ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আপনকথা | রহমান মাসুদ

স্মরণ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫
আপনকথা | রহমান মাসুদ ছবি : রুদ্র আরিফ

আপন চলে গেছে! নাকি সরে গেছে! এটা নিয়ে আমার দ্বিধা আছে। সে কি চলে গেছে, না সরিয়ে দেওয়া হয়েছে! না, এটা কেবলই একটি সাধারণ অ্যাটাক! ১১ সেপ্টেম্বর রাতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম আড়াই/তিন ঘণ্টা।

ক্যান্টিনে এবং ক্যান্টিনের বাইরে। চরম আড্ডা ছিল আমাদের। রাত সাড়ে ১১টায় আমরা অফিস থেকে বের হলাম। ও গেল ওর বাসায়। সোলমাইদে। আমি উত্তরায়।

স্বাভাবিক কারণেই আমরা রাত জাগি বিশ্বপণ্ডিত আর কবি সাহিত্যিকদের সাথে। বালিশের তলাতেও তারা থাকেন। মাথার পাশেও থাকেন। তাদের সঙ্গ সমাপনে রাতের শেষ দিকেই ঘুমুতে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ পরই সেই ঘুম ভাঙে একটা ফোনে। বন্ধু জুয়েল মোস্তাফিজই প্রথম জানাল, আপন এ্যাপোলোতে। সফেদকে ফোন দিলাম। জানলাম সে রওনা দিয়েছে। পথে কথা হলো মাসুদ হাসান, শামীম রেজার সাথে। তখন জানলাম আপন আর আপনে নেই। লাশ হয়ে শুয়ে আছে হিমঘরের প্রকোষ্ঠে।

উত্তরা থেকে বসুন্ধরার এ্যাপোলোতে আসতে আমার বেশি সময় লাগেনি। সময় তো কেবল সাড়ে ৫টা তখন। রাজধানীর আলসেমি কাটে তো আরো পরে! আমি যখন হাসপাত‍ালে আসি তখন তেমন কেউ আসেনি। একটি ছোট রুমে বিথী আর সিঁথী। আরো কিছু স্বজন আছে আপনের শ্বশুরালয়ের। আমাকে দেখেই বিথী চিৎকার করে ওঠে। আছড়ে পড়ে আমার ওপর। আমার কাছে জানতে চায়, “মাসুদ ভাই আপনি তো আছেন, আপন নেই কেন? ও চলে গেল কেন?” আমি ধন্দে পড়ে যাই। উত্তর খুঁজে পাই না! আমি আছি, সফেদ, জুয়েল, সুজন, মামুন, ফেরদৌস, রুদ্র সবাই আছি, সত্যিই তো আপন নেই কেন! কাউকে কিছু না বলে ও কোথায় গেল!

হাসপাতালে সবাই এসেছেন—অগ্রজরা, অনুজরা। এসেছেন স্বজন-পরিচিতজনেরাও। এক রত্ত্বির এক ছেলে। পৃথিবীকে থোড়াই কেয়ার করে একটার পর একটা সিগারেট টানে। বন্ধুদের সাথে যেমন আন্তরিক, সহকর্মীদের সাথেও তাই। তবে, কারো সাথে এত মাখামাখি ছিল না, প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানদের সাথে তো পরিচয়ও ছিল না তেমন, তার জন্য এমন ঢল! কেউ কেউ তো চিন্তিত হতেই পারেন। অনেকেই জানলেন, একজন ক্ষুদে কবির অকাল প্রয়াণ হয়েছে। যে চোখ বুঁজে সুনীলের কবিতা আবৃত্তি করত। জয় গোস্বামীর কবিতায় পথ চলে চলে জীবনানন্দে পেত আশ্রয়। আর খোলা গলায় গেয়ে চলত সঞ্জীব অথবা নচিকেতাকে।

আপনকে নিয়ে কর্মপ্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার কর্তা ব্যক্তিরা এবং কালের কণ্ঠ পরিবারের সবাই ব্যাতিব্যস্ত। নাভিশ্বাস এ্যাপোলো কর্তৃপক্ষেরও। ছোট ছোট জটলায় কেবল আপনের কবিতাসত্তা ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা। অনেকেই ব্যস্ত বিথীর কী হবে, আপনের বাবা-মা, পরিবার কিভাবে চলবে এইসব নিয়ে। আমার কানে কেবল, বিথীর প্রশ্নের স্বর, “মাসুদ ভাই আপনি তো আছেন, আপন নেই কেন?”

