ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

উড়ালই ফিল্মমেকারের পরিত্রাণের পথ : ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো

সাক্ষাৎকারক : বার্ট কার্ডুলো<br>অনুবাদ : রুদ্র আরিফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৯ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১১
উড়ালই ফিল্মমেকারের পরিত্রাণের পথ : ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো

[সাক্ষাৎকারকের নোট :
১৯৮৪ সালের মে মাসের শেষদিকের কোনো একদিন ত্রু ফোর প্রোডাকশন কোম্পানি ‘ফিল্মস ফ্রম কোচ’-এ মুখোমুখি হয়েছিলাম তার। কখনো ফরাসি, আবার কখনো ইংরেজি- দুই ভাষা ধরেই এগিয়েছি আলাপ।

বলে রাখি, জনসমে তার সর্বশেষ উপস্থিতি ঘটেছিলো এ বছরের ১৩ এপ্রিল। বার্নার্ড পিভট উপস্থাপিত এক ‘আলোচনামুলক’ ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের সাক্ষাৎকার ছিলো সেটি। আর আমি কাগজে ছাপার জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়ার উদ্দেশে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উদারভাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। তখন তিনি স্পষ্টতই অসুস্থ ছিলেন; তবু ছিলেন আজবরকম প্রাঞ্জল। সাক্ষাৎকারটির নেওয়ার পাঁচমাসের মধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুর পর এটি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্যারি মরিস সম্পাদিত ‘অ্যাকশন! ইন্টারভিউজ উইথ ডিরেক্টরস্ ফ্রম ক্যাসিক্যাল হলিউড টু কনটেম্পোরারি ইরান’ গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। ]

বার্ট কার্ডুলো : মিস্টার ত্রু ফো, আজকের আলাপচারিতায় আমি আঁতোয়ান দোয়ানেলের উপর ফোকাস করতে চাই। পরে আপনার অন্যান্য ফিল্ম নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবো বলে আশা করছি। আচ্ছা, ফিল্মমেকার হওয়ার আগে আপনার যে জীবন ছিলো, সে জীবন নিয়ে কি আলাপটা শুরু হতে পারে?

ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো : হ্যাঁ। কেন নয়? বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি অনেক ফিল্ম দেখেছি। সেগুলো আমাকে ফিল্মের প্রেমে ফেলে দিয়েছে। ফিল্ম দেখার জন্য নিয়মিত স্কুল পালাতাম। এমনকি সকালে যে ছোট প্যারিসিয়ান থিয়েটারগুলো খুলতো, সেগুলোতেও যেতাম। ফিল্ম সমালোচক হবো নাকি ফিল্মমেকার হবো- এ ব্যাপারে প্রথমদিকে আমি নিশ্চিত ছিলাম না; তবে জানতাম, এ রকমই কিছু একটা হবো। আমি আসলে লেখালেখি নিয়েও ভাবতাম। ফলে ঔপন্যাসিক হতেও ইচ্ছে করতো। পরে ফিল্ম সমালোচক হবো বলে ঠিক করলাম। তারও পরে ধীরে ধীরে ফিল্ম বানানোর কথা ভাবতে লাগলাম। আমি মনে করি, যুদ্ধের সময়ে দেখা সেই ফিল্মগুলোই আমার জন্য এক ধরনের শিক্ষানবিশির কাল হয়ে উঠেছিলো।

আপনি জানেন, অভিজ্ঞতার ঘাটতির কথা তুলে নিউ ওয়েভ ফিল্মমেকারদের প্রায়শই সমালোচনা করা হয়। আসলে সব ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষে ভরা ছিলো এই মুভমেন্টটা। এখানে আমার মতো মানুষও ছিলো, যে কিনা ‘কাহিয়ের দো সিনেমা’য় কিছু লেখালেখা করা আর হাজারো ফিল্ম দেখা ছাড়া কিছুই করেনি! কোনো কোনো ফিল্ম আমি চৌদ্দ-পনোরোবার করে দেখেছি; যেমন, জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য রুলস অব দ্য গেম’ [১৯৩৯]  ও ‘দ্য গোল্ডেন কোচ’ [১৯৫৩]।

Truffauts The Soft Skinঅ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে আপনি যতোটা শিখবেন, ফিল্ম দেখে দেখে তারচেয়ে বেশি শিখতে পারবেন। দেখার অভ্যাস না থাকলে ব্যাপারটা একঘেয়ে কিংবা একাডেমিক হয়ে যায়। বস্তুত, অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর বলা হয় সেই মানুষকে, যে কি-না ফিল্ম বানানো শিখতে চায়। তবে কেউ যদি অবিরামভাবে অ্যাসিস্ট করে যায়, আর সে যদি ক্যামেরার সামনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্টাফ হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে- শুধুমাত্র তাহলেই সে সেটা করতে পারে। আর নয়তো, তাকে সবসময়ই ইউনিটের প্রয়োজন মেটাতে হবে; যা তাকে সেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে আপনি যদি একটা ফিল্ম দশবার কিংবা আরো বেশিবার দেখেন, একটা ফিল্মের ডায়লগ ও মিউজিক যদি আপনার হৃদয়ে গেঁথে যায়, তাহলে সেই ফিল্মটি বানানোর রহস্য আপনি জানতে শুরু করবেন। আর এক্ষেত্রে আপনি যতোটা শিখতে পারবেন, অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করলে ঠিক ততোটা পারবেন না।

কার্ডুলো : শৈশবে কোন ফিল্মটা আপনাকে প্রথম চমকে দিয়েছিলো, যার জন্য এমন ফিল্মের পোকা হয়েছিলেন?

ত্রুফো : সত্যিকার অর্থে আমাকে প্রথম মুগ্ধ করা ফিল্মগুলো ছিলো ফরাসি ফিল্ম। এই যেমন, অঁরি-জর্জ কুজোর ‘দ্য র‌্যাভেন’ [১৯৪৩] এবং মার্সেল কার্নের ‘দ্য ডেভিল’স এনভয়স্’ [১৯৪২]। প্রথম দেখার পর যতো দ্রুত সম্ভব এই ফিল্মগুলো বারবার দেখতে চেয়েছিলাম আমি। একই ফিল্ম বারবার দেখার এই অভ্যাসটা আমি দুর্ঘটনাবশত পেয়েছি। কারণ, প্রথমে কিছু ফিল্ম গোপনে দেখেছি; তারপর বাবা-মা বললেন, ‘চলো আজ রাতে ফিল্ম দেখে আসি। ’ ফলে, একই ফিল্ম আরেকবার দেখা হয়ে গেলো। কারণ, এই ফিল্মটা যে আগেই দেখেছি- সেটা তো আর তাদের বলতে পারিনি!

