ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বইমেলা, বাংলা একাডেমী ও নানা ভাবনা

কামাল রাহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১
বইমেলা, বাংলা একাডেমী ও নানা ভাবনা

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে পনেরো শতকে কাগজে বই ছাপানোর যন্ত্র প্রেসমেশিন আবিষ্কারের সঙ্গে সূত্র রয়েছে বিশ্বের প্রথম বইমেলার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চার বছর পর ফ্রাঙ্কফুর্টে নতুন কলেবরে শুরু হয়ে আজ ওটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। সে-তুলনায় আমাদের বইমেলা বয়সের দিক থেকে নিতান্তই শিশু, কিন্তু ক্রেতা-দর্শক আগমনের দিক থেকে, সংখ্যাগতভাবে, ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলাকে ছাড়িয়ে যায় বাংলা একাডেমীর বইমেলা।

একাডেমীর কোনো পরিসংখ্যান এ বিষয়ে আছে কিনা জানি না, ডিজিটাল বাংলাদেশের কোনো তথ্য আন্তর্জালে পাওয়ার চেষ্টা অনেকটা ভোগান্তির, এর কচ্ছপগতির সঙ্গে অশেষ ধৈর্য নিয়ে এগিয়ে গেলেও অন্যান্য অনেক বিষয় সত্যি অস্বস্তিকর, অশ্লীল সাইট ও হ্যাকারের আক্রমণ ঠেকানো বেশ কঠিন, জানি না বাংলাদেশে এখন কেমন, কিন্তু বিলেত থেকে বাংলাদেশের যে-কোনো সাইটই অনেক সময় বড় ধরনের ঝামেলায় ফেলে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার তথ্য আন্তর্জালে কিক করা মাত্র পাওয়া সম্ভব, বাংলা একাডেমী বইমেলার নয়, হয়তো আমাদের দেশটা ডিজিটাল বলে, ভাগ্যিস জার্মানি দেশটা ডিজিটাল নয়!

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা মূলত প্রকাশক ও লেখকদের মেলা, পাঁচ দিনের মেলায় গত বছর মোট দর্শকসংখ্যা ছিল তিন লাখের মতো, গড়-দৈনিক প্রায় ষাট হাজার, একশো এগারোটি দেশ অংশ নিয়েছিল, সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান, তেষট্টিটি দেশের দশ হাজার সাংবাদিক মেলায় এসেছিল। বই কিনতে ক্রেতা পাঠক সেখানে যায় না। গত বছরের বইমেলার তথ্য থেকে দেখা যায়, নেপালের মতো ছোট্ট একটা দেশের দুটো প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি-প্রদর্শক অংশ নিয়েছিল, বছরে কটা বই বের হয় ওখান থেকে! এমনকি পাকিস্তানের মতো একটা দেশেরও সাতটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল, ভারতের সাতচল্লিশটি, বাংলাদেশের পাঁচটি! দুহাজার আটে শ্রাবণ প্রকাশনী ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলায় অংশ নিয়েছিল, এর আগের তথ্য হাতে নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলায় ঢোকার পথেই মেলার একটা চিত্র পাওয়া যায়, বাংলা একাডেমীর মেলায়ও একটা তথ্যকেন্দ্র রয়েছে, সেখানে থাকতে পারে মেলার ইতিহাস-সম্বলিত তথ্য, পরিসংখ্যান ও স্টল লে-আউট, এবং বড় একটা স্ক্রিনে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে সেগুলো দেখানো, তাহলে স্টল খুঁজে না পেয়ে বিফল হয়ে ফিরে যেতে হবে না কোনো ক্রেতাকে। বাহাত্তরের একুশে ফেব্র“য়ারী মুক্তধারা বাংলা একাডেমীর সামনে একটা মাত্র স্টল নিয়ে যে আয়োজন শুরু করেছিল তা কীভাবে, এখন কোথায় পৌঁছেছে মেলার প্রথম আগন্তুকটিরও তা জানা প্রয়োজন।

