ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নাসির আলী মামুনের সাক্ষাৎকার-২

ক্যামেরাকে আমি প্রাণময় সত্তা হিসেবে দেখি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১১
ক্যামেরাকে আমি প্রাণময় সত্তা হিসেবে দেখি

বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। আগামী বছর তার ফটোগ্রাফির ৪০ বছর হতে যাচ্ছে।

তিনি দেশ-বিদেশের এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি তুলেছেন।

এসব ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন সেক্টরের সেরা সেরা ব্যক্তিরা। তার তোলা ছবিতে আলো ছায়ার মিলনে থাকে রহস্যময় শিল্পের খেলা।

৫ জানুয়ারি ২০১১ নাসির আলী মামুনের সাভার জোরপুরের বাসায় তার সাথে দীর্ঘ আড্ডা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : ফেরদৌস মাহমুদ

ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার সাথে তো  স্টিফেন ডব্লিউ হকিংয়ের দেখা হয়েছিল...

নাসির আলী মামুন : স্টিফেন হকিংয়ের ছবি তোলাও একটা নাটকের মতো। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুসের সাথে আমি গিয়েছিলাম হোয়াইট হাউসে। হোয়াইট হাউসের ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দেবেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সেই অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য।

আমরা রিসিপসনের পাশে বসে আছি, অপেক্ষা করাতাছি। তখন দেখলাম যে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে কাচের ভেতর দিয়ে স্টিফেন হকিং। আমি ড.ইউনুসকে বললাম যে, স্যার স্টিফেন হকিং, তার যদি একটা ছবি তোলা যায়। আমরা রুম থেকে বের হয়ে হকিংয়ের সামনে গেলাম।

আমি হকিংয়ের হাস্যোজ্জল ছবি তুললাম। দেখলাম, যখন ছবি তুলছিলাম তখন তার মেয়ে দূরে সরে গেল। তার মেয়ের নাম লুসিয়া হকিং। তিনিও নাকি বিখ্যাত লোক। লুসিয়া আমাকে পরে কানে কানে বলল, প্রফেসর ইউনুস সাহেবের সাথে যদি আমার একটা ছবি তুলে দাও। আমার খুব অবাক লাগলো, হকিংয়ের কাছে গেছি আর তার মেয়ে বলছে ড. ইউনুসের সাথে ছবি তুলতে!

এই সুযোগে আমি হকিংয়ের সাথে ছবি তুললাম। স্টিফেন হকিংয়ের শরীরে হাত দিয়ে ধরলাম, নরম একটা শরীর। নীর্জিব, নিস্প্রাণ...লাশের মতো। শুধু মাথটা কাজ করে, কথা বলতে পারেন না।

ভয়েজ সিন্টোফাইজার নামে একটা মেশিন আছে, ওইটার মাধ্যমে সে কথা বলে। স্পেশালি তার জন্য ওইটা তৈরি করা হয়েছে। সম্ভবত আইবিএম কোম্পানি তার ওই মেশিনটা, কম্পিউটারটা বানিয়ে দিছে, সারাক্ষণ ওইটা তার হুইল চেয়ারের সঙ্গেই থাকে। সারাক্ষণ ওইটা টিক টিক করতে থাকে।


ফেরদৌস মাহমুদ : হকিংকে তো নোবেল দেওয়া হলো না। এর কারণ কি মনে হয় আপনার?  
নাসির আলী মামুন : আমি যতটুকু  শুনেছি বা জেনেছি তারে নোবেল দিতে অন্তরায় হলো সৌরজগতের যেসব সৃষ্টিরহস্য নিয়ে উনি কাজ করেন, উনি যে সব বিষয়ে রিসার্চ করছেন, প্রবন্ধ লিখছেন সেগুলি প্রমাণ করা নাকি সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে তাকে বিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্যতো অবশ্যই। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী, এই মুহূর্তে তার চেয়ে সেরা বিজ্ঞানী আর নেই।


ফেরদৌস মাহমুদ : হকিং তো এই মাসখানেক আগেই বলল, ভিনগ্রহে প্রাণ আছে। তারা পৃথিবীতে যদি আসে ওটা আমাদের জন্য একটা আতঙ্কের বিষয়। এটা অবশ্য প্রমাণ করা চাইলেই সম্ভব না...

