ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আবদুশ শাকুর : লেখকের জন্মদিনে

স্বকৃত নোমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১১
আবদুশ শাকুর : লেখকের জন্মদিনে

“বোধের উন্মোচন থেকেই আমি অনুভব করে আসছি-- আবদুশ শাকুর যেন তাঁর সহজাত প্রবণতাগুলো নিয়ে ঠিক ততখানি প্রতিকূল ভুবনেই জন্মেছে যতখানি অনুকূল ভুবনে জন্মেছেন, ধরুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপারটার শাখাপ্রশাখায় বিচরণ না-করে এখানে আমি কেবল কাণ্ডখানির দিকে ইঙ্গিত করেই ক্ষান্ত হবো : কর্ণে সুর আর তাল বেজে উঠতেই আমাকে বুঝতে হলো যে, আমি একটি ঐতিহ্যবাহী আলেম খান্দানের সদস্য।

অতঃপর কণ্ঠে ভাষা ও ছন্দ ফুটে উঠতেই আমাকে জানতে হলো যে, আমি ‘স্বনামঘৃণ্য’ একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষ এবং অবোধ্য এক উপভাষাভাষী। ”

উপর্যুক্ত কথাগুলো কথাশিল্পী আবদুশ শাকুরের স্মৃতিকথামূলক রচনা ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’র একটি অংশ। ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন। কিছু কিছু মানুষ আছেন, সাধারণের জন্মদিনের চাইতে যাঁদের জন্মদিন খানিকটা আলাদা। বিশেষ। আবদুশ শাকুরও সেই বিশেষ মানুষ আর তাঁর জন্মদিনও বিশেষ। সে কারণেই এই নিবন্ধের অবতারণা। কিন্তু নিবন্ধটি কীভাবে শুরু করা যায় তা কিছুতেই ভেবে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে তাঁর রচনা থেকে উদ্বৃতি দিয়েই সূচনাটা করা গেল। অবশ্য তা প্রাসঙ্গিক। কেননা, তাঁর জন্মদিনকে উপলক্ষ করেই যেহেতু এই নিবন্ধ, সেহেতু তাঁর আত্মজীবনী থেকে জন্মবৃত্তান্তের খানিকটা ব্যবহার করাটা সমীচীন বলেই মনে হয়েছে।

আগেই জানানো হয়েছে, একটি ঐতিহ্যবাহী আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন আবদুশ শাকুর। পিতা মকবুল আহমাদ ও মাতা ফায়জুন্নিসা। পিতা ছিলেন একাধারে সাহিত্য-সঙ্গীত ও রাজনীতি মনস্ক। আরবি, ফার্সি এবং উর্দু এ তিন ভাষাতেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। উর্দু ও ফার্সিতে অবলীলায় শের রচনা করতেন। কারুকার্যময় কণ্ঠে গাইতেন হাফিজ, গালিব, আমিরের কাসিদা ও গজল এবং মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমির মসনভি। আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাকে প্রথম সবক অ-আ-ক-খ নয়, আলিফ-বে-তে-সে পড়তে দেওয়া হয়েছিল। আর যখন তাকে কোরানের সবক দেওয়া হয় তখন তিনি একেবারেই ছোট। খেলার আসর থেকে তুলে এনে অজুর পরিবর্তে গোসল করিয়ে কোরান পড়তে দেওয়া হতো।
অপরদিকে, ‘স্বনামঘৃণ্য’ একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষ বলে নিজেকে দাবি করেছেন তিনি। কারণ, ১৯৪১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি যে-জেলার যে-গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার রামেশ্বরপুর গ্রাম, সেখানকার মানুষদের বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষরা একটু ঘৃণার চোখেই দেখে বটে; যদিও অদ্যাবধি আবিষ্কার করা যায়নি সেই ঘৃণার কারণটা কী। দুর্বোধ্য উপভাষা ব্যাবহারের জন্য, আচার-আচরণে গ্রাম্যতা প্রকাশ পায় সেজন্য, নাকি ঈর্ষণীয় মেধার জন্য? সঠিক হেতু বোঝা দায়। অনুসন্ধান করতে হবে। তবে এ কথা সত্য, সেখানে ধর্মের নামে অধর্ম বেশি হয়, সেখানকার পাড়ায় পাড়ায় মজিদদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সেখানকার মানুষরা সংস্কৃতি বলতে বোঝে সেই মরুসংস্কৃতি। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করে না তারা। রবীন্দ্রনাথ কি লালন তাদের কাছে গুরত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়ানো একজন মজিদ। ফলে আজকে যে আবদুশ শাকুরকে আমরা চিনি-- কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীতজ্ঞ আবদুশ শাকুর-- এ গুণাবলি কি প্রতিভা অর্জনের জন্য তাঁকে যে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

