ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একুশে বইমেলা : দূর থেকে কাছে দেখা

খালেদ হামিদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১১
একুশে বইমেলা : দূর থেকে কাছে দেখা

আমাদের রাষ্ট্রনীতি-রাজনীতি ও এমনকি অর্থনীতিরও রাজধানীকেন্দ্রিকতার ফলে সারা দেশব্যাপী চলমান সাহিত্যচর্চাও ঢাকামুখী হয়ে আছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী কাল থেকেই। স্বাধীনতা লাভের পরেও ঢাকার বাইরের কবি-লেখকদের লেখা রাজধানীর কাগজে (দৈনিকে, সাপ্তাহিকে) মুদ্রিত হওয়াটাই ছিল বিরল ঘটনা।

অথচ ‘ঢাকার কবি’ বলে পৃথক কোনো নাগরিকত্ব ঢাকাবাসী কবিদের প্রায় কারুরই ছিল না, এখনো নেই। তাঁদের সকলেই বিভিন্ন জেলা-শহর, মফস্বল বা গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে আসা অভিবাসী। তবে সরকারি দৈনিক বাংলায় কর্মরত থাকাকালে, কবি আহসান হাবীবই, খুব সম্ভব, সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার বাইরের লেখা ছেপে। কিন্তু তিনি তাই বলে অকবি-অলেখকদের প্রশ্রয় দেননি, আশ্রয় দেন অনেক প্রকৃত কবি-লেখককে যাঁদের অনেকেই আজ সুপরিচিত অথবা নন্দিত। কিন্তু গেল শতকের আশির দশকে প্রাগুক্ত আশ্রয় ও প্রশ্রয় সমানুপাতে হ্রাস পায়। তবে দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে দেশব্যাপী, বলা যায়, তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নানা অভিঘাতে কল্লোলিত হয়ে ওঠে অসংখ্য অভিনতুন ছোটকাগজ। ফলে ঢাকাসহ দেশজুড়ে তরুণ কবি-লেখকদের পরস্পরকে চেনার, অন্তত একে অপরের নাম জানার, সুযোগটি তৈরি হয়। স্মর্তব্য যে, সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘শামসুর রাহমান মনোনীত কবিতা’ এক পর্যায়ে বিতর্কিত হয়ে উঠলেও, তা ওই আশ্রয়ের আওতা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি করে। এভাবে নব্বইয়ের দশকে এসে উল্লিখিত সর্বকৌণিক সংযোগ ও কলরব আগের চেয়ে বেশি গতিশীল হয়। এই সময় থেকে তরুণরাই দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে ঢাকার বাইরের লিখিয়েদের প্রকাশভাগ্য পূর্বাপেক্ষা অধিকতর প্রসন্নতা লাভ করে। বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রাণপ্রাচুর্যও বুঝি বেড়ে যায়।