নাসির আলী মামুন : হ্যাঁ, উনি বলতেছেন ভিন গ্রহে প্রাণ আছে। যেখানে আমাদের যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তবে ওরা হয়ত আসতে পারবে। তার সেই বিখ্যাত বই ‘দ্য ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’। এত সরল লেখা, বিশ্বমানের এত বড় একজন লেখক, হাত দিয়ে তার শরীর স্পর্শ করাটা আমার জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। তার একটু ভিডিও আমি করেছি। সারাক্ষণ দেখি তার মুখ থেকে লালা ঝরতেছে। দেখলাম এত আকাশচুম্বি, এত বিখ্যাত একজন মানুষ কি অসহায় হতে পারে।

ভয়ংকর বেদনার্ত লোক সে। অসম্ভব নিঃসঙ্গ একজন লোক। সে চাইলে কি না পায়। সে যদি চায় শত  শত সুন্দরী তাকে ঘিরে রাখতে পারে।

তার মেয়ে বলল এখন তো তার বাবা বিখ্যাত হইছে তার যে কোনো জায়গায় প্রবেশাধিকার আছে। আগে যখন সে বিখ্যাত ছিল না, তখন লন্ডনে কোনো রেষ্ট্রুরেন্টে তাকে নিয়ে ঢুকলে বের করে দিত। ওরা বলত বাচ্চারা তাকে দেখলে ভয় পায়। অথচ এখন সে ঢুকলে তার জন্য আলাদা জায়গা করে দেয়। বলা যায় ওইটা একটা বিজ্ঞাপন হয়ে যায়।


ফেরদৌস মাহমুদ : জসীমউদদীন তো আপনার ফুপা। তার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন।

নাসির আলী মামুন : জসীমউদদীনের সাথে আত্মীয়তার কারণে ঠিক না, এমনিতেই আমি যেহেতু বিভিন্ন সৃজনশীল মানুষের ছবি তুলতাম এ কারণেও তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। তার স্ত্রী সে সময়ের অসাধারণ একজন মহিলা, আমার ফুফু অসাধারণ একজন মহিলা। ২০০৩ সালে  জসীমউদদীনের শতবর্ষ উপলক্ষে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আমি সম্পাদনা করি জসীমউদদীন স্মারক গ্রন্থ। বাংলা একাডেমী তাকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ করেছে এরও দুই বছর পর। তাও সেখানকার অর্ধেক লেখাই নাকি রিপ্রিন্ট। আমার মধ্যে জসীমউদদীন বাস করতো বলেই আমি এ কাজটি করতে পেরেছিলাম। তার পরিবারের পক্ষ থেকেও এরকম একটি কাজ করা সম্ভব হয়নি।

আমি প্রথম যখন কবি দেখি ছোটবেলায় জসীমউদদীনকে দেখি। কাজেই আমার চোখ অনেক বড়। আমার মনের ভিতরে যে হার্ডড্রাইভ আছে সেটা অনেক বড়, কেননা জসীমউদদীনের মত একজন মানুষকে আমাকে ধারণ করতে হয়েছে, কত গিগাবাইট জায়গা লাগছে তখন ওই শিশুবয়সে। তখনই তো সে অনেক বড় কবি। তার রচনা বিপুল বিশাল। তখনই তিনি বিরাট কবি। ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে গ্রামের মানুষ নিয়ে সাধু ভাষায় লিখছে। তার লেখা সাধু ভাষা অনেকেই চেইঞ্জ  করে চলতি ভাষায় লিখতে বলছে কিন্তু তিনি চেইঞ্জ করেননি। বিরাট সাহসের কাজ করেছেন তিনি।

কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদদীনের সঙ্গে নাসির আলী মামুন kazi Nazrul islam, jasim uddin and nasir ali mamun


ফেরদৌস মাহমুদ : একটি জাতীয় দৈনিকে আপনি ‘ঘর নাই’ শিরোনামে ছিন্নমূলদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এটার নাম ‘ঘর নাই’ কেন? এই সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে এবারের একুশে মেলায় বই প্রকাশ হওয়ার কথা, এ বিষয়ে কিছু বলুন।