ইউরোপ আমেরিকায়, বিশেষ করে, ক্রিসমাস ইভে শুরু উৎসবদিনের আনন্দ, শেষ হয় নিউ ইয়ার্স ইভের হুল্লোর শেষ হওয়ার পর, বাংলা ভাষায় যারা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তাদের অন্তরে উৎসব বইমেলা শুরুর দিন থেকে, এবং এই ঘোর থেকে যায় মেলার শেষ দিন পর্যন্ত। সারা বছর প্রাণ আকুল থাকে এই সময়ের জন্য, এবং এটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সত্যিই একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয় অন্তরে। বইমেলাকে ঘিরে এই যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের একটা আবহ তৈরি হয় এর অনেক সদর্থক দিক রয়েছে। অনেক দীনতার পরও বাঙালির আছে অফুরান প্রাণের প্রাচুর্য, পৃথিবীর সব জাতির এটা নেই, এবং বিখ্যাত অনেক জাতিরই এটা অনেক কম! মানুষের প্রাণ জাগাতে কত প্রলোভন, কত প্রচেষ্টা নিতে হয় পৃথিবীর দেশে দেশে, অথচ সামান্য হুজুগেই মেতে ওঠে বাঙালি। ভালোভাবে কাজে লাগালে হয়তো অনেক কিছুই সম্ভব হতো এটা দিয়ে। ধর্মের দোহাই ও ধোঁকা, জাতিগত বিভেদ, অর্থনৈতিক শোষণ, শ্রেণীবৈষম্য প্রভৃতির ধুয়া তুলে মানুষকে জাগিয়ে যা-কিছু করা হয়েছে এ পর্যন্ত, বিশ্লেষণ করলে তার সবই অবশেষে ভীষণ রক্তারক্তির মধ্যে শেষ হয়েছে, চূড়ান্তে শ্রেণীস্বার্থই রতি হয়েছে, বিশ্বের নিগৃহীত শ্রেণী এখনও নিষ্পেষণের ভেতরই রয়েছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি কোনো মুক্তিই আসেনি।

চাপিয়ে দেয়া ধর্মীয় আবেগ, বা মুগ্ধ আবেশে গ্রহণ, যেভাবেই হোক, ঐ বিতর্কে না যেয়েও বলা যায় বাঙালি জাতি যথেষ্ট অসাম্প্রদায়িক। নববর্ষ, বৈশাখি মেলা, বসন্ত মেলা, বইমেলা প্রভৃতিতে বাঙালি আসে প্রাণের উচ্ছ্বাসে, মনের টানে। বাঙালির বৈশাখি মেলাকে যেমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষভাবে উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যায়, তেমনি নববর্ষের দিনটি রাষ্ট্রীয় উৎসব হিসেবে পালন করা যায়। শুধু অফিস আদালত ছুটি দিয়ে দিবস উদযাপন নয়, বরং ওখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত উৎসবের দিনগুলি চিহ্নিত করে তা পালন করা উচিত। বইমেলার একটি দিনও জাতীয় সাহিত্য দিবস হিসেবে গ্রহণ করা যায়। পরিকল্পিতভাবে এগোলে এক দশকের মধ্যে উপজেলা পর্যন্ত মেলার বি¯তৃতি ঘটানো যেতে পারে। বাংলাদেশে এখন অনেক বড় বড় প্রকাশক আছেন, যারা উপজেলা পর্যন্ত একই দিনে প্রতিনিধি ও বই পাঠিয়ে উৎসব করতে পারেন। যারা প্রতিনিধি পাঠাতে পারবেন না, তাদের বই বাংলা একাডেমী স্টলে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রথম কয়েক বছর হয়তো আর্থিক দিক থেকে লাভজনক হবে না, নিয়মিত হতে থাকলে একসময় অবশ্যই লাভজনক হবে। মনে হতে পারে কাজটা একটু কঠিন, আসলে তা নয়, ছোট্ট একটা উদাহরণ, যাতায়াতের ক্ষেত্রে সামান্য একটা সিদ্ধান্ত কত বড় শৃঙ্খলা এনেছে! রেলওয়েতে সিট রিজার্ভেশান চালু হওয়ার আগে যে কী ভয়াবহ অব্যবস্থা ছিল, যাদের স্মৃতিতে রয়েছে তারা মনে করে দেখতে পারেন, অথচ এখন গাড়ি ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে যেয়ে নির্ধারিত আসনে বসতে পারেন।

অতীতে বাংলা একাডেমী ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত অনেক বড় বড় কাজ করেছে, বইমেলার এই শুভ দিকটি এখন বিবেচনা করে দেখতে পারে। পরিসর বাড়িয়ে ও আরো বেশি স্টল বরাদ্দ দিয়ে বইমেলার ব্যপ্তি বাড়ানো যাবে কিছুটা, কিন্তু এর গুণগত মান বাড়িয়ে এবং এটা থেকে ভালো কিছু ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করে, এর সদর্থক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটিকে যদি খোলসের ভেতর থেকে বের করে আনা যায়, হতে পারে সেটা সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি। বর্তমান যুগকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, বই এখনো ঐ তথ্য সরবরাহের কার্যকর প্রধান একটা মাধ্যম। প্রেমের, আবেগের, বিজ্ঞানের, হিসাবের, যুদ্ধের, এসব কিছুই ধারণ করে বই। শুরু হয়েছিল পাথরে অর খোদাই করে, এখন ই-বুকে, ভবিষ্যতে কোথায় কে জানে, হয়তো মোবাইল ফোনের মতো ছোট্ট একটা যন্ত্র থেকে ঘরের ছাদে বা দেয়ালে প্রোজেক্ট করে শুয়ে শুয়ে বই পড়তে পারবে অনেক অলসেরাও! যে-কোনো জাতির মানবিক উন্নয়নে এই বইয়ের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন।

