ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের ‘মরীচিকা’ প্রেমের কবিতা নয়

খালেদ হামিদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৫ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১১
রবীন্দ্রনাথের ‘মরীচিকা’ প্রেমের কবিতা নয়

পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম
                                 কস্তুরীমৃগসম।
ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে কোথা দিশা খুঁজে পাই না।


যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না ॥

বক্ষ হইতে বাহির হইয়া আপন বাসনা মম
                                  ফিরে মরীচিকা সম।
বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে বক্ষে ফিরিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না ॥

নিজের গানেরে বাঁধিয়া ধরিতে চাহে যেন বাঁশি মম
                                   উতলা পাগল-সম।
যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না ॥

(‘মরীচিকা’, উৎসর্গ : ১৩১০)

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস না পাওয়ার হেতু বিষয়ে ভাবতে চাইলে প্রথমত রবীন্দ্রসঙ্গীতের, শিক্ষণ ও শ্রবণের প্রশ্নে, অবিরলতাই অগ্রগণ্য হয় এক নিমেষেই কিংবা খুবই সাধারণভাবেই। ব্যক্তিসত্তার নিভৃত কোণ থেকে ‘জীবন দেবতার’ বিমূর্ত উচ্চতা পর্যšত পরিভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টির জন্যেই রবীন্দ্রনাথের গান অজরামর কিনা খতিয়ে দেখতে গেলে আমাদের গেলো শতকের নব্বইয়ের দশকের কবি জহির হাসানের একটি মšতব্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। পত্রিকাšতরে প্রকাশিত এক ছোট্ট গদ্যে তিনি এমনটিই বলেন যে, অঙ্গীকৃত ‘অন্ধকার’ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ অমরত্ব লাভ করেন তাঁর ঈশ্বর আছে বলেই। আর, এদিকে বলতে হয়, পুঁজিবাদী সভ্যতায় পুঁজিই ঈশ্বর, মানুষ নিতাšতই পণ্য। এই জীবšত পণ্যের অধীনতাই ধনতন্ত্রের কাম্য। এ জন্যেই অর্থাৎ এই নিবেদিতচিত্ততার গুণেই কি, গানের বাণীর বিচারে রবীন্দ্রসঙ্গীত কেবল নয়, সমগ্র রবীন্দ্রনাথও এমন অজর, অক্ষয়? কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশ-কবলিত সেই ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক ক্রাšিতলগ্নে এই রবীন্দ্রনাথই ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেন : মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। মানুষের রক্ত-ঘাম-মেধা শুষেও মানুষের প্রতি অবিশ্বাসী যারা তারা শ্রেণীবিভাজন অক্ষুণœ রাখার মাধ্যমে কেবল মানবসমাজকেই কি দ্বিধা করে নাকি মানবসভ্যতাকে সমগ্রতা দানেও সৃষ্টি করে অনতিক্রম্য ব্যাঘাত? রবি ঠাকুরের শেষ জীবনের কাব্য শুধু নয়, তৎপূর্ববর্তী কিছু কবিতাও সভ্যতার অপূর্ণতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে।

অমনই একটি রচনা উপর্যুক্ত ‘মরীচিকা’ কবিতাটির পাঠ নেবার আগে বলে রাখা দরকার যে, প্রেম-বিরহের কবিতা হিসেবে এটির রসাস্বাদনে অনেকেরই অভ্য¯ত থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কবিতা নিছক আবেগের অনুবাদ নয় এবং আবেগ ও মননের যোগফল হিসেবে তা বিধৃত বিষয় কিংবা প্রসঙ্গের নির্দিষ্টতাকে ছাড়িয়ে যায় বিধায়, বলা বাহুল্য, প্রিজমের ধরনে একাধিক তল বা পৃষ্ঠ থেকে বহুবিধ আলোক বিচ্ছুরিত করে। এজন্যেই কিনা জানি না, বর্তমান লেখকের কখনোই আলোচ্য রচনাটিকে ব্যক্তিক কবিতা মনে হয়নি। কবি নিজে কিংবা কবিতায় হাহাকারময় মানুষটি বনে বনে পাগল হয়ে, কস্তুরীমৃগের মতো, ফেরেন কেন? মানুষটি নিজের গন্ধেই বিভোর বলে? এ মানুষ কি নিছক প্রাগৈতিহাসিক? নাকি জঁ জ্যাক রুসো-আলোচিত সাম্যবাদী সমাজভুক্ত সেই আদিম মানুষ, কৃষি-সভ্যতার গোড়াপত্তনের সময় থেকে ভেঙে-যাওয়া, ভেঙে-দেওয়া সুষম সমাজের, রুসোরই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যে প্রতিনিধির নিঃস্বতা অনূদিত হয় প্রথম ¯তবকের অšিতম চরণে? অবশ্য ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই’ আক্ষেপটি নিরীহ পরাজিতের, ব্যর্থ বিদ্রোহীর নয়। তথাপি মানুষের সহজাত (যা মূলত ইতিহাস-সৃষ্ট) আবেগ তথা আনন্দ-বেদনার অনুবাদক একজন বড় কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কলমে ওই অনুশোচনার ভাষাশিল্পে উত্তরণ লাভই স্বাভাবিক। তাই ফাগুনের রাতে, দখিনা হাওয়ায় ‘আপন গন্ধে’ বনে বনে ফেরা আদিম খাঁটিত্বও হারানো মানুষটি দিশাহীন।  

