ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জেমস জয়েস, ডাবলিন ও ইউলিসিস

জাকারিয়া শিরাজী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১১
জেমস জয়েস, ডাবলিন ও ইউলিসিস

২০০৪ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখ ছিল `বুমস ডে`-র শতবার্ষিকী। জেমস জয়েসের ‌`ইউলিসিস` ডাবলিন শহরের একটি দিবসের ঘটনাবলির ওপর আবর্তিত -- ১৬ জুন, ১৯০৪।



একজন লেখকের শতবার্ষিকী হতে পারে; তাঁর রচিত গ্রন্থের প্রকাশনার শতবার্ষিকী হতে পারে। কিন্তু একটা উপন্যাসে বর্ণিত একটা কাল্পনিক দিনের শতবার্ষিকী উদযাপন একটু ব্যতিক্রমী ব্যাপার বৈকি। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের স্বল্পসংখ্যক সাহিত্যপ্রেমী ও জয়েসপ্রেমী দিবসটির বার্ষিকী পালন করে থাকে, নায়ক লিওপোল্ড বুমের নামানুসারে বুমসডে (Bloomsday)  নামে। ১৬ জুন কেউ সকালে কিডনি দিয়ে নাশতা করে, কারণ উপন্যাসটিতে নায়িকা মলি বুম সেদিন সকালে কিডনির নাশতা খেয়েছিল; কেউ কেউ সমুদ্র স্নানে যায়, কারণ উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র বাক মালিগান সেদিন সমুদ্রস্নান করেছিল, কেউ হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করে। এছাড়া নিউ ইয়র্কে জেমস জয়েস সোসাইটি আছে যারা প্রতি বছর 47th Street-এ রাইটার্স সেন্টারে `বুমস ডে` পালন করে ।

কোনো অলীক বস্তু, ব্যক্তি বা ক্রিয়ার স্মরণোৎসব অদ্ভুত ঠেকলেও নজির অনেক আছে। লন্ডনে বেকার স্ট্রিট বলে একটা রাস্তা আছে, যার নাম আমাদের অনেকের কাছে ছোটবেলাতেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিল ডিটেকটিভ বই পড়ার সূত্রে। কাহিনী অনুসারে, বেকার স্ট্রিটে ছিল ডিটেকটিভ সিরিজের নায়ক শার্লক হোমসের বাড়ি। এই বাড়িতেই শার্লক হোমস ও তাঁর সহযোগী ওয়াটসনের কপোপকথনের মাধ্যমে কোনো ঘটনার রহস্য গভীরতর হতো, একসময় যখন কাহিনী পরিণতির দিকে যাচ্ছে তখন রহস্যের জটগুলো খুলতে আরম্ভ করত। পাঠকের আগ্রহ, বিস্ময়বোধ, রহস্যোদ্ঘাটনের তাড়নাকে ক্রমাগত উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছে বেকার স্ট্রিটের একটা কাল্পনিক বাড়ি, আর সেই বাড়ির দুটি কাল্পনিক চরিত্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে আদৌ কি কোনো প্রফেশন ছিল, বা এখন আছে? নাকি পেশাটাও কাহিনীর প্রয়োজনে সৃষ্টি? এম্যারিকায় অবশ্য থাকতে পারে, সে-দেশের হিসাব আলাদা। আর যদি এ-ধরনের কোনো পেশা থেকেও থাকে, তার আইনি ভিত্তি কী? প্রাইভেট ডিটেকটিভের তদন্তকে কি আদালত আমলে নিতে পারে? কিশোর বয়সের  বিস্ময়াবিষ্ট মনে এসব প্রশ্ন দানা বাঁধেনি। কিন্তু এটা অন্য প্রসঙ্গ। প্রতিপাদ্য বিষয় সেটা ছিল না। Stream of consciousness-শৈলীর প্রবক্তার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে নিজেই যেন প্রবহমান খণ্ডচিন্তার ঘূর্ণিপাকে খেই হারিয়ে ফেলছি।

