ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

‘জাগরী’র অন্তপ্রাণ ঘাত-সংঘাত

রানা রায়হান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১১
‘জাগরী’র অন্তপ্রাণ ঘাত-সংঘাত

‘জাগরী’র আকর্ষণীয় দিক হলো কাহিনীর প্রতিটা চরিত্রের নিজ নিজ গল্প-কথা বলার সময়-পরিধি মোটমাট বারো ঘণ্টা। সন্ধ্যা বেলায় গল্পের শুরু।

কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই লেখক প্রতিটা চরিত্রকে নিজ নিজ অতীতে নিয়ে গেছেন, এমনকি শৈশব পর্যন্ত। মোট চার পর্বের উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৪৫ সালে, পরে  ১৯৫০ সালে লাভ করে রবীন্দ্র পুরস্কার। উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয় ভারতবর্ষের অজ্ঞাতনামা রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশে, জাতীয় ইতিহাসে-বিবরণে যাদের নাম কোনো দিনই লেখা হয় না।  

সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর উপন্যাসের কাহিনি হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় পরিবার বা রাজনৈতিক পরিবারকে। প্রতিটা চরিত্রই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়কার কংগ্রেস, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি, সর্বভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি দলের কথা এসেছে, চরিত্রগুলোর সংযুক্ততার কারণেই।

‘জাগরী’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল আছে এর পটভূমি ও বিবেচ্য সময়ের কারণেই-- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডামাডোলে অসংখ্য পরিবারের টগবগে তরুণরা অংশগ্রহণ করে, আত্ম-বলিদান দেয়। কিন্তু লেখক সকল পরিবার থেকে একটা পরিবারকে এখানে হাজির করেছেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন যা আগস্ট আন্দোলন নামেও পরিচিত--এই উপন্যাসে ভিন্ন সুর ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

পুর্ণিয়া জেলের রাজবন্দী বিলু। আর তার বাবা-মাও পৃথক সেলে আটক রয়েছে।   খুব ভোরে বিলুর ফাঁসি কার্যকর হবে। আদেশ হয়েছে, জল্লাদও প্রস্তুত। বিলুর বাবা, মা--যারা অপেক্ষা করে আছে তাদের নিজ নিজ আবেগ অনুভূতি সমেত। জেলগেটে ভাইয়ের শবদেহ নেবার অপেক্ষায় আছে নীলু--বিলুর সহোদর। এদিকে বিলু তার একাকী সেলে ভাবছে তার জীবনের অতীত স্মৃতি। মানসপটে ভেসে আসছে মা, বাবা, নীলু, জ্যাঠাইমা, সহযোদ্ধা রাজনৈতিক কর্মীদের কথা। আন্দোলনের কথা, স্বরাজের কথা।  

বিহারের ‘পুর্ণিয়া সেন্ট্রাল জেলের সেল থেকে একফালি আকাশ দেখা যায়। ’ স্মৃতি আর ওই রাতের আকাশ বিলুর একান্ত আপন। ভোর পর্যন্ত বেঁচে থাকার এগুলোই তার সম্বল। মা-বাবা ভাইয়ের স্মৃতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জাড়িয়ে পড়ে বিলু। ছোটভাই নিলুর কথা মনে আসতে অস্বস্তি-বিব্রত বোধ করে। ‘নিজের পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা দেখাইবার জন্য সহোদর ভাইয়ের ফাঁসির পথ সুগম করিয়া দেওয়া হৃদয়ের সততার প্রমাণ না মনের শুচিবায়ের পরিচয়? বোধ হয় নীলুর ব্যবহার আমার ভিতরের আসল আমি কিছুতেই সমর্থন করিতে পারিতেছি না; তাই উপরের আমি পুরাতন স্মৃতির মধু দিয়া সেই দহনের জ্বালা স্নিগ্ধ করিতেছি। ’

সতীনাথ ভাদুড়ীর বাসস্থান পুর্ণিয়া জেলায়--‘জাগরী’র প্রধান চার চরিত্র পুর্ণিয়ার জেলে বসেই তাদের নিজ নিজ গল্প-অনুভূতি বয়ান করে চলেন। বিলু, নীলু, বাবা, মা--একই পরিবারের চার অন্তপ্রাণ হলেও কাহিনি বর্ণনার সময়-পরিধির তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাত হয় না--নিজ নিজ একান্ত অতীতে তাদের সাক্ষাৎ হয়।

প্রতিটা চরিত্রের মনের গভীরে তন্ন তন্ন করে ঢুঁড়ে মানবিক চেতনার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল উন্মোচিত করা হয়। মনের জটিল বিন্যাস গাঁথা হয়েছে প্রতিটা চরিত্রের অভ্যন্তরে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের মাধ্যমে। বিলু, বাবা, মা ও নীলু প্রত্যেকের মনের একান্ত জগতে লেখক প্রবেশ করেছেন, তাদের মনের ব্যবচ্ছেদ পাঠকের সামনে হাজির করেছেন নিপুণ হাতে। বাংলা সাহিত্যে এমন নজির খুব বেশি দেখা যায় না।     