নাসির আলী মামুন : আমি সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা সেলিব্রেটি তাদের পোট্রেট করি। করতে করতে দেখলাম যে আমাদের কারণে যারা ফুটপাতে পড়ে গেছে, রাস্তায় পড়ে গেছে তাদের মনের অবস্থা কি? কিছুদিন কিছুকাল তাদের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে কেমন হয়? আমি কাওরান বাজার যেখানে অফিস করতাম, সেখানে আশপাশে রাস্তায়-ফুটপাতে অনেককেই দেখতাম ঘুরে বেড়াতে। এদের মধ্য থেকে যারা হোমলেস, যাদের ঠিকানা নাই, ঘরবাড়ি নাই ভাবলাম তাদের কি অবস্থা? এরা কিন্তু মাইনোরিটি। ভিক্ষা করে, চুরি করে, নানা রকমের ছোটখাট ক্রাইমও করে তারা। এরা বেশির ভাগই কিন্তু থাকে বস্তিতে। গ্রামে কোনো না কোনো জায়গায় তাদের একটা ছোট্ট ঠিকানা আছে।   নড়বড়ে ঠিকানা। এরমধ্যে খুব মাইনোরিটি একটা গ্রুপ আছে যাদের গ্রামেও কোনো ঠিকানা নাই। তারা ফুটপাতের মধ্যেই থাকে, রেললাইনের কাছে থাকে। তখন আমি শুরু করলাম এদের ইন্টারভিউ করা।   প্রথমে চারটি ইন্টারভিউ করলাম আমি, অসাধারণ সব ব্যপার। ওদের সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টাইয়া গেল। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রায় ৫ বছর যাবত ছাপা হয়েছে আমার এই সাক্ষাৎকারগুলো।

এইসব সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ওদের এমনও প্রশ্ন করছি ‘ঘর কেমন ক দেখি’। দেখলাম কইতে পারে না। কেননা এরা কখনো ঘরেই থাকে নাই। যখন জিগাইলাম ‘বাথরুম কি রকম’? দেখলাম কইতে পারে না, কেননা এ সম্পর্কে ওদের কোনো ধারণাই নেই। বিচিত্র সব জীবন আমি দেখলাম।  

কিন্তু এই যে একটা শ্রেনী যাদের কোনো ঘর নাই, তাদের আমরা কাজ দেই না।   ফলে ওরা অনেক ছোটখাট ক্রাইম করে। কি করব? বাঁচতে তো হইবো। আমি দেখছি ওদের মধ্যে অনেক মানবিকতাও আছে। আমি একজনও পাই নাই যে আসলে ভিক্ষা করতে চায়, ওরা আসলে চায় কাজ করতে। কিন্তু ওদের আমরা কাজ দেই না। রেফারেন্স ছাড়া তো আমরা সাধারণত কাউকে বাসায় কাজ দেই না।


ফেরদৌস মাহমুদ : এই সাক্ষাৎকারগুলি করতে আপনাকে কোথায় কোথায় ঘুরতে হয়েছে?

নাসির আলী মামুন : আমি ইন্টারভিউ করতাম ঢাকার শহরের বিশেষ কয়েকটি স্পটে, যে স্পটগুলিতে এই গৃহহীন মানুষদের আনাগোনা। সেটা কমলাপুর রেলস্টেশন, গুলিস্তান, পল্টন, বাইতুল মোকাররম, ফার্মগেইট, সদরঘাট টার্মিনাল যেখানে ওদের জন্য সামান্য খাদ্যের ব্যবস্থা আছে। সামান্য কাজাটাজ করলে ওরা খাইতে পারে। এই জায়গাগুলিতে আমি ছোট্ট টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতাম আর ঘুইরা ঘুইরা ইন্টারভিউ করতাম। ভুল উচ্চারণে ভুল ব্যকরণে ওরা যা বলত ওইভাবেই আমি ছাপতাম। ওই লেখাগুলোর মধ্যে কোনো চন্দ্রবিন্দু ছিল না। অনেকেই বলত যে আপনি এটা করেন কেন? আমি বলতাম, যে শ্রেনীর সাথে আমি কথা বলি সেখানে আমার মনে হয় চন্দ্রবিন্দুর কোনো দরকার পড়ে না। এইগুলি যে পাঠকরা পড়ে তারা ওইরকমের মাইন্ডসেট হইয়াই পড়ে, এইখানে ব্যাকরণের কোনো দরকারও নাই। কোনো পাঠক অবশ্য এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি, করেছে দু’চারজন পণ্ডিত। আমি তাদের বলেছি, এই শ্রেনীর কথ্যভাষার ফ্লেভার আনার জন্য আমি এইভাবে কাজটা করছি। বিপুল পাঠক এইটা সমাদৃত করছে।