সে যাই হোক, ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’, আমরা এই বাণীতে আস্থাবান। সুতরাং আবদুশ শাকুর তার জন্মভূমিকে ‘স্বনামঘৃণ্য’ বলুন কি ‘স্বনামখ্যাত’ বলুন তাতে তাঁর পাঠক কি ভক্তসাধারণের কোনো ক্ষতি নেই।

দুই.
আবদুশ শাকুরের প্রধান পরিচয় তিনি একজন কথাশিল্পী। আজকাল কথাশিল্পীর অভাব নেই। পত্রিকার পাতা উল্টালে শত শত ‘কথাশিল্পী’র খোঁজখবর পাওয়া যায়। বইমেলার একমাস জুড়ে এইসব ‘মৌসুমী কথাশিল্পী’দের বইয়ের নানা চটকদার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। দু কলম লিখতে পারলেই হলো, পদবি হিসেবে নামের শেষাংশে যথারীতি এই অভিধাটি জুড়ে দেয় তারা। আমাদের দেশে এরকম ভূরি ভূরি ‘কথাশিল্পী’ রয়েছেন। আবার কেউ হয়তো ‘কাহিনী’ নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু পরিচয় দেন শিল্পী হিসেবে। ‘কাহিনীকার’ ও ‘কথাকার’ এই দুটি শব্দের মধ্যে যে তফাৎ রয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করেন না। কিংবা করেন। জানেনও। কিন্তু জেনেও ‘শিল্পী’ হওয়ার লোভটাকে কিছুতেই সামলাতে পারেন না। বস্তুত কথাশিল্পী তাঁরা, যাঁরা কথার মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করেন। আর এ সৃষ্টিকর্ম মোটেই সহজ নয়, একটা দুরুহ কাজ। আবদুশ শাকুর এই দুরুহ কাজের কাজী, শিল্পী। কথার মাধ্যমে তিনি নিরন্তর শিল্প সৃষ্টি করে চলেন। তার গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা কি রসরচনায় আমরা এই শিল্পের সন্ধান পাই।
 
আবদুশ শাকুর তাঁর লেখায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি করে চলেন। তাঁর লেখার মাধ্যমে আমরা গতানুগতিক শব্দের বাইরে অনেক নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। যেমন, ‘স্বনামখ্যাত’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, কিন্তু ‘স্বনামঘৃণ্য’ শব্দটি একেবারেই নবসৃষ্টি। ‘সুন্দরী’র চাইতে ‘সুন্দরীশ্রেষ্ঠা’ শব্দটি শুনতে বেশ লাগে; যেমন লাগে একেবারে নতুন কোনো জিনিসকে ‘ঝাঁচকচকে’ বললে বা স্নেহের আধিক্য বোঝাতে ‘স্নেহকোমল’ শব্দটি ব্যবহার করলে। ‘কথাশিল্পী’ শব্দটি জানি, কিন্তু ‘কথাকার’ শব্দটি তাঁরই সৃষ্টি। কিংবা ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’র এক জায়গায় তাঁর গ্রামকে তিনি ‘কথাশিল্পীপাড়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং ‘আত্মঘাতী’র বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘পরঘাতী’ ব্যাবহার করেছেন। শব্দদ্বয় যে তাঁরই উদ্ভাবিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর সৃষ্ট এরকম বহু নতুন নতুন শব্দের উদাহরণ দেওয়া যাবে।