যা হোক, লন্ডন শহরের বেকার স্ট্রিটে একটা স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে নয়, রক্তমাংসের কোনো মানুষের স্মারক সংরক্ষণের মানসে নয়; কোনান ডয়েলের কাহিনীতে নির্মিত শার্লক হোমসের কাল্পনিক জিনিসপত্রের আদলে বাস্তব জিনিসপত্রের সমাহার সেখানে হয়েছে, সে-সময়কার প্রচল-সিদ্ধ পোশাক-আশাক, পুরনো আমলের ছাতা-- যা-কিছু শার্লক হোমস ব্যবহার করতেন বলে কাহিনীতে বর্ণিত সবই আছে। আমি সেখানে গিয়েছি। শার্লক হোমস ছিল মাদকাসক্ত, মর্ফিয়ার ইঞ্জেকশন নিতো। সে-আমলের একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জও আছে।

ডাবলিন শহরের বর্ণনা ‌‌‌`ইউলিসিসে` নিখুঁত, তাই ডাবলিন-প্রেমিক আইরিশরা আপ্লুত হতেই পারে। ডাবলিনের একটা দিন, সেদিন আবহাওয়া কেমন ছিল, তাপমাত্রা কত ছিল, জেয়ার-ভাটার সময় কী ছিল, সব কিছু সম্বন্ধে যথাযথ তথ্য নিয়ে ‘ইউলিসিস’ লেখা হয়েছে। হোটেল, পানশালা, হাসপাতাল, বেশ্যালয়, পথঘাট, অলিগলি, বেলাভূমি, ইত্যাদির সঠিক বর্ণনা, সেগুলোর সঠিক আয়তন ও পারস্পরিক দূরত্ব নিয়ে ১৬ জুন ১৯০৪-এর ডাবলিন উপস্থাপিত। নায়ক লিওপোলড বুমের বাড়ি ৭ নম্বর একিস স্ট্রিট। একিস স্ট্রিটও ডাবলিনে আছে, ৭ নম্বরে একটা বাড়িও নাকি আছে, অন্তত ১৯০৪ সালে ছিল। স্যান্ডিকভ, স্যান্ডিমাউন্ট, ডলকি, সকল শহরাঞ্চল যথাযথ।

বিশ্বসাহিত্যের যে-উপন্যাসটি সবচেয়ে বেশি শ্রম, অভিনিবেশ ও যত্নসহকারে লিখিত সেটি হলো ‘মাদাম বোভারি’। গুস্তাফ ফ্লবেয়ারের একটা উক্তি স্মরণ করতে পারি : Il n’est pas fini- It is never finished.  পরিশীলন হতেই থাকবে । জয়েস ‘ইউলিসিস’ লিখতে যে শ্রম ও মনোযোগের প্রমাণ রেখেছেন সেটা গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের সঙ্গে তুলনীয়। ডাবলিন শহরের প্রতি লেখকের ভালবাসার স্বাক্ষর আছে, যদিও বাইশ বছর বয়সের পর তিনি আর ডাবলিনে থাকেননি। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসে যেমন লন্ডন শহরের প্রতি ভালবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে পুরানো ঢাকার অলিগলি ও জীবনযাত্রার প্রতি মমত্বপূর্ণ সম্পৃক্তি দেখা যায়। ভালবাসার বস্তুর সুন্দর হওয়া অত্যাবশ্যক নয়। ডিকেন্সের লন্ডন ছিল অনপনেয় নিষ্ঠুর শহর, মোটেই সুন্দর নয়। কবি শামসুর রাহমানের  ঢাকা শহর টুরিস্টের কাছে হাত পাতে যখন তখন, জৈষ্ঠ্যে পুড়ে এবং শ্রাবণে ভিজে টানে ঠেলাগাড়ি, রাত্রি এলে শরীরকে উৎসব করার বাসনায় জ্বলে, সাত তাড়াতাড়ি যায় বেশ্যালয়ে, এই শহর সিফিলিসে ভোগে। ডাবলিনই কি সুন্দর শহর ছিল? মনে তো হয় না। ডাবলিনের গোলকধাঁধা-তুল্য অলিগলি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন বলেই তো জয়েসের নাম ডিডেলাস। ডিডেলাস গ্রিক পুরাণের কুশলি কারিগর, নির্মাতা ও স্থপতি যে ক্রিটের রাজা মিনোসের জন্যে একটা গোলকধাঁধা তৈরি করেছিল। পরে একটা বিপাকে পড়ে সে এবং তার পুত্র ইকারুস এই গোলকধাঁধাতেই বন্দি হয়। তখন ডিডেলাস তার কারিগরি মনীষার বলে পাখনা ও মোম দিয়ে ডানা তৈরি করে এই ডানা লাগিয়ে পুত্র ইকারুসসহ গোলকধাঁধা থেকে পালিয়ে গেল। ডিডেলাস ও তার গোলকধাঁধা ডাবলিন শহরের অলিগলি ও সর্পিল পথঘাটের চিত্র জাগিয়ে তোলে। ‘ইউলিসিসে’র একটা পৃষ্ঠাও ডাবলিনে লেখা হয়নি। বলা যায় লেখকের ডাবলিনের সঙ্গে এক ধরনের   ambivalent বা মিশ্র অনুভূতি ছিল।