বাংলা একাডেমী বইমেলার চরিত্র যা দাঁড়িয়েছে, এতে মনে হয় এটা পাঠকের মেলা, এবং এসকল পাঠকের প্রায় সবটাই হুমায়ূন আহমেদের মতো বাণিজ্যিক লেখকদের, হুমায়ুন আজাদের মতো লেখকের বই কেনার জন্য কজন আসেন এখানে! মেলায় এই বিপুল দর্শক সমাগমের কৃতিত্ব বাণিজ্যিক লেখকদের, সেই সঙ্গে সৃষ্টিশীল লেখকেরাও মেলায় আসেন এবং কয়েকজন ক্রেতা-পাঠক পেয়ে যান। মেলায় যেসব ক্রেতা-দর্শক আসেন তাদেরকে ভালো বই সম্পর্কে অবহিত করার দায়িত্ব জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলা একাডেমী উভয়ের, নাহলে বাজারি লেখকদের ওখানেই ভিড় করবে পাঠক, মাছ শিকারের জন্য যেমন টোপ ফেলার আগে চার ছড়াতে হয়, তেমনি বাণিজ্যিক লেখকদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বইমেলা পরিচালনা সম্ভবত বাংলা একাডেমীর করণীয় তালিকায় নেই, এখন এটা এমনভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে যে, এখান থেকে সরে আসারও সুযোগ নেই। অনেকে বইমেলাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন, মনে হয় না এটা একটা সমাধান। বইমেলায় আগত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, এটা একটা শুভ লণ, রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে যে সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণের ভাবনা চলছে, সত্যিই যদি তা বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে স্থান সংকুলানের সমস্যা মনে হয় থাকবে না। ইতিহাসবিস্মৃত জাতি হিসেবে যে সুনাম আমাদের রয়েছে তা থেকে উঠে আসতে হলেও ঢাকা শহরের অন্য কোথাও সোহরাওয়ার্দীর নামে আরেকটা উদ্যান করে রেইস কোর্সের আদি নাম ফিরিয়ে দেওয়া যায়, শিশু পার্কটি অন্যত্র সরিয়ে ওখানে বঙ্গবন্ধুর ছাব্বিশে মার্চের ভাষণমঞ্চ, বর্বর পাকিদের আত্মসমর্পণের দৃশ্যসম্বলিত ভাস্কর্য  ও ইন্দিরামঞ্চ নির্মাণ করে ইতিহাসের কলঙ্ক কিছুটা হলেও মোচনের উদ্যোগ নেওয়া যায়। রেইস কোর্স পুরোনো রূপ কিছুটা ফিরে পেলে বইমেলার বর্তমান পরিসর বাড়ানোয় সমস্যা আর থাকবে না।

আরেকটা মেলা করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, সেটাকে যৌথভাবে, একাডেমী ও প্রকাশক সংঘের সমন্বয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলার আদলে আন্তর্জাতিক বইমেলার রূপ দেয়া যায়, যেখানে লেখকসংঘের প্রতিনিধিও থাকতে পারেন। এখানে ক্রেতা-পাঠক প্রত্যাশা না করাই ভালো, পুরোপুরি প্রোফেশনালভাবে এটাকে তৈরি করা যায়। বাংলা একাডেমীর মেলায় সেমিনার, মোড়ক উন্মোচন প্রভৃতি কাজগুলো করা হয়, মনে হয় না এ মেলায় এসবের প্রয়োজন রয়েছে, এগুলো বরং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র মেলার জন্য রাখা যেতে পারে। ওখানে প্রকাশকদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা যায়, একজন ভালো প্রকাশকের জন্য এটা একটা স্বীকৃতি ও প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। ভালো প্রকাশকদের গুরুত্ব অবশ্যই তুলে ধরতে হবে, পুঁজিবাদী বিশ্বে এরাই পুঁজি সরবরাহকারী।