কৃষি-সভ্যতার গোড়াপত্তনের সাথে সম্পর্কিত সেই অভিশাপ বা শ্রেণীবিভক্তি নিয়মে পরিণত হলে অগণিত পরাধীন মানুষ নিজ নিজ সত্তার আদিম প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা হারিয়ে ফেলে। নিজেকে হারিয়ে নিজেরই অনুরূপ কাউকে লাভের আকাক্সক্ষাও তাই মরীচিকায় পরিণত হয়। এভাবে মিলনাকাক্সক্ষা বিরহে এবং মিলন বিচ্ছেদে ভাঙা স্বপ্নের ওপর স্মৃতির ধরনে গড়ালে দ্বিতীয় ¯তবকের শেষে প্রাগুক্ত হাহাকারটি অধিকতররূপে ঘনীভূত হয়। প্রাপ্তির সাথে দূরত্বের অনুভবটি, যেমন ‘যাহা পাই তাহা চাই না’, কবিতার প্রথমাংশের তুলনায়, আরেকটু বেশি বেজে ওঠে পাঠকের সত্তায়। জানি, রবীন্দ্রনাথ, রুসো কিংবা মার্কস-এর উত্তরসূরি হলেও ভিন্ন পথের অভিযাত্রী, বেশির ভাগই রোমান্টিসিস্ট এবং শেষ ভাগে মিস্টিক। কিন্তু বড় কবির কিংবা যে কোনো কালোত্তীর্ণ রচনা অথবা কবিতার সাফল্য এই যে, তা বহুমাত্রিক এবং এমনকি বিবর্তমান। এ কথার পক্ষে একটি দৃষ্টাšতই যথেষ্ট, শেক্সপিয়রের নাটক, বিশেষত তাঁর চারটি বিশ্ববিদিত ট্র্যাজেডি : হ্যামলেট, ওথেলো, ম্যাকবেথ এবং কিং লীয়র-- ভাষাশিল্প, দ্বান্দ্বিক রাজক্ষমতা চিত্রিতকরণ ও কাব্যিকতায় অনন্য-- নাট্যকারের জীবৎকালীন সেই ক্ষমতাকাঠামোর আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও যে সৃজনকর্মগুচ্ছ এখনো প্রাসঙ্গিক। কেননা সামšতবাদের পরে পুঁজিবাদে এসে রাষ্ট্রের আকৃতি পরিবর্তিত হলেও প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলায়নি। ‘অনাধুনিক’ ভূস্বামীর স্থলে ‘আধুনিক’ উৎপাদকের শোষণ (প্রসঙ্গত স্মর্তব্য : মার্কসবাদের ভুল সমালোচক ড. আলী শারিয়াতি সমাজতন্ত্রকেও ‘উৎপাদকের দর্শন’ অভিহিত করেন তাঁর ‘ম্যান মার্ক্সিজম অ্যান্ড ইসলাম’ গ্রন্থে) কায়েম হয় মাত্র। ধনতন্ত্র পশ্চিমা সমাজ থেকে ধর্ম বিলোপ না করে রাষ্ট্র থেকে ধর্মতন্ত্রকে শুধু পৃথক করে। এসব কারণেও কার্ল মার্কসেরও ছিল শেক্সপিয়র লাইব্রেরি। তাছাড়া সাহিত্যের মার্ক্সীয় গবেষক ক্রিস্টোফার কডওয়েল শেক্সপিয়রের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকে মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা আবিষ্কার করেন। রবীন্দ্রনাথের অরাজনৈতিক কবিতারও কোনো কোনোটি বিদ্যমান-চলমান ব্যবস্থার কারণেই, হয়তো বিস্ময়কররূপেই, আর রাজনীতি-বহির্ভূত থাকে না। এও তো বলা বাহুল্য, কোনো কিছুই অরাজনৈতিক নয়। এজন্যই হৃদয়-নিঃসৃত ‘আপন বাসনা’কে বাহু মেলে বা হাত বাড়িয়েও বাহুডোরে আর বাঁধা যায় না। কেন? ব্যক্তির স্নেহ-মমতার অধিকারও বিলুপ্ত কিংবা আদরের পাত্রও কি প্রত্যাশার বিপরীত বলে? হ্যাঁ, অনেকখানিই তা-ই। কেননা, রুসো মানুষের স্বাধীন জন্মের কথা (তাঁর জগদ্বিখ্যাত উক্তি অনুযায়ী, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মেই শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে) বললেও সম্পত্তিহীন শোষিত মানুষের সšতান স্বাধীন হয়ে জন্মায় না। হেগেল হয়ে কান্ট অব্দি এসে স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়ায় : সম্পত্তির ওপর অধিকার। উপরন্তু, এই বিষম সমাজে নারীও যেখানে পুরুষের সম্পত্তি সেখানে নারীর তো নিজের প্রত্যাশা বলেও কিছুই নেই। কিছু চেয়েও তাই তাকে ‘ভুল করে চাই’ মর্মে জর্জরিত হতে হয়।  