ইউলিসিসের দুর্বোধ্যতা প্রবাদতুল্য। বিশ্বসাহিত্যে এর চেয়ে জটিল, গ্রন্থিল কিছু লেখা হয়েছে বলে জানি না। টি এস এলিয়ট তাঁর ‘দি ওয়েস্টল্যান্ডে’র টীকা নিজে লিখে না দিলে সেটার অর্থোদ্ধার অত্যন্ত দুরূহ ছিল। জয়েস কিন্তু পাঠকদের প্রতি সে-ধরনের মমতা দেখাননি। উপন্যাসটির মোড়ে মোড়ে জটিল ভাবানুষঙ্গ, দুরূহ ধাঁধা।

বিংশ শতাব্দী যখন গত হলো বিখ্যাত প্রকাশক Random House-এর Modern Library বিভাগের সম্পাদক পর্ষৎ ‘ইউলিসিস’কে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ একশটা নির্বাচিত উপন্যাসের মধ্যে প্রথম স্থান দিয়েছেন। জয়েসেরই আরেকটা উপন্যাস ‘এক তরুণ শিল্পীর প্রতিকৃতি’ পেয়েছে তৃতীয় স্থান । নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন সুপরিচিত এম্যারিকান ঔপন্যাসিক গোর ভিডাল ও ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক  এ এস বাইয়াট। জয়েস কিন্তু নোবেল প্রাইজ পাননি। নোবেল পুরস্কারের তো প্রশ্নই ওঠে না, তাঁর বই বহু বছর ইংলন্ড ও এম্যারিকায় নিষিদ্ধ ছিল, অশ্লীলতার অভিযোগে। বইটাতে যৌনকর্ম, শরীরী কৃত্য ইত্যাদির খোলাখুলি বিবরণ আছে। তবে ফ্রান্স তো বরাবরই এসব বিষয়ে উদার ও মুক্ত-- ‘ইউলিসিস’ প্রকাশিত হবার ৬৫ বছর আগে শার্ল বোদলেয়ারকে অশ্লীলতার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েও শাস্তি দিতে পারেনি। অস্কার ওয়াইল্ড যদি ফরাসি নাগরিক হতেন, শেষ জীবন এমন কলংকময় হতো না। তাই ‘ইউলিসিস’ প্রথমে প্রকাশিত হলো ফ্রান্সে।

ইউলিসিসে মোট আঠারটা এপিসোড। হোমারের ‘ওডেসি’-তে ছিল চব্বিশটা। সকাল আটটায় কাহিনী শুরু, শেষ হচ্ছে রাত দুটোয় আত্মকথনে মগ্ন মলি বুমের শয্যাকক্ষে। এতে আধুনিক কালের একটা উপন্যাস প্রাচীন মহাকাব্য ‘ওডেসি’র সঙ্গে সমান্তরাল ধারার সৃষ্টি করছে, ডাবলিনের একটা দিন ‘ওডেসি’র দশ বছরের কাহিনীর সমতুল্যতা বা correspondence অর্জন করছে, আধুনিককালের এক নায়ক (বা বিপ্রতীপ নায়ক) গ্রিক মহাকাব্যের নায়কের সমতুল্য হচ্ছে। তবে এই সমতুল্যতার মধ্যে কিছু ফাঁক আছে, কিছু প্যারোডি ও ব্যঙ্গ আছে। ইউলিসিস তথা অডিসিউস একটার পর একটা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে;  লিওপোল্ড বুম ও স্টিফেন ডিডেলাস সারাদিন ডাবলিনের পথে পথে হেঁটেছে। একদিনে তারা ৪০ মাইল পথ পরিক্রম করেছে। আর নায়িকা মলি বুম তো পেনিলোপির ব্যঙ্গচিত্র হিসেবেও দাঁড়ায় না। পেনিলোপি হলেন দাম্পত্য বিশ্বস্ততার প্রতীক, এক যুগ ধরে স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষা করছেন; মলি বুম বহুচারিণী যিনি এই দিনও, ১৬ জুন, বিবাহেতর মিলনে রত হয়েছেন।