তবে এই ঘটনা আমার মধ্যে একই ফিল্ম বারবার দেখার ইচ্ছেটা তৈরি করে দিলো। পরিণামে, স্বাধীনতার তিনবছর পর ‘দ্য র‌্যাভেন’ আমি দশবারের মতো দেখে ফেললাম। তবে ‘কাহিয়ের দো’ সিনেমায় কাজ শুরুর পর ফরাসি ফিল্ম থেকে দূরে সরে এলাম আমি। জ্যাক রিভেতসহ এই ম্যাগাজিনে যতো বন্ধু ছিলো, তারা ভাবলো, আমার এই ‘দ্য র‌্যাভেন’-এর সব সংলাপ মুখস্থ বলা ও কার্নের ‘দ্য চিলড্রেন অব প্যারাডাইস’ [১৯৪৫] চৌদ্দবার দেখার ঘটনা নাকি যত্তোসব উদ্ভট কায়কারবার।

কার্ডুলো : একটু আগে রেনোয়ার দুটি ফিল্মের নাম নিলেন, যেগুলো বারো কিংবা তারো বেশিবার দেখেছেন। আপনার উপর রেনেয়ার প্রভাব নিয়ে কিছু বলেন।

ত্রুফো : আমি মনে করি, ভুলভ্রান্তির ঊর্ধে থাকা একমাত্র ফিল্মমেকারটির নাম রেনোয়া। ফিল্মে তিনি কখনোই কোনো ভুল করেননি। আমি আরো মনে করি, তিনি যদি কোনো ভুল করেও থাকেন, তাহলে সেটার কারণ হলো, তিনি সবসময়ই সারল্যের মধ্যে সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। সেই সমাধান হলো মানবিক সমাধান। তিনি এমনই ফিল্মমেকার, যিনি কখনো ছলনা করেননি। তিনি কখনো কোনো একক স্টাইল ধরার চেষ্টা করেননি। আর আপনি যদি তার কাজ সম্পর্কে জেনে থাকেন, তাহলে দেখবেন, তিনি সাবজেক্টের সকল স্তর নিয়ে কাজ করলেও সেগুলোকে খুবই সমন্বিত রাখতেন। এটা দেখে আপনিও হয়তো কোনো তরুণ ফিল্মমেকারের মতো চমকে যাবেন। এবং রেনোয়া কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতো- তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে স্বভাবতই আপনি একটা সমাধান পেয়ে যাবেন।

উদাহরণ হিসেবে রবার্তো রসেলিনির কথা বলি। তিনি একেবারেই ভিন্ন ছিলেন। ফিল্মমেকিংয়ের মেকানিক্যাল ও টেকনিক্যাল দিককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার মতা ছিলো তার। তার ফিল্মে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। তিনি যখন তার স্ক্রিপ্টের নোট নিতেন, তখন যতোসব অসংলগ্ন কথা লিখে রাখতেন। এই যেমন, ‘ইংলিশ আর্মিরা অর্লিনস শহরে ঢুকেছে’! ভাবুন তো, ‘ওকে, তার অনেকগুলো এক্সট্রা দরকার’। তারপর ‘জোয়ান অব দ্য আর্ক অ্যাট দ্য স্টেইক’ [১৯৫৫] ফিল্মটা দেখেন, এটাতে দশটা ডামি সৈনিককে ছোট্ট একটা সেটে ঠাসাঠাসি করে ঢুকানো হয়েছে। কোনো ফিল্মে রসেলিনি প্রশান্তি কিংবা খাপছাড়াভাব পেলে একই সময়ে সেটাকে ব্যাখ্যাতীতরকম বিস্ময়কর করে তোলেন। কোনো ফিল্ম যদি নূন্যতমও ফিল্ম হয়ে ওঠে, আর সেটার সাবজেক্টের আগে থাকে মানবিকতা, তাহলে শেষমেষ সেটা একটা উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে যায়।

রসেলিনির ফিল্মের মধ্যে ‘জার্মানি ইয়ার জিরো’ [১৯৪৭] আমার খুব পছন্দের। শৈশব কিংবা শিশুদের সাবজেক্ট করে বানানো ফিল্মগুলোর প্রতি আমার দুর্বলতাই সম্ভবত এই পছন্দের কারণ। আরো কারণ হলো, ফিল্মে শিশুদের সত্যনিষ্ঠতার সঙ্গে, অনেকটা ডকুমেন্টারি স্টাইলে সর্বপ্রথম চিত্রিত করেছেন এই রসেলিনিই। তিনি শিশুদের জগতে তাদেরকে বয়স্কদের চেয়েও সিরিয়াস ও চিন্তামগ্ন হিসেবে দেখিয়েছেন; ছোট দেহের কিংবা জানোয়ারের মতো দৃশ্যমান করে নয়। ‘জার্মানি ইয়ার জিরো’র শিশুটা তার নিরাবেগ ও সারল্যে একেবারেই অসাধারণ। ফিল্মে এটাতেই প্রথমবারের মতো শিশুদের মধ্যমণি করে রূপদান করা হয়েছে- যেখানে তাদের ঘিরে থাকা জগত খুবই তুচ্ছ।

রসেলিনি এমন এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জোরদার করেছেন, যেটা ইতোমধ্যে রেনোয়ায় স্পষ্ট। আর সেটা হলো, ফিচার ফিল্মে যতোটা সম্ভব জীবনের কাছাকাছি থাকার আকাক্সা। রসেলিনি এ কথাও বলতেন যে, স্ক্রিপ্ট লেখার দরকার নেই। শুয়োররাই কেবল স্ক্রিপ্ট লেখে। বাস্তবতা থেকেই সহজাতভাবে একটা ফিল্মে সংঘাতের আবির্ভাব ঘটে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট একটা স্থানের একটা চরিত্র আরেকটা একেবারেই আলাদা স্থানের অন্য চরিত্রের বিপরীত হয়। আর সেখানে তাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সংঘাত ঘটে। এবং ফিল্মমেকার মশাই, আপনি সেখান থেকেই শুরু করে। কোনোকিছু উদ্ভাবন করার দরকার নেই।

রসেলিনি ও রেনোয়ার মতো মানুষেরা আমাকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছেন। তারা ফিল্মের যেকোনো জটিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার কৌশল জানেন। তাদের কাছে চরিত্র, কাহিনী কিংবা থিমই অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কার্ডুলো : আপনার উপর আমেরিকান ফিল্মের প্রভাব কীরকম?

ত্রুফো : আমরা যে এখানে [ফ্রান্সে] আমেরিকান ফিল্মের প্রতি অনেক অনেক ঋণীÑ সে কথা আমেরিকানরা নিজেরাও ঠিকমতো জানে না। বিশেষ করে, আমেরিকার প্রথমদিকের ফিল্মগুলো কথা বলতে চাই আমি। এগুলোর কথা আমেরিকানরা খুব কমই জানে। এমনকি তারা হেলাও করে। ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ সময়কার প্রভাবশালী আমেরিকানদের প্রসঙ্গ এলে আমি নেবো সিডনি Truffauts Day for Nightলুমেট, রবার্ট মুলিগান, ফ্রাঙ্ক তাসলিন ও আর্থার পেনের নাম। তারা আমেরিকান ফিল্মের একটা সার্বিক নবায়নের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই নবায়ন কিছুটা ফ্রান্সের কয়েকজন ‘নিউ ওয়েভ’ ফিল্মমেকারের কাজের মতো। তারা চরম তাগড়া ছিলেন। এইসব মানুষের প্রথম ফিল্মগুলো সেকেলে আমেরিকান ফিল্মের মতোই ছিলো। আর একই সঙ্গে তারা কমবেশি বুদ্ধিজীবিও ছিলেন। তাদের ফিল্ম উভয় ধরনের কোয়ালিটির সর্বোৎকৃষ্টতাকে জড়ো করতো। এখন আমেরিকানরা এই ফিল্মমেকারদের তাচ্ছিল্য করছে। কারণ, তারা ওদের ঠিকমতো চিনতে পারেননি। কারণ, এই ফিল্মমেকাররা বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিলেন না।

আমেরিকায় সাফল্যই শেষকথা- এটা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে আপনি ভালো জানেন?

