ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শহর, শহরবান ও কুরবানি | এম জে ফেরদৌস

হৃদকথা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪
শহর, শহরবান ও কুরবানি | এম জে ফেরদৌস অলঙ্করণ: রবার্ট জয়নার

শহুরে মানুষ আমিষ খেতে ভালোবাসে; প্রাণীজ আমিষ। গ্রামীণ কৃষকেরা গৃহপালিত পশু সন্তানতুল্য করে পালে, পোষে।

গৃহপালিত যেকোনো পশুর জীবনাবসানে তারা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়, বেদনায় মুষড়ে পড়ে।

ছাগল ও ভেড়ার তিন নম্বর বাচ্চাটি স্বভাবতই গায়গতরে দুর্বল প্রকৃতির হয়। দাদীকে দেখেছি ছাগল/ভেড়ার তিন নম্বর বাচ্চাগুলোর জন্য ফিডারে করে গরুর দুধ ভরে কোলে তুলে খাওয়াতে। চাচাতো ভাইবোনগুলি নিজেদের গলার বা কোমরের কাঁসার ঘুঙুর মিসমিসে কালো ছাগলের গলায় ঝুলিয়ে দিতো। লাল বকনা বাছুরের খুরে শোভা পেত ছোট বিটির (ফুপু) নূপুর। সাতসকালে কালা পাহাড়, মতিহার, মতিচূড় বা পার্বতী নামের গাইগুলোকে খড়/বিচালি না দিয়ে কারো বেতের ডালায় মুড়ি/চিরা ঢালতো না আমার দাদী শহরবান।

দাদীর নাম শহরবান। ৬৫ বছর বয়সে প্রথম শহর দেখতে এসে বলেছিলো—  এত শান বাঁধান্‌! মানুষ তো পাষাণ হয়্যা যাবি! শান বাঁধানো শহরের লোকেরা পশুবলির মচ্ছব করে, শত সহস্র হত্যার আনন্দে রঙিন হয়ে ওঠে তাদের মুখ। আর শহরবান গভীর রাতে হাম্বা হাম্বা ডাক শুনলেই বুঝতো চারিতে পানি ফুরিয়েছে। মাঝরাতে উঠে গিয়ে কল চেপে পানি দিয়ে আসতো। একবার অসুখে পড়ে কালাপাহাড়ের পানি ছাড়ান দেয়ায় সারারাত উদ্বিগ্ন জেগে কাটায় শহরে না আসা শহরবান। গোয়ালে অবাধ্য ষাঁড়কে হাইলা (রাখাল) ছেলেটা যখন বেদম পিটাতো, হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে গিয়ে দাদী বলতো, এ বাজান মারিস না! আর মারিস না...

ধলাই বিলচাঁদো গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাম। ধলাইয়ের ক্ষীণস্রোতা শাখা বাড়িতে বাড়িতে গোয়াল ঘরের চারিতে জল পৌঁছে দেয়। বাড়িসুদ্ধ ছেলেমেয়ে গরুর পাল নিয়ে সেই গলাডোবা ঘোনাইয়ে গা-গোসল দিতো। খড়ের মাজনি দিয়ে ঘষে ঘষে পরম যত্নে গরুর গা ধুইয়ে দিত শিশু কিশোরের দল। প্রত্যেক শিশুর জন্যই ছিলো নিজস্ব একেকটি গরু ভিন্ন ভিন্ন নামের। নাম ধরে ডাকলেই একই হাম্বা রবে সাড়া মিলতো।

ধলাই নামে ছিলো এক সাদা ধবধবে গাভী, ছিলো ববিতা, শাবানা কবরী। নামেই শুধু নয় তাদের দেমাক ছিলো পূর্ণ নায়িকাসুলভ। গোয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই দৌড়ে আসতো গাইগুলো। গলা বাড়িয়ে দিত চুলকে দেবার জন্য। মাথায় হাত বুলিয়ে গলায় আঙুল বুলিয়ে না দিলেই গোস্বা করে গোয়ালের বাঁশের খুঁটিতে অভিমানে গুঁতো মারতো।

কুরবান কথা...