আলোচ্য কবিতার তৃতীয় এবং শেষ ¯তবকেও ভিন্নরূপে একই কথাই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। তবে সমগ্র রচনাটিকেই কি ইয়োরোপের সেই রোমান্টিসিস্ট ধারার কবিতা বলা যায়? কাক্সিক্ষত সত্তার সঙ্গে মিলনকাতরতাজনিত হাহাকার, যা পরে প্রাপ্তিতে ¯িতমিত হয় কিংবা মিস্টিসিজমে যার সুরাহা হয়, রবীন্দ্রনাথ তারই অনুশীলন সম্পন্ন করেন কবি হিসেবে, এবং, সঙ্গীতকার হিসেবেও। কিন্তু প্রাপ্তির সঙ্গে প্রত্যাশার বৈশাদৃশ্য এতে নেই। রবীন্দ্রনাথ প্রায় গোটা জীবন ব্যেপে যার অনুসন্ধান করেন রোমান্টিসিস্ট হিসেবে, শেষ জীবনে তাকে পেয়ে ‘জীবন দেবতা’ বলে ডাকেন। তাঁর সর্বশেষ কবিতায় অসামান্যরূপে ওই ‘জীবন দেবতা’কে ‘ছলনাময়ী’ বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু এই ‘মরীচিকা’ কবিতাটি সেরকম কোনো বিমূর্ত সত্তার ছলাকলা বা প্রতারণার ফল নয়। এটি এই রক্তমাংসের বঞ্চনাময় সমাজ-সংগঠনেরই সূক্ষ্ম সমালোচনামূলক, এমনকি তির্যক অথচ বেদনার্ত-সমাহিত এক ভাষিক প্রতিভাস। তাই সৃজনশীল প্রেমের কাজও অতৃপ্তিখচিত থেকে যায় এই কবিতার তৃতীয় ও শেষ ¯তবকে। নিজেরই বাঁশিতে সৃজিত সঙ্গীতকে নিজের মতো করে বাঁধা যায় না। যতটুকু যায় তাতে ‘রাগিণী’ খুঁজে না পাওয়ার রূপকে একাšত চাওয়ার স্বরূপও রহিত হয়ে যায়।

তবে এই কবিতাকে কি পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অস্থায়িত্ব এবং এতৎজনিত অপূর্ণতার বোধ ও অস্থিরমতিত্বেরও অনুবাদ বলা যায়? এরকম ধারণা কিছুটা উঁকি দিলেও স্থিত হতে পারে না কিছুতেই। কেননা রবীন্দ্রনাথের চূড়াšত দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক নয় বিধায় কবিতাটি এর আধেয়কে অসীম সম্ভাবনায়  দ্যোতিত করে। কবিতাখানি হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার উপর্যুক্ত সব অসম্পূর্ণতার দিকে কবির লেখনী-নির্দেশ। যুগে যুগে দেশে দেশে গণমানুষের অনেক সংগ্রাম বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনাও এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। তাই প্রতিটি ¯তবকের শেষ চরণখানি, পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও, পাঠকের চেতনায় বেজে চলে অশেষ ব্যঞ্জনায়। এভাবে সমগ্র কবিতাটি হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের অবস্থিতির এক অবিচ্ছেদ্য সত্য।

বাংলাদেশ সময় ১৯০৫, মে ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।