আর ডিডেলাস ও বুম যেহেতু আধুনিক নায়ক, তাদের সংকট অন্য ধরনের। পিতা ও পুত্রের পুনর্মিলনের মধ্যে এই সংকট শেষ হবার নয়। স্টিফেন ডিডেলাস ও তার পিতৃপ্রতিম লিওপোল্ড বুম দুজনই দো-মনা, বিচ্ছিন্ন, নাগরিকতাক্লিষ্ট। সংকট তাদের অন্য ধরনের। দুজনই একটা জায়গায় এসে হারিয়ে যাচ্ছে। বুম অর্ধেক-ইহুদি তাই আইরিশ ক্যাথলিক সমাজের একজন সে নয়। ডিডেলাস কবি হতে চায়। সে ঘর-ছাড়া, ইশকুলে চাকরি নিয়ে সেটাও ছেড়ে দিয়েছে, এক অনির্দেশ্য ন যাযৌ  ন তস্থৌ অবস্থায় রয়েছে।

চেতনাপ্রবাহ শৈলী এই উপন্যাসের সবচেয়ে মৌলিক দিক। পরবর্তীকালের পোস্টমডার্ন উপন্যাসের ওপর ‘ইউলিসিসে’র প্রভাব সর্বব্যাপী। পরের যুগের পোস্টমডার্নরা এই শৈলীকে আরো জটিল করেছে। উপন্যাসে ভয়েস বদলে যাচ্ছে, উত্তম পুরুষে লিখিত উপন্যাস হঠাৎ তৃতীয় পুরুষে বর্ণিত হচ্ছে; ঔপন্যাসিক কখনো উপন্যাসের ভিতরের চরিত্র, কখনো উপন্যাসের বাইরের ন্যারেটর বা কথক। চরিত্রগুলো একে অন্যের মধ্যে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।   চরিত্রগুলো অস্থিতিশীল। ইতালো কালভিনোর উপন্যাসের কাহিনীও অস্থিতিশীল। ‘যদি শীতের রাতে এক পথিক’ উপন্যাসে নায়ক একটা রেল ইস্টিশনে একটা উপন্যাস পড়ছে। স্টেশনের ঘটনা, অর্থাৎ উপন্যাসের কাহিনীর বাইরের প্রতিবেশে যা-কিছু ঘটছে এবং উপন্যাসের ভিতরকার কাহিনী এক হয়ে যাচ্ছে। পরে দেখা গেল নায়ক যে-উপন্যাস পড়ছে, বই বাঁধাইকারীর ভুলের জন্যে অন্য একটা উপন্যাসের ফর্মা এই বইয়ে বাঁধাই হয়ে গেছে যার ফলে একটা উপন্যাসের সঙ্গে আরেকটা উপন্যাস জড়িয়ে পড়েছে।

পোস্টমডার্নরা বলে সত্য অস্থিতিশীল।   আর জন ফাউলস্ যিনি কয়েক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং সমকালের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইংরেজি ঔপন্যাসিকদের অন্যতম, তিনি তো তাঁর চরিত্রগুলোকে শাসনও করতে পারেন না; তাঁর চরিত্রগুলো স্ব-শাসিত, নিজের ইচ্ছায় চলে; স্রষ্টা ফাউল্সের কথা তারা শোনে না। পোস্টমডার্নদের উপাস্য দেবতা প্রটিউস, যার সবসময় চেহারা বদলাচ্ছে। জয়েসের ‘ইউলিসিসে’র একটা এপিসোডের শিরোনাম প্রটিউস। জয়েসের অনুসারী উইলিয়াম ফকনরের উপন্যাসে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এই তিন কালপর্ব একে আপরের মধ্যে লীন হচ্ছে। ফকনরের বাক্যের গঠনেও tense বা ক্রিয়াকাল বিপর্যস্ত। আর হোর্হে লুইস বোর্হেস- তিনি কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখেননি- রচনাগুলো  fragmentary বা খণ্ডিত। সেখানে তো দেখা যায় ঔপন্যাসিক তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সঙ্গে এক ধরনের আদান-প্রদানে জড়িত। ‘ইউলিসিসে’র চেতনাশৈলী সবচেয়ে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে শেষের এপিসোডে যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘পেনিলোপি’, যার সমতুল্য মলি বুম। মলির চিন্তাগুলো একে অন্যের ওপর অপ্রতিহত গতিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, কোনো যতিচিহ্ন নেই বাক্য গঠনে, চিন্তাসূত্রে নেই কোনো বিন্যাস ।