তখন বয়স সাত কি আট। কুরবানির ঈদ.. দাদা-বাড়িতে গেছি, মনে বেজায় আনন্দ...

পালের গরু কখনোই কুরবানি দেওয়া হতো না। গাঁয়ের কোনো গৃহস্থই নিজের পালের গরু কতল করতো না। কুরবানির ঈদে পাড়ার পাঁচ বা সাত পরিবার মিলে একটি কুরবানি। একেকটি পরিবার মানে কয়েকটি পরিবারে সমষ্টি। আদতে সেখানে ১৫/২০ পরিবার।

তবে সেবার ছিলো ব্যতিক্রম। বুড়ি কালাপাহাড়; যার বংশলতিকা ধরেই তাজউদ্দীনের গোয়ালের ৪৭টি গরুর এক নাতিক্ষুদ্র পাল। ১১টি দুধেল গাই, ২টি অবাধ্য ষাঁড়, আর এক জোড়া বলদ ছাড়া বাদবাকি সব ছোট বড় বকনা ও এঁড়ে বাছুর বা গাবতান গাঁই। কালাপাহার ঘাস, খড়, বিচালি ছাড়ান দিয়েছে। পানির সাথে সামান্য খৈল-ভূষি গুলিয়ে দিলে তা অনেকটা সময় নিয়ে খায়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ায় শুয়ে থাকে সারাদিন। মাঠে চড়ে বেড়ায় আর সব গরু। দাদী সারাদিন কালাপাহাড়ের সাথে গোয়াল ঘরে। পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলেটি দাদীর হাতের লাঠি। আচল ধরে তার পিছে পিছে। সেও এখন কালাপাহাড়ের শুশ্রূষায় ব্যতিব্যস্ত।

কালাপাহাড় গর্ভবতী হয় না কয়েক বছর ধরে। হাল চাষের সামর্থও নেই। বাজারে সামান্য মূল্যে বিকোবেও না। বাড়ির কর্তা ওসমান প্রামাণিক, সিদ্ধান্ত নেয় কালাপাহাড়কে এবছর কুরবানি দেওয়ার। তালগাছির হাট থেকে গরু কেনার টাকাটা বেঁচে যাবে এবার। ঈদের আগের দিন থেকেই দাদী ও আল আমিনের নাওয়া খাওয়া বন্ধ। বাড়ির সবার মন ভার।

ঈদগাহ থেকে ফিরে সামাদ মৌলবী এসেছে কালাপাহাড়কে জবাই দিতে। ওসমান, আন্নিছ, মুজা, হেলাল ওল্টানো গাভীটির চার পা ঠেসে ধরেছে মাটির সাথে। বাড়ির মহিলারা উঁকি দিয়ে ভয়ার্ত চোখে আচল দিয়ে মুখ ঢাকছে। দাদীর চোখ বেয়ে অঝরে ঝরছে অশ্রুধারা। তার হাতদুটি পেঁচিয়ে ধরেছে আল আমিনের গলা। আলামিনের মাথায় টপ টপ করে পড়ছে শহরবানের চোখের জল। আল্লাহু আকবার... শব্দের চেয়ে তীব্র গতিতে আল আমিন ছুটে যেয়ে শোয়ানো গাভীটির গলা জড়িয়ে ধরে। নাহ্‌ কালা পাহাড়ের বদলে আল আমিন সেদিন কুরবান হয়নি। অথবা তার বদলে নেমে আসেনি কোনো দুম্বা বা উট। শুধু ধারালো তরবারি শিস বাজিয়ে গেছে আলামিনের কানে। পাড়াসুদ্ধ ভেঙে পড়া উঠানে সমস্বরে সবাই চিৎকার দিয়ে ওঠে। আলা আমিনের মা দৌড়ে এসে সদ্যই প্রাণে বেঁচে যাওয়া শিশুটিকে বুকে নিয়ে কান্নার সুরে গাভীটির জীবন ভিক্ষা মাগে।

সেদিন জবাই করা হয়নি কালাপাহাড়কে। পরদিন বাড়িতে নয়, দূরের জাউল চকে (ক্ষেত) নিয়ে বিসর্জনের নিয়ত পূর্ণ করা হয়েছিলো।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।