কার্ডুলো : ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’-এর শৈল্পিক সাফল্য পাওয়ার রহস্য কী?

ত্রুফো : ‘নিউ ওয়েভ’-এর শুরুতে লোকজন এই তরুণ ফিল্মমেকারদের বানানো নতুন ফিল্মগুলোর বিরোধিতা করে বলাবলি করলো, ‘সব মিলিয়ে এদের কাজকারবার আগেকার কাজগুলোর চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়’। ‘নিউ ওয়েভ’ হওয়ার পেছনে আসলেই কোনো পরিকল্পনা ছিলো কি-না সে কথা আমার জানা নেই। তবে যদ্দূর জানি, আমার কাছে এটাকে ফিল্মে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কিংবা পূর্ববর্তী ফিল্মমেকারদের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে জাহির করার কোনো কিছু বলে মনে হয়নি কখনোই। আমি সবসময়ই ভেবেছি, সততার অভাবজনিত কারণকে বাদ দিলে, ফিল্ম এমনিতে ঠিকই আছে। অন্যরা যা করছিলো, আমিও সেটাই করছি; তবে একটু ভালো করছি। এই আর-কি!

আন্দ্রে মালরাক্সের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘একটা রাবিশের তুলনায় কোনো মাস্টারপিস ভালো কিছু নয়’। আমি এখনো মনে করি, ভালো ফিল্ম হলো সেই বাজে ফিল্মগুলো, যেগুলোকে একটু ভালো করে বানানো হয়েছে। তাছাড়া, আনাতলি লিতবাকের ‘গুডবাই অ্যাগেইন’ [১৯৬১] এবং আমার ‘দ্য সফ্ট স্কিন’- এই ফিল্ম দু’টির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখি না। একই জিনিস, একই ফিল্ম; কেবল আলাদা বলতে, ‘দ্য সফ্ট স্কিন’-এর অভিনেতারা চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। আমরা বিষয়গুলোকে সত্য করে দেখিয়েছি; কিংবা দেখানোর চেষ্টা অন্তত করেছি। কিন্তু আনাতলির ফিল্মটিতে কোনো কিছুই সত্য করে দেখানো হয়নি। কারণ, ইনগ্রিদ বার্গম্যান কিংবা আন্থনি পার্কিনস কিংবা ইভ মোঁতাঁর জন্য এটা উপযুক্ত ফিল্ম ছিলো না। ফলে, ‘গুডবাই অ্যাগেইন’ শুরু থেকেই মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো।

নতুন কিছু সৃষ্টি কিংবা ভিন্নতর ফিল্ম বানানোর কাজ আইডিয়ার নয়; তবে আরো একটা সত্যকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে এটা। আমি যখন ফিল্মমেকিং শুরু করি, তখন থেকেই এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিলো। জাঁ দিলানয়ের ‘দ্য লিটল রেবেলস’ [১৯৫৫] এবং আমার ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর মধ্যে বিস্তর ফারাক নেই। দু’টোই এক; কিংবা ঘটনা খুব কাছাকাছি। আমি কেবল আমারটাই বানাতে চেয়েছিলাম; কারণ, অন্যটার আর্টিফিসিয়ালিটি ভাল্লাগেনি আমার। এই আর-কি!

কার্ডুলো : আমরা জানি আপনি ফিল্মমেকার হওয়ার আগে ফিল্ম সমালোচক ছিলেন। কোন ফিল্মটা নিয়ে প্রথম লিখেছিলেন?

ত্রুফো : চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ [১৯৩৬]। ফিল্মকাবে এটার একটা পুরনো প্রিন্ট দেখেছিলাম। পরে পুলিশ  সেটা জব্দ করেছিলো। কারণ, সেটা একটা চোরাই কপি ছিলো! পরে আন্দ্রে বাজিনের কল্যাণে ‘কাহিয়ের দো সিনেমা’য় লিখতে শুরু করি। জাঁ অরেঁচ ও পিয়েরে ব্যো’র মতো স্ক্রিপ্টরাইটাররা যে ধরনের ফরাসি ফিল্মের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, কাহিয়ের-এর লেখায় ফরাসি ফিল্মের সেই জীবাশ্মে আমি আগুন জ্বালিয়ে দিই। সেই আর্টিক্যাল আমাকে সাপ্তাহিক আর্টস-এ একটা চাকরি জুগিয়ে দেয়। সেখানে চার বছর আমি ফিল্মের কলাম লিখেছি।

আমি মনে করি, সমালোচক হওয়াটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। কারণ, ফিল্মকে ভালোবাসা কিংবা প্রচুর ফিল্ম দেখাটাই যথেষ্ট নয়। ফিল্ম নিয়ে লেখালেখি করলে ফিল্মকে ভালোভাবে বুঝতে সুবিধা হয়। এটা আপনাকে মেধার এক্সারসাইজ করতে বাধ্য করে। আপনি যখন দশ বাক্যে কোনো স্ক্রিপ্টের সারাংশ লিখবেন, তখন সেটার ক্ষমতা ও অক্ষমতা উভয় দিকই দেখতে পাবেন।

সমালোচনা খুবই ভালো এক্সারসাইজ। তবে এটা বেশিদিন করা ঠিক নয়। আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন আমার রিভিউগুলো যতোটা না নেগেটিভ, তারচেয়েও বেশি নেগেটিভ মনে হয়। আর এই কাজকে অহেতুক প্রশংসার চেয়ে নিছক উদ্দীপক মনে হয়েছে আমার।
আত্মরার চেয়ে আক্রমণেই ভালো ছিলাম আমি। আফসোস হয়, এখন আমি কত্তো কম গোঁয়ার; আর ভাবি, সমালোচনামূলক দ্যোতনাই বুঝি শ্রেয়!

কার্ডুলো : চার বছর ফিল্ম সমালোচক থাকলেও আপনি সব সময় ফিল্মমেকার হওয়ার সুযোগ খুঁজতেন, তাই না?