আপনের সাথে আমার যখন পরিচয়, তখন থেকেই তাকে আপন ছাড়া পর মনে হয়নি কখনো। ও তখন আজকের কাগজে বিকেলের শিফটে কাজ করে। সকালে পান্থপথের অন্যদিনে। ফারুখ সিদ্ধার্থ, আরীফ হাসান, দীপংকর গৌতম তার অন্যদিনে কলিগ। আজকের কাগজে শামীম রেজা, মজনু শাহ, সাখাওয়াত টিপু, মাসুদ হাসান, মাহবুব মোর্শেদ, আমজাদ সুজন, বিল্লাল মেহদী, সফেদ ফরাজী, মাহমুদ শাওন, জুয়েল মোস্তাফিজসহ অনেক কবি সাহিত্যিক তার সহকর্মী। এদের বেশিরভাগই তার বন্ধু! বাকিরা অগ্রজ, সহকর্মী। আমি তখন আমাদের সময়ে কাজ করি—সিদ্ধার্থ টিপু, সাইফ ইবনে রফিক, বিপ্লব মোস্তাফিজ, টোকন ঠাকুরের সহকর্মী। রুদ্র আরিফ সমকালে। অশোকদা ভোরের কাগজে। ফেরদৌস মাহমুদ বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে সমালোচনা লেখেন। শূন্য দশকের অন্য অনেকেই তখনও ঢাকায় স্থায়ী হননি। ঢাকায় যারা থাকেন, আমাদের সকলেরই রাতের আড্ডা শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট অথবা পিজির পুরোনো টিনশেড বা বহির্বিভাগে। এটা নৈমিত্তিক রুটিন।

আমি, আলতাফ শাহনেওয়াজ আর সুফিয়ান সজল, অনন্ত উজ্জল, মেসবাহ সুমন তখন থাকি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলিতে। আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকতেন লাকি আকন্দ। আপন কবি আলাউদ্দীন আজাদের সাথে থাকত পরীবাগের বস্তিতে। সেখানে আরো থাকেন ফারুখ সিদ্ধার্থ, আশুতোষ সুজন, সফেদ ফরায়েজীসহ অনেকে। ফারুখ ভাই পরে আমাদের বাসায় এসে ওঠেন। আমি আর আপন গভীর রাতে যখন হেঁটে বাসায় ফিরতাম, তখন আপন মনোগার্ড জাতীয় হার্টের ওষুধ কিনত। জানলাম নবীন বন্ধুটির মনের ওপর অনেক চাপ! সেটা সামলাতে তার ওষুধ খেতে হয়।

আপন আজকের কাগজ ছেড়ে কবি জুয়েল মাজহারের সহকর্মী হলেন সদ্য প্রকাশিতব্য যায়যায়দিনে। বাসা পরিবর্তন করে চলে গেল ইস্কাটনে। কবি মামুন খান, মাস‍ুদ হাসানের সে বাসায় অনেক রাত আমি কাটিয়েছি আড্ডায়। আপন ছোট্ট একটি খাটে ঘুমুত। সেই খাট সারা রাত শব্দ করত। মশারীর মধ্যে মাথা গুঁজে রাত জাগত আপন। সিগারেট ও অ্যাশট্রে থাকত মাথার কাছে। আমি মামুনের বিছানায় ঘুমাতাম।