বাংলাদেশের অনেক মহারথী কথায় কথায় দেশের ভাবমূর্তির কথা বলেন, এটা উন্নত করতে হলে কোনো না কোনোভাবে বিশ্বের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সুব্যবস্থা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে তিলসমান একটা দেশ সিঙ্গাপুরকে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই চেনে, বাংলাদেশটা কোন মহাদেশে বা এর ভৌগোলিক অবস্থান কোথায়, এখনো অনেককে বোঝাতে হয়! বইও যে একটা রপ্তানিপণ্য, বাংলাদেশের প্রকাশকদের দৃষ্টিতে এটা আনতে হবে, চীন ইংরেজি ভাষায় লিখিত বইয়ের একটা বড় রপ্তানিকারক দেশ। উন্নত দেশের নব্বই ভাগেরও বেশি বই পেপারব্যাক, অথচ আমরা এখনো হার্ড কভারে রয়ে গেছি, বাণিজ্যিক লেখক, যাদের বই অনেক বেশি ছাপা হয়, সেসব পেপারব্যাকে ছাপানো হলে দৃষ্টিনন্দন ও ব্যয়-উপযোগী হয়।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মতো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র মেলায় প্রতি বছর একটা ‘গেস্ট অব অনার কান্ট্রি’ রাখা যেতে পারে, অবশ্য ভারতের বইমেলার ‘থিম কান্ট্রি’ করার মতো নয়, যেখানে যাওয়ার জন্য নিরীহ সাহিত্যিকদেরও ভিসা দেওয়া হয় না। ওই গেস্ট অব অনার কান্ট্রির সর্বোচ্চ সংখ্যক অনুবাদগ্রন্থ মেলায় আনা হবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলায় গত বছর গেস্ট অব অনার কান্ট্রি ছিল আর্জেন্টিনা, এবার আসবে আইসল্যান্ড, ভাবা যায় প্রায় বিশ কোটি (আন্তর্জালের তথ্য!) লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, আর আইসল্যান্ডের জনসংখ্যাই মাত্র তিন লাখ বিশ হাজার!

একাডেমীকে শক্তিশালী একটা প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করাতে হলে ভেতর থেকেই উদ্যোগী হতে হবে। একটা জাতির সাহিত্য একাডেমীকে কেন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে! এটাকে পুরোপুরি রাজনীতির প্রভাবের বাইরে এনে অনেক বেশি মতাশালী করা যেতে পারে, চাটুকারিতা ও হঠকারিতা মুক্ত অন্তত একটি জায়গা থাকুক আমাদের। বাংলা একাডেমী বইমেলার উদ্বোধন কোনো রাজনৈতিক নেতার কাজ নয়, এটা করতে পারেন দেশের যে-কোনো গুণীজন, একজন বড় কবি বা সাহিত্যিক, যিনি এটা করবেন, তাঁর জন্যও বিষয়টা সম্মানের, স্বীকৃতির।

বাংলা একাডেমীর অর্থায়নের জন্যও নিজস্ব উৎস সৃষ্টি করা আবশ্যক, যেনো সব বিষয়ে সরকারের মুখাপেক্ষী হতে না হয়। সামান্য উদ্যোগ নিলে বইমেলা থেকেও একাডেমী কিছু আয় করতে পারে, শুধু শৃঙ্খলা এনে, সুসম পরিকল্পনা করে। বইমেলার প্রবেশপথে কয়েনগেট বসানো যেতে পারে, যেটার মেশিনে এক বা দু টাকার কয়েন দিলে গেট খুলবে, পরের ধাপে, নিরাপত্তা গেটে একটা সেন্সর থাকে যা প্রবেশার্থীর মোট সংখ্যাও নিরূপণ করে। বাহির পথে একসারি কাউন্টার থাকবে আইএসবিএন নাম্বার ও বারকোড দিয়ে যা ক্রেতার কাছ থেকে বইয়ের মূল্য গ্রহণ করবে, সঙ্গে সঙ্গে যা প্রকাশকের হিসাবে চলে যাবে। এতে কয়েকশো প্রকাশকের রসিদ দেওয়া ও বিক্রেতা রাখার ঝামেলাও থাকবে না। ক্রেতা যে কোনো স্টল থেকে খুশিমতো বই সংগ্রহ করতে পারবে, বই চুরিও হবে না, কারণ স্ক্যান ছাড়া কোনো বই নিয়ে বেরুতে চাইলে কাউন্টারে সঙ্গে সঙ্গে এলার্ম বেজে ওঠে। এতে প্রকাশক ও একাডেমী, উভয়েরই লাভ, এমনকি সরকারেরও রাজস্ব আয় হবে। কারো বই এক হাজার কপির অতিরিক্ত বিক্রি হলে ভ্যাটের আওতায় এসে যাবে। বই লিখে যারা বাণিজ্য করছে, আর যারা তিলে তিলে সঞ্চয় করে একটা বই প্রকাশ করছে তাদের মধ্যে একটা পার্থক্য অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে।