আবার দেখা যায় অনেক অপ্রচলিত অথচ প্রাসঙ্গিক কিছু শব্দকেও তিনি তাঁর লেখায় অনায়াসে একাঙ্গীভূত করে নিচ্ছেন। তাতে পাঠকের কোনো অসুবিধা হয় না। বরং এককালে বহুলপ্রচলিত অথচ বর্তমানে অবহেলিত সেই শব্দটি পাঠকের কাছে শ্রুতিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। যেমন, বদনসিব, ফরজন্দ, তাহ্জীব, খান্দান, গুণক, গাইয়ে(গায়ক), বয়স্য ইত্যাদি। এতে শব্দ হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং পাঠকালে পাঠকেরও শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। মূলত সাহিত্যিক বা কথাশিল্পীর কাজ তো এটাই। একটা গল্প বা উপন্যাস লেখা মানে তো নিছক কোনো কাহিনী লিখে যাওয়া নয়। কাহিনী তো কারো মুখ থেকেও শোনা যায়; কৈশোরে যেমন দাদা-দাদী কি নানা-নানী তাদের প্রিয় নাতি-নাতনীদের শোনান। কিংবা রেডিও টিভির নাটক দেখলেও কাহিনীটা বোঝা সম্ভব হয়, আলাদা করে সাহিত্য পাঠের প্রয়োজন কী? প্রয়োজন এই জন্য যে, পাঠক নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে, ভাষার সঙ্গে পরিচিত হবে। একটা সহজ কথাকে শব্দপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে কতটা শৈল্পিক করে তোলা যায় একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে সে বিষয়টাই গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আবদুশ শাকুর করে থাকেন। তার ভাষা কতটা শৈল্পিক ও সুখপাঠ্য, তা বোঝানোর জন্য ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’ থেকে আরেকটি উদ্বৃতি দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছি :

“প্রকৃতির শক্তির রূঢ় রূপটি প্রত্যক্ষদর্শনের জন্যে শিশুদেরও-যে অমাবস্যা-পূর্ণিমার গর্জমান জোয়ারের গগনচুম্বী তরঙ্গভঙ্গ দেখাতে স্কুল ছুটি দিয়ে কেন নিয়ে যাওয়া হতো মেঘনা নদীর ধারে, সে গূঢ়তত্ত্বটি আজো আমার পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। তাছাড়া, ওটা কি নদী? ও তো বলতে গেলে সাগর-মহাসাগরের সঙ্গে একাকার একটা ব্যাপার। আমাদের দক্ষিণে আর স্থল কোথায় মেরু পর্যন্ত? থাকলেও দৃশ্যমান তো নেই। ক্লাস-সিক্সের বছরই আষাঢ়ী কি আশ্বিনী পূর্ণিমায় বছরের বৃহত্তম জোয়ারটির প্রলয়ঙ্কর হুঙ্কার ছেড়ে জঙ্গিবিমানের গতিতে ধেয়ে-আসা ধবলগিরি-সমান দুগ্ধফেননিভ, দংশনোদ্যত সাপের ফণার মতো, উত্তুঙ্গ প্রথম ঢেউটি আমাকে জগজ্জীবনে মানবের মৌল ক্ষুদ্রত্ব সম্বন্ধে প্রথম সজাগ করে তোলে”।

আবদুশ শাকুর সমকালীন বাংলা ভাষার শক্তিশালী লেখক, কিন্তু তার পাঠকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তারাই তাঁর পাঠক, যারা প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে খানিকটা অগ্রগামী, ভাষাচর্চাটা যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, বই পড়ে যারা কিছু পেতে চান মূলত তারাই তাঁর বই কেনেন এবং পাঠ করেন। শস্তা কোনো লেখা লেখেন না তিনি। তাই তাঁর পাঠকরাও শস্তা নন। অনেকে আবদুশ শাকুরের লেখার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ আনেন। এ শ্রেণীটির কাছে বিনীত প্রশ্ন, আবদুশ শাকুরের লেখা যদি দুর্বোধ্য হয় তবে কমলকুমার মজুমদার কি দেবেশ রায় বা সেলিম আল দীনের লেখা কী? তাঁদের কি আপনারা ঔপন্যাসিক বা নাট্যকার হিসেবে খারিজ করে দিতে পারবেন? আবদুশ শাকুরের লেখা যাদের কাছে দুর্বোধ্য বলে মনে হয় সাহিত্যপাঠের কোনো যোগ্যতা তাদের আছে কিনা তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে বৈকি!