আমি তখন দৈনিক ডেসটিনিতে কাজ করি। থাকি হাতিরপুল। ইসমাইল, তানজীর মেহেদী ও আমি উতল ভাইয়ের মায়ের বাসায় একটা রুম নিয়ে সাবলেট থাকি। এ সময়েরই কোনো এক রাতে আপন ফোন করে জানতে চাইল আমি কই। বললাম, শাহবাগে। বলল, আমার পা ভেঙে গেছে। হাই কমোড ছাড়া বাথরুম করা সম্ভব না। আমি বললাম, আসতেছি। আমি তানজীর ও ইসমাইলকে নিয়ে গেলাম আপনের বাসায়। বিছানার পাশে ক্রাচ। পায়ে প্লাস্টার। কবিতা উৎসবে টাঙ্গাইল গিয়ে পা ভেঙে এসছে, সবে প্রকাশিত ‘মা ও প্রজাপতি’ সিরিজ লিখে বিখ্যাত হওয়া কবি। এখন তাকে তাচ্ছিল্য করারাও সমীহ করতে শুরু করেছে। তবে ‍অনেকের মতো ভড়ং ধরছে না আপন, উপভোগ করছে। অগ্রজরাও তাকে ডেকে কবিতা নিয়ে আলাপ করছেন, সাকুরা-ময়ুর বাগানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

বন্ধু মামুন খান আপনকে ঘাড়ে করে ৬ তলা থেকে নামিয়ে রিক্সায় পৌঁছে দিল। কয়েকদিনের কথা বলে আসা আপন কিভাবে যেন হয়ে গেল আমাদেরই একজন। সেই থেকে তিন বছর একই বিছানায় ঘুমালাম আমরা। আমরা তিনজন থেকে চারজন রুমমেট হলাম। কাকতালীয়ভাবেই আমরা চারজনই পরিবারের বড় ছেলে এবং সাংসারিক টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতায় অতীষ্ট। তাই রাত করে ঘরে ফিরে আলোচনা, সিনেমা দেখা আর সদ্য যোগ হওয়া ফেসবুকে ফার্মভেইল গেম খেলে ঘুমাতাম ভোরের দিকে।

আমাদের মধ্যে যারা একাবিংশ শতকের শুরুর দিকে কবিতা লেখার জন্য মনোনিবেশ করেছিলাম, তাদের মধ্যে একটু আগেই কবিগুণাবলী এবং কবিত্ব অর্জন করেছিল আপন। ও কখনো ছেঁড়া পাতা, সিগারেটের প্যাকেট, নিউজের স্লিপ ছাড়া কবিতা লিখেছে বলে মনে হয়নি। ওর কবিতা থাকত ওর ঝোলা আর অফিসের ডেস্কে। তাই ওর সব কবিতা আমরা পড়েছি বা পড়তে পারব এমন ধারণা আমার হয় না কখনো।

আপন ছিল খ্যাপাটে তরুণ। গরিব সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত কিন্তু অবিচল। এমন এক কবির সাংসারিক দায়িত্ব নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন বিথী। ওদের বিয়ে হয়েছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মার্চ থেকে সে আমাদের সঙ্গ ছেড়ে বিথীর সংসারে যায়। আপনও সংসার করতে চেয়েছিল, কিন্তু সাংসারিক হওয়ার উদ্যোগী হয়নি। বিথীর তাতে ক্লান্তি আসেনি, দৃশ্যত। তবে, মানসিক দূরত্ব তৈরি হলেও অবাক হওয়ার কিছু তাতে নেই। কারণ, এই ক্ষেত্রে আপন বেহিসেবিই ছিল। তবে সব মনোযোগ ছিল তার গ্রামে। কর্কটে আক্রান্ত পিতার চিকিৎসা, ভাইয়ের, মায়ের চিকিৎসা, ভাই-বোনের পড়াশোনা, প্রবাসী ভাইয়ের সংসার, বিধবা বোনের জন্য টাকা পাঠানো ইত্যাদি কারণে আপন হয়ে উঠেছিল মানসিকভাবে অস্থির। মনের ওপর এই সময়ে চাপ গেছে তার। এই চাপ সামলাতে সে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে শেয়ার বাজারেও বিনিয়োগ করে। একজন কবির শেয়ার ব্যবসা নিয়ে আমরা মজা করতাম ওর সাথে।