নিজ উদ্যোগে বই প্রকাশ ও বিপণনের জন্য লেখককে উৎসাহ ও পরামর্শ দেওয়ার শত শত ওয়েবসাইট রয়েছে, অথচ বাংলায় একটাও নেই। একাডেমী এখানে পথিকৃতের ভূমিকা নিতে পারে। প্রকাশনাশিল্পের জন্য ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতে পারে একাডেমী, তাহলে প্রকাশকদের মধ্যে প্রোফেশনালিজম আসবে। বাংলা সাহিত্যে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলসমূহে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিকদের জন্য এই ডিপ্লোমা আবশ্যিক করা যেতে পারে। দেশের সব কটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের কোনো প্রয়োজন নেই, একটা মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ রাখা যেতে পারে।

বাংলা একাডেমীর কাজ গবেষণা, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, বই প্রকাশ ইত্যাদি, একাডেমীতে আগন্তুক প্রবেশের কারণ ও প্রয়োজন সম্পর্কে সঠিক তথ্য রাখা, ও এসব নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, একাডেমীর মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া কোনো আগন্তুক প্রবেশ করতে দেওয়া ঠিক না। পাশ্চাত্যে ব্যক্তিগত কারণে অফিসে ফোন ব্যবহার করা যায় না, অফিসিয়াল সব কল রেকর্ড করা হয়, যেন প্রয়োজনে বাজিয়ে শোনা যায়। অফিসে বসে চা, ধূমপান ও খাওয়া দাওয়া করা যায় না, চা বিরতি ও দুপুরের খাওয়ার সময় নির্ধারিত ক বা কেন্টিনে যেয়ে অফিসের পরিচালক থেকে নিম্নতম কর্মচারী পর্যন্ত সবার একসঙ্গে বসে খেতে হয়। কোনো পিওন নেই, চেম্বার নেই এসব দেশে। বাংলা একাডেমী এগুলো অনুসরণ করে অন্যান্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।

একাডেমীর ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ যে কাজটি করে, অর্থায়ন করলে যে কোনো একটা ভালো লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকও তা করতে পারে, এজন্য এতো বড় প্রতিষ্ঠানের দরকার নেই। তার চেয়ে বরং, বিগত বছরে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা ও দৈনিকের সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত ভালো লেখাগুলি নির্বাচন, এবং ঐসব লেখা নিয়ে গবেষণাধর্মী মূল্যায়ন করে একটা বাৎসরিক সংকলন প্রকাশ করতে পারে একাডেমী। তাহলে এটার একটা তাৎণিক মূল্য থাকবে, এতে লেখক পাঠক ও সম্পাদক সবাই উপকৃত হবেন। এক সংখ্যা উত্তরাধিকার প্রকাশ করতে ওভারহ্যাডসহ প্রতিষ্ঠানের কত খরচ হয়, বিক্রি কত হয়, তা থেকে পাঠক কতটুকু উপকৃত হন, এর উপযোগিতা কতটুকু, অপচয় হচ্ছে কিনা, এসব খতিয়ে দেখা দরকার, একটা প্রতিষ্ঠানের কাজ প্রতিষ্ঠানের মতোই হওয়া উচিত। পত্রিকাটি আন্তর্জালে রাখা হলে আরো বেশি পাঠকের সংস্পর্শে আসতে পারে, বাংলাদেশের বাইরে এখন প্রচুর পাঠক রয়েছে, যাদের কথা একাডেমী কর্তৃপ ভাবতে পারেন। একাডেমীর বইয়ের তালিকা আন্তর্জালে দেয়া হলে এবং অনলাইনে বই বিক্রির ব্যবস্থা থাকলে, তাৎণিকভাবে না হলেও, নিকট ভবিষ্যতে এটার একটা সুফল একাডেমী পেতে পারে। parabaas.com-এর মতো ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে টিকে রয়েছে, একাডেমী সামান্য উদ্যোগ নিলেই এটা সম্ভব হতে পারে।

ব্রিটেনের হাজার হাজার লাইব্রেরিতে প্রচুর বাংলা বই রয়েছে, সেসবের নিরানব্বই ভাগই কলকাতার বস্তাপচা অপাঠ্য ও হুমায়ূন আহমেদের মতো বাণিজ্যিক লেখকের বই। বাংলা একাডেমী শুধু নিজেদের প্রকাশিত বইই নয়, অন্যান্য প্রকাশকদের ভালো বই পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এর  অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অকৃত্রিম অনুরাগী ড. উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে এ কাজটা করা যেতে পারে। একটা প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ, কিন্তু অগ্রাধিকার নির্ণয় করা মনে হয় জরুরি, যে প্রতিষ্ঠান ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় যায় না, ওরা লন্ডনে এসে মেলা করে যায়, যার খবরও অনেকে জানে না! একাডেমীর এসব খবর আন্তর্জালের মাধ্যমে জানাতে অর্থের অথবা মেধার প্রয়োজন হয় না।