তিন.
বাংলা ভাষা নিয়ে এখন একটা নৈরাজ্য চলছে। যে যে-ভাবে পারছে আমাদের এই মাতৃভাষাটিকে বলাৎকার করে চলছে। দেশের কয়েকজন ভাষাবিদ কি আধা-ভাষাবিদ বুদ্ধিজীবী বা লেখক এই ভাষানৈরাজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমাদের ভাষাচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বাংলা একাডেমীও কম যায় না। তারাও গবেষণাহীন ইচ্ছেমতো শব্দের ওলট-পালট ঘটিয়ে ছাড়ছেন। বিশেষ করে ঈ-কার এবং ই-কারের বিরুদ্ধেই তাদের মূল সংগ্রাম। এই দুটি কার-ই যেন বাংলার ভাষার প্রধানতম সমস্যা! এটা যে একটা নৈরাজ্য তাতে সন্দেহ কী? ভাষাকে সহজীকরণের নামে এই নৈরাজ্যকে আবদুশ শাকুর সচেতনভাবে পাশ কাটিয়ে চলেন। তাঁর একটা আলাদা ভাষা আছে, যে ভাষায় আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিকগণ লিখে গেছেন। তিনি শুধু সেই ভাষাতে লেখেনই না, ভাষা নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে তার বিরুদ্ধেও তিনি ক্রমাগত সোচ্চার। উদাহরণ হিসেবে তাঁর ‘যুবতির কাহিনি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে : “বাংলার যুবতী পেছন থেকে পেঁচিয়ে দীর্ঘ-ঈকারের শাড়ি পরত। নিতম্বিনী শব্দটিকে বেশ দেখাত। সম্প্রতি বাংলাভাষার কোষকার-কার্টেলটি যুবতীর পশ্চাদ্দেশ থেকে ঈ-কারের শাড়িখানি খুলে নিয়ে তার বদেশে ই-কারের ওড়না ঝুলিয়ে দিয়েছে। কারণ দর্শিয়েছে ‘যেসব বানানের একাধিক রূপ প্রচলনে আছে, তার থেকে একটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। অনেক সংস্কৃত শব্দের একাধিক শুদ্ধ রূপ আছে-- দারিদ্র্য, দারিদ্র ; যুবতি, যুবতী’। আমি বলি, সেই বেছে নেওয়ার কাজটি বিংশ শতাব্দের প্রথমার্ধেই হয়ে গিয়েছে। বাছাই শব্দ দুটি হল : ‘দারিদ্র্য ও যুবতী’ এবং সেই থেকে রূপটি প্রচলনেও রয়েছে। অতএব, একই অজুহাতে বানান-দুটির পুনর্বদল অনাবশ্যক। প্রচলিত বানানে অহেতুক অপশান বাড়ানোর পরিণামে বানানের পরিচ্ছন্ন অঙ্গনটি জঙ্গুলে হয়ে উঠবে। এ ধরনের কাজকে বলে নন্-ওয়ার্ক অর্থাৎ ন-কাজ, যা ক্ষেত্রবিশেষে কু-কাজের অগ্রজসম। ....আমি সঘন সংস্কারের মোহে না পড়ে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি রাজশেখর বসু, আবদুল ওদুদ, শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, মিলন দত্ত, অমলেন্দু মুখোপাধ্যায় (সং. ১৯৯৫), ঋষি দাস (সং. ১৯৯৮) ও সর্বাধুনিক ইংরেজী-বাংলা আভিধানিক গৌরীপ্রসাদ ঘোষ (সং. ১৯৯৯) প্রমুখ পদাঙ্কিত সদর সড়কেই রয়ে গিয়েছি। অন্য কথায় আমি সংসদ্ অভিধানের চতুর্থ সংস্করণের ‘বাঙালী’ই আছি, পঞ্চম সংস্করণ কর্তৃক সংস্কৃত হয়ে ‘বাঙালি’ বনে যাইনি। ”