আপন ছাতিম ফুল ভালোবাসত। ও আগে এই ফুল চিনত না। আমি সারা শরতে ওকে রাতের পর রাত ঘুরিয়ে ছাতিম ফুলের গন্ধ শুঁকাতাম। কাশফুল পছন্দ করত, বাইকে করে কাশবনে নিয়ে যেতাম। মৃত্যুর কিছু দিন আগেও আপন ওর সহকর্মীদের নিয়ে কাশবনে ছবি তুলেছিল। তবে সব ফুলই সে গ্রহণ করেনি। যেমন একটি কবিতায় সে লিখেছে, ‘রজনীগন্ধা কেন সবজি হলো না!’ আপনের যখন জানাজা হলো, মিডিয়া হাউজের উঠানে, আমরা তার বাক্সবন্দি দেহ নিয়ে যখন রওনা হব, তখন দেখলাম গোলাম রাব্বানী একটি ফুল এনে দিল বাক্সের ওপর। আপন এই ফুলে ঘেরা চত্বরেই অফিস করত নিয়মিত।

আপনের লাশবাহী গাড়িতে আমি, সুমন ভাই, জুয়েল আর সফেদ। বিল্লাল মেহদীও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কাঁচপুর ব্রিজে তাকে নামাতে হলো অসুস্থতার কারণে। আমরা নয়টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম লক্ষ্মীপুরের কড়ইতলি গ্রামে। গ্রাম তখন তাদের আদরের সন্তান আব্দুর রহীমকে বরণ করতে ব্যস্ত। রহীম আপনের পারিবারিক নাম। আপন যখন যায়যায়দিনে চাকরি ছেড়ে কালের কণ্ঠে জয়েন করে তখন একদিন আমাকে যায়যায়দিন পত্রিকা অফিসে নিয়ে যায় সাক্ষী হিসেবে। সে যে দেনা পাওনার চেক পেল তাতেই লেখা দেখলাম তার সার্টিফিকেট নামটি।

আমরা ফিরে আসার সময় জুয়েল আপনের কবর থেকে মাটি নিয়ে আসে। সারা রাস্তা আমরা একে অপরকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করি। আবার আবেগ তাড়াতে উকিল মুন্সী, শাহ আব্দুল করিমে আশ্রয় নেই। শেষমেষ ভোরে ঢাকায় পৌঁছাই। ততক্ষণে আপনের চলে যাওয়ার একদিন হয়ে গেছে। আপন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সিকিউরিটি গার্ড একটি রিক্সায় তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল।

আপন মারা যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আপনের মা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। ওর বাবা দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন। আমরা অনেকেই তার পরিবারের ফোন রিসিভ করার সাহস দেখাতে পারিনি। বিথীর সামনে যেতেও আমি কুণ্ঠা বোধ করি। ভয় হয়, কানে বাজে সেই শব্দ, “মাসুদ ভাই আপনি তো আছেন, আপন নেই কেন?”

আপনের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, আপনের সমগ্র বের করব। আমরা আপন স্মরণে একটি বড় অনুষ্ঠান করেছিলাম পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। শ’পাঁচেক কবি সাহিত্যিকের সামনে আমরা আপন সমগ্র করার কথা দিয়েছিলাম। আজ তিন বছরেও আমরা সেটা পারিনি। আমি সেই ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি আছি।

বন্ধু আমজাদ সুজন আপনকে নিয়ে অনুষ্ঠান করার কথা এবারও বলেছিল আমাকে। দেশে না থাকায়, সেটা আমি বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছি। সুজন আপনকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছে শুনেছি। সময়ের অভাবে তাতেও ‍অংশ নিতে পারিনি। আমি জানি, আপনকে যারা জানত কবিতার বিচারের আগে তারা আপনকেই মনে রাখবে সবার আগে। আপনের কবিতা নিয়ে তাই পাঠকই মূল্যায়ন করবে। বন্ধুরা যে তা—পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারছি না, সহসা সে সংকট কাটবে বলে আশা করছি।



বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।