তিন দশক আগেও বাংলা একাডেমী বিশ্বসাহিত্যের অনেক ভালো অনুবাদ করিয়েছে, সে সময় অনুবাদ সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা ছিল সীমিত, যে কারণে জলমূল্যে সেসব বই পরে বিক্রি করতে হয়েছে, এখন অনুবাদ সাহিত্যের পাঠকসংখ্যা অনেক বেড়েছে, অথচ একাডেমীর অনুবাদ চোখে পড়ে না! হাজারটা অনুল্লেখ্য বই না করে একটা ভালো অনুবাদ প্রকাশ অনেক বেশি আবশ্যিক। ভালো অনুবাদকের জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার থাকা প্রয়োজন, অনুবাদ একটি অত্যন্ত পরিশ্রম-সাপে কাজ, সৃষ্টিশীলও বটে। লেখক ও পাঠকের আন্তর্জাতিক রুচি অর্জনের জন্য বিশ্বসাহিত্য পড়া অত্যন্ত জরুরি, না হলে বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক বলয়ে নিয়ে যাওয়া বরাবরের মতো সুকঠিনই থেকে যাবে। একসময় পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাভাষীদের বৃত্তি দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় নিয়ে রুশ সাহিত্যের অনুবাদ করিয়েছিলেন তখনকার রুশ প্রশাসন, রাদুগা প্রকাশনের অনেক অনুবাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ, এতে রুশ ও বাংলা, উভয় সংস্কৃতিই লাভবান হয়েছে। বাংলা একাডেমী কি বছরে পাঁচ দশ জন ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী অনুবাদককে বৃত্তি দিয়ে বাংলাদেশে এনে এ কাজটা করাতে পারে না? বৃত্তিগুলো অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে বিনিময়ভিত্তিকও হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের কিছু সাহিত্যিক বিদেশে অনুবাদের জন্য যাওয়ার সুযোগ পাবেন, এবং বাংলা ভাষাও আরো সম্বৃদ্ধ হবে। এক্ষেত্রেও ড. রাদিচের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। তিনি বাংলা সাহিত্যের জন্য আজীবন কাজ করছেন, আমার ধারণা একাডেমীকে সহায়তা দিতে তিনি সম্মত হবেন।

