবা মুসলমান—সারে সারে পরিচয়, একমাত্র পরিচয়ে তুলেছিল যেমন পবিত্র ঘোর। এ ঘর যেন সেই বাড়ির, যার ছাদে  লম্বা ছড়ি হাতে পাহারারত বড়’মা কিংবা ঝিমুনিতে পাওয়া বড়’মার সমুখের সারে সারে আঁচারের বয়াম জাগিয়ে দিয়েছিল রোদের ঘোর, অমোঘ আকাঙ্ক্ষা। এপ্রিলের রাতে মেজর ইসরাফিলের সুখেও কি ছুঁয়েছিল অমোঘ আকাঙ্ক্ষা, দু’চামচ আঁচারের ঘোর, যে রাত বাহান্ন অপরাজিতাকে করেছিল গর্ভধারিণী! আর তাই ‘আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা!’—ব্রতে ব্রততী মুহম্মদ হোসাইন সেইসব দিনরাত্রির আপ্যায়নে নিশ্চিত করেছিল এক মানচিত্র মখমল আঁচার!

দোহাজল পাড়ার দুটি সখী শামসুন্নাহার-চন্দ্রাবতীর বানানো আঁচার পূর্ব/পশ্চিম পাকিস্তান এবং ওপারের বিচিত্র কতসব মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করেছে অনেক কাল। কেউ বলে এসব অতিকথা—আধেক বাস্তব, আধেক রূপকথা। হয়ত এই রূপকথার ফোকরেই ছুঁয়ে থাকে গোপন সত্য। বীর উত্তম জাহিদুল হাসনাতের যেমন মনে পড়ে শহীদ নূরুল হক, ১৯শে নভেম্বর, একাত্তরের চাঁদরাতে আরো একবার হাতে তুলে দিয়েছিল কোনো এক দূর গাঁয়ের দুই অপরাজিতার আঁচার বিক্রির মুনাফা। সেই ঈদে আঁচারের স্বাদ কিংবা দূর থেকে আসা গাঢ় মমতার স্বাদ ভিজিয়ে দিয়েছিল সতের মুক্তিযোদ্ধার অনমনীয় অপাঠ্য চোখ।

তারপর অনেকটা কালে উড়ো উড়ো কথা জমে স্বাধীন বাতাসে—মালাউনের হাতের আঁচার খাওয়ানোর ধৃষ্টতায় অথবা দু’চামচ আঁচারের দ্ব্যর্থহীন অমোঘ আকর্ষণে কিংবা হঠাৎ বুঝে যাওয়ায়—বয়ামে আঁচার ছিল এককালে ঠিকই অথচ তারপর কখনোই আর আঁচার ছিল না, ছিল বয়ামভর্তি মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সাথে আঁচারের কোনো এক গোপন যোগসূত্র খুঁজে পেয়েই হয়ত মেজর ইসরাফিল হয়েছিল ধূমকেতু, দিয়েছিল ঠোঁট নিয়তির বাঁশিতে। তারপর আর দেখা যায়নি সারি সারি অপূর্ব রঙা বয়াম।

কেয়ামতের ধকল সওয়া কেউ কেউ বলে ইসরাফিলের বাঁশি বেজে ওঠার আগেই যাবতীয় বয়াম ডুবেছিল ডোবায়, কেউ বলে কোনো এক ক্যাম্পের দরজার গভীরে ডুবে যেতে পারলেই আমরা পেয়ে যাব শামসুন্নাহার, চন্দ্রাবতী এবং আমাদের হারিয়ে ফেলা যাবতীয় আঁচারের বয়াম। রোদ-খাওয়া পাগল বিষ্ণু দৃশ্য বাড়ায়, বলে, বয়ামসুদ্ধ পুরো বাড়িটাই গায়েব হয়ে গেছে ঘ্রাণের চোরাবালিতে কেননা কেউ আর খুঁজে পায়নি সেই বাড়িটা, খুঁজে পায়নি সেইসব আশ্চর্য রঙা মোহনীয় বয়াম। তবু কেউ কেউ ছুঁয়ে গেছে বিশ্বাস—সেই বাড়িটা, বয়ামগুলো এখনো হারিয়ে ঠিক আছে ইতিহাসের কোথাও কোনো এক অপরাজিতার তেত্রিশটি অপরাজেয় কশেরুকার গভীরে।

কালে কালে বিভ্রান্তি ছড়ায়, সত্যকেও বড় বিভ্রান্ত মনে হয় এই মাটিতে আজকাল। এতসব বিভ্রান্তির অতলে হারিয়ে গেছে কবেকার সেইসব আঁচার, একজন শামসুন্নাহার, এক চন্দ্রাবতী। শুধু দূরে কোথাও এক উত্তরসূরির আঁচারের স্বাদ মুখে নিলেই কিংবা ভাবনার ঘোরে আবছায়ায় দেখতে পায় পৌরাণিক আঁচার, সেইসব আঁচার যারা মিশেছিল এক কিংবদন্তী  মানচিত্রের উত্থানে, পতনে। আর মানচিত্রের কোথাও শুয়োপোকার মতো পৌরাণিক দেয়াল প্রজাপতি হতে গিয়ে গোপনে হয়ে যায় একাত্তরের বয়াম। তবে কি কোথাও অক্ষত থেকে যায় ইতিহাস, ইতিহাসের অনেকটা দৃঢ় হাড়! ছুটে ছুটে আসে প্রিয়তর নির্ভীক বৈতালিক ঘ্রাণ।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।