১৯০৪ সালের ১৬ জুন ডাবলিনের অতি সাধারণ একটা দিন। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার । বিশেষ কিছুই সেদিন ঘটেনি; অন্তত ডাবলিনের ইতিহাসে বা কালপঞ্জীতে এই দিনের সামান্যতম গুরুত্বও নেই। তাহলে জয়েস কেন এই দিনটিকে নির্বাচন করলেন। মনে হয় জয়েসের ব্যক্তিগত জীবনে এই তারিখের একটা গুরুত্ব ছিল। জয়েসের অসংখ্য জীবনীগ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত সম্ভবত রিচার্ড এলম্যান রচিত জীবনী । এলম্যান বলেছেন জয়েস যখন প্রেমিকা নোরা বার্নাকলকে নিয়ে গোপনে দেশত্যাগ করলেন, এই ১৬ জুন তাঁদের সম্পর্ক একটা হোটেলে consummate  হয়েছিল অর্থাৎ তাঁদের চূড়ান্ত মিলন ঘটেছিল অর্থাৎ নোরা বার্নাকল তাঁর কুমারিত্ব হারিয়েছিলেন । তাঁরা বিয়ে করেছিলেন অনেক বছর পরে। বড় ঘটনা যেমন সেদিন ঘটেনি, উপন্যাসের চরিত্রগুলোও সাধারণ মানুষ। এইদিনে একটা শিশুর জন্ম হচ্ছে, একজনের মৃত্যু হচ্ছে, ক্লাস হচ্ছে, অফিস চলছে, পানশালায় খদ্দেররা মাতলামি করছে, ব্যভিচার হচ্ছে। ছোটখাটো ক্লাইমেক্স কিছু আছে, কিন্তু প্লটের কোনো নির্মিতি নেই, আছে নকশা। জয়েস প্রভাবিত হয়েছিলেন আন্তন চেখফের নাটক দ্বারা। চেখফের নাটকে কোনো প্লট নেই, ক্লাইমেক্স নেই, তবে মনোযোগী পাঠক কিছু নকশা দেখতে পাবেন। ‘ইউলিসিসে’র দুর্বোধ্যতার একটা কারণ, এই নকশাগুলো কিছুটা লুকানো; দ্বিতীয় কারণ ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম ও পুরাণ থেকে ভাবানুষঙ্গ যার মধ্যে কতকগুলো স্বল্পপরিচিত ও দুরূহ; তৃতীয় কারণ, আগেই বলেছি, ভয়েস ও ন্যারেটর হঠাৎ বদলে যায়; চতুর্থ কারণ বর্ণিত কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা সাথে সাথে পাওয়া যায় না, অনেকগুলো পৃষ্ঠা পরে কোথাও তার ব্যাখ্যা লুকিয়ে থকে। আখ্যানের ধারাক্রমে কিছু জট লাগানো থাকে।  