আবদুশ শাকুর ঠিকই বলেছেন যে, ভাষা একটা ‘ইনার্ট প্রোসেস’ অর্থাৎ অতৎপর প্রক্রিয়া। সে চলতেই থাকে, আনমনে। চলার পথে তার গায়ে অনেক কিছুই লাগে, কোনোটা থাকে কোনোটা থাকে না। তাতে তার নিজের কোনো মর্জি নেই, তাই অন্যের বেশি মর্জিও থাকতে নেই। অথচ বানান সংস্কারের নামে বাংলা বানানে যখন তখন কমিটি বসছে, নসিহত হচ্ছে, হস্তক্ষেপ চলছে। আবদুশ শাকুর এইসব কমিটি, ওসিহত-নসিহতকে পাত্তা দেন না, ভাষা নিয়ে কোনোরকম ছাড় দিতে তিনি নারাজ। এতই যে, প্রতি বছর তাঁর যখন বই বের হয়, তখন তিনি প্রুফ দেখানোর জন্য কখনো প্রুফরিডারকে বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেন না, কষ্ট হলেও নিজেই দেখেন। এবং পাণ্ডুলিপির সফট কপিও প্রকাশককে হস্তান্তর করেন না, একেবারেই নিজদায়িত্বে সরাসরি ট্রেসিং বের বরে তারপর প্রকাশকের হাতে তুলে দেন। কারণ, পাছে যদি কোনো শব্দের ওলট-পালট ঘটে যায়! এই হচ্ছে আবদুশ শাকুরের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ লেখালেখিটা তাঁর কাছে কোনো শখের বিষয় নয়, এটা একটা রিচুয়্যাল, জীবনেরই একটি অংশ। তাঁর লেখায় শব্দচয়ন, বাক্যের গঠন ও বক্তব্যের মেজাজে মুন্সিয়ানা অগ্রসর পাঠকরাই কেবল ধরতে পারেন। তাঁর চর্চিত এই ভাষা নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় বটে। যে ভাষানৈরাজ্য চলছে, সেক্ষেত্রে তাঁর ভাষা হতে পারে আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

অপরদিকে, আবদুশ শাকুরের প্রবন্ধ মানেই নতুন কিছু, নতুন আস্বাদ, নতুন অভিজ্ঞতা। যে বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রবন্ধ রচনা করেন, সে বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করেন বৈশ্বিক জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থাৎ একককে বিশ্লেষণ করেন সমগ্র দিয়ে। ফলে তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধ হয়ে ওঠে তথ্য ও তত্ত্ববহুল, সুখপাঠ্য। কারণ, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখলেও তিনি কেবল তাতেই স্থির থাকেন না, জ্ঞানের বিভিন্ন উপাদানকে বিষয়ের সঙ্গে একাঙ্গীকরণে তার দক্ষতা অভিভূত হওয়ার মতো। তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধই বিষয়, ভাষা ও শৈলীর দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মননশীল পাঠকের জন্য তৃপ্তিদায়ক, প্রজ্ঞার উৎকর্ষের সহায়ক। এবারের বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘আবদুশ শাকুরের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ শীর্ষক একটি বই। এই বইতে সংকলিত প্রবন্ধগুলোর বিষয়ও অভিনব। এসব বিষয়কেন্দ্রিক প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে দুর্লভই বলা চলে। পাঠেই বোঝা যাবে, এমন পরিশ্রমলদ্ধ কাজ একমাত্র জ্ঞানযোগী আবদুশ শাকুরের পক্ষেই সম্ভব। ‘স্বদেশী রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথের মৌলিক, গভীরচারী ও সুদূরপ্রসারী সমাজচিন্তা ও স্বদেশভাবনার ওপর স্বচ্ছ আলো ফেলে। ‘মৃতুহীন রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধটি পরিবেশবাদের অগ্রপথিক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করে। ‘কবিগুরুর চিরস্থায়ী গালমন্দ’ প্রবন্ধটির মেসেজ হল গুরুদেবও মানুষ ছিলেন। বিভূতিভূষণের উপন্যাস ও সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালি’, বাংলা কাব্যগীতি ও হিন্দুস্তানী রাগসংগীত, গজল এবং ফুলবিষয়ক চয়িত প্রবন্ধগুলিও পাঠকের জন্য নতুন দিক নির্ণায়ক। বিশেষত তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ আমাদের জাতীয় ফুল সম্পর্কিত প্রবন্ধটিকে তো স্বক্ষেত্রে এককই বলা চলে। এসব জটিলতর বিষয় নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না। আবদুশ শাকুরের এই শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আমাদেরকে বারবার এসবের কাছে ফিরে যেতেই হবে।