ত্রুফো : হুম, নিঃসন্দেহে তাই। প্রথমে আমি ১৬ এমএমে ছোটখাটো ফিল্ম বানানো শুরু করেছিলাম। সেগুলো খুব একটা জাতের ছিলো না। বেশিরভাগ অ্যামেচার ফিল্মের মতোই নানা খুঁতে ভরা এই ফিল্মগুলো ছিলো চূড়ান্তরকম দাম্ভিক। এমনকি, অ্যামেচারের হাইট ধরা হয় যে স্টোরিলাইনকে- এইসব ফিল্মে তারও কোনো বালাই ছিলো না। তবে এই কাজ থেকে সম্ভবত আমি কিছু না কিছু শিখেছিলাম। এই যেমন, কোনো কিছু দেখানোর বদলে কেমন করে তার প্রস্তাব রাখা যায়। তবে প্রথমত এই শর্টফিল্মগুলো কিছুই ছিলো না দরজা খোলা আর বন্ধ হওয়া ছাড়া। হায়, কী অপচয়!

১৯৫৭ সালে বানানো ফিল্মটা ছিলো আমার প্রথম প্রকৃত ফিল্ম। এটার ইংরেজি নাম- ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’। এই ফিল্মে গল্প বলার একটা সুযোগ ছিলো; যেটার সঙ্গে সেইসব দিনে করা শর্টফিল্ম-চর্চার কোনো মিল ছিলো না! এই ফিল্ম আমাকে অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করারও সুযোগ দিয়েছে। তবে সংলাপের বেলায় ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’ একটা বিচিত্র কমেন্ট্রি। ফলে ফিল্মটা অনেক সারল্য পেয়েছে। এই ফিল্মের সঙ্গে কিছুটা ভাগ্যেরও সহযোগিতা জুড়ে আছে। ব্রুসেলসের এক ফিল্ম উৎসবে এটি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।

‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’-এর স্ক্রিপ্ট কিন্তু আমার অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট নয়। মরিস পসেঁর গল্প নিয়ে বানিয়েছি এটি। শুরুতে একটি নকশা সিরিজের অংশ হিসেবে একে ভেবেছিলাম আমি। আলাদা তিন-চারটা শর্টফিল্ম বানিয়ে পাওয়া টাকায় একটা ফিচার Truffauts The Wild Childফিল্মের আর্থিক সাপোর্ট জমা করা যাবে এমনটা ভাবা তখন কঠিন ছিলো না; এবং এখনো হয়তো কঠিন নয়। এ কারণে আমি প্ল্যান করেছিলাম, শৈশবের মামুলি কিছু ঘটনা নিয়ে নকশার একটা সিরিজ বানাবো। পাঁচ-ছয়টা গল্প বাছাইও করেছিলাম। তারপর ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’ দিয়ে শুরু করেছিলাম; কারণ, শূটের জন্য এটাই ছিলো সহজতম।

ফিল্মটা বানিয়ে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কারণ, এটা একটু বেশিমাত্রায়ই সাহিত্যময় ছিলো। দাঁড়ান, ব্যাখ্যা করছি। ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’ হলো তরুণ প্রেমিকজুটির উপর গোয়েন্দাগিরি করা পাঁচ পুঁচকের গল্প। নির্দেশনা দিতে গিয়ে আমি  দেখেছি, জেরার্ড ব্লেইনের বউ বার্নাদেত লাফোঁ অভিনীত তরুণী চরিত্রটির প্রতি এই ছোকড়াদের আসলে কোনো আগ্রহ নেই। ব্লেইনকেও তারা ঈর্ষা করে না। তাই আমি তাদের মধ্যে ঈর্ষাবোধ জাগানোর কৌশল বের করলাম। পরে সেটা উল্টো বিরক্তই করলো আমাকে। ফলে, নিজেকেই নিজে বললাম, শিশুদের নিয়ে আবারও কাজ করতে হবে; তবে তখন তাদেরকে তাদের বাস্তবজীবনের মতো করে ব্যবহার করবো। আর তাতে ততোটুকুই ফিকশন রাখবো- যতোটুকু না রাখলে নয়।

কার্ডুলো : আগে সমালোচক থাকাটা কি লেখক-ফিল্মমেকারের জন্য বিব্রতকর কোনো ব্যাপার? আপনি যখন শূটিং করেন, তখন কি আপনার মধ্যে থাকা সমালোচক-সত্ত্বা আপনার কাঁধে এসে বসে এবং বলে, ‘শটটা ঠিক হচ্ছে না মনে হয়!’?

ত্রুফো : এটা বস্তুত বিব্রতকরই। তবে সমালোচক ছিলাম বলেই নয়, তিন হাজারের মতো ফিল্ম দেখে ফেলাটাও একটা কারণ। ফলে ‘যা বানানো হলো, সেটা একটা ফিল্মের মতো’, ‘এক্স-এর ফিল্মের সঙ্গে তুলনা করলে এটা ঠিক ভালো ফিল্ম হয়নি’ ইত্যাদিÑ এ ধরনের চিন্তার একটা প্রবণতা আমার মধ্যে সবসময়ই ছিলো। তাছাড়া, যতোই কাজে লাগুক না কেন, স্টোরিলাইনের ব্যাপারে আমি খুবই সন্দেহপ্রবণ। আর এটা এমনই যে, আমার মাথার ভেতর নিরন্তরভাবে স্ক্রিপ্টের বিশ্লেষণ চলতে থাকে; এবং শেষ মুহূর্তে সেটা এমনই পরিস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছে যে, স্ক্রিপ্টটি নিয়ে ফিল্ম বানানোর চিন্তা বাদ দিতে ইচ্ছে করে।

কার্ডুলো : তাহলে ফিল্মটা কীভাবে সম্পন্ন করেন?

ত্রুফো : উপন্যাস নিয়ে ফিল্ম বানানোর সুবিধাই হলো- আপনি সেটা এমনি এমনি ফেলে দিতে পারেন না। ততোদিনে চালকের আসনে বসা হয়ে গেছে, কন্টাক্ট সাইন সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া, অভিনেতাদেরও খুব পছন্দ করি আমি; অন্তত বেশ কয়েকজনকেÑ যাদেরকে বাছাই করি! তারা কাজ করার কথা দিয়েছেন। এই কথার দাম রাখারও তো দরকার আছে।

তবে কাজ একবার শুরু করে দিলে এই ধরনের স্বাভাবিক সন্দেহবাতিক সমস্যা যে কই গিয়ে পালায়! এরপর, ফিল্মমেকিংয়ে কিছু প্রাত্যহিক সমস্যা থাকে। এগুলো নিতান্তই টেকনিক্যাল সমস্যা। চিৎকার ও হাসিঠাট্টার মধ্যেই এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা সত্যি খুব মজার। তবে ফিল্মি শেষ হয়ে গেলে সন্দেহগুলো আবার ফিরে আসে।

কার্ডুলো : ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর উৎস কী?

ত্রুফো : ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’  শূটিংয়ের সময় ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ও আমার মাথায় ছিলো। তবে সেটা শর্টফিল্মের ফর্মে। নাম দিয়ে রেখেছিলাম, আঁতোয়ান রানস্ অ্যাওয়ে।

কার্ডুলো : আঁতোয়ানের গল্পকে দীর্ঘ করার এবং ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’কে বড় বানানোর কারণ কী?