একটা প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে। বাংলা উপন্যাসে বা বাংলা সাহিত্যে জয়েসের প্রভাব কতখানি। কোনো আধুনিকতাবাদী লেখক তো জয়েসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু যেভাবে বাঙালি পাঠক বিষ্ণু দে-র মাধ্যমে এলিয়টকে চিনল, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বোদলেয়ারকে জানল এবং সুধীন দত্ত যেভাবে মালার্মেকে পরিচিতি করলেন সে রকম বিশেষ ধরনের কোনো চর্চা বাংলাতে জয়েসকে নিয়ে হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস। জয়েসের একমাত্র কবিতার বই ও একমাত্র নাটক বিস্মৃত। তবে ‘ডাবলিনার্সে’র ছোটগল্পগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বহুবার অনূদিত হয়েছে। আগেই বলেছি ‘ডাবলিনাসের্’র সর্পিল অলিগলি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে প্রাণিত করে থাকতে পারে পুরানো ঢাকাকে রূপ দিতে। বাংলাতে চেতনাপ্রবাহ শৈলীর কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৃতীয় ভুবন’ উপন্যাসে। ১৯৫৭ সালে ‘নতুন সাহিত্য’ বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত কয়েক বছর পরে । এটাও কলকাতার একটি দিনের ঘটনা। চেতনাপ্রবাহ টেকনিকের একটা ছোঁয়া বইটার মধ্যে আছে কিন্তু এত দুরূহ ও জটিলভাবে নয়। এই বইটা আজ বহু বছর বাজার থেকে উধাও, এমনকি লাইব্রেরি থেকেও। দীপেন্দ্রনাথ সিপিআই-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর একটা স্বল্প-পরিচিত বইয়ের কথা উলেখ করতে পারি। লেখক কোনো কথাশিল্পী নন, একজন সাংবাদিক ও রম্যরচয়িতা । দেশবিভাগের আগে বিনয় কুমার মুখোপাধ্যায় ‘দৃষ্টিপাত’ বলে অত্যন্ত বাজার-চল একটা রম্যরচনা লিখেছিলেন ‘যাযাবর’ ছদ্মনামে। পরে এই যাযাবর অপ্রত্যাশিতভাবে উপন্যাস-সদৃশ একটা বই লিখলেন ‘জনান্তিক’। কলকাতার একদিনের ঘটনা, আর তার নায়িকার নাম মলি। বিনয় মুখোপাধ্যায় প্রায় উত্তর-স্বাধীন বাংলাদেশে একবার এসেছিলেন।

জয়েস কোনো মূল্যবোধ তুলে ধরেননি । তিনি নৈরাশ্যবাদী । তবে তাঁর নন্দনতত্ত্ব সম্বন্ধে একটা সুস্পষ্ট দর্শন ছিল। সৌন্দযের তিনটা নির্ণায়ক : সমগ্রতা, সুষমা ও প্রভা। এক্ষেত্রে তিনি সেন্ট টমাস একুইনাসের অনুসারী, অর্থাৎ এরিস্টটলের অনুসারী। কিন্তু জীবনের অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে তাঁর কোনো আস্থা আছে বলে মনে হয় না-- প্রেম, বিবাহ, বন্ধন, দাম্পত্য বিশ্বস্ততা। লিওপোল্ড বুম জানেন তাঁর স্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে লাইন আছে। এটাও তিনি জানেন সেদিনই অপরাহ্নে মলি প্রেমিকের সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হবেন। বুম শুধু নির্বিকার নন, নিজেও গোপনে এক মহিলার সঙ্গে ফিলডিং মারছেন। শেষ এপিসোডে এসে মলি বুমের নির্ঘুম উত্তেজিত ভাবনারাশি কতকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রেম, বিবাহ, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি সম্বন্ধে এই নষ্ট নারী কী ভাবছেন? বিশ্বস্ততা ছাড়াও তো প্রেম হতে পারে। স্বামীকে মলি ভালবাসেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তিনি কি স্বামীর সঙ্গে থাকবেন? এই প্রশ্ন আমরা করতে পারি না, কারণ এটা উপন্যাস-বহির্ভূত প্রশ্ন। লেডি ম্যাকবেথের কয় সন্তান ছিল বা হ্যামলেট উইটিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে যাচ্ছিল, এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে রচয়িতা বাধ্য নন। বোধ হয় প্রশ্নটা করাও সমীচীন নয়। জয়েসকে যতই নৈরাশ্যবাদী বলা হোক, উপন্যাসটি শেষ হচ্ছে মলির যে একটানা, ব্যাকরণ-বর্জিত যতিহীন আত্মকথনে, তার শেষ শব্দ-- হ্যাঁ।                                           

বাংলাদেশ সময় ১৪২০, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।