একুশে বইমেলা শুরু করেছে প্রকাশকেরা, বাংলা একাডেমী এটার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এটাকে বর্তমান রূপে আসতে সহায়তা দিয়েছে, এজন্য সাধুবাদ নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানেই যেমন সে-অর্থে ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ বলে কোনো কার্যকর শাখা নেই, একাডেমীরও মনে হয় একই অবস্থা, যে ঘাটতিগুলো রয়েছে সেগুলো পূরণের জন্য গবেষক ও চিন্তাবিদেরা কী করছেন, নতুন সংযোজন কী করেছে, সেসব তথ্য পাঠকের জন্য থাকা উচিত, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানেরই ‘মিশন ও ভিশন স্ট্যাইটমেন্ট’ সহজলভ্য নয়! উন্নত বিশ্বে প্রকাশনা একটা শিল্প, বাংলাদেশে এটাকে শিল্পরূপ দেওয়ার জন্য গবেষণা বাংলা একাডেমীকেই করতে হবে, লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে যোগসূত্র রাকারী একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব দেশে, যারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, লেখকের বইয়ের মান বিবেচনা করে সেটা সম্পাদনা, উন্নয়ন, বাজার যাচাই প্রভৃতি করে প্রকাশকের কাছে পাঠায়, যদি বইটির সম্ভাবনা না থাকে অথবা মুদ্রণউপযোগী না হয় তাহলে লেখককে ফিরিয়ে দেয়। কমিশনের বিনিময়ে এ কাজটা বাংলা একাডেমী করতে পারে, এতে একাডেমীর কাজের মানুষেরা অকাজের হতাশার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ পায়, এবং কিছু আয়ও হয়। মুক্তবাজার বিশ্বে শুধু সরকারের দেওয়া অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকলে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের তল্পিবাহক হতেই হবে, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রতিষ্ঠানের একটা অর্থনৈতিক ভিতও দাঁড় করাতে হবে।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে, বাংলা সাহিত্যের জন্য একাডেমী যা করতে পারে, অন্য কেউ তা পারে না। অথচ এর কর্ণধারেরা মতাসীন সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করেছে, বাংলা একাডেমীকে কেন দলীয় সরকারের অনুগ্রহভাজনদের পুরস্কার দিতে হবে! ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু ব্যতিক্রমই তো সব না, এই যে বাজারি ও রাজনৈতিক, তল্পিবাহক তথাকথিত সাহিত্যিকদের বছর বছর একাডেমী পুরস্কার দেয়া হয়, এটা নিয়ে লেখক ও প্রকাশকরা এখনও প্রশ্ন তুলছেন না কেন, এটাও একটা গবেষণার বিষয়। লেখকেরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন না, কিন্তু লেখার মাধ্যমে হতে পারে তাঁদের আন্দোলন। একাডেমী কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নয় যে তাদের খেয়াল খুশিমতো অযোগ্য লেখকদের পুরস্কৃত করা হবে। এখানে অবশ্যই স্বচ্ছতা আনতে হবে, পুরস্কার নির্বাচকদের তালিকা প্রকাশ্য হতে হবে, দেশের মেধাসম্পন্ন লেখকদের সমন্বয়ে তা গঠিত হতে হবে। পুরস্কার দেওয়ার স্বচ্ছ অনেক পদ্ধতির মধ্যে এমন একটাও হতে পারে, পঞ্চাশজন যোগ্য নির্বাচকের একটা প্রকাশ্য প্যানেল থাকবে, শর্টলিস্টেড দশটি বই এঁদের প্রত্যেককে দেওয়া হবে, প্রত্যেকেই মার্কিং করবে, তা থেকে প্রতিটা বইয়ের জন্য দশজন নির্বাচক নির্বাচন করবে কম্পিউটারে, এঁদের গড় মার্কিংয়ে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত বইটি পুরস্কার পাবে। এতে প্রতিটি বইয়ের জন্য একটা ভিন্ন নির্বাচক সেট তৈরি হচ্ছে, ফলে নির্বাচকদের প্রভাবিত করার বিষয়টি যেমন থাকবে না, প্রকাশ্য হওয়ায় স্বচ্ছতাও থাকবে। পুরস্কারটি মেলার আগে দেয়া হলে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকও বইটির ভালো রয়্যালটি পেয়ে কিছুটা উপকৃত হবেন। পুরস্কারের অঙ্ক অবশ্যই বাড়াতে হবে, যেনো ঐ লেখক বাকি জীবন অন্য কাজ না করে শুধু লেখালেখি করে নিজের ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটাতে পারেন। রাষ্ট্র যদি ডজন ডজন খেলোয়াড়কে ফ্যাট ও দামী গাড়ি উপহার দিতে পারে, ঢালাওভাবে সাংসদদের কোটি কোটি টাকার কর রেয়াত দিতে পারে, একজন লেখককে পুরস্কার হিসেবে পঞ্চাশ লাখ টাকা নয় কেন?

অবশ্য এটা কেউ কখনোই দাবি করবে না যে, সবসময় সকল কিছু পুরোপুরি সঠিক ও নিরপে হবে। নোবেল কিংবা বুকার নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে, নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটিতে গুন্টার গ্রাসের একদা বন্ধু ও পরে শত্রু, বিখ্যাত গ্রুপ ফোর্টিসেভেনের মার্সেল রানিস্কি বছরের পর বছর নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটিতে নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করে গুন্টারের নোবেল প্রাপ্তি ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, এটা একটা ব্যতিক্রম, বাংলাদেশে মনে হয় ব্যতিক্রমই কানুন! বাংলা একাডেমীকে এখান থেকে বের করে আনার জন্য লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সম্মিলিত পদপে নিতে হবে।