ত্রুফো : কারণ, ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’  নিয়ে আমি হতাশ ছিলাম; কিংবা বলা চলে অন্তত এর সংপ্তিতা নিয়ে। দেখুন, আমি এসেছিলাম নানাবিধ নাটিকা বা নকশা নিয়ে বানানোর ফিল্মি ধরনকে অস্বীকার করতে। ফলে, শর্টফিল্ম হিসেবে ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’ ছেড়ে আঁতোয়ান রানস্ অ্যাওয়ের গল্পের সূত্র ধরে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিল্ম বানানোর সুযোগ নেওয়াকেই ভালো মনে করেছি। এরইমধ্যে আমার প্রিয় সেই পাঁচ-ছয়টি গল্পের আউটলাইনও করে ফেলেছি। আর তাতেই হয়ে উঠেছেÑ ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’।

‘আঁতোয়ান রানস্ অ্যাওয়ে’ ছিলো এক বালককে নিয়ে বিশ মিনিটের একটা নকশা। ছেলেটি স্কুল ফাঁকি দেয়। স্কুল ফাঁকির কারণ হিসেবে কোনো অজুহাত খুঁজে না পেয়ে সে গল্প ফাঁদে। বলে, তার মা মারা গেছে। এই মিথ্যে ফাঁস হয়ে গেলে তার আর ঘরে ফেরার সাহস থাকে না। তাই সে সারাটা রাত বাইরেই কাটায়।

সে সময় ইফ ইট ওয়াজ ইউ নামের একটি টিভি প্রোগ্রামের স্ক্রিপ্ট লিখতেন মার্সেল মসি। পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে বানানো এই অনুষ্ঠান একইসঙ্গে খুবই রিয়েলিস্টিক ও সাকসেসফুল ছিলো। ফলে আঁতোয়ানের গল্পটি ডেভেলপে মসির সহায়তা চেয়েছিলাম আমি। মসি ও আমি মিলে আঁতোয়ান-গল্পের শুরু এবং শেষটা অ্যাড করলাম। সেখানে বালকটির ১৩তম বছর হওয়া পর্যন্ত কালানুক্রমে কাঁচা বয়সের গল্প থাকলো।

বস্তুত, ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ বরং একটা দুঃখবাদী ফিল্মে পরিণত হলো। এর থিম যে কী ছিলোÑ সেটা আমি আসলেই বলতে পারবো না। হয়তো কোনো থিমই ছিলো না। তবে, কৈশোরের প্রাথমিক পর্যায়কে জীবনপথের কঠিন সময় ধরে এবং অনভিজ্ঞ যৌবনকালের ‘সে যে সোনারঙা দিনগুলো’ ধরনের গতানুগতিক স্মৃতিরোমন্থনের সুযোগ না রেখে একটা সেন্ট্রাল আইডিয়া চিত্রিত হয়েছে এতে। কারণ, আমার কাছে শৈশবের প্রত্যেকটা ঘটনাই একটা ধারাবাহিক যাতনার স্মৃতি।

আমার এখন খারাপ লাগে। নিজেকে বলি, ‘বড় হয়ে গেছি। মাফ করে দাও’। আর এটাই আমাকে উজ্জীবিত করে তোলে। কিন্তু তবু, শৈশবকে জীবনের একটা কঠিন রাস্তা বলে মনে হয়। যেন তখন আপনার কোনো অধিকার নেই ভুল করারই। ভুল করা যেন অপরাধ কোনো। ভুল করে প্লেট ভেঙে ফেলা যেন অনেক বড় পাপ। ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এ এটাই ছিলো আমার ভঙ্গি। অপোকৃত ফেক্সিবল স্ক্রিপ্ট লিখে ইমপ্রোভাইজেশনের জন্য ছেড়ে দিয়েছি। অভিনেতারাই বেশিরভাগ অংশ পূর্ণ করেছেন। আঁতোয়ান চরিত্রে জাঁ-পিয়েরে লিওর কাজে আমি খুবই খুশি। চরিত্রটি নিয়ে যা কল্পনা করেছিলাম, লিও এটাকে তারচেয়ে অনেক আলাদা করে তুলেছে। অতি উচ্ছ্বাসে এই ফিল্মটা অনেকটাই দুঃখবাদী হয়ে উঠেছে। আমরা যদি আরো ইমপ্রোভাইজ করতাম, তাহলে ণিক ফুৎকারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটা আরো দুঃখবাদী হয়ে উঠতো।

কার্ডুলো : ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর স্ক্রিপ্ট কি কোনো কোনো েেত্র আপনার আত্মজীবনী নয়?

ত্রুফো : হ্যাঁ; তবে তা অংশত। আমি কেবল বলতে পারি, এই ফিল্মের কোনো কিছুই বানোয়াট নয়। যে অংশটা ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে ঘটেনি, সেটা আমার পরিচিতদের জীবনে ঘটেছে। হয় আমার সমবয়সী ছেলেদের জীবনে ঘটেছে; নয়তো সেই মানুষের জীবনে ঘটেছে, যাদের কথা আমি পত্রিকায় পড়েছি। ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এ নিখাঁদ ফিকশন বলতে কিচ্ছু নেই। তবে এই ফিল্মটা পুরোপুরি আত্মজৈবনিকও নয়।

কার্ডুলো : অন্য প্রসঙ্গে যাই। প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, আঁতোয়ান দোয়ান চরিত্রটি আপনার জীবনেরই নানা অংশের প্রজেকশন। আপনি কি চরিত্রটির সেই প্রজেকশনকে নিরূপন করবেন?

ত্রুফো : সত্যিকার অর্থে, আঁতোয়ান দোয়ানেলের মধ্যে কালুনুক্রমিক কিংবা যৌগিক কিছু ঝামেলা রয়ে গেছে। তবে আমার পে সেটা নিরূপণ করা কঠিন। এই চরিত্রটি জাঁ-পিয়েরে লিও ও আমার এক ধরণের মিশ্রণÑ এটুকু ছাড়া আমি সত্যিই জানি না, সে আসলে কে। সে এক নিঃসঙ্গ ধরনের মানুষ। আপনাকে হাসাতে পারবে কিংবা নিজের দুর্ভাগ্যে মুচকি হেসে দেবেÑ এ রকম এক একলা মানুষ সে। আর এ কারণেই তাকে দিয়ে বিষণ্ন সাবজেক্টকে ছুঁতে চেয়েছি আমি। তবে সবসময় সেটা চেয়েছি মেলোড্রামা কিংবা সেন্টিমেন্টালিটি ছাড়াই প্রিতার সঙ্গে করতে। কেননা, দোয়ানেলের মধ্যে এক ধরনের মনোবল ছিলো। সে ব্যতিক্রমী ও অসাধারণ চরিত্র না হলেও গড়-মানুষদের চেয়ে ভিন্নতর হয়ে উঠেছে। কারণ, গড়পরতা কোনো অবস্থানে নিজেকে কখনোই থিতু করেনি সে। চূড়ান্ত পরিস্থিতিতেই যতো স্বাচ্ছন্দ্য তার। একদিকে গভীর হতাশা ও দুঃখযাতনা, অন্যদিকে পরিপূর্ণ উল্লাস ও প্রবল উৎসাহ।
সে তার চরিত্রের একটা শিশুসুলভ ভাবও বেশ ভালোভাবেই বজায় রাখেÑ যেটা আপনাকে তার প্রকৃত বয়স ভুলিয়ে দিতে সম। তার বয়স যদি ২৮ হয়, ১৯৭২ সালে লিওর যা ছিলো, দোয়ানেলের দিকে তাকালে আপনার মনে হবেÑ সে বুঝি ১৮ বছরের। সে কাঁচা, তবে সবার জন্য খুবই ভালো একজন।