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন, যা আগস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত--গান্ধী, প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, নেহেরুদের সাথে অসংখ্য জানা-অজানা তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে অনেকে নৈরাজ্য হিসেবে দেখেছে। তাদেরই একজন বিলুর ছোট ভাই নীলু। আদালতে সে বিলুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। সকলেরই ধারণা নীলুর কারণেই তার বড় দাদার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু বিলু তার ছোট সহোদর নীলুকে বোঝে। এটা তার পার্টির প্রতি একনিষ্ঠতা। অন্যদিকে, নীলু ভাবছে তার দাদা নিশ্চয়ই তাকে ভুল বুঝবে না।

উপন্যাসখানা মূলত সাধু ভাষায় লেখা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের বর্ণ বৈচিত্র্য তুলে ধরবার জন্য লেখক মাঝে মাঝে হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেছেন বেশ সাবলীলভাবে।

বিলুর বাবা মহাত্মা গান্ধীর অনুরাগী ও অনুসারী এবং তাঁর দেখানো রাজনৈতিক পথেই তিনি সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। মহাত্মার অনুকরণে তিনি বাড়িতে একটা আশ্রম খুলেছেন। সেই আশ্রমের প্রতিদিনকার রান্না-বান্নার কাজ করে বিলুর মা। বিলু-নীলুও প্রথম দিকে গান্ধীরই অনুরক্ত ছিল। এই পরিবারকে জানার মধ্য দিয়ে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ ধারালো ধারণা পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, গান্ধীর আদর্শের ঢেউ ভারতবর্ষের প্রায় সকল পরিবারে গিয়ে পড়েছিল।

উপন্যাসের চারটি পর্বের প্রথম পর্বের শেষদিকে দেখা যায় বিলু তার নিজের ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে, ‘... প্রতিলোমকূপে প্রত্যাশিত আতঙ্কের সাড়া--প্রতি স্নায়ুতে--টাইফুনের বিক্ষোভ--এই আলোড়ন অক্ষিগোলকের মধ্য দিয়া ফুটিয়া বাহির হইতে চায়। ...’ একই কারণে বিলুর বাবা অপেক্ষা করছে, ‘... ভগবান। মহাত্মাজী। বিলুর মাকে আঘাত সহ্য করিবার শক্তি দাও, নীলুর মনে বল দাও, বিলুর আত্মাকে শান্তি দাও। ’ সকলেরই অপেক্ষা মোটরগাড়ির শব্দের জন্য, কারণ ওই গাড়িতে করেই বোধহয় বিলুর শবদেহটা বয়ে নিয়ে যাবে।

একেবারে শেষ পর্বে নীলুর কথাবার্তা। নীলুর সাক্ষ্যেই আজ বিলুর ফাঁসি। তাই নীলুর অন্তর্দহন চলছে, ভেতরে ভেতরে কি যেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে অনবরত। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দাদার রাজনীতির মতাদর্শ সম্পর্কে নীলুর ধারণা ব্যক্ত হয়, ‘... দাদার পক্ষপুটে থাকিয়া যে ভঙ্গিতে রাজনীতি দেখিতাম তাহা রুগ্ণ, jaubdiced, ভ্রান্ত; উহা সুবিধাবাদী নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাবপ্রবণতার উচ্ছ্বাস মাত্র। যথার্থ সর্বহারার সাবলীল উদ্দামতার স্থান সেখানে নাই,--জাতীয়তার বাহিরে দেখিবার ক্ষমতা তাহাদের নাই। ’ ১৯৩৪ সালে দাদার সাথে জেল বাসের সময় নীলু দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়। দাদার প্রভাব-যুক্তি তর্কের বেড়াজাল হতেও মুক্তি হয়।

‘ফাঁসি’ নিয়ে এমন রোমহর্ষক উত্তেজনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কোনো উপন্যাসে আছে বলে মনে হয় না।

উপন্যাসের একেবারে শেষে দেখা যায়, নীলু তার দাদার লাশ নিয়ে যাবার জন্য সরকারের অনুমতিপত্রের একটা কাগজ নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ফাঁসির কিছু সময় আগেই সরকারের আদেশ এসেছে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ফাঁসির কাজ মুলতবি রাখার। ফাঁসি হবে না। নীলু কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছ। সে আবার পাখির কলকাকলি শুনতে পায়। লাস্যময়ী পৃথিবী তার কাছে আবার হাজির হয়েছে।

বাংলাদেশ সময় ১৫১২, এপ্রিল ১৫১৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।