২০০০ সালে মাওলা ব্রাদার্স ৪০টা ইন্টারভিউ নিয়ে ‘ঘর নাই’ বই ছেপেছে। বই সবই বিক্রি হয়ে গেছে।

এই ইন্টারভিউ করতে গিয়ে এমনও লোক পাইছি, যে বলতেছে ‘রাজধানীর সব লোকরা দোজখে যাবে। ’  সে নিশ্চিত। কী কারণে সেটাও সে বলতেছে ‘রাজধানীর লোকেরা বেশি পাপ করে, মিথ্যাবাদী তারা, প্রতারক’।

Nasir_Ali_Mamun
আরেকজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ৭০ বছর বয়সী তারেও পাইছি। তার ঘর নাই। সে একটা ব্যাগভর্তি, আর গলার মধ্যে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর একটা ব্যাগভর্তি ক্যাসেট... । জিজ্ঞেস করলাম ‘কী এগুলা’। বলল ‘গীত’। এইগুলি বাজারে বাজারে ফেরি করি। আমি বললাম, আপনে বলতেছেন যে গান করা হারাম, আপনিই আবার গান ফেরি করতেছেন। লোকটা বলে যে, ‘এগুলি তো গান না, এগুলি গীত, এগুলিতে কোনো যন্ত্র নাই’। জিজ্ঞেস করলাম,  কার গলা। সে বলল ‘কাদেরের গলা’। গানগুলি খালি গলায় গাওয়া ‘নূর নবী মোস্তফা রাস্তা দিয়া হাইটা যায়’ টাইপ।

একজন পাইছিলাম ব্যাংকের অফিসার, কেরানি আর কি...। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের আমলে ১২ হাজার কর্মচারি ছাটাই করছিল, ওর মধ্যে উনি পড়ছিল। হোমলেস হইয়া গেছিল। তার দেখা আমি পাইছিলাম মতিঝিলে। বিচিত্র সব ঘটনা এগুলি। এগুলির কোনো শেষ নাই। গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমার মত ঘটনা সব। এগুলি বললে শেষ হবে না।


ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার এই বইটা কারা করছে?

Nasir Ali Mamun`s Book Cover, charalnamaনাসির আলী মামুন : আমার বন্ধু সাখাওয়াত টিপু এইগুলি নিয়ে দীর্ঘ চার মাস ধরে কাজ করছে। তার সম্পাদনায় বইটা প্রকাশ হচ্ছে। আগামী প্রকাশনী থেকে বইটা ফেব্রুয়ারির মেলায় বের হবে আশা করছি। এই বইটা নিয়ে সে রীতিমত গবেষণা করছে। এখানকার কথ্য ভাষা থেকে অনেকগুলি শব্দ নিয়ে একটা অভিধানের মত সে দাড় করাইছে। এইখানে অনেকগুলি শব্দ আছে যেগুলি বাংলা একাডেমীর অভিধানে নাই। যেমন দিকনেছারা, সলিমুল্লাহ খান এই শব্দটার ব্যাখ্যা করছে। ‘ঘর নাই’ সিরিজে অনেক ইন্টারভিউ করছিলাম, ওইগুলি থেকে ১১০ টা ইন্টারভিউ সিলেক্ট করা হয়েছে।

আমি মনে করি এই লেখার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওদেরই, যারা ‘ঘর নাই’ ব্যক্তিত্ব। যারা আমাকে সময় দিছে। আমার প্রশ্নগুলি ইম্পপরটেন্ট কিছুই না। ওদের কথাগুলিই ইম্পরটেন্ট। ওদের ভাষা, ওদের জীবনযাপন পদ্ধতি, ওদের চিন্তা, পেশার প্রকরণ, ওদের গৃহহীণ হওয়ার কারণ সবই লেখাগুলির মধ্যে আছে। এই কাজটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওদেরই। আমি মনে করি এটা একটা উল্লেখযোগ্য বই।



ফেরদৌস মাহমুদ : এই সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হন নাই?