কার্ডুলো : একটা সম্পূরক প্রশ্ন করি। মতঁমার্তে তার ব্যাক্তিগত শৈশব-স্মৃতি তিনি আপনার জন্য ধরে রাখতেন, যেন আপনি সেটাতে ফিরে আপনার অন্তত দু’টি আঁতোয়ান দোয়ানেল ফিল্ম বানাতে পারেনÑ এটাই কি তার কারণ? আমি ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’  ও ‘আঁতোয়ান অ্যান্ড কলেত’-এর কথা বলছি।

ত্রুফো : হ্যাঁ, অনেকটা সে রকমই। পরিচিত রাস্তায় শূট করলে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে নিজের অবস্থান নির্ণয় করা সহজতর হয়। আপনি যখন লিখছেন, তখন আপনার জানাশোনা মানুষ ও পরিবেশের প্রবণতাও আপনার চিন্তায় কাজ করছে। ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর কাজ শুরু করার সময়ও আমি আমার লেখালেখির পদ্ধতি অনুসারেই ‘স্ক্রিপ্ট শিট’ তৈরি করেছি। ‘স্কুল : স্কুলে নানা কিসিমের বিধিনিষেধ থাকবে। বাসা : বাসায় কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। রাস্তা : রাস্তায় সামান্য বিধিনিষেধ থাকবে। ’ আমার মনে হয় সবাই অন্তত কিছু ফিল্মে এভাবে কাজ করে। কমেডি ফিল্মের বেলায় আপনি নিঃসন্দেহে এভাবে কাজ করতে পারেন, এবং এমনকি ড্রামাতেও পারেন। আর এ জিনিস আমার বেলায় বারবারই স্মৃতি-নির্ভরতা থেকে হয়েছে।
আমি এটুকু বুঝি, গুরুত্বপূর্ণ যে অতীতÑ আপনি পারেন সেটার স্মৃতি-চর্চা করতে। যেমন ধরুন, আমাদের কাসের একটা ছবি পেয়েছিলাম আমি। লাইনে সারি বেঁধে দাঁড়ানো সব ছাত্রের সঙ্গে কাসিক্যাল পোজের ছবি। সেটার দিকে তাকিয়ে আমি কেবল আমার দুই বন্ধুর নাম মনে করতে পারলাম। কিন্তু এরপর টানা কয়েকদিন সকালবেলা এক ঘন্টা ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় দেখলাম, সব কাসমেটের নাম, তাদের বাবা-মার চাকরি এবং তাদের বাসার ঠিকানা মনে পড়ছে।

যখন আমি মসির সঙ্গে দেখা করেছিলাম এবং তাকে ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর স্ক্রিপ্টে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, সে সময়ের ঘটনা এটা। ইতোমধ্যে আমি যতো পালিয়ে বেরিয়েছি, সেই একইসব ঝামেলার মুখে আঁতোয়ানও পড়েছেÑ শিকদের ভুয়া নোট, জাল স্বার, বাজে রিপোর্ট কার্ডÑ এই জিনিসগুলোকে আমি অবশ্যই অন্তর থেকে জানি। সকাল দশটার স্কুল-পালানো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলাম। এমন সাতসকালে খোলা বেশকিছু সিনেমা হল ছিলো প্যারিসে। আর সেগুলো প্রায় একচেটিয়াভাবে ভর্তি ছিলো স্কুলের ছেলেমেয়েতে! তাই বলে আপনি কিন্তু স্কুলব্যাগ সঙ্গে নিয়ে ঢুকতে পারবেন না। কারণ, তাহলে আপনাকে সন্দেহজনক লাগবে। আমরা তাই আমাদের ব্যাগগুলো হলের দরজার পেছনে লুকিয়ে রাখতাম।

এ রকম দু’টি সিনেমা হল একেবারে মুখোমুখি ছিলোÑ দ্য সিনিয়াক-ইতালিয়েন্স ও দ্য নিউ ইয়র্ক। প্রত্যেকদিন সকাল পৌঁনে দশটার দিকে সেগুলোর গেটের সামনে পঞ্চাশ-ষাটজন বাচ্চা অপোয় দাঁড়িয়ে থাকতো। আর গেট খুলতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তো। কেননা, লুকানো নিয়ে চিন্তায় থাকতাম আমরা। ঐ পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে যাওয়ার তীব্র ভয় কাজ করতো...।

কার্ডুলো : ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ নিয়ে বেশির ভাগ সমালোচকের প্রতিক্রিয়াই ছিলো উচ্চকিত আবেগতাড়িত। প্রাক্তন সমালোচক হিসেবে আপনাকে এই ফিল্ম নিয়ে কথা বলতে বললে আপনি কি তাদের এই উচ্ছ্বাস নিয়ে কি কিছু বলবেন?

ত্রুফো : না। আমার তা মনে হয় না। সত্যি বলতে কি, এই ফিল্মটাকে আমি পছন্দ করেছি বলেই মনে হয় আমার। কারণ, এই ফিল্মের আইডিয়াটা আমার প্রিয়। খুবই ভালো আইডিয়া এটা। তবে, সমালোচকরা দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ-এর যতো বন্দনা করেছেন, আমি ততোটা করবো না। আমি এটাকে মাস্টারপিস কিংবা গ্রেট আর্টওয়ার্কও বলবো না। কারণ, এটাতে থাকা এক্সপেরিমেন্টাল কিংবা কামজি বিষয়আশয় আমি স্পষ্টই দেখতে পাই।

কার্ডুলো : ফ্রান্সের বাইরে অন্য সব দেশে কি এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়েছে?

ত্রুফো : না। ইতালিতে এটা ফপ করেছে। ইতালিয়ান নিওরিয়ালিস্ট ফিল্মের সঙ্গে এর অনেকটা মিল থাকায়ই বোধহয় ফপের কারণ। নিওরিয়ালিস্ট ফিল্মগুলোও তো সেখানে সবসময়ই ফপ! জার্মানিতেও দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ ভালো চলেনি। কান উৎসবে ক্যাথলিক প্রাইজ জেতার পরও স্প্যানিশরা এটাকে ডিস্ট্রিবিউট করতে চায়নি। তবে জাপান, হল্যান্ড, আমেরিকা এবং আরো কিছু জায়গায় ভালোই চলেছে।

কার্ডুলো : এটা তো ফরাসি সেন্সর বোর্ডের প্রতিক্রিয়ার মুখেও পড়েছিলো, তাই না?