বইমেলায় প্রতি বছরই বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়ছে! বইয়ের সংখ্যা নয়, মান দেখা জরুরি, উৎকর্ষহীন সংখ্যাধিক্য কারো কাম্য হতে পারে না, এককে এক দিয়ে শতসহস্রবার গুণ করলেও ফলাফল একই থেকে যায়। এত বই বেরুচ্ছে প্রতি বছর, মানসম্পন্ন বই কটি? প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দিয়ে মেলায় স্টল পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়, এখানে বইয়ের মান অবশ্যই দেখা উচিত। বইমেলা শেষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা নিজেদের লেখক নিয়ে সেরা বইয়ের তালিকা প্রকাশ করে, খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো একটি বই একাধিক পত্রিকার নির্বাচনে সাধারণ রয়েছে, এতেই বোঝা যায় তাদের নির্বাচনের মাপকাঠি কী! এতে পাঠক ও লেখকের কোনো উপকার হয় কিনা জানি না। নিরপে ও সৃষ্টিশীল লেখকদের একটা প্রকাশ্য কমিটি করে পাঠকদের জন্য কয়েক শো বইয়ের একটা তালিকা প্রস্তুত করে দিতে পারে বাংলা একাডেমী, যেনো পাঠক ভালো বইটি বেছে নিতে পারেন। একটি শর্টলিস্ট প্রকাশ করতে পারে, যেখান থেকে পরের বছর সেরা বইটিকে পুরস্কৃত করা হবে, এক বছর আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকায় শর্টলিস্ট থেকে কোনো ভালো বই বাদ গেলে কিংবা কোনো অযোগ্য বই শর্টলিস্টেড হলে পাঠক তা জানতে পারবেন, এবং পরের বছর এটি শর্টলিস্টেড হতে পারবে। পুরস্কার দেওয়ার জন্য বইয়ের প্রকাশকাল কোনো বিষয় নয়, ‘দ্য টিন ড্রাম’ প্রকাশের চল্লিশ বছর পর এটার জন্য নোবেল পেয়েছিলেন গুন্টার গ্রাস!

শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়া করার প্রতিভা মনে হয় আমাদের মজ্জাগত, বইমেলায় প্রকাশের জন্য গৃহীত বইয়ের একটা সময়সীমা থাকা উচিত। মেলা শুরু হওয়ার আগেই প্রকাশিত বইয়ের কপি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলা একাডেমীতে জমা দিতে হবে। এর পরে প্রকাশিত বই কোনো অবস্থায় মেলায় আনা যাবে না। তাহলে প্রকাশনা শিল্পের ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি অকারণে বইয়ের প্রকাশ খরচ বাড়বে না। এখন মেলার আগে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকাশকদের বাড়তি ব্যয় করতে হয়, চূড়ান্তভাবে যা পাঠকেরাই বহন করে। মেলার তারিখ সবারই জানা, তাহলে এ কাজটা আগে করতে দোষ কোথায়? মেলার কমপে এক সপ্তাহ আগে বাংলা একাডেমী মেলায় প্রকাশিতব্য বইয়ের তালিকা প্রকাশ করতে পারে, পুস্তিকার আকারে, এবং আন্তর্জালে, তাহলে পাঠক ভেবেচিন্তে বই নির্বাচন করতে পারবেন, ভোগান্তি কম হবে, ভালো বই বিক্রি বাড়বে। এসব বিষয়ে প্রোফেশনালিজমের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক ও প্রকাশকদের চুক্তি বিষয়ে সম্প্রতি কিছু আলোচনা ল করা গেছে, এটা একটা শুভ প্রচেষ্টা। চুক্তি থাকাটা জরুরি, কিন্তু চুক্তিটাই সব নয়, অন্তত বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে এটার সামান্য মূল্যই দেওয়া হয়। অগ্রসর দেশে ‘স্ট্যাটিউটরি রাইটস’ বলে একটা কথা আছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একটা আইন পাস করতে পারে, যাতে লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে লিখিত কোনো চুক্তি থাকুক বা না থাকুক, একটা বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, ন্যূনতম কিছু দায় ও অধিকার লেখক ও প্রকাশক উভয়েরই থাকবে। স্ট্যাটিউটরি রাইটস-এর আওতায় রতি অধিকারের মতো এখানেও লেখক ও প্রকাশকের অধিকার সংরতি থাকবে। সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনেক হয় বাংলাদেশে, লেখক ও প্রকাশদের সঙ্গে নিয়ে প্রোফেশনাল কিছু হতে দেখা যায় না, এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে আসার জন্য বাংলা একাডেমী উদ্যোগী হতে পারে।

অসংলগ্ন ও বিপ্তিভাবে কিছু কথা বলা হলো, এসব নতুন নয়, অনেকেই অনেকভাবে বলেছেন, কিন্তু এসবের প্রতি সামান্য আগ্রহও দেখানো হয় না, আজ হোক, কাল হোক, কাজগুলো আমাদের করতে হবে, দেরি না করাই সঙ্গত মনে হয়। বাংলা একাডেমী থেকে যেমন রুচিশীল ভালো বই বেরুতে পারে, উন্নত মানের গবেষণা হতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের আদর্শ সৃষ্টি করা যেতে পারে, তেমনি সুস্থ ও চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করে জাতির মানস গঠনে একটা ভালো ভূমিকাও রাখা যেতে পারে, রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটুকু আশা মনে হয় না খুব বেশি কিছু!

বাংলাদেশ সময় ০০২০, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।