নাসির আলী মামুন : আমি ক্যামেরা লুকাইয়া নিয়া যাইতাম। কারণ ব্যাগ ট্যাগ আর ক্যামেরা দেখলে ওরা ভয় পাইয়া যাইতো। ওরা মনে করতো এনজিওর লোক কিনা, সরকারী লোক কিনা, কিডনি কাইটা নিয়ে যাবে কিনা। নিয়া খারাপ কাজ করবে কিনা। ধইরা নিয়া যাইবো কিনা বর্ডার পার কইরা ইন্ডিয়াতে। নিয়া খারাপ কাজ করবে কিনা। এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি তো ওরা হয়। তাই অনেকেই বলছে, আপনার সাথে আমরা কথা বলব না। আপনাকে আমরা সন্দেহ করি।

ইন্টারভিউ করতে চাইলে অনেকেই ইন্টারভিউ দেয় নাই। এমনও হইছে যে, ৭/৮ জনরে সিলেক্ট করছি দেখা গেছে ওইখান থেকে হয়ত একজন ইন্টারভিউ দিছে।

আমি মনে করি, এই যে ‘ঘর নাই’ এখানকার সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় বা অনেক বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ হবে এবং ছাত্রদের পড়াবে। এই যে এই লেভেলের মানুষের ইন্টারভিউ নিলে তার রেজাল্ট কি, এই লেভেলের মানুষের ইন্টারভিউ কিভাবে করতে হয় এটা তো উপলব্ধির ব্যপার আছে।


ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি তো শিল্পী এস এম সুলতানের অনেক ছবি তুলেছেন। তাকে নিয়ে আপনার একটা আলাদা অ্যালবামও আছে।   আপনার একটা ছবি আছে না, বেশ রহস্যময় ভঙ্গিতে বিড়াল নিয়ে সুলাতান বসে আছেন। অদ্ভুত ছবিটা। আমি আপনার সাথে সুলতানের সম্পর্ক ও তার ছবি তোলা প্রসঙ্গে শুনতে চাচ্ছি।
 
নাসির আলী মামুন : সুলতানের ছবি তোলার সময় সুলতান যে কোঅপারেট করছে আমায় তা না। তার চেহারা, জীবনযাপন, তার পরিবেশটা, তার পোশাকটাই ছিল এরকম যা এ ভারত উপমহাদেশে বা এ সাবকনেটেনের মধ্যে কারও ছিল না। ওরকম চুল, কালো আলখাল্লা বলা যায় রহস্যময় জীবনযাপন। কাজেই নিষ্ঠার সঙ্গে সুলতানের ছবি যে তুলতো সেই আলোচনায় আসতো। তবে সুলতান আমার আলোকচিত্রের যথেষ্ট প্রশংসা করেছে, যেগুলি মুখে না লিখিত আকারে। এগুলির ডকুমেন্ট আছে।
সুলতান আমার মোট ৭টি পোট্রেট করছে। সুলতান আমার ছবির খুব উচ্চ মূল্য দিত। আমি মনে করি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এধরণের চিত্রশিল্পী আর আসবে না। তার উপর নয় বছর আমি কাজ করেছি।

শিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে নাসির আলী মামুন Nasir_Ali_Mamun with S.M Sultan

ফেরদৌস মাহমুদ : সুলতানের সাথে আপনার প্রথম কবে দেখা হয়?

নাসির আলী মামুন : সুলতান সম্পর্কে আমি প্রথম জানলাম, মুনতাসীর মামুনের একটি লেখা থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। লেখাটির শিরোনাম ‘যে জীবন যার’। ১৯৭৬ সালে। সেখানে তার একটা ছবিও ছিল, যে  খালি গায়ে ছবি আঁকতেছে সুলতান। ওই লেখাটা পড়ে এত উজ্জিবিত হয়েছি যে,  আমি শিল্পকলায় তার ছবি দেখতে যাই, তাকে সেখানে দেখি কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি।

সুলতান সম্পর্কে আগেই শুনেছি সে নাকি মেরে দেয়। তার সাথে নাকি বেজি থাকে, সাপ থাকে। পরে সুলতানের সাথে অবশ্য সখ্যতা গড়ে ওঠে। সুলতান আমাকে পছন্দ করত। সুলতানের ওপর আমি একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। এস এম সুলতান আমার দুইটা প্রদর্শনী ওপেন করছে আর তিনটাতে উপস্থিত ছিল। সে বক্তৃতায় বলেছে ‘এই ফটোগ্রাফারের সাথে আমার সেন্টিমেন্টাল এটাস্টমেন্ট আছে’।



ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার মুখের পোট্রেট তো মনে হয় অনেক বিখ্যাত আর্টিস্টই করেছেন।

নাসির আলী মামুন : ৫০ জন আর্টিস্ট আমার মুখের পোট্রেট করছে। সুলতান করেছেন আমার ৭টি পোট্রেট, কামরুল হাসান করছেন ২টি। এই ছবিগুলি দিয়ে আসলে একটা বইই হইতে পারে।

শিল্পী এস এম সুলতান ‍ও কামরুল হাসানের আঁকা নাসির আলী মামুনের পোট্রেট Sultan_Kamrul

ফেরদৌস মাহমুদ : এ পর্যন্ত কত জন  বিখ্যাত লোকের ছবি তুলেছেন ?

নাসির আলী মামুন : এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার বিখ্যাত ও সৃজনশীল মানুষের ছবি আমি তুলেছি।

এর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান, জসীমউদদীন,  জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, অমিয় চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায়,  মৃণাল সেন, বিসমিল্লাহ খাঁ,  সল বেলো, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, অমর্ত্য সেন, ডেরেক ওয়ালকট, বিল ক্লিনটন, মাহতীর মুহম্মদসহ বিভিন্ন অঙ্গনের দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত লোকই রয়েছেন।



ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার তোলা আলোকচিত্রগুলো নিয়ে কোনো মিউজিয়াম করার ইচ্ছে আছে নাকি?

নাসির আলী মামুন : আমার ছবিগুলি নিয়ে, সংগ্রহকে নিয়ে একটা মিউজিয়াম করার ইচ্ছা আছে ‘ফটোজিয়াম’ নামে। ২০১৩ সালের জুলাইতে আমার ৬০ বছর হবে। আমার উপর আরেকটা ডকুমেন্টারি করতেছে একজন আর একটা বইও করতেছে। ২০১২ তে আমার ফটোগ্রাফির ৪০ বছর হবে।

আমি কিন্তু ছবি তুলেই চলে আসি না। একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলি। আজকাল আমি আরেকটা কাজ করি যারা কোনোদিন ছবি আঁকে না, লেখালেখি করে তাদের দিয়ে ছবি আঁকাই।

ডকু জিনিসটা আমার খুব পছন্দের জিনিস। আমি যাদের ছবি তুলছি তাদের মধ্যে অনেককেই আমি যৌবনকালে দেখছি, পরে তাদের বার্ধক্য এবং মৃত্যু পর্যন্ত দেখেছি। যেমন শামসুর রাহমানের কথাই, তাকে প্রথম যখন দেখি ১৯৭৩ সালে কি হ্যানসাম, কি সুশ্রী। এরকম সুশ্রী লোক খুব কমই ছিল। চোখের সামনেই পরে দেখলাম তার বার্ধক্য, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য এবং মৃত্যু। এরকম অনেককেই আমি দেখেছি।



ফেরদৌস মাহমুদ : চল্লিশ বছরে আপনি যত বিখ্যাত লোকের ছবি তুলেছেন, তাদের মধ্যে তো অনেকেই এখন নাই। ওই ছবিগুলি দেখলে আপনার কি অনুভূতি হয়।

নাসির আলী মামুন : যাদের ছবি তুলেছি তাদের মধ্যে ৪০০ জনের উপরে মারাই গেছেন। তাদের নেগেটিভ, তাদের ছবি যখন নাড়াচাড়া করি মনে হয় তারা বুঝি এখনই নড়েচড়ে উঠবে। জীবন্ত হয়ে উঠবে, আমার সাথে কথা বলবে, আমি তাদের সাথে গল্প করবো, ছবি তোলার সময় চাইবো, আমি তাদের অনেক মুহূর্ত বন্দি করবো। এরকম মনে হয়। হঠাৎ এখন কবি শামসুর রাহমানের ছবি দেখলে মনে হয় তিনি মারা যাননি।

মাওলানা ভাসানী ও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে নাসীর আলী মামুন Nasir ali mamun with Maolana Vashani and Sajyajit ray