ত্রুফো : হ্যাঁ। সেটা এই ফিল্মের অবস্থানের কারণে। ব্যাভিচার, নিজের মাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে এক বালকের দেখে ফেলা, সংশোধনী স্কুল থেকে পলায়নÑ এইসব জিনিসের কারণে। ফরাসি সেন্সর বোর্ড দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজকে প্রাথমিকভাবে ষোল থেকে ১৬+ রেটিং করেছিলো। কান উৎসবে শুধু ক্যাথলিক প্রাইজই নয়, বেস্ট ডিরেক্টর পদকও জেতার পর এই ১৬+ রেটিং বাতিল করা হয়।

কার্ডুলো : পুরস্কার পাওয়ার পর সেন্সর বোর্ড কি বোকার মতো ভড়কে গিয়েছিলো?

ত্রুফো : আমার তো তা-ই মনে হয়।

কার্ডুলো : দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ-এ যারা আপনাকে বিপ্তিভাবে প্রভাবিত করেছেন, রেনোয়াসহ সেই ফিল্মমেকারদের কাছে ফিরে যেতে চাই।

ত্রুফো : আসলে, দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ-এ জাঁ ভিগোর প্রভাব আছেই। তবে সাদামাটা ইশারা কিংবা আর্টিস্টিক বা টেকনিক্যাল সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে রেনোয়ার প্রভাব সামান্য হলেও নিশ্চিতভাবেই আছে। যেমন ধরুন, রেনোয়ার গোপনীয়তা নিহিত তার ক্যাজুয়াল স্টাইলে। এখন পর্যন্ত সেই ‘স্টাইলবিহীন স্টাইল’ তাকে নিবৃত্ত করেনি জীবনেরও-অধিক-দীর্ঘ দৃশ্য নিয়ে কাজ করতে। দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ-এ এ রকম জীবনেরও-অধিক-দীর্ঘ দৃশ্যের ঝামেলা ছিলো। স্কুলে অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে শিককে আঁতোয়ান তার মায়ের মৃত্যুর কথা বলে। তার মা দুপুরে স্কুলে এসে হাজির হলে সে ধরা পড়ে যায়। ঠিক করে, সে আর কোনোদিন ঘরে ফিরবে না। স্কুল ছুটি হলে এই প্ল্যান নিয়ে সে তার বন্ধুটির সঙ্গে আলাপ করে। আলাপের এই সংলাপ ঠিক করা আমার জন্য খুব কঠিন ছিলো। কারণ, এটা স্বাভাবিক ছিলো না। বাচ্চারা সাধারণত এ ধরনের কথা বলে না।

আমি খুবই বাস্তববাদি। আর এমন মুহূর্তে স্ক্রিপ্টে প্রকৃতার্থে যা লেখা ছিলো, তা বলা হলে সেটা আমার প্রবণতার বিপরীতে যেতো। ফলে, এই দৃশ্যে জাঁ-পিয়েরে লিওর সঠিক ভঙ্গিমাকে নির্দেশনা করাও কঠিন ছিলো। এইসব কারণে, পরিস্থিতি আমাকে দ্য হিউম্যান বিস্ট-এর [১৯৩৮] কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সেখানে জ্যাক লন্টার চরিত্রে জাঁ গাবিঁ ফিল্মের একেবারে শেষাংশে ফিরে আসেন। সিমনি সিমনের চরিত্রকে হত্যার পরের সকালের তিনি তার মনৌরেলে ফিরে আসেন; এবং নারীটিকে মেরে আসার কথা তাকে অন্য সঙ্গীর চরিত্রে অভিনয় করা জুলিয়েন ক্যারেটের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়।

রেনোয়া তার ফিল্মি স্টাইলের স্বাতন্ত্র্য লণকে কাঁটায় কাঁটায় ব্যবহার করে গাবিঁকে এখানে বিস্ময়করভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত কিংবা তাৎণিকতা। গাবিঁ বলেন, ‘এটা ভয়ানক। তাকে আমি খুন করেছি। তাকে আমি ভালোবাসতাম। আর কখনো তাকে দেখতে পাবো না। আর কখনো থাকতে পারবো না তার পাশে। ’ খুব নম্রভাবে, খুব সাদামাটাভাবে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। লিওকে নির্দেশনা দিতে গিয়ে আমি গাবিঁর পারফরমেন্সের স্মৃতিকে ব্যবহার করেছি। গাবিঁর মতো সে নিজেই ঠিক নিজের ভঙ্গিমাতে কাজ করেছে তার নিজের দৃশ্যে।

দৃশ্যটা খুব কঠিন ছিলো। তিনদিনের অনুপস্থিতির পর নোট ছাড়া স্কুলে যাওয়া এবং এর কারণ হিসেবে মায়ের মৃত্যুর কথা বলবে বলে ঠিক করা- লিওকে এ দৃশ্যের প্র্যাকটিস করিয়ে নেওয়া সহজ ছিলো। এই তাৎণিকতায় আমার উপর ডিরেক্টরিয়াল ইনফুন্সের কোনো প্রশ্ন ছিলো না; বরং আমার নিজের নির্দেশকীয় সহজাতবুদ্ধিতেই এটা করেছি আমি। আঁতোয়ান যে এই মিথ্যেটা বলবেÑ তা তো জানি না আমরা। কেবল জানি, বড় ধরনের একটা মিথ্যে বলবে সে। হ্যাঁ, সে অবশ্যই তার মায়ের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে অন্য অনেক পথ অবলম্বন করতে পারতো। সে কুটিল কিংবা কাতর কিংবা আরো কতো-কী-ই হতে পারতো। আমি ঠিক করেছিলাম, এই ছেলেটার মধ্যে এমন একটা ছাপ থাকবে, যা দেখে মনে হয়- সে মিথ্যে বলতে চায় না। এ কথা বলার সাহস সে দেখায়নি; বরং শিক তাকে বলতে বাধ্য করেছেন। শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন, ‘নোট কই তোমার?’ বাচ্চাটা জবাব দেয়, ‘আমার মার জন্য, স্যার। ’ শিক জানতে চান, ‘তোমার মা? কী হয়েছে তোমার মার?’ এটার একমাত্র কারণ হলো, শিক কথা বাড়িয়েছেন, তাই আঁতোয়ান হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং বলে, ‘সে মারা গেছে!’ লিওকে আমি বললাম, “তুমি বলো, ‘সে মারা গেছে!’ কিন্তু তুমি নিজের মাথায় চিন্তা করো, ‘সে মারা গেছে- কথাটা এখন কীভাবে বলবে?” সে কিছু বললো না। তবে ভাবলো। আর সেটা তাকে একটা যথাযথ চাহনি ও কণ্ঠস্বর দিলো, এমনকি উঁচুমাথাও। ঠিক যেমনটা চেয়েছি আমি। এ ধরনের মিথ্যে জীবনে আপনি কেবল একবারই ব্যবহার করতে পারেন!