চার.
আবদুশ শাকুর শুধু বাংলা ভাষাবিদই নন, একই সঙ্গে প্রাচ্যের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতেও, আরবি, ফারসি, উর্দু, সমান দক্ষ। তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ বইটিতে পারস্যের মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমি ও প্রগতিবাদী উর্দু কাব্যের নারীকবিদের নিয়ে তাঁর যে উজ্জ্বল অনুবাদ এবং প্রাঞ্জল আলোচনা, তা আমাদেরকে প্রাচ্যের দুটি দেশের সাহিত্য সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেয়। একই সঙ্গে তিনি ইংরেজি ভাষাতেও সমান দক্ষ। ফলে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিকের বাইরে তাঁর আরেক পরিচয় তিনি বহুভাষাবিদ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার পর বাংলা সাহিত্যে আবদুশ শাকুরের মতো বহুভাষাবিদের সংখ্যা খুব যে বেশি নেই-- এটা অত্যুক্তি কিনা সেই ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হলো।

রম্য বলি কি রসরচনা বলি, এ ধারার রচনাতে তো আবদুশ শাকুর প্রধানতম। লেখায় রসসৃষ্টিতে তার যে দক্ষতা তা সমকালে অন্য কারো আছে কিনা গবেষণার বিষয়। সত্যিকার অর্থে আমাদের রম্যসাহিত্য দীর্ঘদিন ধরে একটা তীব্র কাতরতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। রম্য, অথচ পড়তে গেলে কান্না আসে! কাতরতার এতই তীব্রতা! সেক্ষেত্রে সাহিত্যের এ জেনরে আবদুশ শাকুরের বিকল্প এখনো পর্যন্ত কেউ দাঁড়াতে পারেনি। আর সঙ্গীতজ্ঞ আবদুশ শাকুর সম্পর্কে এই নিবন্ধে নাই-বা বলা হলো। অন্য নিবন্ধে অন্য কোথাও লেখার ইচ্ছে আছে।

সবশেষে এই যশস্বী লেখকের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য দিয়ে নিবন্ধের ইতি টানছি। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস : ক্রাইসিস, সহে না চেতনা, উত্তর-দক্ষিণ সংলাপ, সংলাপ, ভালোবাসা। ছোটগল্প : ক্ষীয়মাণ, ধস, বিচলিত প্রার্থনা, গল্পসমগ্র, আঘাত, শারীরী, এপিটাফ, শ্রেষ্ঠগল্প, নির্বাচিত গল্প। প্রবন্ধ : মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গীত সংবিৎ, গোলাপ সংগ্রহ, সমাজ ও সমাজ বিজ্ঞান, পরম্পরাহীন রবীন্দ্রনাথ, সংগীত বিচিত্রা, সংগীত সংগীত, আবদুশ শাকুরের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, মহান শ্রোতা, ভাষা ও সাহিত্য, চুয়াত্তরের কড়চা। রম্য : ভেজাল বাঙালী, রসিক বাঙালী, নির্বাচিত রম্যরচনা, নির্বাচিত কড়চা, রম্যসমগ্র। স্মৃতিকথা : ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে ইত্যদি। এছাড়া সম্পাদনাতেও রয়েছে তার খ্যাতি। সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : পরশুরামের সেরা হাসির গল্প, আসহাবউদ্দীন আহমদের সেরা রম্যরচনা, বাংলাসাহিত্যের নির্বাচিত রমনীয় রচনা, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সেরা রম্যরচনা, শিবরাম চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ গল্প ইত্যাদি।

ছোটগল্পে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর ‘গল্প সমগ্র’র জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০০৩ সালের অমিয়ভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। সমগ্র সাহিত্যকর্মের জন্য অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার পান ২০০৮ সালে।

আতিক্রান্ত সত্তুরেও তিনি লেখালেখিতে সমান সক্রিয়। উন্মোচন করে চলেছেন প্রজ্ঞার নতুন নতুন দিগন্ত। জ্ঞানের দ্বার উন্মোচনের জন্য তার রচনা পাঠের বিকল্প নেই। জন্মদিন উপলক্ষে এই বিদগ্ধ পণ্ডিত, ভাষাবিদ ও কথাশিল্পীকে আমাদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।