অ্যালেন গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর যতবারই নিউইয়র্কে গেছি মনে হয়েছে গিন্সবার্গহীন নিউইয়র্ক বিষাদময়। গিন্সবার্গ থাকলে নিউইয়র্ক শহর আরও অনেক ঐশ্বর্যমণ্ডিত হতো আমার অনুভূতিতে। এরকম যাদের মৃত্যু হয়, প্রিয়জনদের যাদের ছবি আমি তুলেছি বা যাদের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল, তাদের মৃত্যুতে খুবই খারাপ লাগে। এটা খুব সহজে মেনে নেওয়া যায় না। এদেরে হাতের লেখা, আঁকা ছবি, বইপত্র এইগুলি ঘাটতে ঘাটতেই তো আমার দিন যায়। আমি এগুলি থেকে অনেক কিছু শিখি, দেখি।

আমি প্রত্যেকের ফেইস রিড করি। তাদের চেহারা আমি পাঠ করি। সেই কারণে যাদের ছবি তুলি কেবল ছবিই তুলি না, তাদের হাতের লেখা, পাণ্ডলিপি, চিঠিপত্র, ডায়েরি আমার সংগ্রহে থাকে। জরাসন্ধ থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজসহ অনেকের আমার কাছে লেখা চিঠি আছে।



ফেরদৌস মাহমুদ : শুধু মুখোমণ্ডলের ছবি দিয়ে মানুষের প্রকৃতিকে কি ধারণ করা সম্ভব?

নাসির আলী মামুন : খুব ভালোভাবেই সম্ভব। মানুষের মুখটা হলো আয়নার মতো। আয়নায় তাকাইলে তুমি কি দেখো। তোমার নিজেকে কি দেখা যায় না। তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকো হাসিটা দেখবা, কাদতে থাকো কান্নাটা দেখবা। সেরকম মানুষের চেহারা আয়নার মতো, চেহারা দেখলে সেই মানুষটাকে মোটামুটি সনাক্ত করা যায়, তার মনের অবস্থাটা বর্ণনা করা যায় যদি তোমার সেরকম মন থাকে, শিক্ষা থাকে।    

একটা মানুষের আঙুল দিয়েও প্রমাণ করা যায়, এই লোকটা অমুক। পিছন দিক দিয়ে ছবি তুলেও বলা সম্ভব এটা অমুক। এটা ফটোগ্রাফারের মুন্সিয়ানার উপর নির্ভর করে সে কতদূর শৈল্পিকভাবে, কতটা দক্ষতার সাথে ছবি তুলতে পারছে।

ক্যানাডার যে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ইউসুফ কার্স, তার বিখ্যাত বই আছে কার্স পোট্রেইট। তার একটা ছবি আছে বিশ্ববিখ্যাত কম্পোজার মিউজিশিয়ান পাবলো ক্যাসালোর। ক্যাসালোর ছবি সে তুলেছে পেছন দিক  থেকে। ওইটা দেখে তাকে কিভাবে চেনা যায়? পাবলো ক্যাসাল একধরণের ওভারকোট পড়তো, যেটা বেল্টের মতো তার পেছন দিক থেকে তার ওভারকোটের সাথে লাগানো ছিল, ওইটা সে সামনে বাধতো না, পেছন দিক থেকে ছেড়ে দিত। তার টাক মাথা ছিল। দেখলেই বোঝা যেত ওটা কে।

আমার তোলা এস এম সুলতানের একটা ছবি আছে যেখানে কেবল হাত দেখা যায়। দেখলেই বোঝা যায় অত লম্বা লম্বা আঙুল ওই সময় সুলতান ছাড়া আর কারও ছিল না। কালো আলখাল্লা পরা। আমি তো পুরা চেহারা আনি নাই।

আমার তো মনে হয় একটা মানুষের একটা বিশষে অঙ্গ দিয়েও বুঝানো সম্ভব মানুষটা কে? এইগুলি তো কিছু না, একেকটা চিহ্ন, একেকটা সিগনালের মতো। কাজেই তুমি যখন একটা ফেইসের ছবি তুলবা তোমার ঠিকানা, তোমার অন্তর্দৃষ্টি তার মধ্যে ঠিকই থাকবে। বিষয়টা নির্ভর করে ফটোগ্রাফারের দক্ষতার উপর।

ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, সারা দিনে অনেক কথা হলো। এবার তো উঠতে হবে...

নাসির আলী মামুন : হ্যাঁ... সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তোমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে।

ফেরদৌস মাহমুদ : আমাকে এভাবে দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাসির আলী মামুন : এত দূর এসে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ।


বাংলাদেশ সময় ১৪১০, এপ্রিল ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।