দাঁড়ান, এবার রেনেয়ার বদলে অন্যকারো ডিরেক্টরিয়াল ইনফুয়েন্স নিয়ে আরেকটা উদাহরণ দিই। দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ-এ আমি যদি দেখাতাম- ছেলেটা স্কুলে ফিরে এসে তার মা মারা গেছে বলার পর বাবা কাসরুমে এসে তাকে চটকানা মারছে, তাহলে এডিটিংয়ে ঝামেলায় পড়তে হতো আমাকে। কারণ, তাহলে আমি এই দৃশ্যে ফাস্ট-অ্যাকশন চাইতাম। আর হয়তো পেতামও; তবে তা অজস্র কাটিংয়ের মাধ্যমে। কিন্তু ফিল্মের বাকি অংশ ছিলো অপরিমিত কাটিং ছাড়া শুধু অসংখ্য পরিস্থিতি ধারণের বিষয়। ফলে আমি জানতাম, এই ফ্রেমের মধ্যেই সামান্য কিংবা কোনো কাটিং ছাড়াই দৃশ্যটিতে নাটকীয়তা তৈরি করতে হবে। আলফ্রেড হিচককের কথা ভাবলাম আমি। নয়তো আমার কোনো রেফারেন্সের পয়েন্ট নেই। তাৎণিকতায় আমি যে দৃশ্য বানাতে চেয়েছিলাম, সেটা এডিট করার কোনো আইডিয়া ছিলো না আমার। আমি এখন জানি, হেডমাস্টারকে দেখানো, দরজায় কড়া নাড়া, ছেলেটিকে নিয়ে অন্য ছেলেরা কী ভাবে- তা এবং তারপর তার মাকে দেখানো দরকার ছিলো। অভিনেত্রী কেয়ার মরিয়ঁকে বলেছিলাম, তিনি যেন কাসরুমে তার ছেলেকে খুঁজে বেড়নে, যাতে বোঝা যায়Ñ তিনি এই প্রথম স্কুলে এসেছেন। কিন্তু তিনি সরাসরি আঁতোয়ানের ডেস্কের দিকে তাকিয়েছিলেন। এতো কচিমুখের সমুদ্রে তার ছেলের মুখ খুঁজে বের করার বাস্তবতা নয়, আমি চেয়েছিলাম একটা নাটকীয়তা সৃষ্টি করতে।

কার্ডুলো : এই ফিল্মের শূটিং হয়েছিলো বাস্তব লোকেশনে। তবে ডাইরেক্ট সাউন্ড নেওয়া হয়নি; তাই না?

ত্রুফো : আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরÑ হ্যাঁ; বাস্তব লোকেশনে শূট করেছি আমরা। প্যারিসের রো কলিনকোর্টে একটা পুঁচকে অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছিলাম। তবে আমি আমার ক্যামেরাম্যান অঁরি দিকাইকে নিয়ে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, তিনি ওখানে শূট করতে চাননি। আমি তাকে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়েছিলাম। আর তিনি জানাচ্ছিলেন- কী হাজারো ঝামেলা অপো করছে তার জন্য। এই যেমন, আমরা যখন বাবা-মা আর ছেলেটাকে খাবারের টেবিলে দেখাতে চাইলাম, দিকাইকে তখন সাততলার কার্নিশে বসতে হয়েছিলো; বাকি সব ক্রু অপো করছিলো সিঁড়ির উপর! এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটেছে।

স্টুডিও আমার পছন্দ নয়- এ কথা বলতে চাই। লোকেশনে শূটিং আমাকে আচ্ছন্ন করে। আর ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ বাদে আমি আমার সব ফিল্মের শূটিং লোকেশনেই করেছি। অবশ্য শূটিংয়ের শেষে ‘ফারেনহাইট ৪৫১’-এর সেট আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম! বাস্তবতার এটা একটা সহজ প্রশ্ন। লোকেশনে হয়তো আউটডোর থেকে ইনডোরে যাওয়া লাগে; তবে এটা যদি কোনো ইস্যু নাও হয়, স্টুডিওতে শূট আর সত্যিকারের একটা অ্যাপার্টমেন্টে শূটÑ এই দুটির রেজাল্ট কিন্তু ভেতর থেকেই একেবারে ভিন্নতর হবে। অনেক খরচ করে স্টুডিওর ভেতরে হয়তো একটা সত্যিকারের অ্যাপার্টমেন্ট বানানো সম্ভব; কিন্তু দরজা তালাবন্ধ করতে গেলে তার কাঠের পরত বলে দেবেÑ সেটা সত্যি নাকি সেট। এ জিনিস আপনি স্টুডিওতে পাবেন না, সেখানে সবকিছু প্লাই-উড দিয়ে বানানো হয়।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরেও ‘হ্যাঁ’ বলি। দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ প্রায় পুরোটাই সাউন্ড ছাড়া শূট করা হয়েছে; পরে ডাবিং করা হয়েছে- শুধু একটা দৃশ্য ছাড়া, যে দৃশ্যে আঁতোয়ানকে মনোবিজ্ঞানী জেরা করে। এই দৃশ্যটি যদি অনেক বেশি মনোযোগ পেয়ে থাকে, তাহলে সেটা কেবল লিওর রিয়েলিস্টিক পারফরমেন্সের জন্যই নয়; এই একটামাত্র দৃশ্যের শূটিং যে আমরা লাইভ-সাউন্ডে করেছি, সেটাও এর কারণ। এ ধরনের দৃশ্যের ব্যাপক অনুপ্রেরণা যে টেলিভিশন থেকে এসেছে, সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন? যদিও আমি বিশ্বাস করি, ফিল্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিভিতে যখন কাব্যিকতা কিংবা ফ্যান্টাসি নিয়ে কাজ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তখন সেটা বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে যায়। এটা যখন কারো কাছে কিছু জানতে চায় এবং নিজের ব্যাখ্যা নিজে দেয়- তখন এটা এরই উপাদান থাকে।

দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ-এর এই দৃশ্যটা নিশ্চিতভাবেই টেলিভিশনকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। জাঁ-পিয়েরের কাছে কোনো স্ক্রিপ্ট ছিলো না। আমি তাকে একটা আইডিয়া এবং উত্তরের ব্যাপারে বেসিক সেন্স দিয়েছিলাম। ফলে সেটা স্টোরিলাইনের সঙ্গে মিলে গেছে। তবে, সে তার নিজের কথা, নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করেছে এবং অবশ্যই এর ফলে এটা ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে।

মনোবিজ্ঞানীকে পাশে সরিয়ে রাখায় ডাবিং বরং ভালো হয়েছে। কারণ, বাচ্চারা সহজেই ডাবিংয়ের কাজটা করতে পারে। তবে জাঁ-পিয়েরে লিও যে আহামরি ভালো ডাবিং করেছে- সে কথা বলতে পারবেন না। এই ফিল্মের বাবা-মাকে ধরলে এটার পোস্ট-সিংক্রানাইজেশন যথেষ্ট ভালো হয়নি।

[চলবে...]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।