কিন্তু রাজধানীর বাইরের লেখকদের বই কি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারির মহান বইমেলায়? না। জেলা-শহরত্যাগী লেখকবন্ধুর সহায়তায় তাঁদের কারো কারো বই এই মেলায় বেরুলেও তা উপযুক্ত মনোযোগ আকর্ষণে কি সক্ষম হয়? এ প্রশ্নের উত্তরও, দুঃখজনকভাবে : না। ওই যে রাজধানীকেন্দ্রিকতা বা ঢাকাবাসী কবি-লেখক-পাঠকদের রাজসিক মনোভাব, তা থেকে এখনো আমাদের জাতীয় সাহিত্যচর্চা সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। অবজ্ঞার এই প্রবণতা একই সঙ্গে সামন্তীয় সংস্কৃতি ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির একটি প্রতিভাস, যা তাঁদের জনবিচ্ছিন্নতার ফল। যেমন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১০-এ প্রকাশিত কবি হাফিজ রশিদ খানের আদিবাসী কবিতা সংগ্রহ (আগামী প্রকাশনী) এবং কবি-গল্পকার মহীবুল আজিজের কাব্যসমগ্র (বলাকা প্রকাশন) বিগত প্রায় এক বছরে কোনো পত্রিকায়ই আলোচিত-সমালোচিত হয়নি। তাঁরা নিছক চট্টগ্রামবাসী বলেই কি? অথচ কতো অতি-তরুণ, পূর্ব-অপরিচিত নবীন পদ্যকারের বই ঢাকা থেকে প্রকাশিত একাধিক বড় দৈনিকে, ওই এক বছরে, বিশেষভাবে মূল্যায়িত হয়! বলা বাহুল্য, হাফিজের আগে বাংলা কবিতায় আদিবাসী প্রসঙ্গটিই অনুপস্থিত ছিল। মহীবুলের বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানার বিশেষ ধরনের কবিতাও আমাদের দেশে তাঁর আগে কেউ লেখেননি। তারপরও কেন এই অন্যায় উপেক্ষা? কেবল তাই নয়, ঢাকাবাসী অনুজ, তরুণ পদ্যকারদের কেউ কেউ বাংলা কবিতা বিষয়ে লিখিত ধারাবাহিক গদ্যে উপর্যুক্ত দুজনের তো বটেই, আরো কয়েকজন পরিচিত-প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ কবির নামও পরিহার করেন। উক্ত প্রকার গদ্যের শেষ কিস্তিতে, কিঞ্চিৎ অনুশোচনার অভিনয় করে, হাফিজ রশিদ খানের নামটি যুক্ত করা হয়। আর, ঢাকার প্রকাশকগণও কি হাফিজ ও মহীবুলের মতো দূরবর্তী (ভৌগোলিকভাবে!) সিরিয়াস লেখকদের বই ছেপেও বণ্টনে ও বিপণনে কিছুটা হলেও অনীহ থাকেন? খোদ লেখকের পক্ষে তো প্রত্যেক সাহিত্য সম্পাদকের দপ্তরে নিজের বই পাঠানো সম্ভব নয়। দেখা যায়, বাংলা একাডেমীর ওয়েবে কিংবা মেলা চলাকালীন ঘোষণায় আলোচ্যমান বইগুলো ঠিকমতো স্থান পায় না। অনেক সময় অনুল্লিখিতই থেকে যায়। কিন্তু আমি যতোদূর জানি, ঢাকার বাইরের কবি-লেখকগণ ঢাকার বড়-ছোট লেখকদের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল কিংবা ঈর্ষাপরায়ণ নন। কেননা, জেলা-শহরবাসী কারো সম্পাদনায় প্রকাশিত কোনো নির্বাচিত/স্বনির্বাচিত কাব্য সংকলনে ঢাকার প্রণিধানযোগ্য কবিদের কেউ বাদ পড়েন না। তবে দেখার বিষয় এই যে, ‘সেরা কবিতা’র কোনো সংকলনে ঢাকা-বহির্ভূত কেবল নয়, ঢাকারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিদের বাদ দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখান কোনো কোনো সম্পাদক। অথচ অপ্রাপ্তবয়স্ক পদ্যকারদের তাঁরা তালিকাভুক্ত করেন সেসব অপসাহসের নমুনায়!

এভাবে অবৈধ প্রশ্রয়ে আমাদের চতুর্দিকে বেড়ে ওঠে অকবিতার জঞ্জাল। ফলে বইমেলায় কাব্যগ্রন্থ প্রায় অবিক্রিতই থেকে যায়। ছাইপাশ উপন্যাস হয়ে ওঠে হট কেক! তবু প্রান্তবর্তী কবি-লেখকদের চিত্তে মেলা শুরুর আগে থেকেই আছড়ে পড়ে প্রকাশিতব্য সামষ্টিক সাহিত্যের তরঙ্গমালা।  

বাংলাদেশ সময় ১৪০৫, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।